Published : 25 Apr 2021, 10:35 PM
মাত্র পঞ্চাশ বছরের (জন্ম: ২৮ এপ্রিল, ১৯৫৩; মৃত্যু: ১৫ জুলাই, ২০০৩) এক ছন্নছাড়া জীবন যাপন করা চিলির বহুমুখী লেখক রবের্তো বোলানঞ একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ট্রাকচালক এবং খণ্ডকালীন মুষ্টিযোদ্ধা আর মা ছিলেন শিক্ষিকা। শৈশব থেকেই যে বই-ই হাতে পেতো তা-ই গোগ্রাসে পাঠ করার অভ্যাস ছিল; যদিও শব্দ শুনে আত্মস্থ করা, পড়া ও লেখার এক জন্মগত সীমাবদ্ধতা (ডিজলেক্সিয়া) নিয়ে সে বেড়ে ওপর ওঠে।
রবের্তো বোলানঞ পনের বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে পরিবারের সঙ্গে মেক্সিকো সিটিতে পাড়ি জমায়, সেখানেই কাটে তাঁর তারুণ্যের অধিকাংশ সময়। মেক্সিকো সিটির বিশালতা আর ব্যস্ততা তাকে এক কল্পজগতে টেনে নেয়। মেক্সিকোতে থিতু হয়েই সে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ে। তারপর নিজেকে কবিতা আর বামপন্থি ছাত্র রাজনীতিতে সমর্পণ করেন এবং একজন কবি হয়ে উঠেন। রবের্তো বোলানঞ বেশ কিছু তরুণ কবিবন্ধুকে নিয়ে একটি সাহিত্যচক্র "ইনফ্রারিয়ালিস্তাস" গঠন করেন,যার কার্যক্রম প্রধানত বিপ্লবাত্মক বা বিদ্রোহীমূলক ছিল। রবের্তো বোলানঞ নিজেকে পুরোপুরি ও একমাত্র কবি হিসেবেই প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন যদিও পরবর্তীতে বেশ বিলম্বে সংসার চালানোর জন্য গল্প-উপন্যাসে লেখায় হাত দিয়েছিলেন। জন্মভূমি চিলের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে আসেন এবং সালবাদর আইয়েন্দের মৃত্যুর পর আউগুস্তো পিনোশেতের বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হোন। সেখান থেকে এক কারারক্ষী- যে তার স্কুলজীবনের সহপাঠী ছিল- তাঁর সহায়তায় প্রাণ বাঁচিয়ে মেক্সিকোতে ফিরে যান। মেক্সিকোতে থাকা অবস্থায় তার প্রথম কবিতা সংগ্রহ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৭ সালে রবের্তো বোলানঞ বিশ্বভ্রমণে বের হয়ে স্পেনে স্থায়ী হন এবং বিয়ে করেন। সেখানে তিনি নিম্ন-বেতনে কাজ করেন এবং ১৯৯০ সালে তার সন্তানের জন্মের পর অধিকতর বেশি আয়ের আশায় গদ্য এবং গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। কিছু ছোট গল্প লেখার পর ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেন "স্কেটিং রিংক্"। তারপর ১৯৯৬ সালে "আমেরিকান নাজি লিটারেচার"এবং "ডিসট্যান্ট স্টার"।
১৯৯৮ সালে প্রকাশিত "দ্য সেভেইজ ডিটেক্টিভ" তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো উপন্যাস যা তাঁকে রাতারাতি লাতিন সাহিত্যের তারকায় পরিণত করে দেয় এবং মর্যাদাপূর্ণ রমুলো গাইয়েগোস পুরষ্কার এনে দেয়। ১৯৯২ সালে লিভারের দূরারোগ্য ব্যাধিতে (হেপাটাইটিস-সি) আক্রান্ত হন আর উন্মত্ত হয়ে লিখতে থাকেন। শেষদিকে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বই প্রকাশ করতে থাকেন। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ উপন্যাস "বাই নাইট ইন চিলে" ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। লিভার প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থেকে ২০০৩ সালে বার্সেলোনায় তাঁর ব্যস্ত আর অস্থির জীবনের অবসান ঘটে।
