প্রতিটি মহৎ শিল্পই এক অর্থে মৃত্যর অনুধ্যান; মৃত্যুর সমাঙ্গ হয়ে ওঠাই যেন শিল্পের সাধনা ।
Published : 15 Jul 2023, 07:34 PM
— দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে— কাব্যগ্রন্থটির সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রে খানিকটা স্পর্ধা নিয়েই বলতে চাই, শুধুমাত্র বাংলা কবিতার বৃত্তে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্য পরিসরে কবি সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতার পাঠক হয়ে ওঠা আমার জন্য এক বিরল আনন্দ-অভিজ্ঞতা । “চলে যাবার সীমারেখায় আজ বৃত্তায়িত সবকিছু”— এই উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কবিসত্তার উন্মোচন, এবং সমগ্র কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে পৃথিবী থেকে চিরপ্রস্থানের ইচ্ছেটাই যেন কবির একমাত্র আরাধ্য বিষয়, কিন্তু সেখানে মৃত্যু কিংবা আত্মহত্যা নিয়ে তাঁর মধ্যে অধিবিদ্যা নির্মাণের কোনো প্রকল্প নেই । ইচ্ছামৃত্যু কিংবা আত্মহত্যা সাহিত্যের একটি মৌল বিষয় মাত্র নয়, বরং বিষয়টিকে নিয়ে অধিবিদ্যা নির্মাণের জন্য মহৎ কবিদের ভেতরে এক ধরনের প্রবণতা হয়ত কাজ করে থাকবে, যদিও ইচ্ছামৃত্যু আর আত্মহত্যা এক জিনিষ নয় । ভারতীয় দর্শনে ইচ্ছামৃত্যুর মধ্যে যে বৈরাগ্য এবং শারীরিক সমাপনের মধ্যে যে শান্ত-সমাহিত রূপ থাকে, আত্মহত্যার মধ্যে তা নেই, বরং আছে অহং-এর উদ্বোধন এবং উদ্যাপন । শারীরিক অবলুপ্তির মধ্যে দিয়ে হোল্ডারলিন বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এক হয়ে বিস্মৃতিময় আনন্দে থাকতে চেয়েছেন, আর জীবনানন্দ অবচেতনায় এবং নির্জ্ঞানস্তরে মিশে থেকে সকল প্রাণের মধ্যে মৃত্যুর বিষণ্ণতাকে প্রত্যক্ষ করে গেছেন । কবি সাইফুল্লাহ এমন কোনো দার্শনিক বোধ দ্বারা তাড়িত নন, তবু ত্রিকালজ্ঞ ঋষির মতো সাক্ষ্য দিয়ে বলে যাবেন, “সবুজ পায়রার হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খেয়ে/ ঠিক তিন বছর পর আমি আত্মহত্যা করে যাবো” (খ্রি. ১৯৭৯) এবং পরিশেষে আত্মহত্যার (খ্রি. ১৯৮১) মধ্য দিয়ে উচ্চারিত স্বপ্নের রপকার হয়ে উঠবেন এই ভাষ্যে, “পাপিষ্ঠ পূণ্যতটে রেখে যাই আমার শেষ অহংকার ।”
কিন্তু মৃত্যুর অভিপ্রায় সুনীলের মধ্যে “কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?”— এই প্রশ্নে দার্শনিক হাইডেগার আমাদেরকে জানিয়ে দিতে চান, যখন কোনো কবির ভেতরে মৌলিক কোনো ভাবনা কিংবা অনুভবের জন্ম হয়, তখন প্রতিটি কাব্যপ্রয়াসের মাধ্যমে তিনি সেই অনুভবকে ধরতে চেষ্টা করেন, কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই এক অর্থে অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সকল পরিভ্রমণ পুনরায় চিন্তাটির উৎসমূলে ফিরে আসে । সেই কারণেই প্রকৃত কবি আজীবন একটি কবিতাই লিখে যান, তবু তাঁর মধ্যে থেকে যায় এক গভীরতর অপূর্ণতার বোধ । অন্যদিকে, প্রতিটি মহৎ শিল্পই এক অর্থে মৃত্যর অনুধ্যান; মৃত্যুর সমাঙ্গ হয়ে ওঠাই যেন শিল্পের সাধনা । কাফকাসৃষ্ট মৃত্যুপথযাত্রী চরিত্রগুলোর মতোই তিনি গভীরতর অর্থেই তাঁদের মতোই মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। কাফকা আমাদের জানিয়ে গেছেন, “যা কিছু ভালো আমি লিখে গেছি তা হলো মৃত্যু ভাবনার মধ্যে গভীরতর এক পরিতৃপ্তির বোধ ।” মৃত্যুশয্যায় তিনি এই সম্পূর্ণতার বোধ নিয়েই মারা যাবেন বলে আস্থা রেখে গেছেন । তিনিই মহান লেখক যিনি মৃত্যুর সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভীত-সন্ত্রস্থ নন, বরং তিনি মৃত্যুর মতোই হয়ে উঠেন একক, সয়ম্ভূ, পরাক্রমশালী । যখন মৃত্যু আর শিল্পীসত্তা সমসয়ম্ভূ, তখনই মৃত্যু নিয়ে যে কোনো শিল্পসাহিত্য বোধকরি হয়ে ওঠে অনন্য মহৎ।
কাফকা মৃত্যুর মধ্যে পরিতৃপ্তির যে বোধ উচ্চকিত করে রাখেন, সেই ভাবনাকে আরও কাব্যিক করে তুলে ধরেন সুনীল সাইফুল্লাহ, “আমি শুধু দিতে পারি আমার শরীর/ একাকী পাখির পূর্ণিমা-পিপাসায় ।” এ সবই আসলে এক অপূর্ণতার বোধ, যখন পৃথিবীর সাথে সকল স্বাভাবিক সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটে গেছে, যে সম্পর্ক এখন একমুখী, কিন্তু সেখানে অনুভব আরও তীব্র হয়ে উঠেছে । পৃথিবীতে শান্তির সাথে বসবাস নয়, বরং মৃত্যুর মধ্যে প্রশান্তির বোধ গভীরভাবে অনুভব করে যাওয়াই যেন শিল্পের ধর্ম । এ যেন প্রাত্যহিকতার ঈশ্বরকে অস্বীকার করে উন্মাদকবির ঈশ্বর দর্শনযাত্রা । “চলে যাবার সীমারেখায় বৃত্তায়িত হতে থাকে আকাশ, সূর্যস্তিসুর, নিথর পানাপুকুর— যেন আনন্দস্বরূপা রাজারপুর ।” আছে আলোছায়াময় আমলকী বনে উৎসবের জন্য প্রার্থনা, কারণ কবি তো “জল, শুধু জল, পরাধীন মেঘের বন্দী!”
