রবীন্দ্রনাথ যে আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন, তা অনির্বাণ।
Published : 21 Jun 2024, 01:27 PM
রবীন্দ্রসঙ্গীত কয়েকটি পর্যায়ে বা পর্বে বিভক্ত--প্রেম, প্রকৃতি, পূজা ইত্যাদি। সব পর্যায়ের গানই সুখশ্রাব্য। যদিও আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ হৃদয়টিকে সত্যিকার অর্থে চেনা যায় তাঁর নিবেদিত পূজা-পর্যায়ের গানগুলিতেই। ঈশ্বরচেতনা, তাঁর প্রতি আত্মনিবেদন ও প্রার্থনা, সমূহ দুঃখ-যাতনাগুলিকে পরানসখা ঈশ্বরের কাছে নিবেদন করে প্রশান্তি লাভ এইসব হিরণ্ময় বোধ বা অনুভূতি শব্দ ও সুরের মায়ায় গেঁথে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা অমোঘ ও অতুলনীয়। শুদ্ধ হৃদয়ের আর্তিনিবিড় পূজা-পর্যায়ের অসংখ্য গানের মধ্য থেকে কয়েকটি গান উল্লেখ করি---আমার যে সব দিতে হবে, প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী, সুন্দর হৃদিরঞ্জন তুমি, মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন, দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে, তুমি রবে নীরবে, আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনই লীলা তব, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে, প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে, ওহে সুন্দর মম, তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে, সীমার মাঝে অসীম তুমি, আমার বিচার তুমি করো, অনেক দিয়েছ নাথ, প্রভু আজি তোমার দক্ষিণ হাত, তব সিংহাসনের আসন হতে, চিরবন্ধু চিরশান্তি চিরনির্ভর তুমি হে প্রভু ইত্যাদি।
''আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে/ দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচার ঘরে/ যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার/ যদি পাপমনে করি অবিচার কাহার পরে/ লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ, ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ/ পরের পীড়ায় পেয়ে থাকি সুখ ক্ষণেক তরে/ তুমি যে জীবন দিয়েছ আমায়, কলঙ্ক যদি দিয়ে থাকি তায়/ আপনি বিনাশ করি আপনায় মোহের ভরে।''
ঈশ্বরের কাছে বিবেকি যন্ত্রণায় বিক্ষত হৃদয়ের এই আকুতিভরা বিচারপ্রার্থনা কবি কি অপূর্ব শৈলীতেই না উপস্থাপন করেছেন! এ কি শুধুই প্রার্থনা? হ্যাঁ। তার সঙ্গে সঙ্গে এ হ'ল এক মানস-দর্পণ, যেখানে প্রতি-মুহূর্তে নিজের গহন সত্তার ছবিটিকে দেখা যায়; আর সমস্ত কলুষ-কালিমা মুছে পরিশুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হতে থাকে।
অধিকাংশ মানুষ রবীন্দ্রসঙ্গীত বলতে তাঁর অধিক শ্রুত কিছু গানকেই বোঝে, অথচ আকাশের মতো প্রসারিত জীবনকে নানা রঙে ও রূপে অনুভব করে কবি অগণিত গানের যে অখণ্ড মালাটি গেঁথেছেন, তা অজানাই রয়ে গেল! সেই মালিকার একটি ফুল হল, কবির নিজের সঙ্গে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধকে বারবার অন্বেষণ করা। কবি জীবনদেবতার কাছে আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে যে শুদ্ধতা ও অপার্থিব আনন্দ পেতে চেয়েছেন, তার ভাগ আমাদেরও দিতে চেয়েছেন।
বস্তুত, কবি তাঁর অনেক গানে নিজের সঙ্গে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধকে অন্বেষণ করেছেন। আর এমন গভীর ও বিশুদ্ধ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই কবি নিজেকে করে তুলতে চেয়েছেন শুদ্ধতম এক মানুষ, কবিকল্পনায় যে মানবমূর্তিটিও ঈশ্বরেরই রচনা। যে মহার্ঘ 'জীবন' কবি পেয়েছেন একদিকে তাকে 'কলঙ্কমুক্ত' রাখার আকুতি ও অন্যদিকে কোন প্রক্রিয়ায় তা অর্জিত হতে পারে সেকথাও তিনি ব্যক্ত করেছেন বড় স্নিগ্ধ, নরম, মরমী উচ্চারণে!
