ভাষার হারিয়ে যাওয়া

প্রাণীজগতের, উদ্ভিদজগতের অনেক-কিছু লুপ্ত হয়ে যাওয়াতে যে কষ্টবোধ, যে হাহাকারবোধ আমাদের তাড়া করে ফেরে, ভাষা-বিলুপ্তি তার চেয়েও কষ্টের। এটা আমাদের বৈশ্বিক বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে ফেলে।

কুমার চক্রবর্তীকুমার চক্রবর্তী
Published : 3 Feb 2024, 06:19 AM
Updated : 3 Feb 2024, 06:19 AM

ডারউইন অনেক দেরিতেই যেন পড়লাম, অনেক অনেক দেরিতে। এই পড়ার গূঢ়ার্থ হল নিমগ্নভাবে পড়া, সক্রিয় ও সরাসরি, বুঝেশুঝে পড়া, পরিগ্রহণের জন্য পড়া; মূল রচনা মৌলিকভাবে পড়া। আমরা এখন অনেকক্ষেত্রেই আর মূল রচনার স্বাদ নিই না, পরিবর্তে আশ্রয়ী বা অবলম্বিত লেখা পড়ে সেই রচনার বিষয় অনুধ্যান করতে চাই, তা দিয়ে পাণ্ডিত্যও ফলাই। তাতে গোল যে বাধবেই তা তো নিশ্চিত। কারণ, আশ্রয়ীলেখায় সেই লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মূল লেখক অংশত উপস্থাপিত হন প্রায়শই, মূল লেখক এখানে অপর লেখকের ছায়ায় ধরা দেন। মূল রচনার বিশেষ ও সুবিধাজনক কিছুকে ইচ্ছামতো নিয়ে লেখাটি গড়ে ওঠে। এটি অনেক সময়েই হয় ‘‘পাখির চোখে দেখা’’। একেই বলে ঝাঁকিদর্শন: ভাসা ভাসা দেখা, তড়িঘড়ি করে একনজর দেখা। এভাবে ভাসাভাসা লেখায় মূল লেখকের সামগ্রিকতা অধরা থাকে। মূল লেখকের প্রতিস্বর অনেকটা অচিহ্নিত থাকে। এটা নিশ্চয় জ্ঞান অর্জনের পথে অযথার্থ এবং শিকড়অসন্ধানী। মূল রচনা পড়া তাই পাঠের স্বকীয়তা এবং স্বাভাবিকতার বিবেচনায় অধিক কাম্য। আর মূল পাঠেই লেখাকে ধরে লেখকের কাছে নিজের মতো করে পৌঁছা যায়। এতদিন এই ঝাঁকিদর্শনেই ডারউইন-পাঠ সীমাবদ্ধ ছিল আমার।

