Published : 24 Oct 2010, 04:30 PM
ভগ্নদশা পৈত্রিক ভিটেয় লেখক
মাঝরাতে একটু শীত-শীত লাগছিল। উঠে ফ্যান বন্ধ করে পায়ের কাছে রাখা নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে শরীরের মধ্যদেশে চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার। ভোরে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে বাইরে থেকে দরজার পাল্লা টেনে চাপিয়ে রেখে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছি। শান্তিকেন্দ্রে রাত্রিবাস করলে এটা আমি উপরি পাওনার মত উপভোগ করি। সেই ১৯৮৯ থেকে চান্দাবিলে আসা যাওয়ার সুবাদে গণউন্নয়ন প্রচেষ্টা-র এই বিশ্রাম আখড়ায় বহুবার উঠেছি। কোনদিন কিছু খারাপ লাগেনি আজ পর্যন্ত। বিশেষ করে, এরকম কুয়াশা জড়ানো ভোরে শান্তিকেন্দ্রের বিভিন্ন সরণি ধরে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ আমি পারতপক্ষে মিস করিনি কখনো। দু'পাশের ঘাসজমি সারারাত শিশিরে স্নান করেছে।
মোরাম বিছানো পথে হাঁটতে-হাঁটতে পেরিয়ে গেলাম ওপন-এয়ার মাদ্রাসা, টোল আর বাইবেল পাঠচক্রের আসর। গত দশ বছরে এর ব্যতিক্রম দেখিনি। ভোরে হাঁটতে বেরলে চোখে পড়ে, বিস্তীর্ণ পার্কের মাঝে-মাঝে খানিকটা করে জমি শানবাঁধানো, ওপরে কংক্রিটের গোল ছাতা আর নিচে ছাতার ডাঁটি ঘিরে পাকা বসার বেঞ্চির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওরই এক-একটির নিচে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠের চর্চা চলেছে। পরম শান্তিময় পরিবেশ। এই সময়ে এখানে যার সঙ্গেই আপনার দেখা হোক, আপনি তাকে হাসিমুখে অভিবাদন জানাবেন, সে-ও প্রত্যুত্তরে সালাম, নমস্কার যে-যার মতো জানাবে।
………
মধুমতি বিল রুট ক্যানেল (এমবআরসি)
………
পুরো এলাকায় গোটা দুই চক্কর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে এক টংঘরের সামনে বসে চা খেলাম। সঙ্গে নোনতা বিস্কুট। দোকানদারের সঙ্গী ছেলেটা কাঠের বারকোশে আটা মাখছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, গরম পরোটার সঙ্গে ছোলার ডাল খুব খায় এখানে। ওর বৌ বাড়ি থেকে নারকোল কুচি দিয়ে ডাল রান্না করে এক্ষুনি দিয়ে যাবে। পাশেই বাড়ি। আমি বলি, ডিম ভেজে দিতে পারবে? খুব পারব, দেশি খাবেন না ফার্মের? আমি নিশ্চিন্ত হয়ে জানালাম, ও যেটা খুশি দিও। দু'রকম মিশিয়েও দিতে পার। তবে পরোটা একটু লালচে ভাজা হবে, বেশ শুকনো-শুকনো আর খাস্তা, তার সঙ্গে ডিমভাজাও অমনি। পারবে না? খু-উ-ব, সে সোৎসাহে এ্যাসিসট্যান্টকে বলে, পরোটা একটা করে নামিয়েই একটু উস্তম-খুস্তম করে ঠোঙায় ভরে ফেলবি, বুঝলি? তা কতগুলো করে কী দেব, সার? আমি বাদলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি টিফিন ক্যারিয়ারশুদ্ধ। এই ধর আমরা চারজন, ড্রাইভার আর বাদল—ছ'জনের মতো খাবার দিয়ে দিও, বলে উঠে পড়ি।
দূর থেকেই দেখা গেল, রুবি, রুবাই, সাজ্জাদ বারান্দায় মিষ্টি রোদে চেয়ারে বসে দাঁত ব্রাশ করছে। এই যে বলি আমি—রাতে শোবার আগে আর সকালে ব্রেইকফাস্টের পর দাঁত মাজবে। তা কে শোনে কার কথা? সবাইকে সুপ্রভাত জানিয়ে আমি স্নানে ঢোকার আগে কেয়ারটেকার বাদলকে ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ আর টাকা বুঝিয়ে দিলাম। স্নান সেরে বেরিয়ে ইনসুলিন নিয়ে ওদের তাড়া দিলাম। চল রুবি, ছেলেমেয়েকে ডেকে নাও, কোথাও যেতে হলে যত সকাল-সকাল বেরোবে, ততই মঙ্গল। বাদল এতক্ষণে তোমাদের নাশতা এনে টেবিল সাজাচ্ছে। ঠিক তাই। বারান্দায় বেরোতেই দেখি, বাদল এদিকে আসছে। আমি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলাম। এসে গেছি আমরাও, বলে আমি সিঁড়ি বেয়ে নিচে পাথওয়েতে পা দিলাম। খাবার ঘরে যাবার পথে ড্রাইভার সেলিমকে ডাকলাম। পুকুরে দু'টো ডুব দিয়ে সে আসছে এক্ষুনি, বাদল হেসে জানাল, ওই টলটলে জল দেখে আর স্নানঘরে ঢুকল না।
আমি খেতে শুরু করেছি। বাঁ হাতের মুঠোয় দু'টো বড়ি। মুচমুচে পরোটা ছিঁড়ে লালচে ভাজা ওমলেটের প্রান্ত ভেঙে পরোটায় মুড়ে নিয়ে ছোলার ডালের ঘন ঝোলে একটু ডুবিয়ে মুখে তুলি। নারকোলের ছোট্ট ফালি কাঁটায় গেঁথে তুলে সেটিও মুখে চালান করে দিই। তারপর চোখ বুঁজে চর্বণ। আহা, সে যে কী রসায়ন! বাদলদা আমার খাওয়া দেখে আর হেসে হেসে সবাইকে সাদরে ডেকে বসায়, খাবার তুলে দেয় প্লেইটে আর বলে, দাদারে খাইতে দিয়াও সুখ। সব মানুষে খাওয়া-দাওয়ার মর্ম বোঝে না ম্যাডাম। রুবির প্লেইটে একফালি নারকোল তুলে দেয় সে। ভাল করে খান, দাদার মতো, আবার কখন ভগবান খাওয়া কপালে রাখছে, তা কে জানে? ওর কথাবার্তা শুনে আর আমার রসিয়ে খাওয়া দেখে স্ত্রী, মেয়ে, জামাই আর সেলিম ড্রাইভার নিঃশব্দে হাসে। বাদলদা, তুমি আমাদের সঙ্গে বসে গেলে পারতে… আমার কথা শেষ না হতেই ওর জিব কাটা, দু'হাত জোড় করে কপালে ঠেকানো এবং ত্বরিত জবাব, আগে দ্যাব্তারে ভোগ দ্যাওয়া হোক, তারপর আমি বাড়ি যাইয়ে স্নান করবো, খাব।
নাশতা হল। চা-পান সেরে উঠতে-উঠতে সবাই খাস্তা পরোটা আর ছোলার ডালের প্রশংসা করতে লাগল। বাদলকে ধন্যবাদ জানালে সে আবার জোড়াহাত কপালে ঠেকায় আর বলে, সবই দাদার বরাত আর ওই পরিমলের হাতযশ। আমি তো ক্যাবল ক্যারিয়ার। এবারে সবাই কোরাসে হাসি। ঘরে ফিরে পোশাক বদলাতে বদলাতে বাদল এল রেজিস্টার নিয়ে। সব বিবরণ পূরণ করে, বিল মিটিয়ে আমরা যার-যার ট্রলিব্যাগ তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। শান্তিকেন্দ্র থেকে যতবার বিদায় নিয়েছি, মন খারাপ হয়েছে। জায়গাটা, বাদল আর ওই অতুলনীয় সরল প্রাকৃতিক পরিবেশ মিলে না জানি কোন যাদুবলে যে কোন হৃদয়বান মানুষের মনের কোণে জায়গা করে নেয়।
সেলিম মাদারিপুর-কোটালিপাড়া-ঢাকা-খুলনা ইন্টারসেকশ্যনে এসে জিজ্ঞেস করে, এবার কোন দিকে, সার? চল, ঐ গতকাল যে পথে এসেছি, সেপথেই ফিরে চল। বলে আমি একটা সিগ্রেট ধরাই। তামাকপোড়া ধোঁয়া যদ্দূর সম্ভব গ্রামবাংলার অক্সিজেনসমৃদ্ধ হেমন্ত আবহে নিষ্কাশিত করি। খানিক পরেই ফরিদপুর শহর থেকে সিরাজ মামা দূরভাষে খবর করেন, বাবু, আমি গোয়ালচামট এরিয়াতে হাইওয়ের পাশেই মোল্লাবাড়ি সড়কের মাথায় থাকব। তোমার আর কতক্ষণ লাগবে? এই তো মিনিট ত্রিশেক মতো—আমি বলি—মামা, এখন তো চৌগাছি যাব, আজ না হয় আপনার বাড়ি না গেলাম! হাঁ-হাঁ করে উঠলেন মামা, হতেই পারে না, কাল রাত থেকেই তোমার মামী আর আমার ঘুম নেই। আর তুমি তো যাবে আমার বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটে হাইওয়ের যে পয়েন্টে পৌঁছনো যায়, তা ছুঁয়ে—তাহলে আর এখানটা হয়ে যেতে বাধা কোথায়? মামার সরল প্রশ্নের উত্তরে আমিও সত্যি কথাটি বলি, কোন অসুবিধে নেই, এই রুবি যা-একটু গাঁইগুই করছে কেন জানি না… ওর সাথে কথা বলেন আপনি… ফোন ধরিয়ে দিই রুবির হাতে। আমার ধূমপানের বারোটা…।
ফরিদপুর শহরে ঢুকতে এক বিশাল হোর্ডিং মহাসড়কের এধার-ওধার বেড় দিয়ে। সেই বেড়জালের মতো বিজ্ঞাপন সোচ্চারে জানান দিচ্ছে—বাঘাটের অমুক ঘোষের অতুলনীয় মিষ্টির স্বাদ নিতে হলে সামনের মোড় থেকে ডাইনে ভেতরে ঢুকে যান—ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশদ পথনির্দেশ। আমরা সেকথা কানে না তুলে মহাসড়ক ধরে চলে লাক্সারি হোটেল বরাবর সেলিমকে গাড়ি রাখতে বল্লাম। বাঁদিকে মোল্লাবাড়ি রোডের মাথায় মামা দাঁড়িয়ে। চল্লিশ বছর আগে যেমন দেখেছি সিলেটে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ত্রিশ বছর আগে সাতক্ষীরায়—তখনো বাটায় কাজ করতেন—তেমনি স্মার্টলি টার্নড্ আউট—জুতোর পালিশ ঝকঝকে, শার্টের ইস্ত্রির ভাঁজ স্পষ্ট, চোখে রোদচশমা। উল্লসিত হয়ে রুবির মনোযোগ আকর্ষণ করি সেদিকে। রুবাই, সাজ্জাদ মৃদু হাসে। ওরা আমাদের এই মামা-ভাগ্নের রি-ইউনিয়ন রীতিমতো উপভোগ করছে। সবাই নেমে পড়ি। মামার সাথে কোলাকুলি সেরে আমি মোড়ের দোকানে ঢুকি। লাক্সারি হোটেলের প্যাস্ট্রিশপ সেটি। তাজা ভেজিটেবল স্প্রিং রোল আর চিকেন প্যাটি নিলাম। তারপর মামার পিছনে আমরা সিঙ্গল ফাইলে মার্চ করে মোল্লাবাড়ি সড়ক ধরে এগোলাম। একটু হেঁটে ডাইনে ঘুরতে মসজিদ দেখা গেল। তার পাশের প্রাইভেট লেইনে দশ পা হাঁটতেই বাঁ পাশে মনজিল—কাজী কুটির—সবুজে ঘেরা সুন্দর দোতলা বাড়ি।
নিচে একঘর ভদ্রলোক ভাড়াটে থাকেন, মামা জানালেন, আমরা দোতলায়। বাহ্, মামা, আলিশান দোতলা বাড়ি করেছেন, কিন্তু নামটি দিলেন 'কুটির'! অভিনন্দন জানাই মামাকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে। দরজা আলো করে মামীর হাসিমুখ। কাজীবাড়ির বৌঝিরা প্রায় সবাই পহ্লে দর্শনধারী (বা'দমে গুণ বিচারি)। হাসি মামী তার ব্যতিক্রম নন। জমিয়ে বসে ঘণ্টাখানেকের আড্ডা হল। এবাড়ির স্নানঘর পছন্দ হওয়ায় রুবাই গা ধুয়ে নিল। মামার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এই শহরেই আমার বোন-ভগ্নিপতির বাস। মামাতো ভাইটি এক বীমা কোম্পানিতে কাজ করে। বাইরের ঘরে একবার উঁকি দিয়ে পালাল সে। ও একটু লাজুক, মামী জানালেন, তোমাদের তো কোনদিন আগে দ্যাখেনি! আর আপনি? আমাদের সঙ্গে তো আপনারও এই প্রথম দেখা, রুবির অকৃত্রিম বিস্ময় ঝরানো প্রশ্ন মামী হেলায় পাশ কাটালেন। বাবুর গল্প তোমাদের মামার মুখে সেই বিয়ের পর থেকে শুনে আসছি! এই দেখা না হলেও আমি তোমাদের সম্পর্কে বিস্তর গল্প অন্যদের অনায়াসে শুনিয়ে দিতে পারতাম!