“এ জন্ম মিথ্যে, সত্যমুকুট ছাড়া একদিনও বাঁচবো না আর/ পাপিষ্ঠ পূণ্যতটে রেখে যাই শেষ অহংকার!” কী সেই অহংকার ? প্রকৃতপ্রস্তাবে, সকল অহংকারই পরাজিত সৈনিকের বিলাপমাত্র । কেন কবি এখানে মহাভারতের পরাজিত সেনানায়ক জয়দ্রথের সাথে সাযুজ্য অনুভব করেন? তিনি কি বালকযোদ্ধা অভিমন্যুর মতো কাউকে বধ করেছেন, আর কোন্ সে দ্রৌপদী যাকে তিনি হরণ করতে চেয়েছেন ? সে আলোচনা অন্যত্র হবে, এই আশা রাখি । কবি দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান জগতের মধ্যে সেতু বন্ধন করে অদৃশ্যমান জগতেরই যেন ব্যাপ্তি দিতে থাকেন । কবি সুনীল সাইফুল্লাহকে কবিতা-সত্যের নিমিত্তে বিশ্বাস করে নিতে হয়, “ছিলো একদিন আজ পচিঁশ বছর পাঁচশ জন্মের ভার।” কিন্তু তিনি কি আদৌ কোনো জন্মভার নিতে সক্ষম ? জন্মভার তো দূরের কথা, তিনি কোনো রাজ্যভার নিতেও সক্ষম নন । কবি সাক্ষ্য দিয়ে যান, “তোমার মৃত্যুদিন ছুঁয়ে থাকে আমার সর্বদিন/ রাজত্বভারে অসমর্থ মুক্তি দাও মহারাজ ।”
যিনি রাজা তিনিই তো ঈশ্বর, এবং সেই ঈশ্বর-দর্শন-যাত্রাই হোল কবি সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতা ! “নদীর ওপারে অন্যদেশ/ ওই আমার জন্মভূমি একদিন যাবো/ ততদিনে তৈরী হোক ময়ূরপঙ্খী/ একদিন নিশ্চিত চিঠি আসবে রাজার ।” তাঁর আছে অসীম ধৈর্য, এ-যেন ইচ্ছামৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষামাত্র। প্রকৃত কবিমাত্রই জানেন, যেভাবে কবি রিল্কে জেনেছেন, যেভাবে ফল পেকে ওঠে, ঠিক তেমনি মৃত্যুর জন্য আমরা অপেক্ষা করি মাত্র। এ নয় ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু, তবু প্রতীক্ষার অনুভবের সিদ্ধিতে প্রায় একইভাবে দীপ্তিমান । মৃত্যু যেন অপচয় মাত্র নয়, বরং প্রতিটি মৃত্যু যেন হয়ে উঠে একক এবং প্রাতিস্বিক ! প্রত্যেকটি মানুষ যেন তাঁর আপন মৃত্যুকে খুঁজে পায়— এই যেন প্রার্থনা আমাদের ।
— রূপসী বাংলা— কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কাব্যগ্রন্থ হয়েও সমগ্রতায় যেমন একটিমাত্র কবিতা, ঠিক একইভাবে — দুঃখ ধরার ভরাস্রোতে— সুনীল সাইফুল্লাহর শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, বরং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ; আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় একটিমাত্র কবিতা, আর সেই কবিতার সব পৃষ্ঠা জুড়ে আছে বিদায় সম্ভাষণ ! “আজন্ম পরিচিত মানুষ ছেড়ে চলে যাবো মৃত্যুদন্ডিত/ মৃত্যুদন্ডিতের মতো/ অথচ নির্দিষ্ট কোন দুঃখ নেই ।” প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁর দুঃখ হয়ত একাধিক, কিন্তু কিছু কিছু দুঃখ নির্দিষ্টও বটে ! যেমন, “কিসের নিয়মে, পাপিষ্ঠ প্রবাহে/ অঙ্কুরিত আত্মজের ভয়ে/ আত্মহত্যা করে একজন/ তাঁর ব্যর্থতা ঝরে চন্দ্রালোকে ।” সমস্ত চলে যাওয়া আসলে পুনর্জন্মেরই প্রকাশমাত্র, আপন অস্তিত্বকে আরও পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ করার অভিপ্রায়মাত্র ! সকল কবিই বোধকরি শেষাবধি আস্তিক—
“আমার অন্ধকারে কেউ বুঝি কাঁদে ছায়াবৃত রাতে
তার স্বরূপ বুঝে নাও মাটি একটি বৃক্ষ জন্ম দিও ।”
যদিও আমাদের সবার মতো কবির চলে যাবার রথও সদাই প্রস্তুত।