যা-ই হোক, তবু যে ডারউইন পড়ে উঠতে পারলাম তাতেই প্রীতি ও প্রাপ্তি জমেছে মনে। ক্লাসিকস বইয়ের একজাতীয় স্বস্থিত আর্কাইভ থাকে, যেখানে সময়ের রূপ ও রহস্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। ডারউইনের প্রভাব এখনও ক্রিয়াশীল। এখনও মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, এবং জেনোমিকস-কে ডারউইন প্রভাবিত করে চলেছে। তো তাঁর বিখ্যাত প্রজাতি-বিবর্তনবাদকে বাদ দিয়ে খুঁজতে লাগলাম অন্য কিছু, যা আশা করছিলাম মনে মনে পাব বলে। পেলামও। ভাষা, চিন্তার বিকাশ এবং প্রকাশ বিষয়ে ভাবনা-জাগানিয়া মৌলিক যা-কিছু ডারউইনে পাওয়া যায়, পাঠকের জন্য তা এক অশেষ দান। এসব চিন্তাসূত্র হয়ে ওঠে বা উঠেছে নব্য রচনার অমোঘ ধরতাই। চিন্তার ফল বাতিল হয়ে যেতে পারে নবতর চিন্তার ফলাফল বা চিন্তার নবতর ফলাফল দ্বারা কিন্তু তাতে আগের চিন্তা গুরুত্ব হারায় না, চিন্তকও গুরুত্ব হারান না। কারণ, ওই আগের চিন্তার জন্যই পরের চিন্তার জন্ম হয়। নতুন অনুচিন্তাটি সম্ভব হয়েছে পুরোনো চিন্তার কারণেই। বুদ্ধবাদের প্রতীত্বসমুৎপাদ দ্বারা একে সহজে বোঝা যায়। অজ্ঞরাই নানা ছলে সবকিছুকে বাতিলের জন্য সদা তৎপর থাকে, কারণ, তারা নিজের জায়গায় স্থির এবং স্থিত থাকতে চায়। তারা পরিবর্তনবিমুখ, বিবর্তনবিরোধী, আপন ভাবনাজগৎকে তারা নাড়াতে চান না। ডারউইন নিজেও বলেছেন যে, অজ্ঞতা সবসময়েই জ্ঞানের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী। অর্থাৎ অজ্ঞরা নিজেকে রক্ষার জন্য অন্য-সবকিছুকে বাতিল করতে পিছ-পা হয় না। কিন্তু জ্ঞানের রাজ্যে চিন্তার সমষ্টি হলো চেইন রিয়েকশনের মতো। এক-একটি জ্ঞানখণ্ড ক্রমবিকাশের এক-একটি চন্দ্রমৌলি।

১৮৭১ সালে প্রকাশিত ডিসেন্ট অব ম্যান-এ ডারউইন বলছেন, কল্পনা হল মানুষের উন্নত ক্ষমতাগুলির একটি প্রধান শক্তি যার মাধ্যমে মানুষ সহজাতভাবেই আগের কোনো ধারণা এবং ভাবনাকে যোগ করতে পারে, এবং এভাবেই সেরা সৃষ্টিকে আবিষ্কারও করতে পারে। ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, কথা-বলা এক শিল্পকর্ম। ভাষা শিখতে হয় কিন্তু মানুষের মধ্যে ভাষা-বিষয়ে এক সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করে। ডারউইন বিষয়টি এভাবে শেষ করেছেন যে ভাষা-সক্ষমতা হল, ‘‘ an instinctive tendency to acquire an art ।’’ ভাষা-প্রসঙ্গে এই শিল্পকে অর্জনের এক সহজাত প্রবণতার কথাই বলেছেন ডারউইন।

বাড়তি হিসেবে একটি ব্যাপার এ প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও চলে আসে--ভাষাতত্ত্বের একটি কথা খুব আলোচিত: ভাষা আগে নাকি চিন্তা আগে। এটা অনেকটা মুরগি আগে নাকি ডিম আগের মতো ধাঁধাদর্শন। বিংশ শতাব্দের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছেন, ভাষা আগে, ভাবনা পরে। এই একই কথার পূর্বাভাস মেলে মহাভারতের অশ্বমেধিক পর্বে। হ্বিটগেনস্টাইনও যে বলেছিলেন, আমার ভাষার সীমা মানে আমার জগতের সীমা। কিন্তু ডারউইনেও এর উল্লেখ আছে, তবে তা একটু ভিন্ন। যারা মনে করে ভাষা-ব্যবহারের ফলেই মানুষের মধ্যে সাধারণ ধারণা গড়ে ওঠে, তিনি তার সঙ্গে একমত হননি, কিছু উদাহরণের আশ্রয় নিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, ওই ধারণাগুলো তাদের মধ্যে আগে থেকেই গড়ে ওঠে।

ডারউইন যে ভাষাকে বলেছেন শিল্পকে ধরার এক সহজাত প্রবণতা, বিশ্বে সেই ভাষাসমূহের বর্তমান অবস্থাটা, বা ভাষার উৎপত্তি-রহস্যটিও বা কেমন?

