মেহনাজের লেখার মধ্যে এলিস মনরোর লেখার প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা এবং বাস্তবতার সঙ্গে ব্যক্তির লড়াইয়ের দিক থেকে।
Published : 28 Mar 2025, 07:31 PM
মোট সতেরোটি গল্পের বইটিতে মেহনাজ মুস্তারিন গভীর মানবিক অনুভূতি, সামাজিক জটিলতা এবং ব্যক্তির মানসিক সংকটের এক অনন্য শিল্পকর্ম তুলে ধরেছেন । প্রতিটি গল্পই আলাদা এক জীবনদর্শনের প্রতিফলন, যেখানে চরিত্রগুলো তাদের নিজস্বতা, চাহিদা, এবং পরিচিতি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। তার গল্পে ব্যক্তিচরিত্রগুলোর স্বাতন্ত্র্য একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে। প্রতিটি গল্পের চরিত্র যেন তার নিজস্ব দুনিয়ার কথা বলে, যেখানে তারা সমাজের কাঠামো, ব্যক্তিগত সংগ্রাম, এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়। এ পর্যালোচনায় আমরা তার গল্পগুলোতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের প্রকাশ নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি কানাডিয়ান লেখক এলিস মনরোর লেখার সাথে মেহনাজ মুস্তারিনের লেখার কিছু মিল নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের রূপায়ণ
মেহনাজের গল্পগুলোতে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। জীবনের নানান স্তরের চরিত্র, তাদের সামাজিক অবস্থান, এবং তাদের মানসিক দ্বন্দ্ব গল্পগুলোর মূল চালিকাশক্তি। লেখক এমন এক দুনিয়া নির্মাণ করেন, যেখানে প্রতিটি চরিত্র নিজের অবস্থান থেকে একা; কিন্তু সেই একাকিত্বের মধ্যে নিহিত থাকে তাদের নিজস্ব স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা।
মেহনাজের ভাষা অত্যন্ত সরল, তবে তাতে গভীরতা রয়েছে। তিনি ভাষার মাধ্যমে চরিত্রগুলোর মনের জটিলতাকে পাঠকের কাছে সহজভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটি চরিত্রের সংলাপ তাদের ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে।
১. “তিনশত তিরিশ টাকা” গল্পটি দরিদ্র দিনমজুর কিসকু মার্ডিকে কেন্দ্র করে। কিসকু তার পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে কঠিন সংগ্রাম করে, তা শুধু আর্থিক সংকটের প্রকাশ নয়; এটি তার নিজের আত্মসম্মান এবং দায়িত্ববোধের লড়াই। গল্পে কিসকুর মেয়ের প্রতি তার দুশ্চিন্তা এবং মেয়ের জীবনের ওপর তার সীমিত নিয়ন্ত্রণের বেদনাবোধ তাকে গভীরভাবে মানবিক করে তোলে। কিসকুর জীবনযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং দায়িত্বের প্রকাশ স্পষ্ট।
২. “তারকাঁটায় জীবন” গল্পে ময়েজের করুণ মৃত্যু এবং তার পরিবারের প্রতিক্রিয়া, দারিদ্র্য, সীমান্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার লড়াইয়ের দিকগুলো তুলে ধরে। ময়েজের গরু পালনের স্বপ্ন এবং তার পরিবারকে একটি ভালো ভবিষ্যৎ দেওয়ার চেষ্টা তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ। তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের শোক এবং বেঁচে থাকার সংকট মানবিক জীবনের গভীর কষ্টকে তুলে ধরে।
৩. “ওঙ্কার” গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়নাল একজন পাগল বলে পরিচিত, তবে তার কাজকর্মে যে গভীর মানবিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে, তা সমাজের চোখে অদৃশ্য। জয়নালের ওঁম উচ্চারণ এবং তার কাগজ কুড়ানো বা সাহায্য করার অভ্যাস তার নিজস্বতার প্রতীক। গল্পে রতনের দৃষ্টিকোণ থেকে জয়নালের প্রতি তার সহানুভূতি এবং সমাজের প্রতি প্রশ্ন তোলার চেষ্টা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গভীর একটি চিত্র।
৪. “এক সকালের গল্প” গল্পে একটি সাধারণ সকালের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের অভ্যন্তরীণ সংকট ফুটে উঠেছে। জব্বার মৃধা, গফুর মিয়া, করিম মুহুরি, এবং পরিমল সরকারের মতো চরিত্রগুলো তাদের নিজস্ব ছোট ছোট লড়াই এবং ইচ্ছার মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে। গল্পে একজন রহস্যময় মেয়ের আগমন এবং তার উপস্থিতি হঠাৎ একটি উত্তপ্ত পরিবেশকে শান্ত করে তোলে, যা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত জীবনের দ্বন্দ্বকে একটি নতুন মাত্রা দেয়।