আপন হৃদয়ে ঈশ্বরের বিরাটত্ব উপলব্ধির অনেকগুলি হিতকর ফলাফল আছে। সর্বাগ্রে যা উল্লেখযোগ্য তা হ'ল, নিজের অসীম 'ক্ষুদ্রত্ব'-কে অনুভব করতে পারা যায়। এর অনিবার্য অভিব্যক্তি হচ্ছে, সর্বনাশা 'অহং' থেকে মুক্ত হওয়া যায়। আগে প্রয়োজন আত্মশুদ্ধি, যা মানুষের সমস্ত কর্মে ছাপ ফেলে। রবীন্দ্রনাথ এই শাশ্বত সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বলেই এমন আকুল আকুতি ঈশ্বরের উদ্দেশে ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন।
মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করা ভাল। যা জানি তা ঠিক জানি তো? যা বিশ্বাস করি তা ঠিকঠাক বিশ্বাস করি তো? সেটা বোঝা এমন কিছু কঠিন নয়। বিশ্বাসের সঙ্গে আচরণের নিবিড় সম্পর্ক। আচরণেই বিশ্বাসের বিশুদ্ধতা প্রতিফলিত হয়। সেখানে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব মানেই বিশ্বাসের ধূসরতা অথবা অস্বচ্ছতা। আবার, যা অবিশ্বাস করি তা-ও কি যথাযথ? অর্থাৎ, মোদ্দা কথা হ'ল, আমার জানা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস সবই খাঁটি, নাকি খাঁটি নয়? এই জগতে কঠিনতম কাজ হ'ল, নিজের মুখোমুখি হওয়া। এই কাজটা হয় না বলেই অন্তহীন 'স্ববিরোধিতা'-কে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নিত্য পথচলা। আমরা অন্যের 'বিচার' করতে ভালবাসি, কিন্তু নিজের 'বিচার'? তার কি প্রয়োজন নেই? নিজেই নিজের সেই 'বিচার' অক্ষমতার অনুভব থেকেই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদন করেছেন: ''আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে", যার নেপথ্য অভিপ্রায়টি হচ্ছে শুদ্ধতম হৃদয়ের ও জীবনের অধিকারী হওয়া।
একথা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের বোধ ও চেতনার ব্যাপ্তি বা প্রসারতা 'ঈশ্বর' নামক অনন্ত বিশালতার সঙ্গে আপন সত্তার সংস্থাপন-সূত্রে রচিত, বিশ্বমানবতাবোধে কবির জারিত হওয়াও সেখান থেকেই উৎসারিত। সবচেয়ে সুন্দর হৃদয় কোনটি, যখন হৃদয়ই 'মানবতাবোধ' নামক সোনার ফসল ফলানোর উর্বর ভূমি? যে হৃদয় আবিল অহংশূন্য, নম্র ও বিনত, সেই হৃদয়ই শুদ্ধ ও সুন্দর। রবীন্দ্রমননে তারই একটি গহন ছবি এভাবে বিধৃত হয়েছে:
''প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারই সম্মুখে/ করি জোড় কর হে ভুবনেশ্বর, দাঁড়াব তোমারই সম্মুখে/ তোমার অপার আকাশের তলে, বিজনে বিরলে হে, নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে, দাঁড়াব তোমারই সম্মুখে/ তোমার বিচিত্র এ ভব সংসারে, কর্ম-পারাবার পারে হে, নিখিল ভুবন লোকের মাঝারে, দাঁড়াব তোমারই সম্মুখে/ তোমার এ ভবে, মম কর্ম যবে সমাপন হবে, ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে, দাঁড়াব তোমারই সম্মুখে।''
নিবেদিত ও সমর্পিত হৃদয়ের এই আকুলতা হৃদয়কে পরিশুদ্ধ ও পুষ্পিত করার জন্য যথেষ্ট এবং অ-বিকল্প। রবীন্দ্রনাথ যে আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করে গেছেন, তা অনির্বাণ। প্রয়োজন শুধু সেই শিখার নিকটবর্তী হওয়া।