এটা ঠিক যে, বিষয়টি নিরন্তর অনুসন্ধেয় বিষয় হলেও এখনও তা রহস্যমুক্ত হয়নি। যুগ যুগ ধরে মানবভাষার উদ্ভব বিষয়ে মানুষ নানা অনুমান করে আসছে, কিন্তু নিশ্চিত কিছুতে উপনীত হতেও পারছে না; রহস্য যেন নতুন রহস্যেরই জন্ম দিয়ে চলছে। পৃথিবীর আদিভাষা কোনটি ছিল, একটি ভাষাই কি আদতে ছিল নাকি বেশ কয়েকটা, নাকি অনেক; এরও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আদম-হাওয়ার ভাষা কী ছিল, তা কি ছিল কোনো চিহ্ন বা প্রতীকভাষা, নাকি কোনো ধ্বনিভাষা? শব্দের উৎপত্তি কীভাবে হল, কীভাবে তাতে অর্থারোপ ঘটল, এই বিষয়টা নিয়ে শুধুই গবেষণা চলছে; কিন্তু ভাষার উদ্ভব এবং বিকাশ বিষয়ে বলা যায়, মোটাদাগে আজঅব্দি অনুমানই একমাত্র সম্বল। ডেনিশ ভাষাতাত্ত্বিক অটো য়েসপেরসনের ভাষা-উদ্ভবসংক্রান্ত চলতি-ধারণাগুলোর বিবেচনায় যে-চার ধরনের বর্গীকরণ রয়েছে--বো-ও,পুহ-পুহ, ডিং-ডং, ও-হি-হো তত্ত্ব--সেখানে চারপাশের পরিবেশজাত ধ্বনির অনুকরণ বা প্রাণীদের উচ্চারিত শব্দের অনুকরণের কথা বলা হয়েছে; মানুষের প্রাবৃত্তিক শব্দ তৈরির কথা বলা হয়েছে, বলা হয়েছে চারপাশের প্রতি মানুষের সংবেদন-প্রতিক্রিয়ার কথা, আর বলা হয়েছে যূথবদ্ধ মানুষের শারীরিক প্রচেষ্টা থেকে সৃষ্ট ছান্দিক মুখশব্দের কথা; কিন্তু এর সঙ্গে তিনি যোগ করেন স্ব-সৃষ্ট ‘‘লা-লা’’ তত্ত্বের যা বোঝায়, মানুষের অন্তরঙ্গ মিলন, প্রেম, ক্রীড়া, কাব্যিক অনুভূতি, সংগীত থেকে উদ্ভূত ধ্বনি থেকে ভাষার উৎপত্তির কথা। বিষয়টি বেশ, কারণ তা জীবনের রোমান্টিক দিককে প্রতিফলিত করেছে; ধ্বনি যে রোমান্টিক উপাদান থেকে উদ্ভূত, ভাষা সৃষ্টির পেছনে তাকে তিনি একক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।

