একটিমাত্র টালির নর্তককে নিয়ে গীতিকাব্য: মেসি আর স্থানের আকৃতিবিলোপ

রোনালদো, মেসি ও মারাদোনার খেলার কলাকৌশল সম্পর্কে একটি চিত্তাকর্ষক তুলনামূলক আলোচনা।

মোস্তাক শরীফমোস্তাক শরীফ
Published : 14 March 2023, 05:23 PM
Updated : 14 March 2023, 05:23 PM

কলম্বিয়ার অগ্রগণ্য তরুণ কথাসাহিত্যিক পাউল ব্রিতো সম্প্রতি ফুটবলের জাদুকর মেসিকে নিয়ে অসাধারণ একটি লেখা লিখেছিলেন। লেখাটির অসাধারণত্ব বিষয়ে নয়, বরং বিষয়কে এক অসামান্য পাণ্ডিত্য ও কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ ও বর্ণনার কারণে। এখানে দর্শন, জ্যামিতি, গণিত, নান্দনিকতা, যুক্তি ও কল্পনা, আর অবিশ্বাস্য শিল্পিতা একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। এই লেখাটির সূত্রে বাঙালি পাঠক কেবল মেসির শ্রেষ্ঠত্বই অনুভব করবেন না, একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকার এক লেখকের অসামান্য বিশ্লেষণী ও কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেও পরিচিত হবেন। লেখাটি প্রথমে লেখা হয়েছিল স্প্যানিশ ভাষায়। পরে আমাদের অনুরোধে এটি লেখক এর একটি ইংরেজি সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। সেটিরই মূলানুগ অনুবাদ করেছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক মোস্তাক শরীফ। বি. স.

