আগে মানুষ মনে করতো ষাট হওয়া মানে বুড়ো হয়ে যাওয়া। সেসব এখন অনেকটাই বদলে গেছে।
Published : 20 Jun 2024, 08:58 PM
ইয়োন ফসে-র সাথে একটি কথোপকথন (অক্টোবর ১০, ২০১৯)
নরওয়েজিয় ভাষায় কথোপকথন: সিসিল সাইয়েন্স
ইংরেজি ভাষান্তর: সিরি হাকভিস্ত
বাংলা ভাষান্তর: আবদুস সেলিম
আমার "সেপ্টোলজি" উপন্যাস লেখা শেষ করার আগে আমি বেশ মৃত্যুভয়ে ভুগতাম। আমার একটা কিছু বলা ভীষণ জরুরি ছিলো, আমার মনে হতো এটা বলাটা আমার একটা কর্তব্য।--ইয়োন ফসে।
সিসিল সাইয়েন্স: সময় থেমে থাকে না। আপনি কয়েকদিনের ভেতরই ষাটে পা দিতে চলেছেন।
ইয়োন ফসে:[চাপা হেসে] হ্যাঁ, আরও অনেক কিছুই এর ভেতর জীবনে ঘটে গেছে।
সিসিল:কিন্তু আপনি ষাট বছরটা খুব একটা পছন্দ করছেন না বলে মনে হচ্ছে?
ইয়োন: জানি না। আগে মানুষ মনে করতো ষাট হওয়া মানে বুড়ো হয়ে যাওয়া। সেসব এখন অনেকটাই বদলে গেছে। আগে সত্তরকে আজকের আশির চোখে দেখা হতো, আর এখন ষাট বছরের মানুষকে বুড়ো হয়েছে বলে মনেই করা হয় না। সত্যি বলতে কি আমি বুড়ো হওয়াটাকে মোটেও খারাপ মনে করি না, কিন্তু আমার কিছু ভালো বন্ধু আছে যারা বেশ জটিল কিছু স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগেছে, আর সেসব দেখে আমার দারুণ খারাপ লাগে। প্রশান্ত লম্বা জীবন কাটাতে অবশ্যই ভালো লাগে, অনেক কাজ করা যায়। আমি এখন যেমন ভালো আছি এমনটা বোধ হয় এর আগে কখোনই ছিলাম না।
সিসিল: ষাট বছর বয়সে আপনি ছয় সন্তানের বাবা--সব চাইতে ছোটটা একেবারেই শিশু।
ইয়োন:হ্যাঁ, আমার জীবনে এটিই শ্রেষ্ঠ ঘটনা--এর চাইতে ভালো কিছু হতে পারতো না। আমি আবিষ্কার করেছি এই বয়সে সন্তানের জন্ম দেয়ার অভিজ্ঞতা অল্প বয়সের চাইতে ভিন্নতর। তবে এটাও ঠিক অল্পবয়সি বাবা থাকাটা অবশ্যই অনেক বেশি সুবিধা জনক। আমার প্রয়াত বন্ধু লার্জ রোর ল্যাংস্লেট-এর বাবা ছিল বৃদ্ধ। আমি যখন নিজেকে বৃদ্ধ বাবা ভেবে চিন্তিত হতাম আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য প্রায়ই বলতো, “আমিও তো বেশ একটা সচল মানুষ হিসেবেই বড় হতে পেরেছি, পারি নি?” তবে হ্যাঁ, আমার চাইতেও বয়স্ক বাবাও আছে। আমি এক সুইডিও অভিনেতার কাছে দুঃখ করলে ও বলেছিলো: ও-ও নাকি পচাত্তর বছরে বাবা হয়েছে—সে তুলনায় আমার এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছুই নেই।
সিসিল:তাহলে তো আগামী পনেরো বছরে আরও কয়েকটা বাচ্চা আশা করতে পারি আমরা?
ইয়োন: [হেসে] নিজে বাঁচি অন্যকেও বাঁচতে দিই। যা হবার তা তো হবেই।
সিসিল:বয়স বাড়া মানে, তা আমরা যে ভাবেই দেখি না কেনো, আসলে তো মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাওয়া।
ইয়োন: আমি কখনই মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হই নি। কিছু মানুষ অবশ্য চিন্তা করে কিন্তু সবাই করে না।
সিসিল:আপনি কি নিশ্চিন্তে মৃত্যুর কথা ভাবেন?
ইয়োন: হ্যাঁ, কিন্তু আবার এই বাবা হওয়ার বিষয়টাও যেকোনো মৃত্যুচিন্তাকে জটিল করে দেয় বটে। এটাই বেশি বয়সে বাবা হবার সমস্যা। কিন্তু আমার বিশ্বাস জীবন যেমন চলে তেমনটাই চলতে দেয়া উচিৎ। সন্তান-সন্ততি হোক, আমি বেঁচে থাকি, তারাও বেঁচে থাকুক, আমি মৃত্যু নিয়ে দুশচিন্তা না করি। জীবনে অনেক কষ্ট আছে। আর আমার ভেতরে অনেক দুঃখও আছে। যেমন ইবসেন বলেছেন: “আমি দুঃখকে উপহার হিসাবে পেয়েছি, আর তারপরই আমি কবি হতে পেরেছি।" বেদনা, দুঃখ, বিষাদ, এবং বিষণ্ণতা, এসবই আসলে জীবনের অঞ্জলি। এই উপাদানগুলোকে আমরা একটা ভালো কিছু সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে পারি।
(ইয়োন ফসে-র জীবনকাহিনী বড়ই অস্বাভাবিক, বিশেষ করে তাঁর নাট্যচর্চা। তিনি এই পেশাতে এসেছেন বলতে গেলে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তরুণ ফসে-এর কাছে নাটক ছিলো নান্দনিক বিষয়ের চাইতে শুধুমাত্র একধরণের মমত্ববোধ, ভালো-লাগা, এবং নাটক লেখাতে প্রবেশ করার তেমন কোনও ইচ্ছা তাঁর ছিলো না। বিখ্যাত নির্দেশক কাই জনসন অনেকবার তাঁকে দিয়ে নাটক লেখাবার চেষ্টা করেছেন। কাই ফসে-র উপন্যাসগুলো পড়েছিলোন এবং ফসে-র ভেতর নাটক রচনার সুপ্তশক্তির খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু ফসে নির্মম ভাবে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর লেখা প্রথম প্রকাশের দশ বছর পর ১৯৯৩ সালে ফসে-এ নাটক লেখা শুরু করেন। কেনো এই রাজী হওয়া? ফসে দারুণ অর্থাভাবে পড়েছিলেন—প্রায় কপর্দকশূন্য। ফলে তার প্রথম সংলাপ বা নাটক রচনা "সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম" এর মাধ্যমে। এভাবেই তাঁর নাটকের জগতে প্রবেশ, এবং ফসে বলেন, “এটিই আমার জীবনের সবচাইতে বড় বিস্ময়কর দৈবপ্রকাশ।" এরপর তাঁর নাটক লেখার ঘোড়দৌড়ের শুরু। পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি অবিশ্বাস্য গতিতে নাটক রচনা করে যান একটার পর একটা--এমন কি কোনো-কোনো গ্রীষ্মে দুটি করেও নাটক লিখেছেন। এর পর এক অবষাদ। তিনি ঘোষণা করেন তার নাটক রচনার যবনিকা হতে যাচ্ছে। নাটক রচনা তার জীবনকে বদলে দিয়েছে সেটা যেমন ঠিক—তিনি এক অতি স্বচ্ছল জীবনের স্বাদ পেয়েছেন--তেমনি নাটকের মঞ্চ তাঁকে কিন্তু তেমন স্বাছন্দ্য দিতে পারে নি যা তিনি সারা জীবন চেয়েছেন। ফসে সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজেকে নাটকের জগত থেকে সরিয়ে নেবেন। তিরিশটি পূর্ণদৈর্ঘ, আটটি স্বল্পদৈর্ঘ নাটকই তাঁর জীবনের সকল ফসল ও প্রাপ্তি।)