ভাষার উৎপত্তির অনুসন্ধান বিষয়ে প্রাচীন একটি ইতিহাসের কথা বলেছেন গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোদোতুস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দের মিশরীয় রাজা প্রথম সামতিক (সামেতিচুস)-এর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন: রাজা সামতিক সবচেয়ে প্রাচীন ভাষার অনুসন্ধান করতে চাইলেন পৃথিবীর প্রাচীনতম মানবজাতিকে আবিষ্কারের জন্য। তিনি সাধারণ ঘরের নবজাতক দুজন শিশুকে একজন রাখালের হাতে তুলে দেন এই বলে যে সে যেন এই দুই শিশুকে তার পশুদের পালে রেখে বড়ো করে, আর কেউ যেন শিশুদের সামনে কোনো কথা না বলে, তারা যেন মনুষ্যবিহীন পরিবেশে একা একা বেড়ে ওঠে। যা হুকুম তা-ই ব্যবস্থা, শিশুদুটিকে নিয়ে রাখাল দূরে চলে যায়, নির্দিষ্ট সময়ে তার পালের ছাগলদের এনে শিশুদুটিকে দুধ খাইয়ে দেয়, তারপর শিশুরা একা একা থাকে। রাজার ইচ্ছা ছিল, সম্পূর্ণ মনুষ্যবিহীন পরিবেশে থেকে, মানুষের ভাষার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপিরিচিত থেকে, শিশুরা কোন ভাষায় প্রথমে কথা বলে, তা পরখ করা। এভাবে দুই বছর অতিক্রান্ত হল, একদিন রাখাল যখন ঘরের দরজা খুলে শিশুদের দেখতে যায় তখন শিশুদুটি চিৎকার করে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আর বলে বসে: বেকস (becos)|)। শুনে রাখালের মন খুশিতে ভরে ওঠে, কিন্তু তাদের দেখভাল করার জন্য রাখাল যখনই তাদের কাছে আসে তখনই শিশুরা পুনঃপুন এই একই শব্দ বলতে লাগে। তখন রাখাল রাজার কাছে শিশুদের নিয়ে যায়। রাজা সামেতিচুস শিশুদের মুখ থেকে একই কথা শুনলেন, তিনি তখন খোঁজ করতে লাগলেন যে কোন জাতির মধ্যে বেকস শব্দটি আছে। দেখলেন, ফ্রিজিয়ার লোকেরা রুটিকে বলে বেকস। এর থেকে মিশরীয়রা এই ধারণা গ্রহণ করে যে ফ্রিজীয়রা মিশরীয়দের থেকে প্রাচীন জাতি। হেরাদোতুস তাঁর লেখায় বলেন, তিনি তা শুনেছেন মেমফিসের হেফিস্তুস দেবতার মন্দিরের এক পুরোহিতের কাছ থেকে । ফ্রিজিয়ার এখন আর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সে-সময় বর্তমান তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাংশে এই ভাষার ব্যবহার ছিল। যা-ই হোক, সামতিকের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। ওই সময়ে ফ্রিজিয়া অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ভাষারই বিকাশ হয়েছিল। আর শিশুরা কেন বেকস বলবে তার কোনো কার্যকারণ নাই, সম্ভবত তা ছিল তাদের প্রাকৃতিক আধো উচ্চারণ বা বুলি। তবে এসব আটপৌরে এবং অনুমিত আলোচনাকে বাদ দিলে দেখতে পাব, এ বিষয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা চলছে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় গ্লসোজেনেটিকস, যা বোঝায় মানুষের ভাষার উদ্ভব এবং বিকাশবিষয়ক অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়, তিরিশ হাজার বছর আগে মানুষের ভাষার জন্ম হয়েছিল, কিন্তু লিখিত ভাষার সাথে এর সম্বন্ধ মাত্র দশ হাজার বছরের।

১৯৯৯ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পৃথিবীতে ৬৭৮৪ টি ভাষাকে চিহ্নিত করা গেছে যার মধ্যে ৬০৬০ টির তথ্যাবলি প্রতুল। বলা প্রাসঙ্গিক, কোনটা ভাষা আর কোনটা উপভাষা তা নির্ধারণ করা অনেক সময় দুষ্কর হয়ে পড়ে; একটি উপভাষা একটি ভাষা হতে পারে আবার না-ও হতে পারে, অন্যদিকে, একটি ভাষার মধ্যে একাধিক উপভাষা থাকা স্বাভাবিক ঘটনা। অনেক গোত্রের মধ্যে ব্যবহৃত ভাষাটির কোনো নাম নেই, এক্ষেত্রে নিজেদের ভাষাকে চিহ্নিত করতে তারা শুধু বলে থাকে ‘‘আমাদের ভাষা’’; আবার অনেক সম্প্রদায় তাদের ভাষাকে অনেক নামে ডেকে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ভাষাকে অনেক নামেও ডাকা হয়। সুতরাং ভাষা-গণনার ক্ষেত্রে এসব এক ব্যবহারিক সমস্যা। যা-ই হোক, ৫১ টি ভাষায় শুধু একজন কথা-বলার লোক রয়েছে। ৫০০ টি ভাষায় কথা-বলা লোকের সংখ্যা ১০০ জনেরও কম। ১৫০০ টি ভাষায় কথা বলে ১০০০ জনেরও কম। ৫০০০ টি ভাষায় এক লক্ষেরও কম। এই উপাত্ত এ-ই বলে যে, অনেক ভাষার মৃত্যু বা বিলুপ্তি হতে চলেছে এবং ইতিমধ্যে অনেক ভাষার হয়েছেও। ভাষার মৃত্যু হয় যখন ওই ভাষায় কথাবলার দ্বিতীয় মানুষটি আর থাকে না। একজন থাকলে ওই ভাষায় কথা বলার সুযোগ থাকে না। ফলত একসময় শেষ ভাষীটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভাষাটিরও মৃত্যু হয়ে যায়। ভাষাটির ওপর গবেষণা চলতে পারে কিন্তু ওই ভাষায় কথাবার্তা না-চললে তাকে মৃত ভাষা বলা হবে। অর্থাৎ উপভাষা হিসেবে ভাষাটির কথন না থাকলেই তাকে মৃত বলে গণ্য করা হবে।