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যদি ফুটবলের একিলিস হন, মেসি নিশ্চয়ই আপোরিয়ার কচ্ছপ। কয়েকটা পা ফেলে গোটা মাঠকে গিলে খাবার ক্ষমতা যদি কারো থাকে, লিওই সেই ব্যক্তি-যিনি মাঠকে ক্রমাগত ভাঙেন, যতক্ষণ না এটি পরিণত হয় একটি গোলকে, বহুদিকে যাবার ক্ষমতাসম্পন্ন একমাত্রিক সারি এবং কাল্পনিক এক অঞ্চলে, যেখানে প্রতিটি বিন্দু অন্য বিন্দুর সঙ্গে সংযুক্ত। রোনালদো যদি হন ইউক্লিডীয় বা নিউটোনীয় জ্যামিতিবিদ, মেসি তবে গসীয় কিংবা আইনস্টাইনীয়। প্রথাগত ফুটবল খেলোয়াড়ের কাছে জ্যামিতি স্থির ও পরম। এমন একটা পিঠা যার টুকরোগুলো গুনে আর মেপে রাখা। মেসির ক্ষেত্রে জ্যামিতি স্থিতিস্থাপক, আপেক্ষিক, এমন এক শক্তিক্ষেত্র, খেলতে নেমেই ইচ্ছেমত যাকে বাড়ান কিংবা কমান তিনি। পায়ের পাতার কারিশমায়, প্রতিটি পদচিহ্নে যার আকৃতি পাল্টায়। তাঁর পায়ের ছাপে জন্ম নেয়া মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে মেসি তৈরি করেন ফাঁক, ফাটল, গুপ্তস্থান, অসমতা আর বিচ্যুতি--মুহূর্তমাত্র আগেও যার অস্তিত্ব ছিল না। অন্য খেলোয়াড়রা দৌড়ান নির্দিষ্ট পর্যায় মেনে, সরলরেখা আর সংক্ষিপ্ততম পথ খুঁজে খুঁজে। মেসি ছোটেন বক্রাকারে, নয়তো অন্তহীন এক স্পর্শকের অনুবর্তী হয়ে--ক্রমাগত গতিবৃদ্ধির মাধ্যমে পৌঁছান তরঙ্গের চূড়ায়। নিজ গতির মধ্যে আবিষ্কার করেন এক উজ্জ্বল উদ্ধার, যা থেকে খুঁজে নেন বেগ আর শক্তি। অনন্তস্পর্শক, স্নায়ুতন্ত্রীর প্রতিটি নড়াচড়া, পায়ের ভঙ্গিমা আর গতির তীর্যক সীমাকে ব্যবহার করেন মুন্সীয়ানার সঙ্গে। মেসির খেলা পরমতার অন্তর্জ্ঞানে পূর্ণ, অন্য খেলোয়াড়দের খেলা স্রেফ যুক্তিসঙ্গত এক আসন্ন মান। কাল ও স্থান যেখানে একীভূত হয়েছে সেই মেরুরেখায় বিচরণ করেন মেসি; অন্য খেলোয়াড়রা খেলেন কার্তেজিয় এক সমতলে, যেখানে স্থান ও কালের রূপ ভিন্ন, পরিসরও বড়। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ, লুইস সুয়ারেজ বা দিদিয়ের দ্রগবার মতো ফুটবলার হচ্ছেন বিদ্যুতের ধনাত্মক প্রবাহ, নিজেদের উপস্থিতি টের পাওয়ান শক্তির শ্রেষ্ঠত্বকে কাজে লাগিয়ে। অন্যদিকে বিদ্যুতের দুটি বিপ্রতীপ প্রবাহের মধ্যে যে বক্ররেখার সৃষ্টি হয় সেটিকে ব্যবহার করেন মেসি। তাঁর চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো শক্তির সঙ্গে সৃষ্টি করেন ঐকতান। তৈরি করেন বিদ্যুচ্চুম্বকীয় এক ক্ষেত্র যা চলার পথে বিদ্যুতের যাবতীয় প্রবাহের ক্ষতিপূরণ করে, তারপর করে আত্মীকরণ। বলা হতো, ফুটবল নাকি ম্যারাডোনার পায়ের সঙ্গে বাঁধা থাকত। উরুগুইয়ান লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো সাক্ষ্য দিচ্ছেন, বল মেসির ভেতরেই থাকে। এটি সম্ভব হয়েছে, কারণ বলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ এক সংশ্লেষণ ঘটিয়েছেন তিনি, পদযুগলকে রূপ দিয়েছেন নিজের মনের অবিচ্ছিন্ন এক অংশে। যা কল্পনা করেন সেটিই খেলতে পারেন। জিদান যদি হন বলরুমে নাচা সেই নর্তক নিজেকে যিনি ছড়িয়ে দেন বিশাল এক এলাকায়; মেসি তবে হাল জামানার সেই নর্তক যে একটিমাত্র টালির ওপর অসাধারণভাবে নাচে, এবং সেই টালি পরিণত হয় পুরো একটি উঠানে। দ্বান্দ্বিকতার পণ্ডিত মেসি, সক্রিয় শক্তির নির্যাস, অস্তিত্বের স্বরূপ-সন্ধানী এক নিরবচ্ছিন্নতা। তা কেবল এজন্য নয় যে তিনি তাঁর মন, পা ও ফুটবলকে একসূত্রে বেঁধেছেন। এজন্যও নয় যে তিনি ফুটবল মাঠকে নিয়ে যান কল্পনার রাজ্যে, তারপর অন্য খেলোয়াড়দের কাছে সেটিকে ফিরিয়ে আনেন নিজ অবচেতনের এক প্রক্ষেপণের আকারে। এজন্যও নয় যে, তাঁকে পাহারা দেয়া মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের পরিণত করেন অনিচ্ছুক সহযোগীতে। এজন্যও নয় যে বলকে ক্রমাগত সরলীকৃত করতে করতে তাকে পরিণত করেন সকল পদার্থ দ্বারা গুণিত এক পরমাণুতে। এজন্যও নয় যে সেই পরমাণু বড় হতে হতে এক সময় এ বিশ্বের পরিধির সমান হয়ে যায়। বরং এজন্য যে, খেলাটি তখন স্মৃতিকাতরতার ওপর চেপে বসে, অতীত আর ভবিষ্যৎকে হালনাগাদ করে রূপ দেয় লাগাতার এক বর্তমানে। এটিই তখন হয়ে দাঁড়ায় ইতিহাসের সংশ্লেষণ, চাকার বিবর্তন, বিন্দুর চুড়ান্ত পরিণতি। চার পা থেকে দু’ পা, দু’ পা থেকে একটিমাত্র আংটা। বর্গাকার ক্ষেত্র থেকে যার রূপান্তর বৃত্তে।