ইয়োন:“আই অ্যাম দ্য উইন্ড" নাটকটি লেখার পর থেকেই আমি গদ্য রচনাতে চলে যাই। আমি "স্লিপলেস" লিখি, তারপর শুরু করি "ট্রিলজি" লিখতে। এখান থেকেই আমার গদ্য রচনাতে উত্তরণ। যদিও “আই অ্যাম দ্য উইন্ড" রচনা শেষ করার পরও আমাকে "দিজ আইজ" নাটকটা লিখতে হয়েছিলো, সেটা আসলে লিখেছিলাম তীব্রভাবে অনুরুদ্ধ হয়ে। তাছাড়া আমি কথাও দিয়ে ফেলেছিলাম। তবে নাটকটা লিখতে ভীষণ এক দোলাচলের ভেতর সময় কাটাতে হয়েছে আমাকে।
সিসিল:তাহলে বলা যায় আপনার নাট্যকার জীবনের এখানেই ইতি?
ইয়োন: হ্যাঁ, আমি নাটকের কাজ আর করতে চাইছিলাম না। এই সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই নেয়া উচিৎ ছিলো। অনেক দিন ধরে নাটক লেখার কাজ করলে নাটক লেখাটা বেশ রপ্ত হয়ে যায় সেটা ঠিক। কিন্তু আমার একটা নাটক আর একটা নাটকের সাথে ভীষণ মিল হয়ে যাচ্ছে। সেটা কি ভালো! একজন স্বাতন্ত্র্য গল্প লেখক হিসাবে যেটা হওয়া উচিৎ সেটা হলো একটি সৃজনশীল লেখনি থেকে নতুন অন্য আরও লেখা ক্রমাগত নিঃসৃত হওয়া। যেমন দেখুন গেয়র্গ ট্রাকল। আমি সম্প্রতি তার কিছু কবিতা নরওয়েজিও ভাষাতে অনুবাদ করেছি। আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হলো, আমার একই নাটকের অনেক অংশ অন্য অনেক নাটকের নতুন অঙ্ক বলে মনে হবে আপনার। যেমন: “দ্য নেইম" নাটকের প্রথম অঙ্ক, “নাইটসংস"-এর দ্বিতীয় অঙ্ক, কিম্বা "উইন্টার"-এর প্রথম অঙ্ক, আর "সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম"-এর দ্বিতীয় অঙ্ক।
(সবারই জানা যে একসময় ফসে মাত্রারিক্ত মদ্য পান করতেন। কিন্তু লেখার সময় তিনি কখনই মদ ছুঁতেন না--লেখা তার কাছে একটি সংযমী ক্রিয়াকাণ্ড ছিলো। বহু বছর ধরে ফসে মদ্যপানকে তার দুশ্চিন্তার নির্বাণ বলে মনে করতেন। মদ্যপান তাঁকে তাঁর জীবনের সকল কর্মকাণ্ডকে স্পর্শ করেছিলো, তাঁর লেখাকে স্পর্শ করতে পারে নি। কিন্তু এক সময় এই মদ্যপান তাঁকেও সম্পূর্ণ পান করে ফেললো। তাঁর মতে, যদিও তিনি কখনো মদান্বিত হন নি, কিন্তু স্বাভাবিক হতে মদ পান করতে বাধ্য হতেন। একবার ২০১২ সালের বসন্ত কালে তিনি কয়েক মাস একাধারে সারা দিনরাত মদ পান করে দৈহিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। সে সময়ে একটি ইমেইলে তিনি লিখেছিলেন: আমি আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি মদ পান করা ছেড়ে দেবো [যদিও একথা ঠিক মদের একাধারে অনেক ভাল এবং মন্দ গুণও আছে], তাই সম্ভবত খুব শীগগিরই আমাদের কাফস্তভা-তে দেখা হবে [অসলো-র একটি ক্যাফে]। আমি প্রচণ্ড প্রলাপ এবং মদাসক্তি অসুস্থতায় ভুগছি। আমি পড়ে জেনেছি চিকিৎসা না নিলে শুধু তিরিশ শতাংশ মানুষই এই রোগে মারা যায় না, চিকিৎসা নিয়েও আরও তিরিশ শতাংশের মৃত্যু হয়।)
সিসিল:২০১২ সাল আপনার জীবনের একটি সন্ধিক্ষণ। ঐ বছর মার্চ মাসে আপনি মদ ছেড়ে দেন এবং গ্রীষ্মে ক্যাথলিক বিশ্বাসে দীক্ষা নেন।
ইয়োন: হ্যাঁ, সেটা একটা পরিবর্তন ছিল আমার জীবনে। আমি নিজে হাতে আমার জীবন-জাহাজের হাল ধরে নতুন যাত্রা শুরু করি।
(ফসে বারে যাওয়া ছেড়ে দেন। তার নিজের নাটক মঞ্চায়ন দেখা প্রায় বন্ধ করে দেন। পাঠানুষ্ঠানে যাওয়া এবং মঞ্চে ওঠা বর্জন করেন। তিনি সামাজিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ অব্যহতি নেন। গত সাত বছরে তিনি আর মদ স্পর্শ করেন নি।)
ইয়োন:অনেকে ভাবতে পারেন আমার মদান্ধতার ধরণটা আসলে কেমন ছিলো। আমি মাত্রাতিরিক্ত মদ পান করতাম, কিন্তু মদ ছেড়ে দেয়াটা আমার পক্ষে মোটেও কষ্টকর হয় নি। আমি এখন আর বারে যাই না--আমি ক্যাফেতে যাই। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমি পাঁচ বছর সংযমী জীবন যাপন করবো, তারপর হয়তো মাঝেমধ্যে দু'এক গ্লাস পান করবো। কিন্তু পরে আর সেটা করতে ইচ্ছে করে নি। তবে মোদ্দা কথা হলো, এখনও আমি ভাবি কোনও না কোনও সময়ে মাঝে মধ্যে দু'এক গ্লাস পান হয় তো করবো। অনেকেই গলা পর্যন্ত পান করেও স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে, আমিও সেই সময়টা পার করে এসেছি। প্যাগ ওলও এনকোয়েস্ট বলে, যে প্রতিদিন এক বোতল মদ পান করে সে আসলে মদ্যপ। আমি অবশ্য মনে করি প্রতি সন্ধ্যায় এক বোতল ওয়াইন পান করা মোটেও মাত্রাতিরিক্ত নয়। তবে তার সাথে এক বোতল মদ যেনো কোনক্রমেই যোগ না হয়! অনেকের জন্যেই মদ অতি উপভোগ্য পানীয়, যদিও আমি নিজে আর মদ পান করি না। একথা জোর দিয়ে বলতে পারি আমার জন্যে পার্টির দিন শেষ। সেসব দিন গত হয়েছে।
সিসিল:ঐ সময়ে, মানে ২০১২ সালে, অন্য একটা ঘটনাও ঘটেছিলো, তাই না?
