শহীদুল জহিরের গল্প ‘আমাদের বকুল’-এর ওপর কিছু নোট

এই গল্পে শহীদুল জহিরের পয়েন্ট অফ ভিউ'র ব্যবহার অসাধারণ।

মাহীন হকমাহীন হক
Published : 4 Nov 2022, 03:31 PM
Updated : 4 Nov 2022, 03:31 PM

শহীদুল জহিরের ‘আমাদের বকুল’ গল্পটা গ্রন্থিত আছে ‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পগ্রন্থে। যেকোনো গল্পে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে তার চৌকাঠ, তথা প্রথম লাইনগুলো দিয়ে শুরু করাই সবচেয়ে নিরাপদ। আমাদের আলোচ্য গল্পটার প্রথম অনুচ্ছেদ হলো:

"গ্রামের লোকেরা তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় ছিল।
সন্ধ্যার আগ দিয়ে আকালু সুহাসিনীতে ফেরে, সেই সময় গ্রামের যারা হেমন্তের বিস্তীর্ণ মাঠে নুয়ে থাকা ফসলের ওপর দিয়ে তাকায়, তারা তাকে বহুদূরে বৈকুণ্ঠপুরে গ্রাম পার হয়ে খোলা মাঠের কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে।"

এতটুকু পড়ে মনে হতে পারে গল্পটা কারো ফিরে আসার। কিন্তু পাঠক, প্রস্তুত হন, এটা হলো অসংখ্য আসন্ন ভ্রান্তির মধ্যে একটি যা জহির আপনাকে পথে ছড়িয়ে দিতে চাইবেন। গল্পটা আদতে কারো চূড়ান্তভাবে চলে যাওয়ার। এবং এই অব্দি পড়ে আমরা যা জানতে পারলাম তা হলো আকালু নামে কেউ দিগন্ত থেকে ফিরে আসছে। এই ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামবাসীদের চোখ থেকে। সিনেমায় এই দৃশ্য অনেকটা একটা ওয়াইড শটের মত হতে পারতো। এবং গ্রামবাসীদের, তথা আমাদের চোখে আকালুকে দেখায় 'একটি বিচ্ছিন্ন বিষণ্ণ ধলা বকের মত'। তার কারণ, আমরা জানি, বকেরা থাকে জোড়ায় জোড়ায়। ফলে আমরা বুঝলাম, আকালু যে-ই হোক, সে তার জোড়ার অপরাংশকে হারিয়েছে। জহিরের গল্পের সাথে এইসব ক্যামেরা-টেকনিকের যোগসাজশ হয়তো আরোপিত না। তাকে এক সাক্ষাৎকারে যখন আহমদ মোস্তফা কামাল জিজ্ঞেস করেন যে তিনি গল্পে এত "হয়তো, সম্ভবত, অথবা" ইত্যাদি অনিশ্চয়তা জাগানোর মত শব্দ ব্যবহার করেন কেন, তিনি উত্তরে জানান, "এইসব অপশন দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যাপারটা একটু ঘোলাটে রাখা। জিনিসটাকে যদি আপনি ছবি মনে করেন, তাহলে বলব, ছবির আউটলাইনটাকে একদম ক্লিয়ার না করা।, ফটোগ্রাফিক না করা, একটু ফাজি রাখা। অর্থাৎ ছবিটাকে আমি একটু ঝাপসা রাখতে চাই।"