যদিও "দ্য সেভেইজ ডিটেক্টিভ" প্রকাশিত হওয়ার পরই রবের্তো বোলাইনঞ লাতিন দেশগুলোতে বেশ সমাদৃত হয়ে যান কিন্তু তাঁর মৃত্যুর আগে বহিবিশ্বে তাঁর লেখা তেমন অনুদিত ও পঠিত হয়নি। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস "২৬৬৬" প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়। এক পর্যায়ে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত তাঁর সকল লেখা ইংরেজিতে অনূদিত হতে থাকে। মৃত্যুর পর আরও ১৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ছোটগল্প সংগ্রহ "দ্য সিক্রেট অব এভিল, ২০০৭"; কবিতা সঙ্কলন "আননোন ইউনিভার্সিটি, ২০০৭", উপন্যাস "থার্ড রাইখ, ২০১০" আর "ওউজ অব দ্য ট্রু পুলিশম্যান"। প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার কবিতা সঙ্কলন "আননোন ইউনিভার্সিটি"তে মনে হয় যেন কেউ ডায়েরিতে ধারাবাহিকভাবে লিখিত তাঁর মহাকাব্যিক জীবনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত পাঠ করে শোনাচ্ছেন। শেষের দিকের কবিতাগুলো যখন লেখা হয় তখন তাঁর লিভারের অসুস্থতা ধরা পড়ে।
১৯৯৩ সালে তাঁর পুত্রের জন্ম হয়। তখন দুটো কবিতায় পুত্র লোটারোকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন- "প্রিয় পুত্র, অনুশোচনা হবে না/ যদি পাঠ করো প্রবীণ কবিদের…"
নিখোঁজ গুপ্তচর
অন্ধকার নগরে নিখোঁজ গুপ্তচর
শুনতে পাচ্ছি বিলাপ
রঙ্গমঞ্চে তাদের পদধ্বনি
এগিয়ে আসছে কণ্ঠস্বরের তীর
ক্যাফে আর পার্কের ছায়া ছোটাছুটি করছে কৈশোরে।
তোমার খোলা হাতে গুপ্তচরের দৃষ্টি
যার নিয়তি নিজের রক্তে রঞ্জিত
আর তুমিতো স্মরণও করতে পারছো না
ভালবাসার মুখগুলো
কোথায় ছিল সেই ক্ষত
কোথায় সেই নারী, যে বাঁচিয়েছিল জীবন।
দরদী কুকুর
যদি ফেরা যেতো কুড়ি বছরে
হয়ে যেতাম ছিটগ্রস্ত।
হয়তো হারাতাম একটি দেশ
কিন্তু জিতে নিতাম এক স্বপ্ন।
আর তেমন স্বপ্নের কাছে সব তুচ্ছ
পেশা, প্রার্থনা অথবা দরদী কুকুরের
পাশে প্রভাতী পড়াশুনা।
আর সেই স্বপ্ন আত্মার শূন্যতায় প্রোথিত থাকতো
গ্রীষ্মমণ্ডলের এক ফুসফুসের ভিতর
আলোআঁধারির এক কুটির
আর কখনো যদি ফেরা যেতো নিজেরই মাঝে
ঘুরে দেখতাম স্বপ্নের অন্দরমহল:
তরল ভাবনায় অমরত্ব পাওয়া এক মূর্তি
ভালবাসায় কিলবিলরত এক শ্বেতকৃমি।
এক লাগামহীন ভালবাসা, স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন
আর এক দুঃস্বপ্ন ডেকে হয়তো বলতো:
সাবালক হও তুমি। ব্যথা আর গোলকধাঁধার ছায়াকে
পিছনে ফেলে বিস্মৃত হয়ে চলে যাও।
কিন্তু ফিরে এসে আবার বেড়ে ওঠাতো পাপ।
এখানেই থেকে যাবো আমি দরদী কুকুরের সাথে।
সহস্র বছর বাদে কিছুই টিকবে না
এই শতকে যা কিছু লিখিত
সহস্র বছর বাদে টিকবে না কিছু।
তারা পাঠ করবে নড়বড়ে বাক্য
হারানো নারীর মুখ
নিথর শিশুর দেহাবশেষ।
টিকবে না
তোমার ধীর সবুজ চোখ
যেনো গ্রিক কাব্য-
এমনকি আরো প্রাচীন কিছু
যেনো আরেক আশ্চর্য
আরেক অনাসক্ত শীতের সমুদ্রতীর।
বৃষ্টি
বৃষ্টি দেখে তুমি বললে-
যেন কেঁদে উঠছে মেঘগুলো।
তুমি মুখ ঢেকে পালালে জোর-কদমে।
আর যেন সেইসব অস্থিসার মেঘগুলো
কেঁদে উঠলো ফুঁপিয়ে।
যদি তা-ই হয় অলিক
তবে কেন সেইসব ক্রোধ, হতাশা
যা নিয়ে যায় সর্বনাশের পথে?