ইয়োন: হ্যাঁ, একটা না, বেশ কয়েকটা বলা যায়। আমার সাথে আনা-র দেখা হলো। আমরা বিয়ে করলাম। আমাদের প্রথম মেয়ে এয়ারলি-র জন্ম হলো। এবং তারপর আমাকে গ্রতন-এ (গ্রতনে নরওয়ে সরকারের তরফ থেকে সম্মান প্রদর্শন করে বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের থাকার স্থান বরাদ্দ করা হয়) থাকার সরকারি অনুমোদন দেয়া হলো। এক সময় বছরের শুধু অর্ধেকটা আমরা ওখানে থাকতাম, গত বছর পুরোটাই ছিলাম। এবার শরত থেকে স্থায়ী ভাবেই থাকবো বলে ভাবছি।
(ফসে-র আদি বাস নরওয়ের পশ্চিমে। ২০১১ সালে দেশের বরেণ্য লেখক হিসাবে তাঁকে গ্রতন রাজপ্রাসাদে বসবাস করার সম্মান দেয়া হয়। অসলো-র শহর কেন্দ্রে এই প্রাসাদটিতে লেখক-শিল্পীদের বরাদ্দ দেয়াটা তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন রূপে প্রচলিত। কিন্তু ফসে পশ্চিম নরওয়ে থেকে--যেখানে পাহাড়, স্রোতস্বিনী এবং অবিরাম বৃষ্টিপাতের সাথে তাঁর বেড়ে উঠা--অসলোতে আসার জন্য তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বেশ কিছুদিন দ্বিধাতে ছিলেন এবং পরে সরেজমমিনে গ্রতন-এ যেয়ে প্রাসাদটি দেখে আসেন। অনেক ভেবে চিন্তে শেষ পর্যন্ত তিনি গ্রতন-এ যাবার সিদ্ধান্ত নেন এই ভেবে যে নরওয়ের ভাষিক পার্থক্যটি--কারণ তাঁর অঞ্চলে যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয় তা সাহিত্যের লিখিত ভাষা হিসাবে তেমন স্বীকৃত ছিলো না--তার আয়ত্ত্ব করা জরুরি।)
ইয়োন: হ্যাঁ, বলতেই হবে গত দশ বছর বেশ ঘটনাবহুল ছিলো। এতো কিছু ঘটেছে যে আমার লেখালেখিতে একটা বিরতি নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। বাস্তব জীবনে সবার মতোই আমার অনেক অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়, লেখার সময়েও তার কোনও ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু জীবনের অভিজ্ঞতার চাইতে লেখার সময়ের অভিজ্ঞতাগুলো আসলে এক গভীরতর অভিঘাতের সৃষ্টি করে। লেখা মূলত জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখার মতো। নিজেকে এক নিয়ন্ত্রিত স্বাপ্নিক আবহে অবস্থান করা, আর তখন এক অলৌকিক কণ্ঠস্বর লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমি তাই যখন মানসিকভাবে নাজুক পরিস্থিতিতে থাকি তখন লেখালেখি করা থেকে বিরত থাকতে চাই। যেমন আমি বর্তমানে মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছি, আমার ধর্ম-বিশ্বাস পরিবর্তন করেছি। আমার প্রথম কাজ হলো বাস্তবতায় ফিরে আসা।
সিসিল: আপনি কি তখন লেখালেখিকে ভয় পেতেন?
ইয়োন: না, তা ঠিক নয়। কিন্তু তেমন ভাবে উপভোগ করতাম না। নিজেকে এগিয়ে নিতে পারতাম না। আর লেখালেখি তো অজানাকেই আবিষ্কার করা। তখন এতটাই অনিশ্চয়তা বিরাজ করতো!
(ফসে মনে করতেন নাটকে তাঁর যা কিছু লেখার ছিলো তা তিনি সবটাই লিখে ফেলেছেন আর তাই তাঁর গদ্যে ফেরা উচিৎ। লেখক হিসাবে গদ্যকেই তিনি তাঁর শেকড় বলে মনে করতেন। ফলে "স্লিপলেস", "ওলাভ'স ড্রিমস", এবং "ওয়ারিনেস" নিয়ে তাঁর তিনটি প্রেমের গল্পের নভেলা একটি "ট্রিলজি"-তে পরিণত হয়ে যায়, এবং এই গদ্য রচনাই তাঁর জন্য বয়ে আনে ২০১৫ সালের নর্ডিক কাউন্সিল লিটেরেচার প্রাইজ। ফসে তার নাম মনোনীত হওয়ায় ভীষণ খুশিই হয়েছিলেন, কিন্তু যেহেতু তিনি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে স্বছন্দ অনুভব করতেন না, রেকজাভিকে পুরস্কার নেবার অনুষ্ঠানে যাবার তেমন ইচ্ছা তাঁর ছিলো না। কিন্তু উদ্যোক্তারা শেষ পর্যন্ত তাকে অনুষ্ঠানে যোগ দেবার ব্যপারে রাজী করাতে পেরেছিলেন। ফসে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে অনুষ্ঠানে যাবার জন্য এতো পীড়াপিড়ি করার কারণ আসলে তাঁকে পুরস্কার দেয়া, এবং তিনি একেবারে সময় মতোই অনুষ্ঠানস্থল হার্পা কন্সার্ট হলে পৌঁছে যান। কিন্তু তাঁর সব আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতাবোধ উবে যায় যখন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী অ্যানা সোলবেগ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে যে দায়িত্বহীন মন্তব্য করেন তার সাথে ফসে একমত হতে পারেন নি, ফলে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে তাঁর হোটেলে ফিরে যান, এবং তারপর ঐ অনুষ্ঠানের নৈশ পার্টিতে আর ফিরে আসেন নি। তবে তিনি স্বীকার করেন পুরস্কারটি তাঁকে অনেক মানসিক প্রশান্তি দিয়েছে।
নর্ডিক কাউন্সিল লিটেরারি প্রাইজ তাঁর উপর এক ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, এবং তাঁর পুরষ্কার গ্রহন বক্তব্যে তিনি বলেন যে এই পুরস্কার তাঁর জীবনে এক শুভ মুহূর্তে এসেছে কারণ তিনি আগামী বছরগুলোতে শুধু গদ্য রচনাতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেশ কয়েক বছর ফসে লেখালেখি নিয়ে উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন কিন্তু ২০১৫-র গ্রীষ্মকালে তিনি আবার লেখালেখি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময় তাঁর এক আত্মীয় তাকে ফ্রান্স-এ একটি শ্যাটো দু ব্রাঙ্গুস-এ আমন্ত্রণ জানান। তিনি তাঁর গদ্য লেখা শুরু করার জন্য এই আমন্ত্রণকে স্বাগত জানান।)
ইয়োন: আমরা যখন ওখানে ছিলাম তখন একটা তাপপ্রবাহ চলছিলো। বাইরে এতো গরম ছিলো যে মনে হচ্ছিলো আমরা গরমের দেয়ালের সাথে গা লাগিয়ে রয়েছি।
সিসিল: গরম আপনার পছন্দ নয় নিশ্চয়?