এই গল্পে শহীদুল জহিরের পয়েন্ট অফ ভিউ'র ব্যবহার অসাধারণ। ফাতেমা হারিয়ে যাওয়ার পর প্রথমে আকালু ও তার দুই সন্তান বকুল ও আমির হোসেন মিলে একসাথে তাকে খোঁজে। অর্থাৎ আমরাও ফাতেমার সন্ধান করছি এই তিনজনের ঐক্যবদ্ধ নজরে। এই সন্ধানের একটা এক পাতার বিবরণী আমরা পাই, যা আপাত অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু এই বিবরণীর আসল উদ্দেশ্য হলো ফাতেমার চলে যাওয়াতে এই তিনজনের দুনিয়ার যাকিছু এলোমেলো হয়ে আছে তার বিস্তারিত ফিরিস্তি। ফাতেমা গেছে, ফেলে গেছে খালি কলসি, গরুর চাড়িতে জাবনা দিয়ে যায়নি, শুকনা পাতা ঝাঁট দিয়ে যায়নি। জহির সময় নিয়ে, একঘেয়েভাবে বর্ণনা করতে থাকে এই প্রত্যেকটি স্থানের বিস্রস্ত অবস্থা। সুতরাং, আমরা বুঝতে পারি, যে গেছে সে এক গৃহবধূ। তার চলে যাওয়া পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয় না। তার চলে যাওয়াতে অনেককিছু এলোমেলো হয়ে যায়।
এরপরে আকালু বকুলকে বলে রৌহার বিলে তার মা'কে খুঁজে দেখতে। বকুল তাকিয়ে দেখে, "বিলে কোনো মানুষ নাই, ফাতেমাও না।" এই দুই কথা আলাদা করে বলার মানে কী? ফাতেমা কি মানুষ না তবে? প্রথমবারে এটাকে জহিরের স্বভাবজাত চমক-দেয়া ধোঁয়াশা বাক্যই মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের অজান্তেই, ইতিমধ্যে ফাতেমাকে তার মানবসত্তা হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। বাকিটুকু আমাদের কাছে পরে প্রকাশ করা হবে। তাছাড়া এই দৃশ্য আমরা পাই বকুলের দৃষ্টিতে, সেটারও আলাদা তাৎপর্য আছে।

আবার যখন আকালু একা ফাতেমাকে খুঁজতে যায় গ্রামে, আকালুকে তার দুই সন্তান হতে আলাদা করে ফেলা হয়। অর্থাৎ এবার আমাদের পয়েন্ট অফ ভিউ বিশেষভাবে আকালুতে নিবদ্ধ। আকালুকে এইভাবে আলাদা করা প্রয়োজন ছিল। তার কারণ ফাতেমার একটি স্মৃতি এখন আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে যা কেবলমাত্র আকালুর নজর দিয়ে দেখার মাধ্যমেই আমরা পেতে পারতাম, তার সন্তানদের মাধ্যমে না। গ্রামে খোঁজার সময় আকালুর মনে হয়, হয়তো ফাতেমা কোনো মিয়াবাড়িতে তার "প্রবল নিতম্ব দুলিয়ে ধান ভানে অথবা চিড়া কোটে।" এই নিতম্বের কথা হঠাৎ আকালুর কেন মনে হলো? সে কি তার স্ত্রী'র নিতম্বের প্রতি বিশেষভাবে যৌনকাতর? নাকি, মিয়াবাড়িতে তথা পরপুরুষের সামনে তার স্ত্রী নিজের নিতম্ব নাড়ায় সেই হেতু তার চাপা ক্ষোভই প্রকাশ পায় তাতে? গল্পে আরেকটু আগালেই আমরা বুঝতে পারবো, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটাই সত্য।

গোটা গল্পে ফাতেমার হারিয়ে যাওয়াতে আকালুর তেমন কোনো জোরদার আবেগ দেখানো হয় না। সে বিষণ্ণ হয়, পেরেশানও হয়, কিন্তু তা তো কারো চশমা খোয়া গেলেও লোকে হয়। বরং উল্টো ফাতেমাকে খুঁজতে তার তিন দিন নষ্ট হওয়া নিয়ে তাকে বিরক্ত হতেই দেখা যায় বেশি। প্রথম কোনো প্রকট অভিব্যক্তি আমরা দেখতে পাই যখন তার মাঠের বন্ধুদের খোচাখুচির এক পর্যায়ে আকালু কেঁদে দেয়। সেই কান্নার বর্ণনা দেয় জহির এইভাবে, "তখন আকালু কাঁদে, হেমন্তের নরম রোদের স্পর্শ এবং পাকা ধান গাছের সোঁদা গন্ধের ভেতর বসে সুহাসিনী গ্রামের ভূমিহীন দিনমজুর আকালু শেখ চোখের পানি ফেলে।" প্রথমে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত তিনটি শব্দের জানান দেয়া হয় যে আকালু কাঁদে। তারপর তার এই চোখের পানির বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। যেন কোনো ক্যামেরা একটানে জুম আউট করে নেয়া হলো। দ্বিতীয় বাক্যে আর তার কান্না নিছক সাংবাদিকতা থাকে না, আমরা দেখতে পাই হেমন্তের নরম রোদের মধ্যে পাকা ধানগাছের সোঁদা গন্ধের মধ্যে একজন স্ত্রীহীন, জমিহীন, দরিদ্র দিনমজুর কাঁদছে। তার কিছুই নাই। এরকম তিনটি শব্দের একটি ছোট বাক্যে পরবর্তী একটি দীর্ঘ বাক্যের পাটাতন তৈরি করা সাহিত্যের খুব চিরায়ত এক টেকনিক। মনে পড়ে যায় তলস্তয়ের কসাকের প্রথম লাইন, "Moscow lies silent. From time to time screeching wheels echo in the wintry streets."