কিন্তু কেন তা ঘটে? ভাষার মৃত্যু হতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গণহত্যা বা সাংস্কৃতিক সাঙ্গীকরণের কারণে। বিচ্ছিন্ন ভূগোলের ছোটো ছোটো জাতিগোষ্ঠীগুলি নানা ধরনের প্রকৃতিক দুর্যোগে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, যেমন দুর্ভিক্ষ, বন্যা বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণেও নিশ্চিহ্ন বা অতি তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে গোষ্ঠীগুলি যা তাদের ভাষাপ্রবাহকে আর ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। মহামারিতেও ঘটতে পারে তদ্রুপ ঘটনা। কিন্তু সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ প্রধান একটি কারণ যা শুরু হয়েছিল ৫০০ বছর আগে, উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে। আর এক্ষেত্রে প্রধান কয়েকটি ভাষা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে: ইংরেজি, ফরাসি, পোর্তুগিজ, ডাচ, স্পেনিশ। আবার উপনিবেশ স্থাপনের আগে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য যে-সম্রাটরা রাজ্য দখল করত, তাদের ভাষাও আরোপিত হত বিজিত রাজ্যের অধিবাসীদের ওপর। এ বিষয়ে ডারউইন বিবর্তনকে মাথায় রেখেই বলেছেন, প্রধান ভাষা এবং উপভাষাগুলি ছড়িয়ে পড়ার কারণেই অন্য ভাষাগুলি ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে চলে যেতে থাকে। আরেকটি বিষয়, আদিবাসী গোষ্ঠীরা প্রায়শই হয় আত্মভাবাপন্ন, মানে তারা বহিরাগমনকে গ্রহণ তো করতেই পারে না, ফলত তা এলে তারা আত্মধ্বংসী মানসিকতায় মেতে ওঠে। নিজেদের বিলুপ্তির দিকে চালিত করে।