প্রকৃতি, গুপ্ত রাখে কিছু কারদানি
সৎভাই প্রহেলিকার কাছে।
তাই অদ্য বিকেলে, যাকে তুমি বলেছো
পৃথিবীর এই অন্তিম বিকেল
ধারণাতীত দ্রুততায় বিলীন হবে বিষন্নতায়
অতঃপর এই বিকলে নিঃসঙ্গ হয়ে হারিয়ে যাবে
প্রকৃতির দর্পনঃ স্মৃতিতে। অথবা ভুলে যাবে সব।
আজ বৃষ্টি, ক্রন্দন, অথবা গিরিপথে প্রতিধ্বনিত
তোমার পদধ্বনিতে কিছুই এসে যায় না;
আর এখন তুমি শুধু কাঁদতে পারো।
ফুটপাথের পাশে রাখা গাড়ির উইন্ডশিল্ডে
তোমার প্রতিকৃতিকে মলিন হতে দিতে পারো
কিন্তু কিছুতেই তুমি হারিয়ে যেতে পারো না।
মেক্সিকোতে গডজিলা
শোন পুত্র, শোন অনন্যচিত্তে-
মেক্সিকো শহরে যখন পড়ছিল বোমা
ঠাহরও করতে পারেনি কেউ
সড়ক আর জানালায় ঢুকছিলো বিষাক্ত বাতাস
হয়তো তুমি মাত্রই আহার শেষে
কার্টুন দেখছিলে টেলিভিশনে।
শয়নকক্ষে ব্যস্ত, ভেবেছিলাম মরে যাচ্ছি আমরা।
মাথা ঘূর্ণন আর বমনেচ্ছা ঠেলে পৌঁছে দেখি
রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে আছো তুমি
আলিঙ্গন করতেই জানতে চাইলে
-কী ঘটেছে?
বলতে পারিনি আমরা আছি এক মৃত্যু-কর্মসূচীতে
– ঘাবড়াবে না, চলছি একসাথে এক অন্য ভ্রমনে।
তারপর সবকিছু ঠিকঠাক
মৃত্যু আমাদের চোখ বুজাতেও হয়েছিল ব্যর্থ।
তারপর সপ্তাহ বা বছর বাদে
কোন একদিন জানতে চাইলে
-আমরা তাহলে কী?
পঁচা স্যুপের গামলায় ভাসতে থাকা
পিপীলিকা, ভোমরা অথবা পোকা?
-পুত্র, আমরা মানুষ, অনেকটা পাখি অথবা দেবতা
প্রকাশ্য অথবা গুপ্ত…
নোংরা, মলিন পোশাকে
যে পথে কুকুরেরা হাঁটে সে পথেই
আত্মা আমার পেয়েছে হৃদয়ের হদিস।
ভগ্ন-শরীর কিন্তু প্রাণবন্ত
নোংরা, মলিন পোশাক কিন্তু প্রেমপূর্ণ।
যে পথে কুকুরেরা চলে
সে পথে যায় না কেউ
শুধু অনন্যোপায় কবিগণ হাঁটে
যদিও আমার কতকিছুই আছে করার!