৫. “ছায়ায় ছায়ায় মুখ ঢেকে যায়” গল্পে অন্তরা চরিত্রটি তার দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিজের জন্য সময় বের করার চেষ্টা করে। মধ্যবয়সী একজন নারী হিসেবে তার শরীরচর্চার প্রতি আগ্রহ এবং নিজের জন্য কিছুটা সময় বাঁচিয়ে নেওয়া নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। যখন তার স্বামী রফিক তার জিমে যাওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে, তখনও অন্তরা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তার এই দৃঢ়তা নারীর আত্মনির্ভরশীলতার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
৬. "নগ্ন স্তব্ধতা" গল্পটি এক নারীর জীবনের তীব্র সংগ্রাম, পিতার প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রটি তার বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পূর্ণ, যেখানে পিতার নীতি এবং আদর্শ তার নিজের পরিচয় তৈরির মূল ভিত্তি। বাবার দেওয়া "লাল টিপ" এখানে শুধু তার পিতার স্মৃতির প্রতীক নয়, বরং এটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং তার নিজের আত্মপরিচয়ের একটি সিম্বল। এই গল্পের মূল দ্বন্দ্ব দুটি—একটি ব্যক্তিগত এবং অন্যটি সামাজিক। যাত্রাপথে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবহেলা যখন তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে আঘাত করে, তখন সে তার পিতার আদর্শ এবং স্বাধীনতার প্রতীককে আঁকড়ে ধরে। এটি শুধু তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ নয়, বরং সমাজের প্রতি এক নীরব প্রতিবাদ।
৭. “যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ” গল্পে প্রণব চরিত্রটি তার ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়কে মেনে নিতে লড়াই করে। প্রণবের চরিত্রের মাধ্যমে লেখক ট্রান্সজেন্ডারদের সামাজিক অবহেলা এবং তাদের আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের এক নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন। প্রণবের এই বক্তব্য, “আমি আমার শাড়ি পরব। কারওটা নেব না,” তার আত্মসম্মানবোধ এবং নিজের জীবনের উপর তার নিয়ন্ত্রণকে প্রকাশ করে। যদিও তার লড়াই শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক পরিণতিতে পৌঁছায়, তবুও প্রণব তার ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্যে এক আলাদা জায়গা দখল করে।
৮. “ঋণ” গল্পটি কেবল একটি ব্যক্তিগত আর্থিক লেনদেনের কাহিনি নয়; এটি সময়, সম্পর্ক এবং দায়িত্ববোধের এক গভীর বিশ্লেষণ। সোহাগ এবং রুমির চরিত্র একদিকে নাগরিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে, অন্যদিকে তাদের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব মানবিক আবেগ এবং সময়ের সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে। গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে দায়িত্ব পালন এবং সম্পর্কের প্রতি সচেতনতা কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা সময়মতো হওয়াও অপরিহার্য। মেহনাজ মুস্তারিন এই গল্পের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পাশাপাশি সময় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি চিরন্তন সত্যকে শিল্পিতভাবে তুলে ধরেছেন।
৯. “বিষম” গল্পটি সামাজিক বৈষম্য, আর্থিক সংকট, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গভীর একটি কাহিনি। খদেজা একদিকে একজন প্রান্তিক চরিত্র, অন্যদিকে কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা এবং নিজের জেদ তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। এই গল্প কেবল একটি কিশোরীর স্বপ্নের কথা বলে না; এটি সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষমতার বিরুদ্ধে একটি সাহসী প্রতিবাদ। মেহনাজ মুস্তারিন এই গল্পের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে শিল্পের জন্য আর্থিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপট নয়, বরং মনের গভীরতা এবং আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট।
১০. “ছোটু” গল্পের ছোটু একজন শিশু, যার নিজের কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং আত্মসম্মানবোধ তাকে বিশেষ করে তোলে। ছোটু বলে, “আমি তো কাজ ছাড়া আর কিছুই জানি না। কিন্তু এই কাজে আমার আনন্দ।” তার সরলতা এবং নিজস্বতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা গল্পটিকে গভীর মানবিকতায় পূর্ণ করেছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সীমাবদ্ধতা এবং গল্পের পর্যালোচনা