যেমন দেবা, তেমনি দেবী দেখছি, মনে মনে বলি। ফটো সেশন হল বেশ বিস্তারিতভাবে, নানা কম্বিনেশ্যনে। মামা উৎফুল্ল হয়ে উৎসাহ দেন রুবাইকে, দাদিআম্মার ক্যামেরা দেখছি ডিজিট্যল! অ্যাঁ? তোল, তোল, আমাদের মামা-ভাগ্নের ছবি আগে তোল, হিসেব করে তো আর তুলতে হবে না! ডিজিট্যল বাংলাদেশ তো তোমাদেরই গড়ে নিতে হবে, না কি বল? আমাদের নাতজামাই তো শুনলাম ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার, অ্যাঁ? সোনায় সোহাগা বলে একেই, নাকি বল, হাসি? বলে জলখাবার পরিবেশনে ব্যস্ত মামীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। মামী মামার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে টেবিল সাজান আর রুবিকে বলেন, তোমাদের মামার আর পরিবর্তন দেখলাম না কোন। এতগুলো বছর গেল, আমার বিয়ে হয়েছে, একবার তো আমেরিকা গেলেন ভাগ্য ফেরাতে। তো ফিরে এলেন আবার বছর না ঘুরতেই। কেন, কেন? রুবির ঔৎসুক্যে জল ঢেলে দেন মামা, দূর। ওদেশে মানুষ থাকে? তারচে আমার এই নিরিবিলি সবুজ বাড়ি কাজী কুটিরের আশ্রয় অনেক নিশ্চিন্তির না? আর ওখানে সব যা-তা কাজ করতে বলে, বুঝেছ? আমার তো কোন টেকনিক্যাল কাজ জানা নেই, কাজেই…।
অনেক বলে-কয়ে, চৌগাছি গিয়ে লাঞ্চ খাবার কথা—এইসব গপ্পো কপ্চে মামার কাছ থেকে ছাড়া পেলাম। অবশ্য কড়ার করতে হল, সামনে বাঘাট বাজারে রাজকুমার ঘোষের দোকান থেকে মিষ্টি নেব, তারপর হাইওয়ের পাশে দুলাখালার বড়ছেলে ছোটবাবুর বাড়িটা দেখে, কামারখালিতে কমলমামার সঙ্গে চোখের দেখা সেরে যাব। সিরাজ মামাদের বাড়ি কামারখালির একটু আগে—মসলন্দপুর। আমার নানির কাজিন ডাক্তার নানার বাড়ি কামারখালিতে। আরো কত যে আত্মীয় এপথের দু'পাশে! এক ফরিদপুর শহরেই কতজনা—সিরাজ মামার ছোটবোন শীলাখালাদের পাড়ায় অর্ধেক বাড়িই নাকি আমাদের আত্মীয়Ñকুটুম্বদের, মামা জানালেন—এবং এর পরের বার কমপক্ষে সাতদিনের জন্য কাজী কুটিরে আতিথ্য নিলেই কেবল সেসবের হিল্লে-হদিস করা যাবে—এও জানিয়ে দিয়েছেন। গাড়ি ছুটেছে বেগে—অবশ্য রাস্তা ফাঁকা। অন্যমনস্ক হয়েছিলাম ক্ষণেকের জন্য। গাড়ির গতি কমে আসছে বুঝতে পেরে সামনে দৃষ্টি মেলে দিলাম। হাইওয়েতে যদ্দূর সোজা দেখা যায়, অন্ততঃ পঞ্চাশটা থেমে থাকা গাড়ির লম্বা কিউ, তারপর রাস্তা বাঁক নিয়েছে, গাড়ির মিছিলও ডানে ঘুরেছে।
সেলিম গাড়ি দাঁড় করালে নেমে খোঁজ-খবর করে জানা গেল, সামনে কিলোমিটার খানেক পরেই বাঘাট বাজার। ওখানে আজ সকালে একটি স্কুলছাত্র গাড়ি চাপা পড়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ হয়ে আধঘণ্টা হল মহাসড়ক বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যস্ত বাজারের সামনে আজ নিয়ে গত সাতদিনে নাকি তিনজন বাসচাপা পড়েছে। ফরিদপুর থেকে ডিসি, এসপি আসছেন। স্থানীয় সাংসদ এই সড়ক বন্ধ্ সমস্যার কোন সমাধান এখনো করে উঠতে পারেননি। আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি বিডিনিউজের ফরিদপুর সংবাদদাতাকে ফোন করে জানলাম, সেও বাঘাট বাজারেই আছে। করিৎকর্মা ছেলে, কর্তব্যে অবহেলা নেই। মফস্বলের অনেক ছেলেমেয়েকেই দেখেছি, শুদ্ধ খবরের নেশায় ওরা চব্বিশ ঘণ্টা ঘরের খেয়ে পরের ভেড়া চরিয়ে বেড়ায়।
সাজ্জাদও নেমেছে গাড়ি থেকে। খবরের কাগজে এরকম দুর্ঘটনার পর সড়ক অবরোধের বিষয়টা সকলেরই জানা। আমি নিজেও প্রায়ই দুর্ঘটনার সংবাদ লিখে হয়তো সকালে পোস্ট করি বিডিনিউজের সাইটে আর দিনভর আপডেইট দিতে থাকি। বাস্তব অভিজ্ঞতা কেবল নিজে রাস্তায় বেরলে হয়। এই হাইওয়েতে আগে আমি ট্র্যাভেল করিনি, সাজ্জাদ বলে উঠল, লক্ষ্য করলাম, দু'দিকে অনেক রাস্তা বেরিয়ে গেছে। এর কোনটা ধরে কি আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে ঘুরে সামনে কোথাও গিয়ে উঠতে পারি না? খুশি হলাম ছেলের কথা শুনে। তাই তো! এ তো আমার চেনা জায়গা। কমলমামাকে ফোন করলাম। মামা বললেন, বাজারের একটু আগে ডাইনে একটা খোয়াবাঁধানো পথ নেমেছে। ওটা হাইওয়ের সমান্তরালে চলে প্রায় আমাদের বাড়ি ছুঁেয় আবার বাঁয়ে ঘুরে গড়াই সেতুর আগে তোর যশোর রোডে পড়েছে। তুই ওখানে একটু এদিক-ওদিক খোঁজ নিয়ে চুপচাপ ওই রাস্তায় নেমে চলে আয় এখানে। আমি মসজিদে যাচ্ছি। বাড়ি তো চিনিস্, নাকি? নিশ্চয়, থ্যাঙ্ক ইউ মামা, বলে ফোন কেটে দিয়ে সেলিমকে সব জানালাম। অতঃপর গাড়িতে উঠে নিশ্চিন্তে ঢাকা থেকে আনা কাগজ পড়তে শুরু করলাম।
সেলিম চালাক-চতুর ছেলে। রাস্তার হদিস জেনে এসে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে, ঘোরানোর ভঙ্গি করে উল্টো পথে পঞ্চাশ গজ গিয়ে বাঁয়ে নেমে গেল। আমরা যেখানে থেমেছিলাম, সেখান থেকে ফরিদপুরের দিকেও তখন থেমে থাকা যানবাহনের সুদীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। আস্তে আস্তে চালাও, সেলিম, হর্ন বাজাও, বাচ্চা-বুড়ো-গরুছাগল… সাবধান। কোন দুর্ঘটনা ঘটুক, আমি চাই না। শক্ত কথা শুনে সেলিম একবার আমার দিকে তাকিয়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তাটা দেখল, তারপর চট্পট বলল, রাইট স্যর। বাঁয়ে ঘোরার পর পথ মোটামুটি সোজা চলেছে। ফসলের মাঠ, প্রাইমারি স্কুল, বসতি পেরিয়ে যাচ্ছি। পথে যে দু-চারজন মানুষের দেখা মিলল, তারা কেউ কেউ হর্ন শুনে পাশে সরে গিয়ে অবাক হয়ে আমাদের বাহনটি দেখতে লাগল। আমি দু'একজন প্রবীণ মানুষকে জিজ্ঞেস করে পথনির্দেশ বিষয়ে নিশ্চিত হলাম। কোথাও কোথাও খালপাড়ে রাস্তা বেশ সরু। সেসব জায়গায় গ্রামবাসীর বাড়ির উঠোন ছুঁয়েই আমরা যাচ্ছি। মিনিট পঁচিশ চলে রাস্তা আবার বাঁয়ে উঠে মহাসড়কে পড়ল। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
রুবি সরলমনে, নাকি ক্ষিদে পেয়ে যাওয়ায়, শুধোয়, আচ্ছা, তোমার কমলমামা অপেক্ষা করে থাকবেন না? রুবাই হেসে উঠে বলে দিল আমার হয়ে, আবার জিগায়…। সেলিমশুদ্ধ সবাই হো হো হাসলাম। জীবনে এই একবারই সড়ক অবরোধে আট্কা পড়ার আগেই কেমন বেরিয়ে এলাম, বল? বলে আমি আবার হাসি। সেলিমও খুশির চোটে ভোঁ ভোঁ গাড়ি চালিয়ে কখন যে গড়াই সেতু পেরিয়ে অনেকদূর চলে এল, তেমনভাবে কেউই লক্ষ্য করিনি। এ ব্যাপারে আমারই সবার আগে সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল, যেহেতু বয়স বৃদ্ধকাল হওয়া সত্ত্বেও আমি পরিবারের অবিসংবাদিক চালক, দিকনির্দেশক। সে যাক্গে। সেলিম গাড়ির গতি কমিয়ে ডাইনে একটা সরু পাকা রাস্তার মাথায় থেমেছে। আমি নেমে দোকানদারদের দু'জনকে পরপর জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম, গড়াইয়ের এপাড় ঘেঁষে যাওয়া গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের যে বাঁধরাস্তা আমি খুঁজছি, তা' কয়েক কিলোমিটার পেছনে ফেলে এসেছি। অবশ্য, সামনের সরু রাস্তায় যেমন, আরও এমন ক'টা পাকা রাস্তার যে কোন একটা ধরে গেলে আমাদের গন্তব্য চৌগাছি পৌঁছতে পারব। তবে এগুলি সবই একটু ঘুরপথ বটে।
বলা হয়নি, চৌগাছি থেকে এরিমধ্যে মেজমামার ফোন পেয়েছি। জানিয়েছি, আমাদের জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমরা পৌঁছে যাব ঠিকই এবং যা রান্না হয়েছে, তার সবই খাব। বেলা গড়ালেও কারো তেমন ক্ষিদে পায়নি এখনো, কারণ মাদারিপুরে ভারি ব্রেইকফাস্টের পর ফরিদপুরে মামার বাড়িতে যে জলযোগ হয়েছে, সেও নেহাত হেলাফেলার নয়, এখনো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তা অচেনা, কিন্তু জায়গাগুলোর নাম ছেলেবেলা থেকে আমার চেনা। আলোকদিয়া, পুখরিয়া, বরিষাট, নাকোল, রাধানগর—সবই নানাবাড়ির সূত্রে সব আত্মীয়স্বজনের বসবাসের পীঠ জানি। রাস্তা পাকা হওয়ায় এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন অর্থাৎ নগরায়ন ঘটেছে। বহু পাকা বাড়ির দেখা মিলল—ছাদে সেই পুরনো দিনের টিভি এ্যান্টেনা, ছোট ছোট ফুলবাগান শোভিত, বড় বড় পুকুরওয়ালা, মাঝারি আকারের সব বাড়ি… মূল্যবান কাঠের গাছের বাগিচা…। নোয়াখালির ছেলে সেলিম বলছিল, গ্রামের মধ্যে দিয়া, এ্যাত সুন্দর পাকা রাস্তায় আমি আগে আর গাড়ি চালাই নাই। খুব ভাল্লাগতাছে আমার।
রাধানগর বাজারে নেমে ঘোষের দোকান থেকে চার-পাঁচ রকমের ছানার মিষ্টি ও গরম তেলেভাজা নিলাম। সব মিলিয়ে দাম হল চারশ' আশি টাকা। সাজ্জাদ বাজার দেখতে গাড়ি থেকে নেমেছিল। বিস্ময় প্রকাশ করল নিচুস্বরে, আনবিলিভ্যাবলি লৌ প্রাইসড্ মিষ্টি! খেয়ে দেখলাম, খাঁটি ছানার মিষ্টিই বটে!
ছাঁচিলাপুর বাজারের মধ্য দিয়ে রাস্তা। হাটবার হওয়ায় খুব সাবধানে ধৈর্য্য ধরে বাজার এলাকা পার হতে হল। শুকিয়ে যাওয়া এককালের নামডাকের হানু গাঙের ওপরে সেতু। পেরিয়ে বাঁয়ে চৌগাছির রাস্তা। সোজা চলে যাও, রাস্তা যেখানে প্রথম বাঁয়ে ঘুরবে, সেটাই চৌগাছি গ্রাম। ডাইনে কুঠিবাড়ি হাইস্কুলের দোতলা দালান। আমার মা, খালা, মামারা সবাই এখানকার পড়ুয়া ছিলেন। অন্তত প্রাইমারি পর্যায়ে। পঞ্চাশ বছর আগে আমার বাল্যকালে এটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। নানাবাড়ির পড়শি সোকন ভাই তখন এখানে পড়াতেন। স্কুলের পর সেই শতায়ু বটবৃক্ষ। অসংখ্য ঝুরি নেমে তার প্রায় বিঘে দুই জায়গা প্রায় আঁধার করে রেখেছে। তারপর সেই কুঠিবাড়ি—নীলকর সাহেবদের আস্তানা, পরে যেখানে জমিদার অমূল্যচরণ মুনশির বাড়ি, কাচারি ও ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমি পঞ্চাশ বছর আগেকার স্মৃতি রোমন্থন করছি প্রায় স্বয়ংক্রিয় ভাবে—এমন সময় পেছন থেকে রুবি বলে উঠল, সেলিম, ওই ছোট কালভার্টটা পার হয়ে ডাইনে পুকুর পাড়ের রাস্তায় উঠে যাবেন।
প্রকৃতই তালপুকুর। বড় পুকুরটির চারপাশে প্রাচীন চেহারার উঁচু তালগাছের সাড়ি। চওড়া পাড়ের মাঝখানটা ঘাসজমি, ফাঁকাই প্রায়। ছোটখাটো ঝোপঝাড় গজায়, ছেঁটে ফেলা হয় নিয়মিতভাবে। ফুট দশেক প্রস্থের ঐ উঁচু পাড়ের আরেক প্রান্তে নানারকম ফলের গাছ—আম, জাম, বেল, জাম্বুরা, মায় ছাতার মতো ক্যানোপিওয়ালা পুরনো তিন্তিড়ি বৃক্ষও রয়েছে। বেশ ক'টি নিমগাছ বাড়ির বাসিন্দাদের জন্য শুদ্ধ ব্যাধিনিবারক বায়ু সরবরাহ করে যাচ্ছে। চৌগাছির শেষ ভূম্যাধিকারী শ্রী অমূল্যচরণ মুনশির ঠাকুরদার বসতবাড়ি ছিল এটি একশো বছর আগে। অমূল্য মুনশির ঠাকুরদা কুঠি চৌগাছির মালিক হজ্সন সায়েবের মুনশি ছিলেন। স্বীয় দূরদর্শিতা ও বিষয়জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রভূত ধনসম্পত্তি অর্জন করেন। হজ্সন বিলেতে ফিরে যান বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছর। কুঠি চৌগাছির স্বাভাবিক দখলদার বলে যান সায়েবের দোর্দ-প্রতাপ মুনশি অচ্যূতচরণ। পঞ্চাশ বছর দাপে জমিদারি চালায় মুনশিরা। শেষ জমিদার অমূল্য মুনশির এস্টেট ম্যানেজার ছিলেন তার প্রাণের সখা কাজী আনসারউদ্দিন আহ্মাদ। খ-িত ভারতবর্ষে অমূল্যবাবু ধীরে ধীরে সব গুছিয়ে নিয়ে কোলকাতায় বসতি স্থাপন করেন। তার সখা ও সচিব কাজী সাহেব ন্যায্যমূল্যের বিনিময়ে সমুদয় সম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার লাভ করেন।
ইস, বাবু, এই নতুন জামাইকে নিয়ে পথে পথে ঘুরছ, বেলা কত বাজে জান? বড়মামীর তিরস্কারছোঁয়া অনুযোগে আমি স্মৃতিবিধুরতা কাটিয়ে বর্তমানে ফিরি। জামাই সাজ্জাদকে রুবি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, মা-মেয়ে-জামাই গুরুজনদের কদমবুসি পর্ব সেরে নিয়েছে, হাতমুখ ধুয়ে মেজমামার বাংলোয় খাবার টেবিলে বসতে যাচ্ছে। বড়মামীকে সালাম করে আমি উঠোন থেকে মেজমামার বাড়ির বারান্দায় উঠে মেজমামা-মামীকে কদমবুসি করলাম। বড়ভাই, হাতমুখ ধোন, তিন্নি তোয়ালে এগিয়ে দিল, ঐ যে বারান্দার সঙ্গে নতুন স্নানঘর করা হয়েছে, বেসিনও আছে ওখানে। তোয়ালে কাঁধে এগোই সেদিকে। অ্যাটাচ্ড বাথ! বড় কাজী যখন পঞ্চাশ বছর আগে এবাড়িতে উঠেছিলেন, শোবার ঘর থেকে কমসেকম তিনশ' ফুট দূরে সেতখানা তৈরি করিয়েছিলেন! আমার বয়স তখন এগারো, রাতে ভয় পেতাম সেতখানা যেতে, চারধারে যা ঝোপজঙ্গল গাছগাছালি এবাড়িতে! বাথরুমে ঢুকে আমি যুগপৎ বিস্মিত, আমোদিত হই। বড়সড় বেসিন, কমোড বসানো হয়েছে। এককোণে পর্দাঘেরা স্নানের ট্রে পর্যন্ত! মামার ছেলেরা নিয়মিত পালা-পরবে আসে, যায়—ভালোই হয়েছে। অন্ততপক্ষে মেয়েদের জন্য তো নিশ্চিতই এটা সুবিধাজনক ব্যবস্থা।
অবেলায় খেতে বসে আমার চক্ষু চড়কগাছ! ধোঁয়াওঠা পলান্ন, লাল ভাত, মাছ, মাংস, ছোট মাছের চচ্চড়ি, টক, স্যালাড। অল্প ভাত, চচ্চড়ি, কবুতরের মাংস নিলাম প্লেইটে। বারান্দায় মেজমামার ইজিচেয়ারের পাশে মোড়ায় বসে খেতে খেতে তার শরীরের হাল-হকিকত জানতে চাইলাম। পঁচাশিতে পৌছলেও মামা ভালই আছেন। নিরোগ দেহ। শীর্ণকান্তি থেকেছেন উনি আজীবন। বড়মামা, কুটিমামা দু'জনেই প্রচুর মুটিয়ে, রোগভোগের পর ইহলীলা সাঙ্গ করেছেন। ভোজনবিলাসী ছিলেন দু'জনেই। মেজমামা বলছিলেন, তোমার মা আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। তোমার বাপ আমার ছ'বছরের বড় ছিলেন। আমি তো কোনদিনই তেমন খাওয়াদাওয়া করিনি। তাই বোধহয় এরকম থেকে গেলাম। মামার থুতনিতে হো চি মিন দাড়ি। একটু বাদেই কাজীপাড়ার মসজিদে যাবেন নামাজ আদায় করতে। জানালেন, বাদ নামাজ একটি মজলিশও রয়েছে নাকি। কীসের সভা, মামা? আমি খাওয়া সেরে প্লেইট রাখতে যাব, উঠে দাঁড়াই। ঐ খালদুয়ার পাড়ায় একজোড়া ছেলেমেয়ে বিয়ে না করে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। আজ ওদের বিয়ে দিয়ে দেব দু'পক্ষের গার্ডিয়ানদের উপস্থিতিতে। আমি উঠছি, তোমরা বিশ্রাম কর, জুতোজামা বদলাও, বলে মামা সৌখিন ছড়ি বাগিয়ে বারান্দা থেকে নিচে নামেন।
জুতো খুলে ফ্রেশ মোজা পরে পায়ে চপ্পল গলাই। পায়ের আরাম হল এতক্ষণে। বাইরের উঠোনের একপাশে সেলিম তার ভ্যান দাঁড় করিয়ে ধুতে ব্যস্ত। সেলিম, ভাল করে খেয়েছো তো? আমার প্রশ্ন শুনে সে বিগলিত হেসে বলে, এত ভাল রান্না অনেকদিন পরে খাইলাম, স্যর। বাড়ি গেলে মা এমন রান্না কইরা খাওয়ায়। সব খাটি সইরষার ত্যালে রান্না অইছে। সিগ্রেট ধরিয়ে একা পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাকা পথে নেমে কালভার্টের রেইলে বসলাম। সাজ্জাদ এল একটু বাদে। গ্রামটা একটু ঘুরে দেখি? ওর কথা শুনে মনে হল, আমারই তো ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা। চল, আমিও যাব। এই খালধার দিয়ে একটু চক্কর দিয়ে আসি। অবেলায় খেলাম, হাঁটলে অগ্নিমান্দ্যে আক্রান্ত হবার ভয় থাকবে না, আমি হেসে বলি। সাজ্জাদের হাতে পানির বোতল। এগিয়ে দিল, খান। একঢোঁক জল গিলে ওকে বোতল ফেরত দিই। বলি, থ্যাঙ্ক ইউ, বাবা। ইউ আর থটফুল। তারপর দু'জনে নরম মাটিতে হেঁটে যাই।
আধঘণ্টা হেঁটে ঘাম ঝরিয়ে ফেরত যাত্রায় ভাইপো মোহিতের বাড়ির বাইরে খোলা বৈঠকখানায় বসা গেল। জলপান করলাম। বেলা গড়িয়ে সাঁঝ নামছে। প্রদোষকালে কেমন যেন এক মনখারাপে পায় আমাকে মাঝে-মাঝে। নিসর্গমায়া, শান্ত সমাহিত গ্রামীণ আবহ একেবারে আবিষ্ট করে ফেলে। চুপ করে বসে থাকলাম মিনিট দশেক। চলেন, ওদিকে আবার সব ব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। সাজ্জাদের উৎকণ্ঠা আমার ভাল লাগে। ছেলেটার নরম মন। ওদের বিয়ের পর যেবার কুয়াকাটা বেড়াতে গেলাম, বরিশালে স্টিমার থেকে নেমে অসুস্থ আমি ওর ওপরে পরিবারের সকলের দায়িত্ব সঁপে দিয়েই সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। হেসে বললাম, চল। মেজমামার ঘরের বাইরে পৈঠার দুধারে হেলান দেয়া সিমেন্টে বাঁধানো বেঞ্চি। আরাম করে বসতে চা নিয়ে এল ফিরনি। তিন্নিও এসেছে পিছু পিছু। ওকে তো আগে দ্যাখেন নাই বড়ভাই, তাই ওর হাতে চা পাঠালাম। তিন্নি কষ্টে হেসে বলল। ওর চোয়ালের গড়ন জন্মাবধি অস্বাভাবিক। ও যখন বাচ্চা ছিল, ঢাকায় কুটিমামার বাসায় ওকে দেখেছি। অনেক চিকিৎসা হয়েছে। তেমন সুফল মেলেনি। তিন্নি মা-বাবার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
আর ফিরনির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি এর আগে নানা কারণে। এক নম্বর, গত কুড়ি বছরে আমি এই নিয়ে মোটে দু'বার নানাবাড়ি বেড়াতে এলাম। ফিরনি গ্রামের বাইরে ওর বড় ভাইবোনের বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করেছে এতদিন—এই হল আরেকটা কারণ। সদ্য গ্র্যাজুয়েশ্যন করা ফিরনির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে আলাপ করছি, এমন সময় বিডিনিউজের কুষ্টিয়া করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বলের ফোন এল। স্যরি, উজ্জ্বল, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করি। আজ আর কুষ্টিয়া পৌঁছনো হল না। নানাবাড়িতে পৌঁছতেই দিন কেটে গেল। রাস্তায় বেশ দেরি হল। আজকের বুকিংটা ক্যানসেল করা সম্ভব না হলেও কাল রাত কাটানোর মতো দু'টো ঘরের ব্যবস্থা রাখবেন ভাই। অবশ্যই, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে, খোদা হাফেজ। লোডশেডিং এখানে মাত্রাছাড়া। একঘণ্টা পর পর। পল্লীবিদ্যুতের সংযোগ, এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। ওরা দু'বোন অনেকগুলো হারিকেন নিয়ে এল। চিমনি-সল্তে পরিষ্কার করে, তেল ভরে বাতিগুলো জ্বেলে আলোর শিখা কমিয়ে ঘরে-ঘরে রেখে এল। ভারি লক্ষ্মী তো মেয়ে দু'টি!
বড়মামীর ঘরে গেলাম। মামাতো ভাই স্বপনের করিৎকর্মা বউটি চা করছে। আমার চায়ে চিনির বদলে এখো গুড় দিও বৌমা। আমার আবদার শুনে সাজ্জাদ বলে ওঠে, আমারও তাই চাই কাকিমা। বড়মামী, আমি হেসে ফেললাম। বাবুর ছেলে তো বাবুর মতোই হয়েছে, বড়মামী আহলাদ করে বলেন, রাতে কিন্তু আমার ঘরে খাবে তোমরা। অবশ্যই, আমি সোৎসাহে বলি চায়ে চুমুক দিতে দিতে, গোরুর ঘন দুধ আর এখো গুড়। অপূর্ব সোয়াদ এই চায়ের, সাজ্জাদ, বুঝলে? সেই ছোটবেলায় নানির কাপ থেকে চামচে করে নিয়ে খেতাম। একেবারে সেই স্বাদ। তোমার গোলাপমামা মারা গেল গত হপ্তায়, মনটা আমার থম্ ধরে আছে। নতুন জামাই নিয়ে এলে, তেমন কিছুই রাঁধা হল না। মামীর গলায় আফশোসের সুর করুণ হয়ে বাজে। প্লিজ মামী, গোলাপমামা তো আমাদেরও বন্ধুর মতো ছিল, মনে নেই? আমি কি বুঝি না আপনার ভেতরটা কেমন করছে? ওই বৌ যেমন পারে, দু'টো রুটি গড়ে দেবে আমাকে, তাহলেই হবে।
আমার কথা শুনে মামী ছেলের বৌকে বলেন, মা, তুমি জেনে এসো তো রুবি, রুবাই ওরাও যদি রুটি খায়, তাহলে আতপ চালের গুঁড়ো রয়েছে, ক'টা চালের আটার রুটিই করে দাও। ঝোল দিয়ে ভিজিয়ে খাবে'খন। আর সকালে ওদের চিতই পিঠে করে দিও। চা শেষ করে উঠলাম। মেজ মামা সালিশ বিচার শেষ করে ফিরলে তার কাছে বসব খানিকক্ষণ। উঠোন পেরিয়ে মেজমামীর রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। মামী আর তিন্নির গল্পগাছা, রান্নাবান্না চলছে প্রায় নিঃশব্দে। মৃদুভাষী সুন্দর মানুষ মেজমামীর হাতে ছোট মাছ চচ্চড়ি, সর্ষে তেলের পোলাও—এসব রান্নার স্বাদ অতুলনীয়। বড়মামী অবশ্য সর্বার্থেই এ বাড়ির বড় বউ—দায়িত্বশীলা, কর্তব্যে কঠোর, সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম, সংসারকর্মে যাদুকরী নৈপুণ্য দেখিয়ে এসেছেন দীর্ঘ ষাট বছর যাবত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত বড়মামা তো গোটা জীবনই কাটিয়েছেন আপন মনে—কোনো রকম কাজকর্ম বা পেশায় কখনো যান নি, কেবল নিয়ম মতো স্নানাহার, নিদ্রা, নামাজ আদায় করে গেছেন। ভোজনরসিক কর্মবিমুখ বড়মামার সামনে যখন যেমন দরকার, রসনাসুখকর খাদ্যের সম্ভার পেশ করা, জমিজমা চাষবাস পরিচালনা, নানা-নানির যতœআত্তি, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া—সব বড়মামী সামলেছেন, বড়মামা গত হবার পর এখনো একা হাতে সামলে চলেছেন।
হ্যাঁ, মেজমামা মসজিদ থেকে ফিরে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছেন। মেজমামার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকলাম, মামা, শুয়ে পড়বেন এক্ষুনি? না, না, এস বাবু, সাজ্জাদ এস, বোস এইখানে, আমার খাটে উঠে বোস। সাজ্জাদ চেয়ার টেনে বসল। তোমার বইটা তপন গতবার বাড়ি আসবার সময় নিয়ে এসেছিল। পড়েছি। বলে মেজমামা মৃদু হাসলেন। বড়মামা অট্টহাস্য করতেই অভ্যস্ত ছিলেন, মনে পড়ল। মামা, আব্বা তো আপনার ভগ্নিপতির চেয়ে সখাই ছিলেন বেশি, আর আপনাদের সময়ে মানুষ অনেক অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণ ছিলেন শুনেছি। সেসব দিনের কথা কিছু মনে পড়ে? আমার জন্মের আগে আপনারা যেরকম ঘুরতেন ফিরতেন, সে বিষয়ে জানতে ইচ্ছে করে। সাজ্জাদও হাসিমুখে সায় দিয়ে চেয়ার আরেকটু এগিয়ে এনে বসে। তোমার নানা ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারাস, আমরা সেরকম হইনি, মামা স্মৃতিবিধুর কণ্ঠে আস্তে আস্তে বলেন, তোমার বড়মামা আর আমি তো গৃহমুখী মানুষ, বলতে গেলে সারাটা জীবন—পুরনো বাড়িতে পয়ঁত্রিশ আর এই নতুন বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আমার কেটে গেল তো! তো শোন, একবার তোমার বাবা আমজাদ মীর সাইকেলে তোমাদের পাবনার বাড়ি থেকে চৌগাছি এসেছিল। আমজাদের তখন ক্লাস এইট, আর আমার থ্রি চলছে। ওতো আমার চেয়ে ছ' বছরের বড় ছিল। কিন্তু দুনিয়া ছেড়ে গেছে ঢের আগে। বছর পঁচিশ হয়ে গেল, তাই না? আমি মাথা ওপর-নিচ করে সায় দিলাম।
গল্পের গন্ধ পেয়ে ফিরনি এসে মামার ওপাশে বসেছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মামা বলে চলেন, পাবনা থেকে আসা তোমার বাবাকে ঘিরে চৌগাছির কাজীপাড়ায় রীতিমত উৎসবের আমেজ। পথের বর্ণনা, বিপদ-বিপত্তি ইত্যাদি জানতে আমরা সবাই উৎসুক। আমজাদ তো এমনিতেই একটু শাই, এত মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে ও জেরবার হচ্ছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই একরাতে খাবার সময় সে মৃদুস্বরে জানাল, পরদিন সে পাবনা ফিরে যাবে। তোমার নানা কেমন হুল্লোড়ে মানুষ ছিলেন, তুমি তো দেখেছো। বাপজান বল্লেন, তুমি আমার স্ত্রীর বোনপো, আমার ভায়রাভাইয়ের মা-মরা ছেলে। তোমাকে আমি সাইকেলে পাবনা ফিরতে দেব না মোটেই। টুকু বলছিল, ও তোমার সঙ্গে খালার বাড়ি বেড়াতে যাবে। তা তোমরা দু'জন রেলগাড়ি, নৌকা, পাল্কিতে যাও। মীর সাহেব শুনলাম বাড়ির কাজে হাত দিয়েছেন। তার বজরা চেপে টুকু ফেরত এসে সাইকেল তুলে দেবে। ব্যস, হল? অতঃপর তোমার বাবা আর আমি সারারাত মা-কে জপিয়ে, বুঝিয়ে আমাদের পরিকল্পনা মাফিকই সে যাত্রায় অ্যাডভেঞ্চারে বেরোতে পেরেছিলাম।
মানে, বড়কাজীর অমন বিশদ আদেশ অমান্য করে আপনারা দুই বালক-কিশোর সাইকেল চেপেই গেলেন? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি। হ্যাঁ, মামা নিঃশব্দে হাসতে হাসতে জানান, তোমার নানি যে আমাদের পক্ষ নিলেন! তবে কষ্ট হয়েছিল পথে, সেকথা স্বীকার করব। তখন তো পথঘাট তেমন ছিল না, বনজঙ্গল ঝোপঝাড়, নদনদী-খালবিলে ভর্তি বঙ্গদেশ। এখান থেকে গড়াই গাঙ পার হয়ে, গ্রাম-প্রান্তর পাড়ি দিয়ে ফরিদপুরের রাজবাড়ি এলাকায় পদ্মাপার হয়েছিলাম। ওপারে পাবনার সাতবাড়িয়া ঘাট। পথে তোমার আব্বার মামাবাড়ি দুলাই চৌধুরীদের বাড়িতে রাতের অতিথি হলাম। মামাবাড়িতে আমজাদের শৈশব কেটেছে। ওর মা ওকে জন্ম দিয়েই বেহেশ্তবাসী হন। চৌধুরিদের চকমেলানো বিশাল দোতলা বাড়ি, প্রকা- দীঘি, কাচারি বাড়ি—ছবির মতো মনে ভাসে। সেটা ছিল ১৯৩৫ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার চার বছর আগের ঘটনা এটা। তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেখলাম, খালু বিস্তর ইঁট কাটিয়ে পুড়িয়েছেন। দোতলা বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছেন। বাড়িতে মিস্ত্রি-মজুর, লোকজনের আসা যাওয়া—উৎসবের আমেজ। থাক সে কথা। তোমরা খেয়ে নাও গে। আমি এখন শোব।
আশা—মানে স্বপনের বৌ আমাদের ডাকতে এসেছিল। বড়মামীর ঘরে দস্তুরমত দস্তরখান পেতে খানার ইন্তেজাম করা হয়েছে। লোডশেডিং হল আবার। মাথার ওপরে ফ্যানের ঘোরা বন্ধ হল। কেজো মেয়ে আশা চট্পট্ আগে থেকে চার্জ দেয়া দু'টি লণ্ঠন বসিয়ে দিল টেবিলে। হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগল। আমি বিব্রতবোধ করলাম। বাতাসের দরকার নেই। অক্টোবরে তোমাদের এখানে তো মাঝরাতে ঠাণ্ডা লাগবে মনে হয়। আর মামী, আমি রাতে দু'টো রুটি খাই, এত খাবারের আয়োজন দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, মন থেকেই বলি আমি। এ বাড়িতে এলে আমরা যথাসাধ্য করব, এটাই তো স্বাভাবিক—তাতে এক-দু'দিনে তোমাদের স্বাস্থ্যের কী আর ক্ষতি হবে বল? বড়মামী স্পষ্টতঃই ক্ষুণœ হয়েছেন। অলরাইট, লেট'স ডু জাস্টিস টু দ্য ডিশেজ লেইড আউট হিয়ার, বলে আমি বসে গেলাম। সবাই বসেছে। সেলিমও। দেখে খুশি হলাম। আশা, রাতে চোখে কম দেখি, আমি বলি, কিছু সব্জি আর ওই বড়মামীর স্পেশ্যাল মোরগের ঝোল আর নারকেলের টুকরো আমার প্লেইটে তুলে দাও প্লীজ। আমার রান্না খাবেন না! আশা আমার নির্দেশ মতো খাবার তুলতে তুলতে বলে, আপনার ভাই হাট থেকে আপনার জন্য পাকা খাসির মাংস এনেছিল আজ। দু'হাত ওপরে তুলে বললাম, ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছেমতো দিয়ে যাও, আমি কিছু বলছি না আর। সবাই হেসে উঠল।
ভাতের ব্যবস্থাও ছিল। যার যেমন ইচ্ছে, রুটি, ভাত তুলে নিল। শোভা বড়মামীর ইঙ্গিত অনুসরণ করে দক্ষহাতে খাবার পরিবেশন করছে পাতে-পাতে। স্বপন বসেছে আমাদের সাথে। বড়মামী আগেই খেয়ে নিয়েছেন ঠিক আটটায়। ডাক্তারের নির্দেশ, রাতের খাবার খেয়ে দু'তিন ঘণ্টা টিভি দেখে কাটিয়ে, তারপর ঘুমোতে যাবেন। তুমি যে দিস্তে দিস্তে রুটি ঝোলে ডোবাচ্ছ আর মুখের ভেতর চালান দিচ্ছ, রুবি হুঁিশয়ারি উচ্চারণ করে। ওই ডাক্তারি পরামর্শ এখানে চলছে না যে, আমি দুর্বল যুক্তি দেখাই এবং সকলের খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও মুরগির ঝোলের বাটি থেকে দোমালা নারকোলের টুকরো তুলে চিবোতে থাকি। আহ্, সে এক রেয়ার অভিজ্ঞতা। ওই নারকেল ঢাকায় পাওয়া যায় না। চিনে, বুঝে, গাছ থেকে পাড়তে হয়। বিদ্যুৎবাতি জ্বলতে সবার সম্বিৎ ফিরল। ঘণ্টাভর খাওয়া দাওয়া করলাম নাকি!
শোবার ব্যবস্থা মেজমামার ওখানে। ঈদ আর অন্য ছুটিছাটায় মামার সব ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরা এলে ঘরগুলো কাজে লাগে। বড় বড় ম্যাট্রেস দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। অতিরিক্ত অতিথিদের জন্য। একপাশের দু'টি ঘরে আমাদের চারজনের রাত্রিবাসের জন্য বিছানা পেতে মশারি ফিট্ করে দিয়েছে তিন্নি, ফিরনি। রাতে ভালই ঘুম হল। রাতে উঠে অবশ্য আমি ফ্যান স্লো করে দিয়ে কাঁথা টেনে নিয়েছিলাম। মাঝরাতের পর ঠা-া হয়ে যায় পরিবেশ। আর হ্যাঁ, পাহারাদার কুকুর ডেকেছিল বেশ ক'বার।
সকালে উঠে হেঁটে এসে ফিরনির করা গরম চা পেয়ে গেলাম। স্নান সেরে নিয়ে কিছু পড়ছিলাম। এমন সময় কুষ্টিয়া থেকে উজ্জ্বলের ফোন এল। দুঃসংবাদ। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া স্ত্রীকে নিয়ে ও পয়লা বাসে ঢাকা রওনা হয়েছে। থাকতে পারছে না বলে দুঃখপ্রকাশ করল আর ওরই বন্ধু 'যায় যায় দিন'-এর জেলা সংবাদদাতা জুয়েলের ফোন নম্বর দিয়ে সে বলল, আমরা কুষ্টিয়ার কাছাকাছি গিয়ে জুয়েলকে ফোন করলেই আর কোনো সমস্যা হবে না। ঢাকায় পৌঁছে আগে স্ত্রীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই ওর আশু কর্তব্য, আমি জানালাম। বাইরের উঠোনে গিয়ে সেলিমকে গাড়ি রেডি করতে বললাম। বড়মামীর ঘর থেকে নাশতার ডাক এল।
প্রায় রাতের মতোই বিস্তারিত আহার্য সম্ভার। টাট্কা চারাপোনার ঝোল, সব্জি, ভর্তা, ডিমভাজা আর দু'রকমের হালুয়া। ভাত, রুটি দুই-ই রয়েছে। সেলিম খুশি হয়ে গরম ভাত, মাছের ঝোল, ভর্তা তুলল প্লেইটে। তারপর বলল, বাড়ি গেলে মা সকালবেলা এইরকম গরম ভাত, ভর্তা খাইতে দেয়। ঢাকায় তো চা খাইয়া ডিউটিতে বাইরই। যহন যা জোটে, তাই খাই। এইট কীসের ভর্তা মামানী? খুব স্বাদের তো! বড়মামী হাসেন। বলেন, সেলিম, পেট ভরে খান। ওটা আলু আর চিংড়ির ভর্তা, সামান্য সর্ষেবাটাও রয়েছে। ঘি খাবেন? আশা, ঘিয়ের বয়েমটা আন তো ফ্রিজ থেকে, মা। 'গাঁয়ের নাম চৌগাছি, চাক বেঁধেছে মৌমাছি'—ছড়া লিখেছিল ভাইঝির বর ছড়াকার সালেহ আহমেদ বহুদিন আগে, শ্বশুরবাড়ি প্রথমবার বেড়াতে এসে। আমার জন্য চৌগাছির প্রধান আর্কষণ ছিল এর হারিয়ে যাওয়া জলাভূমি আর জীববৈচিত্র্য। মামা-মামীরা যদ্দিন আছেন, আমাদের শারীরিক ও অন্যবিধ সঙ্গতি যতদিন থাকবে—আমি চৌগাছি আসতে থাকব, প্রধানত স্মৃতি রোমন্থনের জন্যই। বাবু, তুমি একটু ভর্তাভাত সরবাটা ঘি মেখে খাবে না? খাও একমুঠো, বলে বড়মামী আমার প্লেইটে দু'চামচ ভাত তুলে দেন। নিয়মভঙ্গ করে আমি নিরবে খ্যাটন মোডে সুইচ করি।
নাশতার পর বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে চা-পান করতে করতে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই ঢিলেঢালা পোশাকেই গাড়িতে উঠব। যা খেয়েছি, তাতে শার্ট-ট্রাউজার্স-জুতো পরবার মতো ফিট্ আমি আর নেই। একটু রিল্যাক্সড হালতে করিব ভ্রমণ। আমার কথা শুনে সকলে হেসে কুটিকুটি। কেবল বড়মামী গম্ভীর হয়ে বলেন, সেই ইস্ত্রিকরা বাবু সায়েবের এই হাল ছেড়ে দেয়া হাল! আমরাই এখনো বুড়ো হলাম না, আর তুমি বলছ পাজামা চপ্পল পরেই কুষ্টে যাবে!! আমি নির্বাক। মামীর বয়স আমার মায়ের মতোই—আশি পার হয়েছেন নির্ঘাত! রুবাই-সাজ্জাদ ফটো সেশনের জন্য সবাইকে তাড়া দেয়। আমি ধূমপানের উদ্দেশ্যে পুকুরপাড়ের রাস্তায় উঠি। গতকাল এখানে এসেই বড়কাজী আর তার প্রাণসখা জমিদার অমূল্য মুন্শির কথা মনে পড়েছিল। যৌবনে মুন্শি আর বড়কাজী ঘোড়ায় চড়ে কাহাঁ-কাহাঁ মুলুকে সফর করতেন, সেসব কাহিনী আমি নানার কাছে শুনেছি। বিহারের পুর্ণিয়া জেলায় মেলা দেখতে গিয়ে একবার দু'বন্ধু কি বিচিত্র বিভ্রাটে পড়েছিলেন এবং তার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য মুন্শিকে দার পরিগ্রহ করে ফিরতে হয়েছিল—সে কাহিনীও নানা অকপটে আমাকে বলেছিলেন। জমিদার বাড়িতে ওই অবাঙালি সুন্দরী বউ হয়ে আসবার পরই অমূল্য বাবুর বাউ-ুলে স্বভাবের পরিবর্তন ঘটে, তিনি বিষয়কর্মে মন দেন।
স্যর, ছবি-টবি তোলা শেষ। আসেন, গাড়িতে ওঠেন। সেলিমের ডাকে বাড়ির ভেতর যাই। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের জামাই, কুমিল্লার নবীনগরের ছেলে সাজ্জাদেরও চোখে অশ্রু। বড়মামী, মেজমামী, রুবাই, রুবি—সবার চোখ লাল। বেশ কান্নাকাটি হয়েছে তো আমার চোখের আড়ালে এই অল্পক্ষণেই! মেজমামাকে কদমবুসি করে উঠে দাঁড়াতে উনি আমার মাথায় হাত দিলেন। বললেন, এইরকম হুটহাট করেই চলে এস, যখন ইচ্ছে হবে, সুযোগ আসবে। কেমন? আর তোমার বোন ফিরনির জন্য একটা ছেলের খোঁজ করবে। ভদ্রলোকের ছেলে হলেই চলবে, বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজব এবার। কথা দিলাম, অবশ্যই দেখব। ওর বিয়ে হওয়াটা দরকার। গাড়িতে উঠে হাত নাড়লাম। বাড়ির সীমানা পার হয়ে সেলিম বাঁয়ে গাড়ি ঘোরাতে যাচ্ছে, এমন সময় বললাম, বাঁয়ে নয়, ডাইনে যাও, আমার জন্মভিটের মাটি ছুঁয়ে যাই একবার। পাঁচশ' গজ গিয়ে রাস্তা শেষ হয়েছে এক মসজিদের মুখোমুখি। নেমে মসজিদের বাঁয়ে লাগোয়া বড়কাজীর পুরনো বাড়িতে ঢুকলাম। যে ঘরে আমার জন্ম হয়েছিল বাষট্টি বছর আগে, তার পৈঠা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকালাম। ভাইপো-বৌমা-নাতিনাতনীদের সঙ্গে দু'টো কথা বলে বিদায় নিলাম।
একই পথে ফিরমু তো স্যর? সেলিম শুধোয়। হ্যাঁ, চিনবে তো? ওই মাগুরার আগে যেখানে হাইওয়ে থেকে নেমেছিলে কাল, ওখানে গিয়ে আজ ডাইনে ঘুরবে। বলে আমি স্মৃতির পুকুরে ডুব দিই। সন ছেষট্টিতে যখন একবার পান্নুভাই নাজ সিনেমার টিকিট কেটে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন, সেদিন বলেছিলেন, তোমার মুখে চৌগাছির নানা আর তার বন্ধু অমূল্য মুন্শির গল্প শুনেছি। আজ আমরা যে ছবিটা দেখতে যাচ্ছি, সেটির গল্প ইতিহাস ভিত্তিক—অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে তৈরি হয়েছে এই 'বেকেট'। আমি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠি—এই সেদিনই তো পড়লাম 'মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রাল' নাটক! তারপর ইউসিস লাইব্রেরিতে বসে দু'দিন এনসাইক্লোপিডিয়া ঘেঁটেছি। অবিমৃষ্যকারী রোম্যান্টিক রাজা হেনরি দ্য সেকেন্ড ঘাতক পাঠিয়ে তার বন্ধু ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপ টমাস বেকেটকে ১১৭০ সালে ক্যান্টারবেরি ক্যাথিড্রালের ভেতরে কর্তব্যরত অবস্থায় হত্যা করিয়েছিলেন। এনি কোয়েস্ট্যেন? না, বুঝেছি, তোমার হোমটাস্ক করাই আছে। পান্নুভাই চুপ করে গিয়েছিলেন। সেদিন নাজ সিনেমায় রিচার্ড বার্টন আর পিটার ও'টুলের অভিনয় বুঁদ হয়ে উপভোগ করার পর বাইরে বেরিয়ে বলেছিলাম, কিন্তু অমূল্য মুনশি আর বড়কাজীর সখ্য আমৃত্যু বজায় ছিল, যদ্দূর জানি। হ্যাঁ, বিষণ্নকণ্ঠে পান্নুভাই মন্তব্য করেছিলেন, বেকেটের মৃত্যু আর দ্বিতীয় হেনরির অনুশোচনা কেবলই দুঃখদায়ক—বিশুদ্ধ অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স।
ছাঁচিলাপুর বাজারে আজ গতকালের মতো ভিড় নেই। সেলিম, একটু থাম। আমি এক মিনিটের জন্য নামব। হাটের মাঝখানে বটতলায় গাড়ি থামল। নেমে গিয়ে পানের দোকানির কাছে বাঘাটের ঘোষেদের দোকানের হদিস জানতে চাইলাম। মেজমামার কাছে গতরাতে শুনেছি, বাঘাটের ঘোষেদের মিষ্টি এখানেও মেলে। দোকানি কথা না বলে আঙুল তুলে দেখাল। কোনো সাইনবোর্ড নেই। ভেতরে ঢুকে তাই নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্ন করলাম, এটা কি বাঘাটের… এই পর্যন্ত বলতেই ক্যাশে বসা ফিন্ফিনে আদ্দির ধব্ধবে ফুলহাতা শার্ট পরিহিত গৌরবর্ণ মানুষটি বিগলিত হেসে বললেন, আজ্ঞে, এটাই। তা চলছে আজ নব্বুই বছর হল। প্রখ্যাত মিষ্টান্নশিল্পী রাজকুমার ঘোষ আমার ঠাকুর্দা ছিলেন। সেলিম পেছন থেকে বলে উঠল, আপনার তো ডাইবিটিস, স্যর। আমি মিষ্টি বাইছা দেই? প্লীজ, বলে আমি দোকানের বাইরে গিয়ে সিগ্রেট ধরাই। নিম্কি থাকলে নিও, সেলিমকে মনে করিয়ে দিই। ঘোষ মশাই নিজে উঠে গিয়ে তদারকি করছেন। দেখলাম, সেলিম আঙুল দিয়ে বিভিন্ন মিষ্টি দেখালে তাকে একটি করে স্যাম্পল করতে পিরিচে তুলে দিচ্ছে একটি ছেলে। আমি মাথা নেড়ে ওকে উৎসাহ দিলে খায় আর ক্লিয়ারেন্স দেয়। স্যর, দশ কেজি নিয়েছি, নিমকিও—আর মনে হয় লাগবে না, কী বলেন? সেলিমের প্রশ্ন শুনে আমি বলি, কত দাম হয়েছে? মাত্র আটশ' পঁচিশ? আটশ' দিলেই হবে, মালিক বললেন।
সেলিম যত্ন করে মিষ্টির হাঁড়ি আর বাক্সগুলো পেছনে তুলে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল। চল্ মুসাফির বাঁধ গাঁঠরি… রাস্তা না চিনলে ডাকবে, বলে আমি মাথা পেছনে হেলিয়ে চোখ বুঁজি। ব্রেইকফাস্টের মৌতাতে বোধকরি ঝিমুনি এসেছিল। সাজ্জাদের কণ্ঠে 'এবার ডাইনে যাবেন' কমান্ড কানে যেতে চোখ খুললাম। সেলিম এক পলক আমাকে দেখে নিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরাল। এই যে দেখ নবগঙ্গা নদী, আমার শৈশবে এটা স্রোতস্বিনী ছিল, প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ঘোষণা করেছেন—নবগঙ্গা, গড়াই, কপোতাক্ষ আবার জলে ভরে উঠবে। নাব্য করা হবে ব্যাপক ড্রেজিং করে শীগ্গিরি, আমি সুযোগ বুঝে সংবাদ পেশ করি! আমাদের ওদিকে, মানে নানাবাড়ি যেতে বড় নদী মেঘনাকে দেখে তেমন তফাৎ বুঝি না, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অসংখ্য ছোট নদী মরে-হেজে গেছে, যাচ্ছে, সাজ্জাদ বলল, আসলে দেশ জুড়েই নদীখনন জরুরি হয়ে পড়েছে। মাগুরা শহর পেরিয়ে গেলাম। এবারে রাস্তা ফাঁকা। হু হু করে বাতাস কেটে এগোচ্ছে গাড়ি। সেলিম, ভাত খেয়ে ঘুম আসছে না তো? চা খেতে ইচ্ছে হলে পছন্দমতো জায়গায় থেম। রুবির কনসার্ন বুঝে নিয়ে আমাদের সারথি জানায়, অবশ্যই। আপনাদের সাথে তো আমি ডিউটি করতাছি না, মনে অইতাছে বেড়াইতাছি। এখানে হাইওয়ের দু'পাশে তেমন ঘনবসতি নজরে পড়ছে না।
ঝিনাইদা' বাইপাসে পড়ার আগে এক জায়গায় থেমে আমরা চা খেলাম। জেলা শহর বাঁয়ে রেখে ডাইনে কুষ্টিয়ার পথে চললাম। ডানদিকে ক্যাডেট কলেজ। এগিয়ে গেলে বাঁয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। চা খেয়ে বেদম গাড়ি ছোটাচ্ছে সেলিম। বটতৈল। সাইন চোখে পড়ল। জুয়েলকে ফোন করলাম সসঙ্কোচে। আফটার অল, অন্য কাগজে কাজ করে ছেলেটি আর আমরা কোথাকার কে গিয়ে ওর ঘাড়ে চাপতে চাইছি! জুয়েল জানতে চাইল, সার্কিট হাউসের বাতানুকূল ঘর দু'টি যেহেতু আগেই বুক্ড হয়ে গেছে, আমরা ওখানে সড়কের অন্যধারে দিশা'র অতিথি নিবাসে থাকব কিনা। অবশ্যই, আপনি যা রেকমেন্ড করবেন… এক রাতের তো ব্যাপার, আমি বলি। আমরা পৌঁছে, ব্যাগ রেখে, হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়ব। ঠিক আছে, ঘর পছন্দ না হলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য ব্যবস্থা করব, আসুন আপনারা, জুয়েল ডাব্লি এ্যাশূওর করে। সাংবাদিক বলে কথা! আমি লাউড্লি অ্যাপ্রিশিয়েইট করি। শহরে এসে গেছি। মজমপুরের মোড় চিনতে পারলাম। ইদানিং সব শহরেরই চেহারা দ্রুত পাল্টাচ্ছে কিনা! এখান থেকে বাঁয়ে গেল মীরপুরের রাস্তা। মনে আছে, মা, সেবার যে রুপালিদের বাড়ি বেড়াতে গেলাম। আমার প্রশ্ন শুনে রুবাই হ্যাঁ-সূচক মাথানাড়া দিল। ডাইনে প্রধান সড়ক ধরে চল সার্কিট হাউস তক্, সেলিম। সেলিম হেসে আমার পানে তাকায়, নড্ করে। গাড়ি এগিয়ে চলে।
ব্যস, এবারে বাঁয়ে রাখ। ডাইনে সার্কিট হাউস, আর বাঁয়ে ওই যে 'দিশা'-র সাইন দেখছি, বলে আমি নামার জন্য টুপি পরি, হাতে নোটবই নিই। নেমে ভেতরে গিয়ে রিসেপশ্যনে আমার নাম বলতেই অপেক্ষমান ঝক্ঝকে চেহারার এক যুবক বলে ওঠে, স্লামালেকুম ভাই, আমি জুয়েল, যায় যায় দিন-এর কুষ্টিয়া সংবাদদাতা। হাত মেলাই, হাসি। চলুন, আমরা দোতলায় গিয়ে আগে ঘর দেখি। আপনি অ্যাপ্রুভ করলে এরা মালপত্র নামাবে, সেন্সিব্ল যুবক জুয়েল প্রস্তাব দেয়। লেট'স গৌ দেন… ইউ এ্যান্ড আই,… অ্যান্ড ক্যাচ আ ফলিং স্টার… পরের শব্দগুলো বিড়বিড় করে বলাতে জুয়েল সিঁিড় উঠতে গিয়ে দাঁড়ায়, আমাকে কিছু বলছেন? নাহ্, চলুন এগনো যাক, বলে আমি দ্রুত সিঁড়ি টপ্কাই। দুটো ঘরই চমৎকার। চাদর, বালিশের ওয়াড় ধবধবে সাদা, বাথরুম শুকনো। খুব ভাল ব্যবস্থা, জুয়েলকে নিশ্চিত করি। শুনে খুশি হয়ে সে বেয়ারাকে বলে, গাড়ি থেকে গেস্টদের নামিয়ে নিয়ে এস মালপত্রসুদ্ধ, কেমন?
সবাই ওপরে উঠে এলে ট্রলিব্যাগ ঠেলে করিডোরের ওদিকে এগিয়ে যেতে যেতে রুবিকে বললাম, এই ঘরটা ওদের। একটু দেখেশুনে চেঞ্জ করে নিতে বল। জুয়েল আর আমি ও ঘরে বসি। এখন তো বারোটা বাজে। আমরা বেরিয়ে পড়তে চাই, জুয়েল। আগে যাব শিলাইদহ। শুনেছি গড়াইয়ের ওপর সেতু হয়েছে। ফেরার সময় লালন ফকিরের আশ্রম হয়ে আসব। শহরে আমার বড়খালা আর এক মামাতো বোনের বাড়ি যাব পরে, যদি সময় পাই। জুয়েল বলে উঠল, আমি তো অফিসে বলেছি, আজ আপনাদের সঙ্গে থাকব! আমি সঙ্গে গেলে কি… ওর কথা শেষ হবার আগে আমি বাধা দিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলি, তাহলে তো সোনার সঙ্গে সোহাগা মিলে গেল! এমনিতেই আপনি আমাদের অপেক্ষায় বসে কাজের দিনটা মাটি করছিলেন ভেবে আমি খুবই কুণ্ঠাবোধ করছিলাম এতক্ষণ। আমরা ঘণ্টাদুই আগে এ্যাত খেয়ে বেরিয়েছি নানাবাড়ি থেকে যে, এখন খিদে নেই মোটেই। তাছাড়া গাড়িতে প্রচুর মিষ্টি আর নিম্কি মজুদ রয়েছে। আপনি কি লাঞ্চ খেয়ে নেবেন? না না, জুয়েলও একই সুরে বাজল, আমিও বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছি। মোটরবাইকটা এখানে রেখে আপনাদের সঙ্গী হব এখন।
শিলাইদহের পথে চলেছি আমরা। এ রাস্তা আমাদের অচেনা। শেষবার যে শিলাইদহ গিয়েছিলাম, সেটা বড়বাজারের একপাশে গাড়ি রেখে অধিকাংশ পথ হেঁটে, বড়জোর তিরিশ গজ প্রশস্ত শীতের গড়াই খেয়া নৌকায় পার হয়ে, ওপারে উঁচু পাড়ে উঠে রিকশা ভ্যানে কোরাসে রবিবাবুর গান গাইতে গাইতে যাওয়া। সে যাওয়াও বড় আনন্দেরই হয়েছিল সন ১৯৯৫-এ। এবার যাচ্ছি পিচঢালা মসৃণ রাজপথে, দু'পাশে গ্রামের বাড়িঘর, ক্ষেতখামার—পাকা বাড়িঘর সংখ্যায় বেড়েছে। সামনে পাইলটের আসন জুয়েলকে ছেড়ে দিয়েছি। ওই কথা বলছিল। ইউনাইটেড স্কুলে পড়েছে সে, যেখানে চুন্নুভাইয়ের সঙ্গে ক্লাস সিক্সে আমিও ছাত্র ছিলাম ১৯৫৯ সনে। ওদের বাড়ি মিলপাড়ায়, মোহিনী মিলের কাছেই। উজ্জ্বলের বাড়িও একই পাড়ায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কুষ্টিয়া শহরের চেহারা, লোকজন ইত্যাদি বিষয়ে ও আমাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমার বেশ লাগল। ছেলেটি অত্যন্ত সহজ, মিশুকে ধরনের। আমিও কুষ্টিয়ার বর্তমান সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। ক্রসফায়ারের ঘটনা ইদানিং রোজই ঘটছে, ইংরেজি স্টোরি অনেক সময় আমি নিজেও করি বলে জানি। জুয়েল বলল, হ্যাঁ, মীরপুর এলাকাটা বিশেষভাবে নটরিয়াস হয়ে উঠেছে। আপনাদের চেনাজানা কুষ্টিয়াকে আর পাবেন না আজ।
হতাশ জুয়েলকে প্রণোদনা যোগাতে বলি, তাই তো এখানে পা দিয়েই চলেছি পুরনোর সন্ধানে—রবিতীর্থে। তা ঠিকই বলেছেন আপনি, ও সায় দেয়, কেবল ওই জায়গাটারই খুব বড় একটা পরিবর্তন এখনো ঘটেনি, তবে চেষ্টা চলছে খুব। একসময় পথ সরু হয়ে এল, যখন বাঁ দিক থেকে হঠাৎ নতুন একটি সড়ক এসে আমাদের পথ হয়ে গেল। বুঝলাম, গতবার ওই পথে রিকশাভ্যানে চড়ে এসেছিলাম। মস্তবড় প্রবেশপথ হয়েছে কুঠিবাড়ির—নতুন, বাহারি উদ্যান রচনার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। সবই হল, কিন্তু জানা গেল, না জেনে আমরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এ্যাদ্দূর এসে পড়েছি। সেই খায়া পিয়া কুছ নেহি, এক গেলাস তোড়া, আ-ঠা-নে… কেসে পড়লাম নাকি? গাড়িভাড়াই গ""া গেল? দুপুরের খাওয়াটাও কোন্ ফাঁকে কোথায় গলে গেল কে জানে? কেবল এলুম-গেলুম-দেখলুম না কিছুই? না, এটা মেনে নেয়া যায় না একেবারেই। অতএব আমি চটি ফ্টফটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম, পেছনে আমার ফুট সোলজাররা মৃদু পায়ে অনুসরণ করছে, জুয়েলকে দেখা গেল একটু তফাতে পেছন-পেছন আসছে, দুই কানে ওর দু'টি সেলফোন। এমন না হলে জার্নালিস্ট? মনে মনে আবার বলি।
বহুদিন যাবত গোলাপি রঙে রঙিন থাকবার পর কুঠিবাড়ির রঙ বদলেছে। সদর দরজায় তালা। ওয়াকওয়ে বাঁয়ে ঘুরে জোড়া বকুল ও বাঁধানো ঘাটশোভিত পুকুরের দিকে গেছে। বাহ্, ওপারে একটি প্রশস্ত নতুন ঘাট বাঁধানো হয়েছে। পঁচানব্বুই সালে ওটা ছিল কি? মনে পড়ল না। বয়স বাড়ছে। একটি বকুল গাছের মৃত্যু বোধকরি আগেরবারই প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তবে এটা নিশ্চিত যে, সেই ঊনষাট সাল থেকে পুরনো বাঁধানো ঘাটের দু'দিকে আমি দু'টো মস্ত বকুল গাছই দেখে এসেছি। বেদিতে বসে আমড়াওয়ালা ছেলেটিকে ডেকে বেশ জম্পেশ করে কাঁচালঙ্কা-কাসুন্দি দিয়ে আমড়াঝাঁকা দিতে বললাম টাকা দশেকের। গোটা পাঁচেক আমড়া কেটে মশলাপাতিশুদ্ধ ওর কৌটায় ফেলে ছেলেটি ঢাকনা লাগিয়ে খুব খানিকক্ষণ ঝাকানাকা করে কলাপাতায় ঢেলে এগিয়ে দিল। আমি ওর ঝাঁকায় দশ টাকা ফেলে দিয়ে সাগ্রহে কলাপাতার বাসনটি বাঁ হাতের তালুতে বসিয়ে নিলাম। তারপর একটুকরো আমড়া তুলে মুখগহবরে চালান করে কামড় দিয়ে চোখ বুঁজে ফেল্লাম। আমার চোয়াল কিছুক্ষণ পর সচল হলে চোখ খুলে হাস্যমুখ ছেলেটিকে শুধাই, কোথ্থেকে এই প্রাণঘাতী লঙ্কা পেলি রে? বাড়ির গাছের মরিচ, স্যর, ওর গর্বিত জবাব শুনে বললাম, দু'টো দে তো, পকেটে করে নিয়ে যাই, রাতে ডাল-ভাতে ডলে খাব। খুশি হয়ে সে বেশ ক'টি ক্ষুদে মরিচ আমার হাতে তুলে দিল। ওকে আরও ক'টি খুচরো টাকা দিলাম জোর করে। অতঃপর রুবি, রুবাই এবং জুয়েল ওই আমড়ামাখা চাখার পর অঁকোর অঁকোর আওয়াজ তুলল। অতএব আরেক দফা আমড়াগাছি হল।
বকুলদীঘি পরিক্রমা করে, প্রচুর তস্বির খ্যাঁচাখেঁচির পর যখন ফিরতি যাত্রায় প্রধান ফটকের সামনে প্রায় পৌঁছে গেছি, তখনই পেছন থেকে সাজ্জাদের 'ইউরেকা, ইউরেকা' উল্লাসধ্বনি শুনে থমকে দাঁড়ালাম। এতক্ষণে হাসিমুখ জুয়েল কাছে এসে জানালো, বিস্তর ফোনাফুনির পর সে খুলনায় বিভাগের বিভাগীয় পুরাতত্ত্ব কর্মকর্তার নাগাল পেয়ে পরিস্থিতি ওর নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে, অর্থাৎ, শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে প্রবেশের বিশেষ অনুমতি পাওয়া গেছে। এবারে চল্ল কেয়ারটেকারকে খোঁজার পালা। জুয়েলের পরিচালনায় 'অপারেশন কেয়ারটেইকার হান্ট'-এ সাজ্জাদও যোগ দিল। আমি ওদের জানালাম, আমার চায়ের তেষ্টা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠার কারণে আমাকে বাদ দিয়ে ওরা কুঠিবাড়ি পরিদর্শনপর্ব শেষ করুক এবং আমি এই গেইটের বাইরে খোলা দোকানে 'অন কল' রইলুম। ভালই হল, সাজ্জাদ তো আগে কখনো এ তল্লাটে আসেনি, আমি স্বগতোক্তি করি, ওর ঝুলিতে গল্প করার মতো কিছু অভিজ্ঞতা জমা পড়বে। ঘন গোরুর দুধ আর সর দিয়ে কড়া লিকারের চিনিছাড়া এককাপ চায়ের কথা বলে আয়েস করে বসে সিগ্রেট ধরালাম।
ওরা ফেরত এসে কিছু স্যুভনির কেনাকাটা করে গাড়িতে উঠলো। এবারে ফেরার পালা। যথাসময়ে মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ির মোড় এসে গেল। বাঁয়ে গাঁয়ের ভেতর এক কিলোমিটার যাবার পর সাদা রঙ করা বিশাল অট্টালিকা। ইহাই তবে উহা। নেমে শ্রদ্ধানিবেদনান্তে ফের যাত্রা শুরু। কুষ্টিয়া শহরের এদিককার প্রান্ত ছুঁয়ে মিলপাড়ার লাগোয়া ছেঁউড়িয়া মৌজায় মরমী সাধক ও সঙ্গীত রচয়িতা লালন ফকিরের আশ্রম। ছেলেবেলায় দেখা আখড়ার সঙ্গে এখনকার আশ্রমের চেহারা মোটেই মিলল না। এবারে আমিও এই-প্রথম-এলাম ভাব নিয়ে ঘুরে ঘুরে মন দিয়ে সব দেখলাম। আর ক'দিন বাদেই অনুষ্ঠিতব্য লালন মেলা উপলক্ষে আগত সাধক-বাউল-সঙ্গীতশিল্পীদের দেখে ভাল লাগল। প্রকা- হলের মতো চারদিক খোলা ছাদওয়ালা দালানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বালক সব বয়সের অতিথি। একশো হাত লম্বা জটাজুটধারীকে ঘিরে কোথাও আসর বসেছে। কোথাও বা চাল-ডালে খিচুড়িভোগ রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত বাউলের সাধন সঙ্গিনী। রুবাই-সাজ্জাদ ছবি তুলে চলেছে। সংলগ্ন প্রাঙ্গনে একটি একতলা দালানের গর্ভগৃহে সন্ত লালনের সমাধি। তার অন্তিম আশ্রয় ঘিরে শিষ্যসেবকদের কবর। সীমানা পাঁচিলের ভেতর দেয়ালে লালনের বহুশ্রুত অমর বাণীসমূহের দৃষ্টিনন্দন ম্যূরাল। আইডিয়া যারই হোক, আমার ভাল লাগল দেখে।
বাইরে বিস্তীর্ণ কম্পাউন্ডে স্থায়ী মঞ্চে সাজসজ্জার কাজ চলছে আসন্ন মেলা উপলক্ষে। ওখানে চা খাওয়া হল। রুবি, রুবাই, সাজ্জাদ দোতারা, লালনের প্রতিকৃতি প্রভৃতি স্মারকবস্তু দেখল ঘুরে ঘুরে, কিছু কিনল। সাঁঝ ঘনিয়ে এলে গাড়িতে চাপলাম। তীর্থদর্শনের কুষ্টিয়াপর্ব সাঙ্গ হল বলা যায়। মিলপাড়া দিয়ে শহরে ঢোকা হল। তাড়া থাকায় জুয়েল-উজ্জ্বলদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও নামা গেল না। আরেকবারে হবে। আমি তো রাস্তা-ঘাট চিনতে ভুল করছি, প্রচুর নতুন নির্মাণ চোখে পড়ছে। আপনি আমাদের থানাপাড়ায় গড়াই পাড়ের রাস্তায় নিয়ে চলুন। সময় বাঁচাতে জুয়েলকে বলি। সেই হাই রোডের নাম ও চেহারার পরিবর্তন ঘটেছে। জুয়েলের নির্দেশে গাড়ি চালিয়ে সেলিম একসময় অপেক্ষাকৃত কম আলোকিত এক মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছল। আমার স্মৃতির মণিকোঠায় একটি-দু'টি বাল্ব জ্বলে উঠল। এটা সাতরাস্তার মোড় নয়? ওই রাস্তাটা যজ্ঞেশ্বর-রেনউইকের সেই কারখানার দিকে গেছে না? তাহলে এই ডাইনের রাস্তায় গেলে মনে হয় থানাপাড়ার ফরিদপুর লজে যেতে পারব। আমার ইন্সপায়ার্ড উচ্চারণ শুনে জুয়েল সোৎসাহে জানাল, ইউ আর ভেরি রাইট, স্যর। চিনলেন কীভাবে? আশ্চর্য! বলছেন, প্রায় ত্রিশ বছর পরে এই ঠিকানা খুঁজছেন!
প্রায়ান্ধকার রাস্তায় আস্তে আস্তে চলে ঠিক বাড়িটার সামনে এলে সেলিমকে থামতে বললাম। ওদের গাড়িতে বসতে বলে দরজায় বেল চাপলাম। কোনো সাড়া নেই। কড়া নাড়া দিলাম সশব্দে। এবারে ওপর থেকে জিজ্ঞাসা ভেসে এল, কে? লোডশেডিং চলছে তো। তাই বেল বাজেনি। কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে বললাম, ভাবী, আমি বাবু। ঢাকা থেকে এসেছি। একটুক্ষণ বিরতির পর দুড়দাড় সিঁড়ি বেয়ে কেউ নেমে আসছে টের পেলাম। ফ্ল্যাশলাইট হাতে ভাবীর বড় ছেলে এল, কোল্যপসিব্ল গেইটের তালা খুলল। আসেন বাবুকাকা। ওর আহবানে সাড়া দিয়ে বললাম, তোমার কাকিমাদের নিয়ে এস। আমি সেলিমকে বললাম, কিছু মিষ্টি নামিয়ে নিয়ে তুমিও এস। গেইটের বাঁদিকে ফাঁকা জায়গায় গাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে লক করে এস। বাতি চলে আসবে একটু পরেই। সবাই ধীরেসুস্থে ওপরে উঠলাম। নতুন জামাই সঙ্গে, পরিচয় করিয়ে দেয়ার দায়িত্ব আমারই। বড়খালার বড়ছেলে নান্নুভাই বছর দশেক আগে গত হয়েছেন। ভাবী দুই ছেলে, এক মেয়েকে বড় করেছেন। বাড়ি দোতলা করে নিচেরতলা কৃষিব্যাঙ্ককে ভাড়া দিয়েছেন। স্থানীয় ছেলে জুয়েল বেশ আলাপিও বটে। স্বচ্ছন্দে আধঘণ্টার মতো গল্পগুজব করে আমরা যাবার জন্য বিদায় চাইছি, এমনি সময় বাতি জ্বলল।
এবারে শেষ গন্তব্য: আমার মেজমামার বড়মেয়ে শাহির বাড়ি। ঠিকানায় পৌঁছতে মোটেই ঝামেলা হল না। সার্কিট হাউসের কাছেই নতুন আটতলা বাড়ির তৃতীয় তলায় ওদের ফ্ল্যাট। এখানেও একই সমস্যা। ও পাড়ায় আলো জ্বলল তো এখানে লোডশেডিং শুরু। একই রকম বিড়ম্বনা। এবার আমার বোনটি স্বয়ং বাতি হাতে নেমে এসে তালা খুলল। সেলিমকে বললাম, একই প্রক্রিয়া এখানেও চলবে। ও কেবল হেসে বলল, স্যরের মাথায় কত কিছু কত আগে থাইকা সেট করা। আমি হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলাম, বললাম, ফির আগে দেখো অউর কিয়া কুছ হোতা হ্যায়। শাহির ছোট্ট ফ্ল্যাট অত্যন্ত সুচারুরূপে ডিজাইন্ড ও সাজানো। খাবার টেবিল ঘিরে বসে আড্ডা জমানো হল। ফোন পেয়ে ওর ছেলে আসিফ মোটর সাইকেল চেপে এসে গেল। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে কাজ করে। ওর বাবা রিটায়ার করে টেকনিক্যাল বুক বোর্ডে উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছে। ঢাকায় পোস্টেড। মা ও ছেলের সংসার। ওদের ছোটছেলে পটুয়াখালিতে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। পাঁপড়-চা খেয়ে উঠে পড়লাম। হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলাম ক্লান্তি-র অজুহাত দেখিয়ে। বেরিয়ে এলাম। আসিফ আবার অফিসে ফেরত গেল।
দিশা-র আস্তানায় পৌঁছে জুয়েল বিদায় চাইল। আমরা সবাই ওর প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা উচিত মনে করেই করলাম। হাল্কা হলাম। ওর মোটর বাইকের সাইড ক্যারিয়ারে একবাক্স মিষ্টি তুলে দিলাম। বল্লাম, ফরিদপুরের বাঘাটের মিষ্টান্নশিল্পী মাগুরার ছাঁচিলাপুরে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত দুধের ছানা করে যে সুখাদ্য তৈরি করছে, তার নমুনা কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় একটুখানি পৌঁছে যাক্ না কেন? জুয়েল হেসে মোটর বাইকের স্টার্টারে কিক্ করল। ঘরে ফিরে প্রথমেই বেশ স্টিফ একটা ভডকা নিলাম গ্লাসে। লেবুর পাতলা-পাতলা দু'টো চাকা চাইলাম, এসে গেল। পানীয়ে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে আরাম করে জুতো-কাপড় বদলাতে লাগলাম। রুবি ঘরে ঢুকে, এয়ার-কুলার চালিয়ে দিয়ে গোসলে গেছে। চেয়ারে পিঠ হেলিয়ে দিয়ে মনে হচ্ছিল, সারাদিনের ক্লান্তি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে কক্সিক্সের অস্থিময় অস্তিত্বে বিলীন হচ্ছে। ত্রস্তভাবে চোখ মেললাম। খুট্ শব্দে বাথরুমের দরজা খুলেছে। আহ্! বাথরুমে যাও, মনে হবে সনা নিচ্ছ। রুবির কথায় সম্বিৎ পেয়ে বলি, হ্যাঁ। আমার শরীর জুড়িয়ে পান্তা। সনা-ই নেব অতঃপর। গামছা নিয়ে স্নানে যাই।
আমি স্নান সেরে বেরতে রাতের খাবারের ডাক পড়ল। গায়ে একটা পাতলা টি-শার্ট চাপিয়ে চটি চট্চটিয়ে নিয়ে নামলাম। রুবাইরা এল। বাহ্ চমৎকার। আলুভর্তা, বেগুনভাজা, লাউঘণ্ট, ডিমের কালিয়া আর ডাল—কার পছন্দে এ রকম বাঙলা ডিনারের আয়োজন? আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে সাজ্জাদ জানাল, আমরা তো দুপুরে কিছু বলে যাইনি। তাই আমি আর রুবাই ওদের বললাম, ভাঁড়ারে যা আছে, রাঁধ। এত রাতে আর মুরগি-টুরগি আনতে বলিনি। আর চৌগাছিতে তো যে যা তুলে দিয়েছেন পাতে, চোখ বুঁেজ খেয়েছি। তাই… ভেরি গুড, মাই বয়, বলে আমি ওর পিঠে হাত রাখি। রুবি-রুবাই মুচকি হাসে। লঙ্কা, লেবু, চৌগাছির আচার সহযোগে আমি একটি স্বস্তিকর ও স্বাদু নৈশাহার করলুম মনে হল। রাতে ভাল ঘুম হল। মাঝরাতে উঠে কেবল কুলারটা ফ্যানে দিয়ে আবার শয্যা নিয়েছিলাম।
সকালে উঠে নিঃশব্দে ঘর লক্ করে হাঁটতে গিয়েছিলাম। ঘাম ঝরিয়ে কাঁধে ফেলা গামছায় মুছে ভোরবেলাকার চা-খোরদের সঙ্গে বসে গল্পগুজবের সঙ্গে ছোট গ্লাসের চা খাওয়া হল দু'বার। ফিরে স্নান সেরে সবাই নাশতা করতে নিচে গেলাম। হাতরুটি, আলু-পেঁপের তরকারি, ডিমের ওমলিট আর পৌচ। বিল দিতে বলে ওপরে গিয়ে পোশাক পালটে তৈরি হলাম। বেরতে হবে সকাল-সকাল। সেলিম কি এখনো ঘুমোচ্ছে? না, সাজ্জাদ জানাল, ওকে তুলে দেয়া হয়েছে। আমি অতিথি নিবাসের বিল পেমেন্ট করে বাইরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট ধরাই। সবাই গাড়িতে ওঠে। তুমি খেয়েছো তো, সেলিম? জ্বি সার। গুমটা একটু বেশি অইয়া গেছে। সেলিমের কণ্ঠস্বর বেশ রিল্যাক্সড্—মনে হল। বেশ-বেশ, সবাই ভাল থাকলেই বেড়ানো সার্থক, মনে মনে বলি।
আজ তুমি চলে যাও পদ্মা পেরিয়ে পাবনা, আমি মানচিত্র দেখে সেলিমকে পথনির্দেশ দিতে দিতে বলি, পাবনা থেকে পরে যাব শাজাদপুরে ঠাকুরদের কাচারিবাড়ি, তারপর মঞ্জিলে ওয়াপাস্, ঠিক হ্যায়? জ্বি সার, আপনি ডিরেকশন দিবেন, আমি চালামু—কোনো অসুবিদা নাই। দু'পাশে শস্যক্ষেত—নানারকম রবিফসল ফলে পদ্মার এপার-ওপারে। এসে গেল লালন সেতু—আমাদের কারো সঙ্গেই এই সেতুর চাক্ষুস পরিচয় হয়নি আগে। সাজ্জাদ, রুবাই ছবি তুলল। হায় রে পদ্মা, নিচে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল নদীর বিশীর্ণা তাপসী কলেবর দেখে। দূরে শতাধিক বর্ষ হল হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দণ্ডায়মান—পাবনা-কুষ্টের লোকজন বলে, সাঁড়ার পুল। সেতু পেরিয়ে বাঁয়ে হাইওয়ে চলে গেল রাজশাহী হয়ে উত্তর বঙ্গের দিকে। নাক বরাবর সরু, পিচঢালা, তুলনামূলকভাবে কম ব্যবহৃত একটি পথ উত্তরে গেছে। ওই পথে চল, যদ্দূর মনে হয়, ওটা পাবনা যাবার পুরনো সড়ক, আমি সেলিমকে বলি। ইতস্ততঃ করে আধ কিলোমিটার যেতেই আধভাঙা হলুদ রঙ উঠে যাওয়া মাইলপোস্ট পাওয়া গেল। পাবনা ৯ মাইল। ঠিকই যাইতাছি সার, সেলিম উৎসাহিত ও নিশ্চিন্ত উচ্চারণ করে। আমি স্মৃতির ভাঁড়ারের দরজা খুলি।
পাবনা বাইপাসে গিয়ে উঠলাম। তুমি 'অনন্ত' সিনেমার ওখানে বাঁয়ে ঘুরবে। একটু ফলটল নেব যদি পাই, খেয়াল রেখ, সেলিম। আমি পঞ্চাশ বছর পেছনে চলে গিয়ে পুরনো শহরের হামিদ রোড, রূপকথা সিনেমা, লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভা-ার, বিশ্বাস অটো এজেন্সির বাসস্ট্যান্ড, বাণী সিনেমা, সুচিত্রা সেনদের বাড়ি, পুরনো ডাকঘর, বনমালী ইন্সটিটিউট, ডিএম কুটির অর্থাৎ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট'স বাংলো, খায়রুল কাকার বাড়ি পার হয়ে হেমায়তপুরের রাস্তায় পড়ি, শিল্প এলাকা পেরিয়ে একসময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সৎসঙ্গ আশ্রমের আঙিনায় পৌঁছে যাই, যেখান থেকে এগিয়ে গিয়ে পদ্মাপারে ঘুরে এসে মেন্টাল হসপিটাল হয়ে ফিরে আসি মোকামে, অর্থাৎ অনন্ত সিনেমার পাশে দাঁড় করানো ভ্যানের অভ্যন্তরে। পাশেই ফলের দোকান। আমি, সাজ্জাদ নেমে কিছু ফল, বিস্কুট নিলাম। চল এবার। আধ কিলোমিটার পরেই বাঁয়ে পাবনা গোরস্তান, তারপর রাস্তা নেমে গেছে হায়দার ব্রাদার্সের ভিটেয়। এরপর যে রাস্তাটা বাঁয়ে দেখবে, ওটাই আমাদের বাড়ির পথ। আমার কথামত সেলিম গাড়ি চালিয়ে একেবারে বাড়ির সামনে পুকুর পাড়ে থামাল। বাকি মিষ্টি এখানে নামিয়ে দাও, ওকে বললাম।
নেমে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সাঙ্গ করলাম। আমি পুরনো অভ্যাসমতো ছাদে যেতে চাইলাম। বাধা পেলাম। ছাদের ঘরে আমার সেজচাচার সেজছেলেকে শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। চুপ্সে গিয়ে পুকুর ঘাটে বসে ধূমপান করতে লাগলাম। দু'বছরের বড় মুকুল কাকা ডেকে তার ঘরে নিয়ে বসালেন। চাচাত বোনটি চা-চানাচুর-মিষ্টি-ফল পরিবেশন করল। জলবিয়োগ করতে বাথরুমে গেলাম। ফিরে ছোটদাদির পুরনো উঁচু খাটে শুয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ চোখ বুঁজে। শৈশবে দাদির সঙ্গে আমি এই প্রকা- খাটে ঘুমোতাম। রুবি মেয়ে-জামাইকে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে সবার ঘরে ভিজিট সেরে এল। তোমার ছোট ভাই মুশতাককে বৌমা ফোনে জানিয়েছে। ও আসছে এক্ষুনি। আমি কিছু বলার আগেই মুশতাককে পুকুরপাড়ে রিকশা থেকে নামতে দেখলাম। ওর হাত থেকে ঝোলা নিয়ে বৌমা ভেতরে গেল।
আমি জানালাম, শাজাদপুর কাচারি বাড়ি হয়ে ঢাকা ফিরব তো, সুতরাং, যত আগে বেরনো যায়…। মুশতাক নাছোড়বান্দা, ভাত-টাত খেয়ে তারপর ঢাকা যাবেন। পুকুরঘাটে হেলান দিয়ে বসে সেলিম চা খাচ্ছিল ধীরেসুস্থে। আমি সেলিমকে রেডি হতে বললে মুশতাকের টনক নড়ল। তাহলে নাস্তাপানি যা এনেছি গাড়িতে তুলে দি', বড়ভাই, ঠিক আছে? ওর উৎকণ্ঠা প্রশমিত করার জন্য বললাম, ওক্কে ভাই, তাই হবে'খন, তুমি যখন ছাড়বেই না। ঐ তোমার প্রেশার কুকার সিটি মারছে, বৌমা, মাংসটা মন দিয়ে রেঁধে আমার পাগলা ভাইটাকে খাওয়াবে কিন্তু। বলেই মনে মনে জিভে কামড় দিলাম। কি না কী ভেবে বসে মেয়েটা—ভাই তো আরো একটা বদ্ধপাগল। মুকুল কাকার সঙ্গে কোলাকুলি করে দ্রুত গাড়ির পানে হাঁটা দিলাম। এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকলে আবার বেফাঁস কিছু বলে বসব।
উল্টোপথে চল, দোহারপাড়ার ভেতর দিয়ে ঢাকা রোডে উঠবে, বললাম সেলিমকে। দোহারপাড়াকে আর গ্রাম বলা যায় না কোনোক্রমেই। আমাদের মৌজাতেই অনেকগুলি হাউজিং সোসাইটি ছোট ছোট প্লট করে জমি বিক্রি করছে। চিকন কালো কালো বাঁধানো পথ গোটা গাঁটাকে ক্রিসক্রস করেছে। ডিভেলপারদের দখলে পুরো গ্রাম-মহল্লা! তাড়াতাড়ি চল সেলিম এখান থেকে, আমি বলি, সারা গ্রামে একটা গাছ নেই, পুকুর নেই। এতো আরেক জেনিভা ক্যাম্পে এসেছি মনে হচ্ছে!
তবে আপনাগো বাড়িতে গুইরা দেখলাম, সব ফলের গাছই আছে অনেকগুলি কইরা সার।
ওগুলো আর পরের বারে এলে দেখবে না, চল, বীতশ্রদ্ধ কণ্ঠস্বর আমার নিজের কানেই নিরস হয়ে বাজল। পরিত্রাণের আশায় স্মৃতি যেহেতু সততই সুখের, সেখানেই আশ্রয় নিলাম। ফিরে গেলাম সন আটান্নোয়, যেবার স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল মো. আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। তখন আমার মেজকাকা মীর মোহাম্মদ আলীর প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। তার নাম রাখা হল মীর আইয়ুব আলী। ২৭ শে অক্টোবর আইয়ুবের জন্মদিন, আইয়ুব খানের সর্বময় ক্ষমতা অধিগ্রহণের দিনও সেটি। মেজকাকার মস্তবড় ফার্মেসি ছিল মিউনিসিপ্যালিটির উল্টোবাগে। আমার স্কুল সেইন্ট গ্রেগরীজও ওই একই জায়গায়—লক্ষ্মীবাজারে।
মেজকাকার বিয়ের আগে আমি আর কাকা পাবনা গিয়েছিলাম পাত্রী দেখতে। সাদুল্লাপুরের চৌধুরীদের বাড়িতে পালিতা আত্মীয়া কারিয়াকে দেখে চাচার হৃদয় দ্রবীভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সাত বছর বয়সে আমি সেটা বুঝে সায় দিয়েছিলাম বিয়েতে। আর যায় কোথা? পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাজী এসে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বিয়ে সম্পন্ন করে দিলেন। চৌধুরীদের শালগাড়িয়ার বাড়ি থেকে কাকা আর আমি যখন রিকশায় শহরের আরেক প্রান্তে আমাদের দোহারপাড়ার বাড়ি ফিরছি, কাকা আমার কানের কাছে গুণগুণ স্বরে নানা যুক্তির জাল বুনে যাচ্ছিলেন। মোদ্দা কথা, প্রিয় ভাইপোর ওপর তখন অনেক কিছু নির্ভর করছে, এটা আমি বুঝে নিলাম এবং কর্তব্য ঠিক করলাম। মীরবাড়ির সদর দপ্তর দোহারপাড়া এবং আমাদের ঢাকার বাসায় ঐ গাঁটছড়া বাঁধবার ঘটনাকে মঙ্গলদায়ক ও পরিবারের সুখসমৃদ্ধির জন্য সহায়ক প্রতিপন্ন করার ব্যাপারে আমাকে বালসুলভ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা করেছিলামও সফলভাবে। মীর হায়দার আলির বড় নাতি হিসেবে আমার গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত—তাই ওটা সম্ভব হয়েছিল।
মেজকাকা একসময় আলাদা বাড়ি ভাড়া করে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। কাছাকাছি বাস করার সুবাদে আমাদের দু'বাড়ির বাসিন্দাদের আসা যাওয়া ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। মুকুল কাকা পাবনার স্কুল থেকে টিসি নিয়ে ঢাকা এসে ইস্ট বেঙ্গল ইন্সটিটিউশ্যনে ভর্তি হয়েছেন আমার একক্লাস ওপরে। মেজকাকী কোলকাতার মেয়ে। তার রান্নাবান্না, পোশাক আশাক পরার কায়দা অন্যরকম ছিল। আমাদের বাচ্চাদের কাছে মেজকাকীর খাসির রেজালা হিট্ রান্না মনে হত। মা ঠিক সায় দিতেন না ওতে। তবে চর্বিদার খাসির মাংস ওবাড়িতে প্রায় রোজই আসত। অনেক বছর পরেও আমি কারিয়া বেগমকে বলতে শুনেছি, মুকুল, বাজার থেকে চরবওয়ালা খাসির মাংস এনো। সে হুকুম এখনো কানে বাজে। আমার মেজকাকার ব্যবসা বাড়ে, প্রচুর জমিজমা কেনেন শহরে, আশেপাশে, কাকিমা গয়না গড়ান এন্তার, শাড়ি কেনেন লট্ ধরে। কাকাকে হৃদয়ের ব্যারামে ধরে, অকালে ঝরে যান। বিধবা কারিয়া বেগম, ছেলে, তিন মেয়ে ও বিস্তর সম্পদ রেখে। চালু দোকানই তো ছিল গোটা দুই তখনো। তারপর শুধু ক্ষয়ের গল্প। ঢাকা শহরে বোধকরি ওদের আর কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। সবই বিক্রি হয়ে গেছে। আইয়ুব আলী সব উড়িয়ে-ঝুরিয়ে দিয়েছে।
স্মৃতিচারণার ফাঁকে-ফাঁকে জেনে নিচ্ছিলাম, শাজাদপুরের পথ কদ্দূর এগোনো গেল। আর দূরে নেই, আর দূর নয়… সেলিম পথ চিনে দু'তিনটে শর্টকাট পথ ধরেছে ইতোমধ্যে। তো মুকুল কাকা জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আযম কলেজে পড়া শেষ করে পল্লী উন্নয়নের কাজে লেগে যান। অবসর নিয়েছেন এই সেদিন পাবনার বিআরডিবি অধিকর্তা হিসেবে। পৈতৃক ভিটেয় ঘরবাড়ি তুলে ভাড়া দিয়েছেন, বসবাস করছেন আলহাজ্ব মীর মোকাররম আলী।
শাজাদপুর বাজার পেরিয়ে কাচারিবাড়ির বাইরে গাড়ি রেখে টিকিট কেটে ঢোকা হল। বাগানে ফুল না থাকলেও পরিসরটি বড়, ভাল লাগল। অডিটরিয়াম, লাইব্রেরি হয়েছে। কাচারিবাড়ির কলি ফেরানো হয়েছে। নিচে-ওপরে ঘুরে ঘুরে ঘরগুলো, দ্রষ্টব্য বস্তুরাজি দেখা হল। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, আজ দেখার পর আরেকটি পুষে রাখা বাসনা নিবৃত্ত হল। গাড়ি ছুটল উত্তরে। যমুনা সেতু পার হবার আগে এক রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ খেলাম। নদী পার হলাম বিকেল তিনটেয়। টাঙ্গাইলের পর থেকেই লম্বা টেইলব্যাক—হাইওয়েতে যানজটের খবর লিখি, আজ প্রত্যক্ষ করলাম। গাজিপুর চৌরাস্তা হয়ে গেলে তেমন ভিড় নাও হতে পারে—ভেবে চন্দ্রা মোড়ে ডাইনে না ঘুরে সেলিম সোজা চলল এবং মৌচাকের পর থেকেই আবার দীর্ঘ, সর্পিল গাড়ির সারি। কখনো একেবারে থেমে থাকতে হচ্ছে। সেলিমের আদরের বোনপো বারবার ফোন করছে, চারদিন মামাকে দেখে না বাচ্চাটা। সেলিম তাকে প্রবোধ দিয়ে চলেছে, এই তো আসছি, মামা। তোমার জন্য আনব…।
রুবাই-সাজ্জাদকে ওদের বাসায় নামিয়ে আমাদের বাড়ি ফিরতে রাত ন'টা হয়েছিল। তাও ভালো। ক'দিন আগে উবিনীগ-এর কর্মকাণ্ড দেখে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা ফিরতে ছ'ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা কমে যাওয়াতেই তো মাঝে-মাঝে আমাদের এই উৎসে ফেরার মহড়া চলে, ফিরে আসতে হয় আবার এই শহরেই—নানা ধরনের টানে—কোনোটাই প্রাণের নয় যদিও। বৃটিশ রোম্যান্টিক কবিরা লিখতেন, 'ইয়ারো ভিজিটেড', ফিরে দেখে 'ইয়ারো রিভিজিটেড'—তেমনি আমরাও যেখান থেকে এসেছি, সেই জায়গাগুলো ফিরে ফিরে গিয়ে দেখলে মন শান্ত হয়, আবার ফিরে আসি কংক্রিট আর কাচের দখলে, শ্বাস নিই ভয়ে ভয়ে। আর অপেক্ষায় থাকি—আবার যাবো কবে সবুজে-শ্যামলে-সরিষার ক্ষেতে নদীর সমীপে!