দুর্ভাগ্যবশতঃ ভাস্কর্যের রাজনীতি আজও, এই স্বাধীন বাংলাদেশেও বন্ধ হয়নি।
Published : 29 Mar 2024, 09:27 PM
তিনি অবিস্মরণীয় কিন্তু তার স্মৃতি ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলতে চায় তার জন্মভূমি। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হাজারো মিথ আর ছড়ানো হয়েছে সহস্র মিথ্যা। কিন্তু মিথ আর মিথ্যা খন্ডনে তার নির্লিপ্ততা দেখে তাকে আলবেয়ার কামুর উপন্যাস থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র বলে মনে হয়। তিনি নভেরা আহমেদ, বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত, ক্ষণজন্মা এক ভাস্কর। আজ তার জন্মদিন।
ঔপনিবেশিক ভারতের রক্ষণশীল সমাজে জন্ম নভেরা আহমেদের। কিন্তু তুমুল প্রতিভাবান এবং ক্ষুরধার ব্যক্তিত্বের অধিকারী নভেরা সমাজের চেয়ে দু কদম আগে হেঁটেছেন সবসময়। কিন্তু বাংলামায়ের এই গুণী কন্যাকে স্বীকৃতি এবং সম্মান দিতে বরাবরই কার্পণ্য করেছে রাষ্ট্র। চার দশক ধরে নভেরার ভাস্কর্যগুলো এখানে ওখানে অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট তো হয়েছেই, তাকে বঞ্চিত করার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি হলেও আজ পর্যন্ত স্থপতির স্বীকৃতি না দেওয়া।
একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। বিলাত থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছেন নভেরা আহমেদ। তার পরপরই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার সময় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কেন্দ্রের নানাবিধ অসহযোগিতার কারণে কোনো প্রকাশ্য টেন্ডার ছাড়াই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ব্যক্তিগত আহবানে শহীদ মিনারের নকশা করতে শুরু করে ভাস্কর নভেরা আহমেদ এবং শিল্পী হামিদুর রহমান। তদানীন্তন সরকারের স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাঁ দেলোরার ওপরে ভার ছিল এই কাজের তদারকি করা। আনা ইসলাম তার নভেরা: বিভুঁইয়ে স্বভূমে বইতে দলিল সহকারে নভেরা ইসলামের শহীদ মিনার সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রাথমিকভাবে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং মূল নকশায় ফোয়ারা, একাধিক ভাস্কর্য ইত্যাদি অন্তর্ভূক্ত ছিল। ধীরে ধীরে মিনারের ভিত মঞ্চ ও কয়েকটি স্তম্ভ, রেলিং, পায়ের ছাপ, ম্যুরালের কিছু কাজ এবং নভেরা আহমদের তিনটি ভাস্কর্যের কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনার তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী মূল নকশায় বহুলাংশে পরিবর্তন এনে দ্রুত শহীদ মিনারের কাজ শেষ করা হয়। এই পরিবর্তনে বাদ পড়ে যায় নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য। ভাস্কর্য বাদ পড়ার কারণ হিসেবে ধর্মীয় অনুভূতি, অর্থাভাব ইত্যাদি অস্বস্তিকর কিছু কারণ উঠে আসে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ ভাস্কর্যের রাজনীতি আজও, এই স্বাধীন বাংলাদেশেও বন্ধ হয়নি। ধোলাইপাড় মোড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে গ্রিক দেবী থেমিসের ভাস্কর্য- বারেবারে ভাস্কর্য ভাঙার হুংকার দিয়েছে এক শ্রেণির ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। জোট সরকারের শাসনামলে জামাতের এমপি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ভিন্ন ধর্মালম্বীদের উপাসনার মূর্তি ছাড়া সকল "মূর্তি" ভেঙে ফেলা হবে। ভাস্কর্য তথা শিল্প তৎকালীন পাকিস্তানেও প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে কালচার ওয়ারের একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল এবং এখনো আছে। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্রের জন্য এ বাস্তবতা সত্যিই লজ্জার। খোদ শহীদ মিনারও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি এবং বিরুদ্ধ শক্তির মধ্যে সাংস্কৃতিক যুদ্ধের একটি অস্ত্র। যেহেতু শহীদ মিনার বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনার প্রতীকস্বরূপ, একে "দখলে" নিয়ে আসার আগ্রহ এবং প্রয়োজনীয়তা প্রায়ই ব্যক্ত করে থাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি।