মেহনাজের গল্পগুলোতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যে প্রকাশ আমরা দেখি, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে কিছু জায়গায় এই স্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ গল্পের গতি শ্লথ করে দেয়। অনেক চরিত্রই তাদের নিজের মনের দ্বন্দ্ব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে গল্পের প্লট সামান্য পিছিয়ে যায়।
তবে, এই স্বাতন্ত্র্যের গভীরতা গল্পগুলোর প্রতি পাঠকের আকর্ষণ বাড়ায়। মেহনাজ তার চরিত্রগুলোর মনোজাগতিক অবস্থাকে এতটাই নিখুঁতভাবে প্রকাশ করেছেন যে পাঠক চরিত্রদের সাথে একাত্ম হয়ে যান। তার গল্পগুলো একদিকে যেমন মানবিক, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক বাস্তবতাকে প্রকাশ করে।
এলিস মনরো ও মেহনাজ মুস্তারিন: মানবিক সম্পর্কের গভীরতায় মিল
মেহনাজের লেখার মধ্যে এলিস মনরোর লেখার প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা এবং বাস্তবতার সঙ্গে ব্যক্তির লড়াইয়ের দিক থেকে। মনরোর মতোই মেহনাজও সমাজের চাপে পিষ্ট হওয়া সাধারণ মানুষের গল্প বলেন। মনরোর গল্পের মতো, মেহনাজের গল্পেও জীবনের ক্ষুদ্র ঘটনাগুলো বৃহৎ অর্থ বহন করে। উদাহরণস্বরূপ, "নগ্ন স্তব্ধতা"র লাল টিপ যেমন গল্পের মূল প্রতীক হয়ে ওঠে, তেমনি মনরোর "The Bear Came Over the Mountain" গল্পে স্মৃতির ক্ষুদ্র ঘটনাগুলো একটি বৃহৎ বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে আসে। দুই লেখিকার মধ্যেই এমন এক সাদৃশ্য আছে, যা ব্যক্তি এবং সমাজের টানাপোড়েনকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
উভয়েই তাদের গল্পে সাধারণ মানুষের জীবনের জটিলতা, মানবিক সম্পর্কের গভীরতা, এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অনুসন্ধানকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। মনরোর ছোটগল্পে যেমন মা-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, এবং পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা যায়, তেমনি মেহনাজের গল্পে পারিবারিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। উদাহরণস্বরূপ, এলিস মনরোর “Runaway”-এ কার্লার চরিত্র নিজের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে, যা মেহনাজের “ছায়ায় ছায়ায় মুখ ঢেকে যায়”-এর অন্তরা চরিত্রের আত্মনির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠার সাথে মিলে যায়। একইভাবে, মনরোর গল্পে প্রান্তিক চরিত্র এবং তাদের জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রাম যেমন উঠে আসে, মেহনাজের গল্পেও তা স্পষ্ট। “ছোটু” গল্পের ছোটু এবং মনরোর কোনো গ্রামীণ চরিত্রের মধ্যে সেই প্রান্তিকতার ছাপ লক্ষ করা যায়। তবে, মনরোর গল্পে যেখানে চরিত্ররা অনেক সময় পরিস্থিতির সাথে আপস করে, মেহনাজের চরিত্ররা বরং সক্রিয়ভাবে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বোধকরি, বাঙালি সংস্কৃতির এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা কিনা এলিস মনরোর চরিত্রগুলোর সঙ্গে পার্থক্য গড়ে দেয়। এ মিল এবং পার্থক্য তাদের গল্পগুলোকে এক ভিন্ন আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করে।
উপসংহার
মেহনাজ মুস্তারিনের গল্পে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ কেবল একটি সাহিত্যিক উপাদান নয়, বরং এটি তার গল্পগুলোর হৃদয়। তার চরিত্রগুলো সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তোলে। নারীর আত্মপরিচয়, ট্রান্সজেন্ডারদের সংগ্রাম, শিশুর সরলতা—সবই তার গল্পে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
মেহনাজের গল্পগুলো শুধু সাহিত্যিক কৃতিত্ব নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলনেরও প্রতিনিধিত্ব করে। তার চরিত্রগুলো পাঠকদের ভাবতে বাধ্য করে—নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজের জন্য দাঁড়ানো, এবং জীবনের কঠিন সময়েও নিজের উপর বিশ্বাস রাখা। এমন গল্পসম্ভার বাংলা সাহিত্যে এক অনবদ্য সংযোজন।
উল্লেখ্য, গল্পগ্রন্থটি যুক্ত প্রকাশনী থেকে ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।