কিন্তু যখন একটি সংস্কৃতি অন্যটিকে উদ্দেশ্যগতভাবে আত্মীকরণ করে তখন তিন ধরনের স্তরান্তর দেখা যায়--বলেছেন ভাষাবিদ ডেভিড ক্রিস্টাল-- প্রথম স্তরে দেখা যায়, অধিবাসীদের ওপর মারাত্মক মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় প্রাধান্যবিস্তারক ভাষাটিতে গ্রহণের জন্য, আর তা ঘটে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবে; এ হতে পারে ‘‘টপ-ডাউন’’ পদ্ধতিতে-- পুরস্কার, প্রেরণা, কার্যক্রমগ্রহণ, শিক্ষাপ্রসারণ, প্রস্তাবনা বা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আগত ভাষাটিকে চালুকরণের জন্য কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট হয়ে পড়ে। বা তা হতে পারে ‘‘বটম-টপ’’ পদ্ধতিতে যেখানে সমাজের অভ্যন্তরে চলতি ফ্যাশান হিসেবে বা পিয়ার গ্রুপের(সমাজে প্রভাববিস্তারি বা অনুসরণীয় দল) চাপে ভাষা-ব্যবহার চালু হতে থাকে। ব্রিটিশ ভারতেও ইংরেজি চালু হওয়ার সময় এই অবস্থা দেখা গিয়েছিল। আবার সুস্পষ্ট কোনো সূত্র ছাড়াই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে, উন্নত জীবনমান অর্জনের কথাকে শিরোধার্য করে এই প্রভাবক ভাষাকে গ্রহণ করা শুরু হতে পারে। এক্ষেত্রে আগত ভাষাটিকে অভিজাত ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয় এবং তাকে ব্যবহার করা আভিজাত্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হতে পারে। কিন্তু যেভাবেই এই চাপ সৃষ্ট হোক না কেন, ফলাফল হিসেবে, দ্বিতীয় স্তরে, দুটি ভাষাই সমান্তরালে চলতে শুরু করে। এই সময়ে নতুন ভাষার ওপর দক্ষতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে এবং পুরোনো ভাষাকেও ধরে রাখার চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই পুরোনো ভাষা নতুন ভাষার কাছে পরাজিত হতে থাকে তার স্থান ও গুরুত্ব হারানোর মাধ্যমে। এভাবে তৃতীয় স্তরের আবির্ভাব হয় যখন নতুন প্রজন্ম নতুন ভাষায় অধিকতর দক্ষ ও স্বচ্ছন্দ হয়ে যায়, ধীরে ধীরে পুরোনো ভাষার ওপর অধিকারকে ছেড়ে দিতে থাকে, সমাজ নতুন ভাষার ব্যবহারকে মর্যাদাকর মনে করতে থাকে। এভাবে পরের প্রজন্ম নিজ আদি ভাষাটিকে ভুলে যায়, পর ভাষাকে নিজ ভাষা বলে ভাবতে থাকে। এ সময় একটি পরিবারে হয়তো পারিবারিক-ভাষায় ( ফ্যামেলি ডায়েলেক্ট) দুটি ভাষা চলে কিন্তু ঘরের বাইরে, সমাজে-অফিসে-আদালতে-আড্ডায়, নিজ ভাষার ওপর অপর ভাষাটির নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ জনগণ অপর ভাষাতেই কথা ও কাজ সম্পন্ন করতে চায় এবং করেও। এমনকি অধিকৃত ভাষায় শিল্প-সাহিত্য চর্চাও চলতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায়, এক প্রজন্মে বা এক দশকেই একটি পরিবারের সুন্দর দ্বিভাষাচর্চা একটি আত্মচেতনিক অর্ধভাষিক রূপ নেয় যা ধীরে ধীরে একভাষিক চেহারায় পরিণত হয় এবং নিজ ভাষাটি বিলুপ্তির দিকেই চলে যায়। ডেভিড ক্রিস্টাল এমনটাই বলতে চেয়েছেন, এবং এটাই সর্বজনীন সত্য। একই সাথে বাইরের এবং ভিতরের জগতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ভাষাটি। এই প্রক্রিয়ায় আত্ম হয় পর আর পর হয়ে উঠতে চায় আত্ম। এটাকে বলা যায় বিপ্রতীপের খেলা।

