যোগবিজ্ঞান বা বেদান্ত দর্শনে ভয়কে নিতান্তই মনের ঠুনকো এক সৃষ্টি হিসেবে দেখা হয়।
Published : 05 Dec 2024, 07:30 PM
স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ভয় হচ্ছে মোক্ষম একটি অস্ত্র। আমাদের বেড়ে ওঠার সময় মা-বাবারা প্রায়শই এটি ব্যবহার করতেন। তরকারি পছন্দ না হবার কারণে খেতে না চাইলে ভয় দেখিয়ে মা বলতেন, “তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও, নইলে রাতে ভূত এসে ধরে নিয়ে যাবে…” অথবা পুলিশ কিম্বা ডাকাত! আরও বড় হয়ে স্কুলে যখন গেলাম, তখন বিশেষত বড় ভাইয়েরা, পাড়ার মাস্তানেরা আরও কিছু ভয় দেখাতে শুরু করে, তাদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য। পরে সন্ধায় বাইরে গেলেই মনে হতো ভূত চলে আসবে (ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং) । আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না।
পাশ্চাত্য এক প্রবাদ বলছে, "একজন মানুষের মৃত্যুকে ভয় করা উচিত নয়, বরং সে যে তার বাঁচার মত করে একটি জীবন শুরু করতে পারছে না, সেটিতেই ভয় পাওয়া উচিৎ। আরও একটি প্রবাদ হলো: আমরা যা কিছুতে ভয় পাই তা এড়িয়ে চলি।
ভয় নিয়ে অনেক গল্প, উপন্যাস, হরোর সিনেমা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে আর অনেক মানুষ ভয় (মনে মনে ভাবুন মজা) পেতে ঐ বইগুলো পড়ছে, ঢুঁ মারছে সিনেমা থিয়েটারে। ভয় বিষয়ক আরও অন্যান্য ধরণের ব্যাখ্যায় আমরা যাব। শুধু একটি বাক্য বলে আমরা ভয়ের মনস্তাত্ত্বিক ও অন্যান্য অলি-গলি থেকে ঘুরে আসি। সেটি হলো, এই দূর্দিনে, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য কষ্টে পৃথিবীর মানুষ যখন ক্লিষ্ট, তখন কোন এক দেশের শীর্ষ নেতা বলছেন, “আমরা কিন্ত পরমাণু বোমা মেরে তোমাদের উড়িয়ে দেব!” এটি নিয়ে এখন শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ কি তাহলে শুরু হয়ে যাচ্ছে!
মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী ভয় একটি প্রাথমিক আবেগ যা আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করার (পালাবার) জন্য প্রকৃতি ডিজাইন (এভুলেশন) করেছে। কিন্তু, বিপদ থেকে রক্ষার বিষয়টি সত্য হলেও অতি ভয় আমাদের সুখ-শান্তিকে বিনাশ করার ক্ষমতা রাখে।
ভয় মাত্রই ভয়ঙ্কর
শুধু তাই নয়, ভয় আমাদের চিন্তা বা কাজকে অবশ করার ক্ষমতা রাখে। এটি আমাদের জীবনের লক্ষ্য অর্জন এবং পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে নানাবিধ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়। যে কাজ করলে আমাদের অর্জন সমৃদ্ধ হবে সে কাজের ঝুঁকি নিতে ভয় আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করে। এতে আমাদের সম্ভাবনা হারিয়ে যেতে পারে। ভয় বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত করে ফেলতে পারে। তাতে, মন ছোট কোন হুমকিকে আতশী কাঁচের নিচে রেখে বড় করে দেখাতে পারে। আর সম্ভাবনাময় সুযোগকে করতে পারে হেয়। আতঙ্ক যদি দূর না করা যায়, তাহলে এই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগ এবং জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসের অবক্ষয় ঘটাতে পারে, বিশেষত যখন আমরা ক্রমাগত ব্যর্থতা বা প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হই।
এই অতীব প্রাচীন অনুভূতিটি আত্ম-সন্দেহের একটি চক্র তৈরি করতে পারে যেটি কিনা আমাদের নতুন কোন সুযোগ নিতে দ্বিধান্বিত করে। এছাড়া ভয় বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। আমাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে সরে যেতে বা সমাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কাকে প্ররোচিত করতে পারে। এই বিচ্ছিন্নতা একাকীত্ব এবং হতাশার অনুভূতির দিকে আমাদের ঠেলে দেয়।
থমাস হ্যারিসের দ্য সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস (সিনেমার পরিচালক জোনাথন ডেম) ছায়াছবিতে একাধিক দৃশ্যে আমরা ভয়ে জর্জরিত হই! এই সাসপেনসফুল থ্রিলারটি অজানা ভয় এবং দানবীয় এক ভয়কে আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। সিনেমায় ক্লারিস স্টারলিং একজন তরুণ এফবিআই প্রশিক্ষণার্থী, যিনি একজন সিরিয়াল কিলারকে ধরার জন্য ভয়ঙ্কর হ্যানিবল লেক্টারের (এন্থনি হপকিন্স)-এর মুখোমুখি হন, যা ক্রমাগত দর্শকদের ভাল এবং মন্দের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।
মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: এই ক্লাসিক উপন্যাসটি অজানা নানা ভয় এবং চরম উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণতি তুলে ধরেছে। ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দ্বারা সৃষ্ট দানবটি অন্যের ভয়কে মূর্ত করে, যে ভয় আমরা উপলদ্ধি করতে পারি না। এখানে সৃষ্টির প্রতি একজন স্রষ্টার দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। ফ্রান্কেন্সটাইন তার সৃষ্ট প্রাণীটিকে আতঙ্ক এবং ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেন; ফলত ঐ সত্তাটি অনেক কষ্ট পায় এবং অবশেষে প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই জটিল সম্পর্কটি আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, অবহেলা বা প্রত্যাখ্যান করলে আমরা যা তৈরি/ আবিষ্কার করছি, তার লালন বা দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হলে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মূলত ক্ষমতা এবং জ্ঞানের জন্য মানবতার তৃষ্ণার নৈতিক এবং মানসিক পরিণতি সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। এটি পাঠকবর্গকে বইটি পড়বার সাথে সাথে এসংক্রান্ত দায়িত্ব, মানবতার প্রকৃতি এবং আমাদের সামাজিক বন্ধনের ভঙ্গুরতা বিবেচনা করার জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
ভয় সংক্রান্ত গভীর তত্ত্বটি অনেকটা কম আলোচিত হয়। পৃথিবীতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ভয় হলো মৃত্যভয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Thanatophobia। আমরা যখন সাপের বা বিচ্ছুর কামড়ের ভয় পাই, তখন আমরা মূলত অবচেতন মনে মৃত্যুকেই ভয় পাই। একইভাবে, কিছু মানুষ মাকড়ষা, টিকটিকি বা তেলাপোকা কাছাকাছি এলে ভীত হয়ে পড়েন। ভয় বা ফোবিয়া শব্দটিই এসেছে গ্রীক ফোবোস থেকে। গ্রীক পুরাণে ফোবোস মানে ভয়, আতঙ্ক আর তাঁকে বলা হতো ‘পালিয়ে যাওয়ার দেবতা।’ তাঁকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পথের দেবতা (যেন যোদ্ধা একজন মৃত্যু পথযাত্রী) হিসেবেও মানা হতো। মনোবিজ্ঞানের ফোবিয়া শব্দটির আদি সূত্র এই ফোবোস।
ভয় নয়, ভালোবাসা, বলছেন সূফী-সাধুগণ
এদিকে সাধু-সন্ত-আওলিয়াগণ বলছেন ভিন্ন কথা। সুফিবাদের কেন্দ্রীয় জায়গাটি হলো, বান্দা আল্লাহকে ভালোবাসবার আগে বান্দার প্রতি স্রষ্টার ভালবাসা বর্ষিত হয়। কারণ স্রষ্টার ভালবাসাকে বান্দাগণ/ মানবগণ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না কারণ সেই ভালবাসা অত্যন্ত তীব্র এবং গভীর শান্তিময়। সূফীবাদের ঐতিহ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, প্রেম স্রষ্টাকে জানার ও নৈকট্য লাভের একটি বড় উপায় (মাকামত)। পবিত্র কুরআনে ভয়ের কথা ১২৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর ভালোবাসার কথা উল্লেখ আছে ১৯০ বার (৭৯টি সুরায়, সূত্র Quora)। ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, লেখক এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা বলেছেন, আল্লাহর ভয় মানুষকে সকল ভয় হতে মুক্তি দেয়।
এদিকে, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে অভয় দিচ্ছেন শ্রী কৃষ্ণ। অর্জুন ব্যর্থ হবেন সেজন্য ভীত ছিলেন না। তিনি জানতেন, সকল প্রতিপক্ষের ওপর তিনিই জয়ী হবেন। তাঁর ভয় ছিল মনস্তাত্ত্বিক। কারণ, তাঁকে যুদ্ধে নিজের স্বজন, পরিচিতদের হত্যা করতে হবে। তাতে তিনি পাপিষ্ঠ হবেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে রক্তপাতের মাধ্যমে অর্জিত রাজ্য উপভোগের যোগ্য হবে না। কৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, যুদ্ধে যাঁরা মারা যাবেন তিনি (কৃষ্ণ) তাঁদের সকল কর্ম (পাপ) ক্ষয় করে দেবেন। ফলে, অর্জুনের চিন্তিত হবার কারণ নেই। এ নিয়ে হয়তো তর্ক হতে পারে। সেটি ভিন্ন এক আলোচনার বিষয়। কিন্তু অর্জুনের ভয়কে অস্বীকার করার উপায় নেই।
যোগবিজ্ঞান কি বলে?
যোগবিজ্ঞান বা বেদান্ত দর্শনে ভয়কে নিতান্তই মনের ঠুনকো এক সৃষ্টি হিসেবে দেখা হয়। শুধু বেদান্ত দর্শন নয়, বৌদ্ধ দর্শন, তিব্বতীয় দর্শন, কাশ্মিরী শৈব (শিব সংক্রান্ত) ও জেন দর্শন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মানুষ তার ঘনিষ্টজন থেকে বিচ্ছিন্ন (মৃত্যু কিম্বা বিচ্ছেদের মাধ্যমে হারানোর ভয়) হতে পারে, অথবা তার সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ নাও হতে পারে, সেটিই মানব মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। ভয়কে আসক্তি (Attachment) বা জাগতিক ভালবাসা এবং বিদ্বেষ (Detachment)-এর সম্প্রসারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই বিষয়টিই মনকে দ্বৈত (আমি এবং ঈশ্বর ভিন্ন সত্তা) করে রাখে এবং ব্যক্তির মুক্তিকে (Liberation/ Nirvana) বাধা দেয়।
যার মধ্যে জাগতিক আকাঙ্ক্ষা নেই, যিনি জানেন আত্মা অমর, যিনি পরমাত্মাকে সাধনার মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন, তাঁর কোন ভয় নেই। তাঁর মধ্যে আছে চিরন্তন, গভীর একটি প্রশান্তি যে কারণে একজন সিদ্ধ ব্যক্তি সবসময় সচ্চিদ্দানন্দ, সদাই ঈশ্বরময়!