গল্পটা একইসাথে ভীষণ মেইল-গেজ শাসিত। গোটা গ্রামে ফাতেমা বাদে একজনও পরিণত নারীর উল্লেখ নাই। যতবারই "গ্রামবাসী" কোনো কথা বলে, তা বলা হয় পুরুষ টোনে। অসংখ্য যৌনকাতর পুরুষের লোলুপ নজরে কোণঠাসা হয়ে আছে গ্রামের একমাত্র মহিলা—ফাতেমা। আকালু বিয়ের পর ফাতেমাকে ও যৌতুক হিসেবে পাওয়া গরুটাকে নিয়ে প্রথম গ্রামে প্রবেশ করার পর যখন তাদের সাথে গ্রামবাসীর পরিচয় হয় তখন তাদের দেখার নজর থাকে এইরূপ: "সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার পর থেকে তার ভরাট স্তন, বিস্তৃত নিতম্ব এবং মোটা পায়ের গোছা প্রকাশিত হয়; গ্রামের লোকেরা চলতে ফিরতে দেখে, তারা বলে, ক্যারে আকালু, এমন বৌ বিয়্যা কইরলি, এমন ধামার নাহাল তর বৌয়ের শরীল!"
এইখানে এসে বোঝা যায় শুরুতে কেন আকালু এই ভেবে ক্ষুদ্ধ হয় যে তার বৌ হয়তো কোনো মিয়াবাড়িতে তার "বিশাল নিতম্ব" দুলিয়ে ধান ভানে। কারণ সে জানে গ্রামবাসী তার স্ত্রী'কে এই নজরেই দেখে। ফলে হয়তো সে ইন্সিকিউরিটিতে ভোগে।
তারা আরো বলে, "বিয়া কইর‌্যা এমন একখান বৌ আনলি, বিয়া কইর‌্যা এমন একখান গরু আনলি; দুইট্যাই একরকম...তর গাইয়ের দিকে তাকাইলে শালার কাপড় খারাপ হয়া যায়!" এর আগেই প্রচ্ছন্নভাবে ফাতেমার থেকে তার মানবসত্তা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে, এবার ঠাট্টার ছলে তার সাথে একটা গরুর সংযোগস্থাপনও সম্পন্ন হয়ে যায়। এই সংযোগ আরো দৃঢ় হয় যখন গ্রামবাসী হঠাৎ লক্ষ করে যে, এক বছর হয়ে যাবার পরেও ফাতেমা কিংবা গরু কারো পেটেই বাচ্চা হচ্ছে না। এবং যখন হয়, তখন গরু ও ফাতেমা দু'জনেই একইসাথে দু'টি করে যমজ সন্তান প্রসব করে। এবং গরুটা হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরেই ফাতেমা নিখোঁজ হন। আমরা বুঝতে পারলাম, এই গ্রামে, কিংবা আকালুর পরিবারে মহিলা হিসেবে ফাতেমার অবস্থান একটা গবাদিপশুর মতই।

এরপরে জহির যতক্ষণে আমাদের নজর আকালু ও ফাতেমার কন্যা বকুলের দিকে ফেরান ততক্ষণে হয়তো আমরা ভুলেও বসেছিলাম যে গল্পটার নাম 'আমাদের বকুল'। মাতৃহীন বকুলের জন্য মায়া লাগে মসজিদের ইমাম মোহসিল আলির। সে বকুলদের বাড়ির পিছনে একটা কলাগাছ লাগিয়ে বকুলকে প্রবোধ দেয় যে এই গাছে কোনোদিন পানি ঢালা হবে না, তারপরও যদি গাছটা বেঁচে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ফাতেমা বেঁচে আছে, আর যদি মরে যায় তাহলে...। কিন্তু গাছটা মরে না, বরং ফাতেমার মতই শুশ্রূষাহীন, আদরহীনভাবে পড়ে থাকলেও বেঁচে থাকে। এবং এমন সবল ও লম্বা হয়ে বেড়ে ওঠে যে গ্রামের লোকদের এই গাছের গুড়ি দেখে আবার ফাতেমার সুঠাম শরীরের কথা মনে পড়ে। পুনরায় ফাতেমাকে গুলিয়ে ফেলা হয় অপর এক প্রাণের সাথে। কিন্তু যেহেতু এখন ফাতেমা জীবিত নাকি মৃত আমরা নিশ্চিত না, ফলে এবার তাকে চিহ্নিত করা হয় একটা গাছের মাধ্যমে, যে জীব ও জড়ের মধ্যখানে অবস্থান করে।

গল্পের শেষখানটাতে জহিরের জাদুবাস্তবতা, এবসার্ডিটির ব্যবহার সব এসে ঘনিভূত হয়। আকালু আবার বিয়ে করে, গ্রামের লোকজন ফাতেমার কথা ভুলে যায়। শুধু বকুল একলা একলা কলাগাছটাকে মা ভেবে ভেবে একসময় বড় হয়ে যায়। গ্রামের লোকেদের বকুলের শরীরের স্ফীত অঙ্গ দেখে আবার বহুদিন পর ফাতেমাকে মনে পড়ে। বকুলের পরিণত হওয়ার বর্ণনা জহির দিচ্ছেন এইভাবে, "তার করতলের ভেতর তার নিজের কালো দেহের বিস্ময় ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়।" আর এরপর যখন তার পেটে অসহ্য ব্যথা ওঠে, "যেন তার পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে", তখন এক বিহ্বলতার ভেতর বকুল দৌড়ে এক কলাগাছের গোড়া জড়িয়ে ধরে মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতে মাটির ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকে। গল্পের শেষ লাইনগুলো হলো, "তখন বিচিকলা ঝোপের ভেতর লাল পিঁপড়া প্রতীক্ষায় ছিল, তারা তাদের ঢিপি ছেড়ে উঠে আসে... সুহাসিনীর লাল পিঁপড়া বকুলকে খেয়ে যায়।"

লাল পিঁপড়া খেয়ে যাওয়ার মাধ্যমে একটা গল্পের সমাপ্তির নজির এটাই প্রথম না। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছরও শেষ হয় এই একই ইমেজ দিয়ে। বুয়েন্দিয়া বংশের সর্বশেষ সন্তানকে পিঁপড়ারা খেয়ে তুলে নিয়ে যায় তাদের ঢিবির দিকে। আর শহীদুল জহিরের মার্কেজপ্রীতি সম্ভবত এখন সর্বজনবিদিত। নিঃসঙ্গতার একশ বছর হলো একটা পৌনঃপুনিকতার গল্প, যেখানে প্রতিটা চরিত্র বারবার বারবার নিজের পূর্বপুরুষের নিয়তির পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়। সেই গ্রন্থের একদম শেষ সন্তানকে যখন পিঁপড়ারা খেয়ে যায় তখন তারা এই নিয়তির শেকল ভেঙে দেয়, বুয়েন্দিয়া পরিবারের আর কোনো সন্তানকে নিজের পিতাদের নিয়তি ফের পুনরাবৃত্তি করতে হবে না, যদিও সেই মুক্তির বিনিময়মূল্য ছিল মৃত্যু। সেই পিঁপড়াদেরই শহীদুল জহির আমদানি করলেন তার এই গল্পে। বকুল যখন পরিণত নারী হতে শুরু করলো, যখন তার উপরও গ্রামবাসীর সেই একই পুরুষনজর পতিত হতে লাগলো, তখন আরো স্পষ্ট হতে লাগলো যে নারী হিসেবে তারও নিয়তি হয়তো হবে তার মায়েরই মত। এবং যখন তার নারীত্বের ষোলকলা পূর্ণ হলো, সে দৌড়ে গেল তার কলাগাছরূপী মায়ের কাছে। তার মা তাকে উদ্ধার করলো নিজের কোটরে থাকা পৌরাণিক লাল পিঁপড়াদের মাধ্যমে, সেই একই দাম দিয়ে।