ভাস্কর নভেরা আহমেদের ভাস্কর্যও এই প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনীতিতে শহীদ মিনারে আর ঠাই পায়নি। আরও যে ভয়াবহ ব্যাপারটি ঘটেছে, শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে পুরোপুরি মুছে দেওয়া হয়েছে নভেরা আহমেদের নাম। এখন আমরা কেবল হামিদুর রহমানের নামটিই জানি।
অধ্যাপক লালা রুখ সেলিমের মতে, সমাজের চিরন্তন পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার হয়েছেন নভেরা আহমেদ। নভেরার অনুপস্থিতিতে তার সৃষ্টি কিংবা ভাস্কর্য নিয়ে তার সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে যে আশ্চর্য নীরবতা দেখা গেছে তা দেখে লালা রুখের সঙ্গে একমত না হয়ে পারা যায় না। একজন নারীকে দেশের আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে মেনে নিতে হয়তো কারো কারো ভালো লাগেনি। আর পাকিস্তান আমলে, ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশে শহীদ মিনারের মতো স্পর্শকাতর স্থাপনায় একজন নারী ভাস্করের নামকে আদর্শিক কারণেই ঝামেলাপূর্ণ মনে করেছিল প্রশাসন।
অধ্যাপক লালা রুখের বক্তব্য থেকে জানা যায়, সৃষ্টিকর্মের অর্থনৈতিক মূল্য না পাওয়াও একটি বড় কারণ নভেরার দেশত্যাগের। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ভাস্কর্য কেনার মতো কোনো শিল্পবোদ্ধা ছিলেন না। তাই প্রথমে তিনি লাহোরে চলে যান এবং সেখানেও তার শিল্পকর্মের পর্যাপ্ত মূল্য না পেয়ে সবশেষে শিল্পনগরী প্যারিসে পারি জমান। সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন তিনি। উপমহাদেশে শিল্পের চিরাচরিত কিন্তু অসহনীয় অবমূল্যায়নের এক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এটি।
নভেরা আহমেদের স্বেচ্ছা নির্বাসনের কারণ কেউই স্পষ্টভাবে বলতে পারেন না। তিনি নিজেও কাউকে বলে যাননি, ঠিক কী কারণে তিনি মাতৃভূমি থেকে দূরে ছিলেন। শুধু দূরেই নয়, রীতিমতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তরালে ছিলেন। অনেকে বলেন, দমবন্ধ সামরিক শাসন, রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় একজন স্বাধীনচেতা, দুঃসাহসী নারী হিসেবে মানিয়ে নিতে পারেননি তিনি। অনেকের ধারণা, শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়াই তার সবচেয়ে বড় ক্ষোভ। আবার অনেকের মতে, কোনো ব্যক্তিগত হিসাব-নিকাশ নভেরাকে স্বদেশ বিমুখ করেছে।
আমার অবশ্য তার নিরাসক্ত, সংশ্রবশূন্য মানসিকতা ও আচরণে আরেকটা কথা মনে হয়েছে যে তিনি বুদ্ধের শূন্যবাদ চর্চা করেছেন। বুদ্ধের দর্শন অত্যন্ত পছন্দ করতেন নভেরা, তার ঘনিষ্ঠজনেরা এমনই সাক্ষী দেন। আর শূন্যবাদ হলো বৌদ্ধ দর্শনের গভীরতম সিদ্ধান্ত। নভেরা আহমেদের মধ্যেও শূন্যবাদের মনোভাব প্রবেশ করেছিল এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে বাস্তবে তিনি কোন অভিমানে দেশ থেকে দূরে ছিলেন কিংবা আদৌ তার কোনো অভিমান ছিল কি না তা এখন আর জানবার কোনো উপায় নেই।
১৯৯৭ সালে সরকার নভেরাকে একুশে পদক প্রদান করে কিন্তু নভেরা সে পদক গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে পদক গ্রহণে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেন। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তা আর সম্ভব হয়নি। নভেরা আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর নিকট মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে বিশাল একটি ভাস্কর্য তৈরির স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন। নভেরার মৃত্যুতে সে সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু লক্ষ্যণীয়, এত নিস্পৃহতার মধ্যেও শিল্পীর দেশপ্রেম এবং রাজনৈতিক কর্তব্য সম্পর্কে বিস্মৃত হননি তিনি।
গুণী এই মানুষের জন্মদিনে নৈবেদ্য নিবেদন করবো সেই দুঃসাহস নেই। কারণ আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র তার কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি। এমন অবস্থায় নৈবেদ্য শোভা পায় না, রাষ্ট্রের কাছে শুধু আকুল আবেদন জানানো যায়, নভেরা আহমেদকে শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিন, তার সৃষ্টিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করুন।