কিন্তু ভাষা লুপ্ত হলে কী যায় আসে? পৃথিবীতে কত কিছুই তো হারিয়ে যায়, রূপান্তরিত হয়, বিপ্লবী বা বিবর্তনিক প্রক্রিয়ায়। তবে ভাষা গেলে ক্ষতি কী? প্রাণীজগতের, উদ্ভিদজগতের অনেক-কিছু লুপ্ত হয়ে যাওয়াতে যে কষ্টবোধ, যে হাহাকারবোধ আমাদের তাড়া করে ফেরে, ভাষা-বিলুপ্তি তার চেয়েও কষ্টের। এটা আমাদের বৈশ্বিক বৈচিত্র্যকে নষ্ট করে ফেলে। যে বিচিত্রের সন্ধান সতত আমরা করে বেড়াই, সেই সন্ধানী বিষয়গুলি না-থাকলে আমাদের বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগমন অসম্ভব। ভাষা হল কোনো সম্প্রদায়ের পবিত্র মন্দির যেখানে তার ইতিহাস ধারিত, তার সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রোথিত--অনেকটা এমনই বলেছেন ডেভিড ক্রিস্টাল। তিনি বলেছেন, The world is a mosaic of visions. To lose even one piece of this mosaic is a loss for everyone। অন্যের স্বপ্ন বা রূপকল্প থেকেও আমরা অনেক-কিছু জানতে পারি। অনেক সময় এই জানা ব্যবহারিকও হয়, যেমন, প্রাচীনকালের ব্যবহৃত কোনো ওষুধ থেকে যখন বর্তমানকালে কোনো ওষুধ আবিষ্কারের ঘটনা। কিন্তু ভাষাটি হারিয়ে গেলে প্রাকৃতিক ধারাবাহিকতার ছেদ পড়ে, মানব-ইতিহাসের অর্জনগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে জানতে গেলে, সেই সভ্যতার আর্টিফেক্ট-মেনটিফ্যাক্ট-সোশিয়োফ্যাক্ট বুঝতে গেলে সেই সময়ের ভাষাটিকে জানার প্রয়োজন, আর ভাষাটি রক্ষা না-করা গেলে সেই জানার জগৎটিই অনারব্ধ থেকে যায়। তাই ভাষার মৃত্যু মানে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির মূল্যবান উৎসকে হারিয়ে বসা। ডারউইন স্যার সি. লাইয়েল-এর কথার আলোকে বলেছেন যে, কোনো প্রজাতি যেমন একবার হারিয়ে গেলে আর পুনরাভির্ভূত হতে পারে না তেমনই কোনো ভাষাও একবার হারিয়ে গেলে তার আর পুনরাগমন ঘটে না। এই বিলুপ্তির হাত থেকে ভাষাকে রক্ষা করা যায় ভাষার পুনঃসঞ্জীবনীকরণের মাধ্যমে। এ কাজে আক্রান্ত ভাষাটির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন তার প্রতি মূল সংস্কৃৃতির সমর্থন। তারপর এর পেছনে অর্থ বরাদ্দ করা যেন ডকুমেন্টিংয়ের জন্য কাজ করা যায়। ‘‘রিভাইটালাইজেশন’’ প্রক্রিয়ায় কিছু সার্থকতা দেখা গেছে। হিব্রু ভাষা মৃত ভাষা ছিল কিন্তু ইসরায়েল রাষ্ট্রে তার পুনর্জন্ম হয়েছে। ওয়েলশ ভাষা যে বিলুপ্তির পথে অগ্রসরমান ছিল তা ঠেকিয়ে এখন ভাষাটির টিকে থাকার গতিকে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে, এবং তা করা হয়েছে দুটি আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। নিউজিল্যান্ডে যে মাওরি ভাষা রয়েছে, তাকেও ‘‘ল্যাঙ্গুয়েজ নেস্ট’’ পদ্ধতির মাধ্যমে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৮২ সালে প্রবর্তন করা হয় এই পদ্ধতির; এই প্রক্রিয়ায় এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যারা পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের ঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই এই ভাষা-ব্যবহারে অভ্যস্ত করে তোলে। এক্ষেত্রে স্থানীয় এলাকার মাওরিদের নিয়োগ করা হয় শেখানোর কাজে এই ভরসায় যে শিশুরা ‘‘ভাষা-বাসা’’ পর্যায় শেষ হবার পরও অর্জিত মাওরি ভাষার দক্ষতাকে বহন করে চলবে আর বুড়ো হলে এক্ষেত্রে প্রজন্মের জন্য রোল মডেল হয়ে উঠবে। এ ধরনের প্রকল্প অন্যত্রও চলমান: হাওয়াইয়ান (হাওয়াই দ্বীপের ভাষা), তাহিতিয়ান (তাহিতি দ্বীপের ভাষা) ইউকাগির (সাইবেরিয়ার ভাষা), উত্তর আমেরিকাসহ আরও অনেক স্থানে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার পুনঃসঞ্জীবনীকরণের জন্যও এ ধরনের প্রকল্প রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বটম-আপ এবং টপ-ডাউন পদ্ধতির মাধ্যমে ভাষা-অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়। জাপানে আইনুভাষীর সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছিল আট জনে, তাও আবার সবাই ছিল বুড়ো। নতুন সরকারি নীতিতে তার আবার পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছে। জাপানিভাষীরা ভিন্নচোখে দেখার কারণে আধখ্যাঁচড়া জানা আইনুভাষীরা আবার সক্রিয়ভাষী হয়ে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ায়ও দেখা যায়, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কাউরনা ভাষাকেও জাগিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সম্ভব হয়েছে কারণ, ভাষাটি ভালোভাবে ডকুমেন্টেড ছিল।

