Published : 15 Aug 2018, 10:58 AM
তুমি যেদিন রমনার রেসকোর্স ময়দানে দীর্ঘবাহু,
আকাশপটে তর্জনীতে সিরাতাম মুস্তাকীম এঁকে বলেছিলে,
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'
সেদিন সূর্যের প্রতিটি রৌদ্ররশ্মি থেকে তাক করা হয়েছিল ক্যামেরা
তোমার ছবি মুদ্রিত হয়েছিল সাড়ে সাত কোটি জনতার চোখে।
তুমি যেদিন ইবলিশের বন্দিশালায় তোমার জন্য খুঁড়ে রাখা
কবর-বিবর টপকে ফিরে এলে আপন ভূমিতে,
পরম শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ালে তোমার নাড়ী-পোঁতা মাটিতে,
জলোচ্ছ্বাস উঠলো দুই চোখের দরিয়ায়, আয়ু দিয়ে বরণ করে নিলে
তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা পবিত্র প্রাণময়ী মাটি–
সেদিন এদেশের প্রতিটি ধূলিকণায় তোমার ছবি আঁকা হয়েছিল,
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতিটি ঘরে টাঙানো হয়েছিল তোমার অশ্রুবিলাপি ছবি।
তারপর, যেদিন তোমার চুম্বনসিক্ত মাটিতে,
তোমার নিঃশ্বাসমন্দ্রিত মাটিতে,
তোমার অশ্রুবিধৌত মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্র
তোমার মাটির দেহ ঝাঁঝরা করে দিলো,
হিংস্র কুঠারের ঘায়ে দীর্ঘশীর্ষ মহীরূহের মত তুমি পড়ে গেলে অনন্তের সিঁড়িতে
তোমার বুকের সাদা জামার বেহেশতি জমিনে ফুটে উঠলো অজস্র পুষ্পকোরক,
তোমার প্রিয় পাইপ একটি অবাক চোখের মত অদূরে পড়ে থেকে দেখলো
অনন্তের সিঁড়ি বেয়ে চলে যাচ্ছে আগুনরঙা গোলাপের মিছিল।
তোমার এই ছবিটি তুলে নিল বাংলার পতাকা
তোমাকে রাখল তার বুকের কেন্দ্রমূলের ফুলদানীতে।
এখন নগরে বন্দরে গঞ্জে গ্রামে তোমার ছবির মহোৎসব।
শহরের অলিতে গলিতে, লাইটপোস্টের গতরে,
দেয়ালের গায়ে ঠমকি নায়িকা কিংবা পণ্যের বিজ্ঞাপনের পাশে,
বৈদ্যুতিক তারে, কাকের নখরের নিচে, ক্ষতবিক্ষত তোমার ছবি।
এখন তোমার ছবি পোস্টারে, মুর্যালে, টাইলসে, দেয়ালে
তোমার ছবি বুটিক শপে, টিশার্টে, পাঞ্জাবিতে, অর্নামেন্টস গ্যালারিতে।
নতুন ডিজাইনের লকেটে, পকেটে, টিকেটে, টাকায়, আঁকায় তোমার ছবি।
এসব ছবিতে তুমি নিত্য নতুন রঙে ঝলমল করো,
ফেরেববাজ বাজারে ছড়াও বাণিজ্যিক দ্যুতি।
কিন্তু, তোমার রৌদ্ররঞ্জিত ছবিটি দেখি না কোথাও
তোমার অশ্রুবিধৌত ছবিটি দেখি না কোথাও
তোমার প্রাণজ্বলন্ত ছবিটি দেখি না কোথাও
ওই ছবিগুলো বাাঁধানো আছে এক অমর দেয়ালে।
সে দেয়াল আমার হৃদয়। সে দেয়াল বঙ্গভূমির বুকের জমিন।
১২.০৮.২০১৮
টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ মাটিতে শিউরে উঠলো ভোর
জননীর কোলে এলে তুলতুলে খোকা
মধুমতী জলে তোলপাড় তোলে দুরন্ত কৈশোর,
সাঁতরে পেরোও নদী, তুমি একরোখা।
কালবৈশাখি ঝড়ের প্রতাপ প্রতিবাদে বিক্ষোভে
ওরা কারা? করে নষ্ট ভবিষ্যৎ!
কৃষকের আশা শ্রমিকের ঘাম ব্যর্থ কাদের লোভে
তোমার লড়াই বলে, একটাই পথ
তরুণ কণ্ঠে বজ্রের ধ্বনি সত্তার সংকটে
তোমার ভাষারা অগ্নিগর্ভ-কথা
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জুড়ে স্ফুলিঙ্গ-ফুল ফোটে
স্বাধিকার চাই, চাই শুধু স্বাধীনতা!