ইয়োন: না, একেবারেই না। গরমের সাথে আমার সম্পর্কটা মোটেও ভাল না। সবাই একেবারে কাহিল হয়ে পড়ছিলো, আমিও মোটেও ভালো ছিলাম না। কপাল ভালো আমাদের একটা কামরা ছিলো ঐ ক্যাসলের একটু ঠাণ্ডার দিকে। সন্ধ্যার শুরুর দিকে আমি বাইরে যেতাম। দিনের বেলা "সেপ্টোলজি"-র শুরুটা লেখা নিয়ে বসতাম। পেটের উপর ল্যাপটপ নিয়ে লিখতাম—ভালই লাগতো। লিখতে বসলে একটা কিছু ঠিকই মনে এসে যেতো। আমার কখখোনই "রাইটার্স ব্লক" (লেখক প্রতিবন্ধকতা) বলে কিছু হয় নি।
(ফসে ঠিক সেভাবে ভেবেচিন্তে এই উপন্যাস লেখাতে হাত দেন নি, কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই লেখা শুরু করে দিয়েছিলেন। তারপর লেখাটা সাত খণ্ডে শেষ হলে নাম দিলেন "সেপ্টোলজি"। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে নিজেই গল্পটা বলছে, তার নাম আসলো। সে একজন চিত্রকর, বিপত্নীক। একা বসবাস করে বিওর্গভান-এর উত্তরে দিলা-তে। তার মাত্র দুজন প্রতিবেশী-বন্ধু--অ্যাজলেক আর বেয়ার। বেয়ার আসলে শহরে বাস করে কারণ তার একটা ভাড়া দেবার গ্যালারি আছে। বিওর্গভান-এ আসলো নামে আরও একজন চিত্রকর বাস করে। কাহিনিকার আসলো এবং অপর আসলো দেখতে সদৃশ্যাকার—তারা একই জীবনের দুই সংস্করণ। আমরা উভয় আসলো-র জীবনযাপনকে অনুসরণ করি এবং তাদের অতীত জীবনকে অবলোকন করি ফ্ল্যাসব্যাকের মাধ্যমে। তারা একাধারে এক এবং দ্বৈত অস্তিত্ত্ব।)
ইয়োন: আমি উপন্যাসটা শুরু করেছিলাম এক চরিত্র দিয়ে, কিন্তু লেখা এগুতে থাকলে একজন আসলো থেকে আরও একজন আসলে সৃষ্টি হয়ে গেলো। তারা একাধারে একই আবার একও নয়। উপন্যাসের মৌলিক ধারণাটা আসলে এই। আপনি ইচ্ছে করলে একে একটি ধ্রুপদ সাদৃশ্যিক প্লটের উপন্যাস বলতেই পারেন।
(ফসে এই উপন্যাসের সিংহভাগ রচনা করেছিলেন হাইনবুর্গ-এর স্টাডিতে। এই স্টাডির জানালা দিয়ে সরাসরি তাকালে একটা রাস্তা এবং কিছু ফ্ল্যাট দৃশ্যমান হতো। কিন্তু একটু ঝুঁকে দেখলে একটি মধ্যযুগীয় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়তো।)
ইয়োন: হাইনবুর্গ-এ বাস করার সবচাইতে বড় সুবিধা হলো, একটু বাড়িয়ে বললে, আমার পারিবারিক ঘনিষ্ঠজনদের সাথে ছাড়া আর কারও সাথে যোগাযোগ হতো না। সপ্তাহে একবার আমি গির্জাতে যেতাম ম্যাস প্রার্থনার জন্য। আর হ্যাঁ, বাজার করতেও যেতে হতো ঐ সাত দিনে একদিন। জায়গাটা সুনসান, শান্ত। আমি ঘুমাতে যেতাম নয়টার ভেতরেই, উঠতাম ভোর চার কিম্বা পাঁচটায়। পুরো সেপ্টোলজি-টা আমি লিখেছি ভোর পাঁচটা থেকে নয়টার ভেতর।
সিসিল: আপনি লেখার জন্য ঐ সময়টা কেনো বেছে নিয়েছিলেন?
ইয়োন: আমি মদ পান করা ছেড়ে দেবার পর আমার লেখার অভ্যাসটা পালটে যায়। আগে আমি রাত-পেঁচার মতো ছিলাম। সন্ধ্যায় গ্লাসের পর গ্লাস মদ পান করতে ভলো লাগতো। জীবনটা ওভাবেই বেশ চলছিলো। কিন্তু যখন থেকে পান করা ছেড়ে দিলাম, রাতে ঘুমাতে যেতাম তাড়াতাড়ি আর দুপুরের পর দিতাম একটু ঝিমানী। সেপ্টোলজি-টা ভিয়েনা শহরের কাছে থাকার সময়ে ভোরবেলার লেখালেখির পরিণতি।
সিসিল: দেশ থেকে দূরে কোথাও থাকা কালে আপনার গল্পের গাঁথুনিতে কি কোনো মানসিক অভিঘাত সৃষ্টি হয়?
ইয়োন: হ্যাঁ, হাইনবুর্গ-এ আমি একাধিক বিষয়ের অবতারণা করেছিলাম যেগুলোর কোনো কিছুর অস্তিত্বই সরাসরি ওখানে ছিলো না। এই ব্যপারটা আসলে আমার ভেতর একটা মুক্ত এবং জাগতিক অনুভূতির জন্ম দেয় যার কোনোটাই আমি নরওয়েতে অনুভব করিনা। আর এখন যখন পুরো কাজটা শেষ করতে পেরেছি--বলতেই হবে বেশ দুরূহ কাজ—আমি অবাক হয়ে ভাবি, “কি ভাবে শেষ করলাম আমি কাজটা?” পাণ্ডুলিপিটা প্রথমে হয়েছিলো ১৭৫০ পৃষ্ঠা, এখন এসে দাঁড়িয়েছে ১৫০০তে।
(ফসে লেখার স্বচ্ছল ও স্বাধীন গতিতে বিশ্বাসী। তিনি লেখাকে মনে করেন একধরণের "মন্থর গদ্য" রচনা। অর্থাৎ, কথাসাহিত্য রচনা যেমন সময় সাপেক্ষ, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই এক সর্পিল যাত্রা এবং অনেকাংশেই সাংবেশিক—লেখার এই যাত্রাটি কোনোক্রমেই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে কোনো দ্রুত যাত্রা নয়—গদ্য রচনা সদাই মন্থর, এঁকেবেঁকে কিম্বা বক্রাকারে অগ্রসরমান প্রক্রিয়া। গদ্যের অন্তর্গত বৈশিষ্ঠ হলো এর "পারিবাহিক অনুক্রম" (transport stages) নির্দেশ, এবং "বর্ণনাক্রম" (descriptions) এবং "পরাবর্তন" (reflections).)
ইয়োন: বেশ কিছু বছর আমি নাটক নিয়ে আবেগতাড়িত ভাবে কাজ করেছি। আমার নাটক লেখার পদ্ধতি ছিলো সীমিতকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রীকরণ এবং প্রাবল্য সৃষ্টি করা। একটি নাটক কখনোই বাহ্যিক নাটকীয়তা দাবী করে না। নাটকের মূল উপজীব্য হলো তীব্র অন্ত-প্রসারণ--উদ্দীপিত চাপ। তাই "মন্থর গদ্য" আসলে দ্রুত ঘটমান নাটকের পরিপন্থী। গদ্য রচনা নাট্য রচনার চাইতে সময়সাপেক্ষ। গদ্য রচনার জন্য আমার দৈনন্দিন জীবনে,মনের গভীরে এক অতিপ্রশান্তির আবেশ বিশেষ প্রয়োজন।
(তাঁর সেপ্টোলজি উপন্যাসের জন্য ইয়োন ফসে-এর একটি কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু সেই চরিত্রটিকে কোনো লেখক হবার দরকার ছিলো না। পরিবর্তে ফসে তাকে চিত্রকর হিসেবে দেখিয়েছেন। ফসে সবসময়ই চিত্রকর্মে আগ্রহী ছিলেন, বিশেষ করে তৈলচিত্রে। কিশোর বয়সে তিনি আঁকাআঁকিও করেছেন, এবং তাঁর তিরিশপ্রারম্ভ বয়সকালে বেশ কিছু স্কেচ এবং চিত্রাঙ্কনও সম্পন্ন করেছিলেন।)
ইয়োন: কিন্তু সেই ছবিগুলো আমি সবই নষ্ট করে ফেলেছি। আসলে ওই ছবিগুলো আঁকার অনেক আগেই আমার আঁকাআঁকি ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিলো। হ্যাঁ, আমি ছবি আঁকার অনেক চেষ্টা করেছি, অনেক ছবির গ্যালারিতে, জাদুঘরেও গেছি। আমার বেশকিছু বন্ধু আছে যারা চিত্রশিল্পী।
(ফসে তাঁর চিত্রকর বন্ধুদের সাথে বিশদ আলাপচারিতা করে চিত্রকর হবার প্রাযুক্তিক বিষয়টি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এবং সেইসব বন্ধুদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন: হাভার্ড ভিখাএন, অভার টোরসাইম, এবং কামিলা বাইরেঙ্কল্ড। ফসে চিত্রাঙ্কনের প্রযুক্তিগত বিষয়ে তাঁদের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রশ্ন করেছেন, যেমন, চিত্রাঙ্কনের অভিপ্রায়, প্রদর্শন, রঙের সংমিশ্রণ, এবং ক্যানভাসের ব্যবহার।)
ইয়োন: আমার আলাপচারিতার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী ছিলো হাভার্ড। এই আলোচনা আমাকে স্পষ্ট করেছে সৃজনশীলতার দিক দিয়ে বিচার করলে সকল শিল্পী-ই একই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়, তা সে চিত্রকরই হোক কিম্বা লেখক কিম্বা সঙ্গীতজ্ঞ।
(ফসে একাধিকবার নিজেকে অন্তর্গত ভাবে একজন কবি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি যাকিছু লিখছেন তার ভেতর তাঁর কবিসত্তা উপস্থিত। ফসে-র কাছে বাক্যের ছন্দময়তা একটি প্রধানতম বিবেচ্য বিষয়; একইসাথে তিনি মনে করেন গঠনশৈলী এবং বক্তব্য অঙ্গাঙ্গীভাবে নিবিড়, তারা একই সূত্রে বাঁধা অস্তিত্ব, এবং পাঠকের উপর উভয়েরই সমপরিমান অভিঘাত রয়েছে। তিনি মনে করেন বক্তব্য আসলে গঠনশৈলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কবিতা লেখারও মৌলিক প্রণালি। ফসে একাধিকবার লক্ষ্য করেছেন অনেক কথাসাহিত্যিকের সাথে তাঁর অমিলটা ঠিক ওখানেই। তাঁরা বরং গবেষণা কাজে বেশি আগ্রহী। কিন্তু একথা সত্য তিনি "সেপ্টোলজি" লেখার সময় তাঁর অন্যান্য সহ-কথাসাহিত্যিকদেরই অনুসরণ করেছেন বটে।)
ইয়োন: এই প্রথম আমার লেখাতে একটি প্রাবন্ধিক চারিত্র পরিলক্ষিত হয়, এবং আমি বাস্তব জনমানুষদেরও উপস্থাপন করার চেষ্টা করি, অবশ্য তাদের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। স্যামুয়েল বেকেট, গেওর্গ ট্রাকল, লর্স হার্তেভিগ—আমার মনে গুরুত্বপূর্ণ এইসব লেখকদের কথা উঠে এসেছে, আর সেই সাথে আমি কিছু চিত্রকর্মেরও উল্লেখ করেছি,যেমন, অ্যাডলফ টাইডমিয়ান্ডি ও হান্স গুদে-র ব্রাইডাল প্রসেসন অন দ্য হার্ডেঙ্গাফিওর্ড। এর ভেতর আমার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ মায়েস্তার এখহার্ত-ও সামিল ছিলো।
সিসিল:এই যে বাস্তব বিশ্বের মানুষদের কথা উল্লেখ করলেন, তাতে কি আমরা মনে করতে পারি যে আপনি একজন প্রগতিবাদী?
ইয়োন: হ্যাঁ, এইসব বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করার কারণে অবশ্যই প্রগতিবাদের কথা আসতেই পারে। তবে আমি যাকিছু লিখেছি তার সবটুকুকেই অতীন্দ্রিয় বাস্তবতা (mystical realism)--"জাদুগরি" নয়, অতীন্দ্রিয়তা—এবং কিছুটা এই কারণেই আমি সম্ভবত সরাসরি উল্লেখ এবং প্রাবন্ধিক সংযোজন পরিহার করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সেপ্টোলজি, নির্দিষ্টভাবে, একেবারে স্পষ্ট একটি অতীন্দ্রিয় বাস্তবতা, যেখানে এই বাস্তব উদাহরণগুলো সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে আমার ধারণা, এবং এর ভেতর এক প্রাবন্ধিক চারিত্রও সৃষ্টি হতে পেরেছে। আমার মতে এই উপাদানগুলো উপন্যাসের কথক যেভাবে চিন্তা করে, তার সাথে সঠিকভাবে মেলানো গেছে। তবে এটা বলা বাঞ্ছনীয় যে উপন্যাসের কথকের চিন্তা কিন্তু আসলে আমার চিন্তা নয়।
সিসিল:সেপ্টোলজি-র অন্যতম একটি বিষয় হলো শিল্পের প্রকৃতি বিশ্লেষণ, কিন্তু এর ভেতর স্রষ্টাও যেমন আছে তেমনি আছে মদ্যাসক্ততা বা সুরাসক্ততা। আপনি কি আমার সাথে একমত?
ইয়োন:হ্যাঁ, কিন্তু এর ভেতর মৃত্যু চিন্তাও যথেষ্ঠভাবে রয়েছে। উপন্যাসে মদ এবং মৃত্যুর একটি সংযুক্তি আছে। বিষয়টি আত্মবিনাশ নিয়েও বটে। এটি আত্মহননেরই আর এক রূপ। উপন্যাসের মূল বিষয়ই হলো মহাসমুদ্র, মৃত্যু এবং প্রেম।
সিসিল: আবারও?
ইয়োন: হ্যাঁ, আবারও। (হাসি) সেপ্টোলজি-র পুরোটাই শুধু একটা তাৎক্ষনিকতা, একটা ভারাক্রান্তি, একটা মৃত্যু-মুহূর্তে। বলা হয়ে থাকে একজন মানুষ মারা যাবার সময় তার জীবনের পুনরাবৃত্তি অবলোকন করে। সেপ্টোলজি সম্ভবত সেই মুহূর্তের ধারণা থেকেই পাঠ করা যেতে পারে। আমি আমার পড়া বিভিন্ন বইয়ের অভিজ্ঞতা এখানে সংযুক্ত করেছি, অন্তত আমি যেসব বিষয় জেনেছি সেগুলো, কিন্তু লেখালেখি একেবারেই একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্যাপার। লেখা আসলে আমার যাবতীয় পড়াশুনা, শিক্ষা, অপরের কাছ থেকে জানা, কিম্বা তার অংশীদার হওয়ার একটি সার্বিক রূপান্তর। গল্প বলা মূলত এক রূপান্তরমাধ্যম যার ভেতরে থাকে একটি অঙ্গীকার, এবং এই রূপান্তর এবং অঙ্গীকারই একাধারে এর চালিকাশক্তি এবং সার্থকতা।
সিসিল: আপনি একজন শিল্পীর গল্প বলেছেন যে ঈশ্বরের কথা ভাবে এবং একই সাথে সুরাসক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ব্যপারটা আপনার জীবনের সাথে কতটা সম্পৃক্ত?
ইয়োন: উপন্যাসের মুখ্য বিষয়টিই আমার নিজের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, কিন্তু একইসাথে পুরোটাই পুরোপুরিভাবে পুনর্বিন্যস্ত। কিন্তু আমি কল্পবিলাসিতাও করেছি বিস্তর! উপন্যাসের মূল চরিত্রের ঝুঁটিবাঁধা (ponytail) পাকা চুল, ঠিক আমারই মতো। তার দুটি কালো ভেলভেটের জ্যাকেট আছে। আমারও এই মুহূর্তে তেমন একজোড়া জ্যাকেট আছে। আসলে আমি প্রথমে এই জ্যাকেটের কথা লিখি উপন্যাসের কাহিনীতে, তারপর নিজের জন্য ঐ একই রকম দুটো জ্যাকেট কিনি! আমি যে জীবনের কথা বর্ণনা করি তা সম্ভবত আমার নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আমি কোনো না কোনো ভাবে আমার ঐ উপন্যাসের চরিত্র, উপন্যাসের চরিত্র চিত্রকর আসলো হতে পারি কিম্বা তার ছোটবেলার বন্ধু সিগভ-ও হতে পারি, যে একটা আসবাপত্র তৈরির কারখানায় চাকরি করে।
সিসিল:সেপ্টোলজি-তে অনেক মোটরগাড়ি চালাবার কথা আছে। আপনিও বেশ গাড়ি চালাতে, গাড়ি বিষয়ে আলাপ করতে, এবং গাড়ি চড়া নিয়ে কথা বলতে ভালবাসেন। এই বিষয়টিও কি আপনার জীবনের সাথে সামন্তরিক?
ইয়োন: হ্যাঁ, আমি গাড়ি চড়ে দীর্ঘ ভ্রমণ পছন্দ করি, কিন্তু শহরের ভেতর গাড়ি চালাতে আমি মোটেও পছন্দ করিনা। অসলো শহরে গাড়ি চালানো প্রায় এক অসম্ভব ব্যাপার। আমি গ্রতন-এ আসাযাওয়ার রাস্তাতে গাড়ি চালানো শিখেছি-- ব্যাস, এই টুকুই। আমাকে যদি জীবিকা হিসাবে সনাতন কোনো পেশা বেছে নিতে হতো তবে আমি ট্রাক-চালকের চাকরি নিয়ে ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দাবড়ে বেড়াচ্ছি বলে কল্পনা করতাম। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ ছিলো আমার বর্তমান বয়সের অনেক আগেই। এখন আমার ঐ পেশায় যাবার আর উদ্যম নেই।
সিসিল: ড্রাইভার হয়ে ইউরোপের রাস্তায় রাস্তায় ট্রাক চালাতে চালাতে আপনি নিশ্চয়ই অডিও বুক (audio book) পড়া শুনতেন?
ইয়োন: হ্যাঁ, অবশ্যই শুনতাম। আমার সবচাইতে পছন্দের অডিও বুক হলো (তারেয়াই) ভেসেস-এর দ্য বার্ডস-এর পাঠ। দারুণ! দূরে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় আমি অডিও বুক পাঠ শুনতে ভীষণ ভালবাসি--যেমন অসলো থেকে বার্গেন-এর রাস্তায়।
সিসিল:সেপ্টোলজি লেখা শেষ করে আপনি নিশ্চয় অনেকটাই আশ্বস্ত বোধ করছেন?
ইয়োন: হ্যাঁ, আমি অবিশ্বাস্য রকমভাবে মৃত্যু-চিন্তাতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম—ভাবতাম এই লেখাটা শেষ করার আগে আমি কোনক্রমেই মরতে পারি না। ব্যাপারটা পাগলামো মনে হতে পারে, কিন্তু আমি শেষ লাইনটা লিখে যেতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করেছি। আমরা সবাই মারা যাবো সেটা ঠিক, কিন্তু ওই সময় আমি ভয়ে ছিলাম আমার স্বাস্থ্য এবং উদ্যম দুটোই বোধ হয় ফুরিয়ে যাবে বইটা লেখা শেষ করার আগেই। আমার এই অভিজ্ঞতাটি প্রকৃতপক্ষে আমার একান্ত অভিজ্ঞতা। আসলে এটা আমারে রক্তের ভেতরেই আছে; মনে পড়ে আমি যখন আমার প্রথম দিককার উপন্যাসগুলো লিখছিলাম তখনও আমার মৃত্যু নিয়ে ঠিক এমনই দুশ্চিন্তায় ছিলাম—ভাবতাম আমি বুঝি ঐ উপন্যাসগুলো লেখা শেষ করার আগেই মারা যাবো।
সিসিল: কিন্তু আপনার ভেতর এমন চিন্তা কেনো আসে বলে আপনার মনে হয়?
ইয়োন:কারণ, সম্ভবত আমার ভেতর একটা বিশ্বাস কাজ করে যে আমি যা বলতে চাই সেটা আমার বলাটা অত্যন্ত জরুরি। এই বলাটা আমার একটা দায়।
সিসিল:তার মানে আপনাকে সেপ্টোলজি লিখতে হয়েছে কারণ আপনি মনে করেছেন আপনার জরুরি একটা কিছু বলার আছে?
ইয়োন:হ্যাঁ, যদিও উপন্যাসের গঠন শৈলীটাও জরুরি, কারণ আমি যা বলতে চেয়েছি তার জন্য ঐ গঠন শৈলীটাও জরুরি ছিলো--ঐভাবে ছাড়া আমার গল্পটা বলা সম্ভব হতো না। ফলে গল্পের অবয়ব ও বক্তব্যের গুণাগুণ সঠিক ভাবে সংমিশ্রিত হতে পেরেছে। ভালো লেখা আসলে অনন্য অবয়বের মতো। বলতে গেলে প্রতিটি নতুন রচনা এক একটি নতুন অবয়ব।
(ষাট বছর বয়সে ইয়ন এক বিশাল গদ্য রচনা সম্পন্ন করেছেন। পঞ্চাশ বছর বয়স পূর্ণ হলে তিনি নাটক লেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। চল্লিশে প্যারিসে তাঁর বিশাল সাফল্য চিহ্নিত হয়েছিলো। কিন্তু তিরিশে? কি হয়েছিলো ১৯৮৯-তে? যে সাফল্য তাঁর জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিলো? ঐ সময়ে ফসে একজন সফল লেখক। ১৯৮৩ সালে তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস "রেড, ব্ল্যাক" উপন্যাস প্রকাশ করেন। বিষয়বস্তু ছিলো নরওয়ের পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারি এক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। এর পর বেশকিছু উপন্যাস রচনা, এবং ১৯৮৬ সালে প্রথম কবিতাগুচ্ছের প্রকাশ। কিন্তু নরওয়েতে তাঁর প্রথম সত্যিকার সাফল্য আসে ওই ১৯৮৯ সালের শরতে--আর সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর "বোটহাউস" উপন্যাসের মাধ্যমে। উপন্যাসের প্রথম বাক্যটি তাঁর চরিত্রের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিলো: “আমি বাইরে কোথাও যাই না, এক অস্থিরতা আমার ভেতরে স্থান করে নিয়েছে, এবং আমি বাইরে বের হই না।" “বোটহাউস"-এর মাধ্যমে ফসে সাহিত্যে নরওয়েজিয় ক্রিটিক্স প্রাইজই শুধু পান নি, তিনি অফুরন্ত সমালোচক-প্রশস্তিও অর্জন করেন। তিনি দ্রুত সাহিত্য জগতে আভিজাত্যের অংশীদার হয়ে পড়েন। ঐ সময়ে তিনি শিক্ষকতা পেশাতে নিয়োজিত ছিলেন। ফসে শিক্ষক হতে চান নি, কিন্তু ঘটক্রমেই "দ্য পেনম্যানশিপ একাডেমি ইন হর্ডল্যান্ড”-এ শিক্ষকতার চাকরি নেন। তাঁর "মাই স্ট্রাগল" প্রবন্ধে এই শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু পরিচয় মেলে।
১৯৭৯ সালে ফসে-র বয়স ছিলো বিশ বছর। ঐ বছরের বসন্ত কালে তিনি ওয়েস্টিস স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। সেখানে তিনি এক ছাত্রাবাসে থাকতেন। এর পর ১৯৭৯ সালেই তিনি বার্গেন চলে আসেন। সেখানে যাবার ব্যপারে লেখাপড়া নিয়ে ফসে-র কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিলো না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মানবিকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তাঁর পড়াশুনার বিষয় ছিলো সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, এবং সাহিত্য। বার্গেন-এ প্রথম বছর ফসে একটি সংবাদপত্র "উলা তিউদুয়া”-তে কাজ পান। যদিও ফ্রিলান্স করতেন, ফসে মানুষের সাথে আলাপচারিতাতে মোটেও স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না। তবে লিখতে পছন্দ করতেন। বিশাল কম্পুটারের সামনে বসে বসে সময় কাটাতেন, এবং এভাবেই লেখালেখির সাথে তাঁর ভালবাসার সম্পর্কের সূত্রপাত।
ফসে এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে বলেছেন তাঁর নাটক লেখার দিন শেষ, এর পরও তিনি ”স্ট্রং উইণ্ড" নামে আর একটি নাটক রচনা করেন যেটি ২০২০/২০২১ সালে "ডেইট নর্স্ক টিট্রেট"-এ অভিনীত হয়েছে।)
ইয়োন: নাটকটা লেখার সময় মনে হচ্ছিলো একটা যেন সুবাতাস বইছে! একটা লম্বা বিরতির পর নাটক লেখা এবং সেই লেখাকে সঠিকভাবে বসে আনা এতো সুখকর হতে পারে সে অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না আগে। মন্থর গদ্য সৃষ্টি আর নাটককে তার যথাযথ আকার দেয়া সম্পূর্ণ আলাদা ব্যপার। নাটক লিখতে আমি সাধারণত মাত্র কয়েক সপ্তাহ বা খুব বেশি হলে দু-এক মাস সময় নিই। আমার কাছে নাটক লেখা এক বসাতে শেষ করারা বিষয়। অনেকটা কবিতা লেখার মতো। সাধারণত প্রথম খসড়াতেই যা লেখার সব লিখে ফেলি। কিন্তু নাটকও—হ্যাঁ, ঐ অতীন্দ্রিয় বাস্তবতাই, যদিও আমার এই মুহূর্তেই মনে হলো নাটককেও ঐ অভিধাতে সংজ্ঞায়িত করা যায়। কিন্তু তবুও আমি নিশ্চিত নই আমার এই সংজ্ঞায়ন সঠিক হচ্ছে কিনা।
সিসিল: এখন থেকে আপনি কি আবারও নাটক লিখবেন?
ইয়োন: সম্ভবত লিখবো, তেমন ইচ্ছা আছে, তবে নিশ্চিত নই। আমি লেখাকে একটা সহজাত গুণ বলে মনে করি, আর তাই বিশ্বাস করি একই মানুষের একাধারে একাধিক গুণসম্পন্ন হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। তবে এটা ঠিক আমি বর্তমানে এক নাটক লেখা শেষ করে পরবর্তী নাটক লেখা পর্যন্ত একটি বিরতি দিতে পছন্দ করি। আগে যে গতিতে লিখতাম এখন সে গতিতে লিখতে চাই না।
সিসিল: এক সময় কি অবসর নেবার কথাও ভাবছেন?
ইয়োন: না, সেটা আমার ক্ষেত্রে ঘটবে না। আমি জানি কেউ-কেউ লেখা বন্ধ করে দেয়, আবার অনেকেই সারাজীবনই লেখালেখি করে। আমার সব সময়ই একটা সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন হয়, আর সেটার অভাব হলেই আমার ভেতর অস্থিরতা কাজ করে, আমি অসুখী হয়ে পড়ি।
(১৯৬৯ সালে ইয়োন ফসে দশ বছরের বালক ছিলেন। এর অনেক আগে থেকেই ছিলো তাঁর মাথাভর্তি লম্বা চুল, বিদ্রোহীসুলভ মন, বিদ্যালয়ের পড়াশুনার প্রতি বিতৃষ্ণা। কিন্তু বারো বছর বয়সে তাঁর হঠাৎ আবিষ্কার হলো এই লেখালেখি। তখন তিনি থাকতেন নরওয়েয়ের হার্ডেঙ্গাফিওর্ড যাবার পথে স্ট্র্যান্ডবার্ম-এর কাছে ফসে-তে--যেটি তাঁর নামের অংশ, যদিও তাঁর আসল নাম হলো ইয়োন ওলাভ। তিনি বেড়ে ওঠেন সমুদ্র খাঁড়ির ঐ ছোট্ট শহর ফসে-তে সমুদ্রের ঢেউ দেখে। তাঁর পিতামহদের বসবাস ছিলো খামারবাড়ীর একটি বাসস্থানে, অন্যদিকে ইয়োন ওলাভ, তাঁর বাবা-মা, এবং দুই বোনসহ বাস করতেন অন্য একটি বাড়িতে। তাঁর বাবা ছিলেন স্ট্র্যান্ডবার্ম কোঅপারেটিভ-এর ম্যানেজার, আর মা ছিলেন গৃহকর্মী। ইয়োন ওলাভ এক সময় তাঁর বাবার সাথে ঐ কোঅপারাটিভে কাজ করেছিলেন। ইয়োন নিঃসঙ্গতা পছন্দ করতেন না, সেই সাথে ভীষণ পড়ুয়া ছিলেন। ফসে-র প্রতিটি বাড়িতে ছেলেমেয়েদের বসবাস ছিলো প্রচুর। তারা পুরো শহরময় বল্গাহীন ঘুরে কাটাতো প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য দেখে-দেখে, সমুদ্রখাঁড়ির একান্ত কপ্লবিশ্ব তাদের মনের গভীরে স্থাপন করে। তাদের ছিলো ভাবনাহীন, দুঃসাহসিক, সুন্দর, নিরাপদ শৈশব। তাদের বেড়ে উঠা ছিলো প্রার্থনালয় আর যুবসঙ্ঘের যাতায়াতের পথে।)
সিসিল: আপনার বয়সী অনেকেই তাদের শৈশব জীবন ফিরে পেতে চায়। আপনার কি তেমন কিছু ভাবার সময় এসেছে?
ইয়োন: এই শরতে আমার বাবার বয়স হবে নব্বই। আমার মনে হয় যে আমি ধরেই নিয়েছি মাবাবা ওখানে আগের মতোই সুস্থ-সবল আছে। সেটা, মানতেই হবে, একধরণের বোকামী চিন্তা। আমি আমার শৈশবে ফিরতে আগ্রহী নই। স্ট্র্যান্ডবার্ম-এর প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। বরং আমার ভেতর এক বিপরীত অনুভূতি কাজ করে। আমার আকর্ষণ, যেমনটা ইঙ্গভার মও বলেছেন, “পশ্চিম উপকূল আমার ভেতরেই বসবাস করে।" তবে ইঙ্গভার- এর মতো সেই বসবাস কোনও অশনি-বসবাস নয়, বরং এক শুভ-সুন্দর বসবাস।
সিসিল: স্ট্র্যান্ডবার্ম-এর প্রতি আপনার আকর্ষণ না থাকার কারণ?
ইয়োন: এটা আমার চারিত্রিক কারণে। আমি ওখানে সুন্দর জীবনযাপন করেছি সেটা ঠিক। কিন্তু একই সাথে ঐ সময়টা আমার এবং অন্যান্যদের জন্য খুব একটা সুখকরও ছিলো না। সম্ভবত কথাটা আমার জন্যই বেশি প্রযোজ্য।
সিসিল: কিন্তু ঐ সমুদ্রখাঁড়ি, পাহাড়, বৃষ্টি, জল?
ইয়োন:আমার সেপ্টোলজি-র মূল চরিত্র বসে বসে বাইরে তাকিয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখে। আমি নিজে ইউরোপের হৃদয়ের ঢেউ অবলোকন করি আমার নিজের ভেতরে।
সিসিল:তার মানে আপনি কিন্তু সেখান থেকে সরে আসেন নি?
ইয়োন: হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি চিরকালই একজন সঙ্গতিপ্রবণ মানুষ। আমি কোনো নির্দিষ্ট স্থানের সাথে আটকে থাকি না। নাটকের কারণে আমি তিরিশ বছর বয়স থেকে রাস্তায় রাস্তায় থেকেছি। আমি বিচিত্র সব জায়গায় বসবাস করেছি।
সিসিল: কিন্তু ডিংজা-তে আপনার একটা স্থায়ী কুটিরও আছে, আর সেখান থেকে আপনি সমুদ্রও দেখতে পান।
ইয়োন: হ্যাঁ, ওখানে থাকাটা ভারি আনন্দের। ওখানকার আলোটা অবাক করা হালকা এবং নীলাভ। সমুদ্র, টিলা, আর গোলাপি-লাল ফুলগাছের ঘেরে বাস করা সত্যিই অপূর্ব! জানি না কেন, দারুণ ভাল লাগে।