ভাষা মানুষের অস্তিত্ব ও অহমের অংশ। ভাষারক্ষা তো অস্তিত্বকেই রক্ষা, নিজের মাতৃরূপকে রক্ষা করা। মাতৃরূপ হল অস্তিত্বের এক অধিষ্ঠান যা জীবনের ও জগতের অবিছিন্নতাকে ভিতর থেকে রক্ষা করে চলে। ভাষা হারিয়ে গেলে সেই হারানোর বেদনা থাকে অপরিমাপিত। অস্ট্রেলীয় লেখক ডেভিড মালুফ তাঁর ছোটো গল্প ‘‘দ্য অনলি স্পিকার অব হিজ টাং’’-এ বলেন, ‘‘যখনই আমি ভাবি, আমার মুখের ভাষাটি আর মানুষের কাছে জীবিত নাই, তখনই এক হিম আমার ভেতর দিয়ে বয়ে যায় যেন তা আমার মৃত্যুর চেয়েও গভীরতর, কারণ, এটা আমার সমগ্র গোষ্ঠীরই সামগ্রিক মৃত্যু’’:‘‘ When I think of my tongue being no longer alive in the mouths of men, a chill goes over me that is deeper than my own death, since it is the gathered death of all my kind.’’

ডেভিড ক্রিস্টাল বলেন, ভাষার হারিয়ে যাওয়া অন্য অনেক কিছুর হারিয়ে যাওয়ার মতো কোনো সাধারণ বিষয় নয়। মানুষ যখন মারা যায় তারা তাদের চিহ্নগুলি--বাসাবাড়ি, সম্পদ, সন্তানাদি--পৃথিবীতে রেখে যায়। এমনকি সে নিদেনপক্ষে একটা ধ্বস্ত সমাধিও রেখে যায় যা অনন্তের সঙ্গে কথা বলে চলে নীরবে; মানুষ ক্ষণিকের জন্য হলেও এসে সেই সমাধির পাশে থমকে দাঁড়ায় আর মৃত মানুষটিকে স্মরণে নিয়ে নেয়। এককথায় বললে, মৃত ব্যক্তিও তার পুরাতত্ত্বকে রেখে যায় পৃথিবীতে। কিন্তু মুখের ভাষা মরলে কোনো পুরাতত্ত্ব থাকে না তার। একটি রেকর্ডহীন আনডকুমেন্টেড ভাষা যখন মরে যায়, তখন মনে হয় পৃথিবীতে ভাষাটি ছিলই না কোনোদিন। কিন্তু তা তো সত্য নয়, ভাষাটি তো ছিল একদিন--মানুষের মুখে ও মনে, ও মননে, যে-ভাষা অনুরণিত হয়েছিল অন্তরে-বাহিরে তার সমস্ত ঐশ্বর্য এবং আনন্দ-বেদনা নিয়ে! আজ ভাষাটি নেই, কিন্তু তার কান্না যেন ছড়িয়ে আছে চারপাশে, পৃথিবীর গোপন কোটরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে!