প্রজন্মান্তরে টিকে আছে স্যাকরারা, যারা মূলত গয়না তৈরির পেশার মানুষ; তাদের স্বর্ণকার বা সুবর্ণকারও বলা হয়।
Published : 10 Oct 2024, 08:36 PM
পুরান ঢাকার তাঁতী বাজার, তার অলি-গলি ধরে গয়না তৈরির ঘর বা কারখানা, সেখানে যারা কাজ করেন তাদের বলা হয় স্যাকরা; চোখে পড়ে তাদের ব্যস্ততা।
প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রজন্মান্তরে টিকে আছে স্যাকরারা, যারা মূলত গয়না তৈরির পেশার মানুষ; তাদের স্বর্ণকার বা সুবর্ণকারও বলা হয়।
ঢাকার লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে 'স্যাকরার তাঁতী বাজার’ শিরোনামে এক প্রদর্শনীতে উঠে এসেছে সেই স্বর্ণকারদের জীবন, তাদের হাতিয়ার এবং নানা উপাদান; ছোট্ট হাতুড়ি থেকে রয়েছে নানা উপকরণও।
বুধবার শুরু হওয়া সবার জন্য উন্মুক্ত প্রদর্শনীটি চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।
চারশ বছরের প্রাচীন শহর ঢাকার তাঁতী বাজারে তারও আগে স্যাকরা ছিল কিনা, তার হদিস মেলা ভার হলেও যতটুকু জানা যায় স্যাকরারা সেখানে গয়না তৈরির কাজ করে আসছে শহর-ঢাকার গোড়া থেকেই।
পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রেখে আজও স্যাকরারা তাঁতী বাজার আঁকড়ে তাদের পেশা বাঁচিয়ে রেখেছে; সময়ের প্রয়োজনে কত কিছুই বদলে গেছে, শুধু যেন স্যাকরা-জীবন বদলায়নি। গয়না তৈরির উপাদানেও খুব বেশি বদল ঘটায়নি তারা।
এখনও তাঁতী বাজারে গেলে দেখা যায় স্যাকরারা সেই ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে টুনটান শব্দ করে কাজ করে যাচ্ছে, স্বর্ণ বা রূপা মাটির পাত্রে রেখে পিতলের ফুনকি দিয়ে আগুনের শিখা প্রবাহিত করে ছাঁচে ফেলে বা নকশা তুলে গয়না বানাচ্ছে।
তাঁতী বাজারের বহু বিচিত্র গয়না তৈরির এই কারিগরদের এক দশক ধরে কাছ থেকে দেখে এসেছেন ঐতিহ্যবাহী সরঞ্জাম সংগ্রাহক তাহমিনা শৈলী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্যাকরাদের জীবন ও কর্ম পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নানা উপাদানও সংগ্রহ করে আসছেন।
তাহমিনা শৈলীর সেই সংগ্রহ থেকে স্বর্ণের ও রূপার গয়নাগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে; লাল মাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে তা মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
হাতুড়ি, প্লাস থেকে শুরু করে গয়না বানানোর নানা সরঞ্জামের পাশাপাশি প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে ক্যাশবাক্স এবং স্যাকরাদের খেরো খাতাও। সব মিলে যেন একখণ্ড তাঁতী বাজার দেখানোর আয়োজন করেছেন তাহমিনা শৈলী।
অবশ্য প্রদর্শনীতে থাকা কোনো গয়না ও সরঞ্জাম বিক্রি করা হচ্ছে না বলে তথ্য দিলেন আয়োজন-সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী তাঁতী বাজারের ‘গয়না শিল্প-বাজার’ এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছেন তাহমীনা শৈলী। তিনি নিজেই এই প্রদর্শনীর কিউরেটর।
তাহমীনা শৈলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যাকরার দোকানের সাথে সম্পর্ক নেই, এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেই সুদূর অতীতেও প্রকৃতির বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে মানুষ গহনা তৈরি করত।”
ঢাকার তাঁতীবাজারের স্যাকরার দোকানের এক ঐতিহ্যময় ইতিহাস আছে বলে মন্তব্য করে শৈলী বলেন, “ঐতিহ্যবাহী গয়না শিল্পীরা হলেন স্যাকরা; তারা প্রজন্মান্তরে সোনা, রূপাসহ বিভিন্ন ধাতুর বৈচিত্র্যময় গয়না তৈরি করে এই এলাকার জন্য এনে দিয়েছেন প্রবাদপ্রতিম খ্যাতি, তৈরি হয়েছে ‘তাঁতীবাজার' মিথ।
“আমি এক দশক ধরে সেখানে ঘুরে নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কারিগরদের সঙ্গে কথা বলেছি। নানা গহনা ও সেগুলোর উপকরণ সংগ্রহ করেছি। বলা চলে আমার এক দশকের অভিজ্ঞতায় স্যাকরার তাঁতীবাজারকে যেভাবে দেখেছি, খণ্ডিত হলেও তার এক রূপই এই প্রদর্শনী।”
তাঁতী বাজারের এই শিল্পকর্মের আড়ালে থাকা স্বর্ণশিল্পীদের সংগ্রামমুখর জীবনের গল্প তুলে ধরতে এ ধরনের প্রদর্শনী আরও বড় পরিসরে আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে শোনালেন তাহমিনা।
তিনি বলেন, “বিশ্বায়নের পরিবর্তনশীল বাজারের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলায় তাঁতীবাজারে জারি রয়েছে এক অনন্য শিল্প-সংগ্রাম। স্যাকরা সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন, আনন্দ-বেদনার পাশাপাশি তাঁতী বাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবার, জীবন শিল্পের বহুমাত্রিক উপাদান এবং পারিপার্শ্বিক অনালোকিত দিকও তুলে আনতে চেয়েছি।
“তাঁতী বাজার নিয়ে এর আগে এমন কোনো প্রদর্শনী হয়েছে বলে আমার জানা নেই।"