তবুও আমি: লাল পিঁপড়াদের জন্য, কালো পিঁপড়াদের জন্য
ঝুলিয়েছি নিজেকে ফাঁসির রজ্জুতে
আর ঘুরে বেড়াই বিরাণ গ্রামজুড়ে:
ভীতি বাড়ছে নক্ষত্র পর্যন্ত।
যে চিলিয়ান বেড়ে উঠেছে মেক্সিকোতে
বিশ্বাস আমার, টিকে যাবে সে
কিন্তু তেমনতো ঘটেনি
আমার বুক কেঁদে ওঠে রাতে।
এক জীবন-নদী কিছু জ্বরাক্রান্ত ঠোঁটের গল্প করছে
পরে জেনেছি এইসব নিজেরই ঠোঁট।
জীবনের-নদী, জীবনের-নদী,
পরমানন্দ ভেঙে পড়ে এইসব বিরাণ গাঁয়ে।
গণিতবিদ আর ধর্মতত্ত্ববিদগণ,
জ্যোতিষী আর লুঠেরারা
জেগে ওঠে ধাতব বাস্তবতার মাঝে
এক জলজ দুনিয়া হয়ে।
দর্শনকে তাঁতিয়ে দিতে সক্ষম
কেবল কবিতা আর জ্বর
কেবল প্রেম আর স্মৃতি।
এই পথও না, এই প্রান্তরও না। এমনকি এই গোলকধাঁধাও পারবে না।
এটা সত্যি, আমার আত্মায়
হৃদয়ের হদিস না পাওয়া পর্যন্ত
আমি পীড়িতই ছিলাম কিন্তু
বেঁচেতো ছিলাম।
নাচতে শেখাও
নাচতে শেখাও
শেখাও মেঘের তুলোয় আঙুলের মুদ্রা
কেমন করে ছাড়িয়ে নেবো
তোমার পায়ে জড়িয়ে থাকা আমার পা।
শেখাও, বালির উপর বাইক চালানো
স্বপ্নের রাজপথে সাইকেলে প্যাডেল মারা
করিডোরের শেষ মাথায় কেমন করে ভেসে থাকে নিথর ধোঁয়া
স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেন ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য।
ঝুলানো আয়নায় দেখি
নিজের মুখের মাস্কারা আর নখের আঁচড়
তুমি দেখবে আমার গালে অশ্রুর নক্ষত্র
আর আমি পালিয়ে যাবো…
শেখাও, তোমার দেহে ক্ষতের উপর কেমন করে লেপ্টে থাকি
কেমন করে কিছু সময় তোমার হৃদয় হাতের উপর ধরে রাখি
শেষ বিকেলের শিশিরে ফুল যেমন বাতাসে পাপড়িগুলো মেলে ধরে
পা দুটো ছড়িয়ে দিতে তেমন করে শিখিয়ে দাও।
এই রাতে নাচতে শেখাও, তালে তালে তোমার ছন্দে নাচতে চাই
ছাদের দরজা খুলে দিতে চাই
তোমার একাকিত্বে বিলাপ করবো আর উপর থেকে তাকিয়ে দেখবো
গাড়ি, ট্রাক, জ্বলন্ত মেশিন আর পুলিশের দখলে রাজপথ।
শিখিয়ে দাও পাদুটো ছড়িয়ে নিয়ে নিজের মাঝে লাগিয়ে নিতে
আর আমার মৃগী-কম্পন ধারণ করো তোমার চোখে
তোমার ঠোঁটে জড়িয়ে রাখো আমার চুল আর শঙ্কা
যেগুলো উচ্চারণ করেছে এত অভিশাপ! আর ধারণ করে আছে এত ছায়া!
নিদ্রায় ঢলে পড়তে শেখাও, এখানেই হোক সমাপ্তি।