মুক্তিমন্ত্রে ধারালো রৌদ্রে খাপখোলা তলোয়ার
দাঁড়াও দীর্ঘ বীরবাহু রমনায়!
খাড়া তর্জনী! ধনুকে তুলেছো সুতীব্র টংকার!
দিক-নির্দেশে স্বাধীনতা চমকায়!
জাগ্রত দেশ, গুনছে তোমার কারাপ্রাচীরের কাল
অদৃশ্যে থাকো দৃশ্যের চেয়ে স্থির
বাংলাদেশের দশ দিগন্তে নতুন চক্রবাল
লিখছে তোমার মহত্ত্ব কীর্তির!
পুণ্ড্র বঙ্গ সমতট ছিল পূর্ব-পিতার বুকে
প্রাচীন জমিনে প্রোথিত তাঁদের হাড়
তুমিও জনক যাও হিতকর জনকের অভিমুখে
সঞ্চয়ে রাখো মাটির সারাৎসার।
রক্তের সাথে স্বপ্নের সাথে হৃদপিণ্ডকে রাখো,
স্বদেশ তোমার মুকুটের কোহিনূর,
তিরিশ লক্ষ শহীদের নাম আত্মার সাথে মাখো
আর্তকে দাও বুকের অন্তঃপুর।
নোনা উপকূলে আকাশ-বৃক্ষ! অমা-রাতে বাতিঘর,
জেগে থাকো তুমি দেশের শিয়রে পিতা,
তোমারি রক্তে ভিজে গেল ফের শ্যামল মাটির স্তর
মৃত্তিকা লেখে শেষ মনুসংহিতা।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খুলছে ইতিহীন ইতিহাস
মুদ্রিত আছে অবিনাশী অক্ষর
ক্ষিতি-অপ-তেজ-ব্যোম ও মরুৎ, প্রজাপতি-ফুল-ঘাস
তোমাকে পড়ছে, পিতা, শেখ মুজিবর!
১৯.৪.১৭
শুকনো গাঙে দারুণ খরা,
সূর্য এখন অগ্নিক্ষরা,
পুড়ছে শ্যামল শস্যখামার,
পুড়ছে বিধান তোমার আমার।
তোমার হাতের জলের ঝারি
লুট করেছে চোর ব্যাপারি,
চাটার দলে জিভের লালে
অম্বলে আর ঝোলে ঝালে
নিত্য চাটে, দুগ্ধ মাখন,
যখন তখন, এইতো এখন!
তোমার আঙুল বর্শাফলক
প্রেতকফিনে গাঁথলো কীলক,
সেই প্রেতেরা বেরিয়ে এসে
নৃত্য করে তোমার দেশে,
লালসা লাল জিহ্বা ওড়ায়
সোনার দেশের স্বপ্ন চূড়ায়,
চলছে তুমুল স্বপ্নদাহ,
পুড়ছে নবান্ন পুণ্যাহ,
পুড়ছে লিখন সবুজপত্র,
পুড়ছে জীবন জলের সত্র,
পুড়ছে জীবন জয়ের ভাষা
আগুন এ যে সর্বনাশা!
নেভাও আগুন কোথায় তুমি,
তুমিই সত্য জন্মভূমি!
তোমার স্নেহের চোখের পানি,
স্বেদকণিকা পেরেশানির,
এই তো তোমার শুদ্ধ তরল,
যুদ্ধদিনের বেহেশতি জল,
সব দিয়েছ উজাড় করে,
বঙ্গভূমির সকল ঘরে।
তোমার হাতের জয়পতাকায়
বাংলার হৃদপিণ্ড আঁকা,
মানচিত্রের জমিনজিরাত,
তোমার বক্ষ বিশাল বিরাট,
বুকের ভূতল রক্তাভ পট,
তোমার উঠান পালান হালট
সেই শ্যামতল নিত্য তামা
সরস মাটি রুক্ষ ঝামা,
এখন আমি রাখছি তুলে
আমার প্রাণের মর্মমূলে,
তোমার রক্তসিক্ত মাটি,
তোমার সকল খুঁটিনাটি,
তোমার দুঃখ তোমার আঁধি,
আমার বুকেই তার সমাধি,
হৃদয়পুরের শ্যাম ভুতলে,
রোজ ধুয়ে দিই চোখের জলে।
০৭.০৮.২০১৮