Published : 19 Oct 2020, 05:06 PM
বিস্তীর্ণ কলকাতা, কত গলি, কত বাড়ি, রাজপথ। এখনকার সুসজ্জিত কলকাতা, ঝালরের সমারোহ সারি-সারি দোকান, অভিজাত অফিস, মোটরকার ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে বুদ্ধদেব বসুর সময়ে এমন জমজমাট ছিল না। এই শহরের বুকে বুদ্ধদেব নিজ প্রতিভায়-মর্যাদায় অবিচল হয়ে অগ্নিময়, জ্বল জ্বল করছেন যেন। কবিতায় তাঁর নিজের অবস্থান স্পষ্ট হচ্ছে, গল্প-উপন্যাস নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। রাণুকে বিয়ে করবেন অথচ চাকরি নেই। কিন্তু এসব নিয়ে কে ভাবে! লেখক-কবি হিসেবে কীতিকর্ম তো কম নেই। রাণুকে যে তিনি বিয়ে করতে আগ্রহী এমনটি সোজাসুজি ভাবে রাণুর বাবা-মা'কে জানিয়ে দেবার পর বিয়েটা অনেকটাই এগিয়ে যায়। এর আগে পাত্রের চাকরি নেই, এই শোরগোলে প্রেমের আনন্দের স্বাদ ফিকে হয়ে উঠছিল। প্রতিভা বসু তাঁর আত্মজীবনী 'জীবনের জলছবি'তে লিখেছেন, যেদিন বুদ্ধদেব তাঁকে এনগেজমেন্ট রিং পরিয়ে দিয়েছিলেন সেদিনই খুব আশ্চর্যভাবে রিপন কলেজে অধ্যাপনার চাকরিটি পাকা হয়। বিয়ের কথা চূড়ান্ত হবার সময়েই চাকরি- এই সমাপতন না হলে ঘরবাঁধার সূর্যালোকিত স্বপ্ন হয়ত ভেঙেই যেত। বলিদানের পাটাতন তো তৈরীই ছিল, অনেক অনেক দামী সুপাত্র, তাদের আবার নানা প্রতিভা। বিয়ে হয় উনিশ শ চৌত্রিশ সালে, যখন বুদ্ধদেবের বয়স ছিল ছাব্বিশ।
কলেজের চাকরিটি বুদ্ধদেব মাত্র এগার বছর করেছিলেন। কেন চাকরি ছাড়লেন সেই আলোচনায় আমরা পরে প্রবৃত্ত হব।
রিপন কলেজ ভারতের অন্যতম প্রাচীন কলেজ। ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড রিপনের নামানুসারে ১৮৮৪ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রিপনে তিনি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন কবি বিষ্ণু দে-কে। বুদ্ধদেব এবং বিষ্ণু দে দুজনই ইংরেজি পড়াতেন। 'লঙ্গার ন্যারেটিভ পোয়েমস' নামের কবিতা সংকলন থেকে পড়াতেন বিষ্ণু দে, 'শর্টার ইংলিশ স্টোরিজ' পড়াতেন বুদ্ধদেব বসু। রুটিনে লেখা থাকত, লঙ্গার বি. দে আর শর্টার বি. বোস। যারা এদের দুজনকে দেখেছেন তারা এই রসিকতার মর্মার্থ উদ্ধার করে বেশ মজা পেতেন। কলেজটি বিখ্যাত হলেও এখানে বিভিন্ন জায়গার ফেল করা ছাত্ররা পড়তে আসতো। বুদ্ধদেব রিপনেই প্রথম ছাত্রদের মধ্যে 'ইম্পট্যান্ট' কোশ্চেন পড়ার প্রচলন দেখেন এবং এ শব্দটির অর্থ সম্পর্কেও প্রথম অবগত হয়েছিলেন। অনুশীলনরহিত, উৎসাহরহিত ছাত্রদের ওপর তিনি বেশ বিরক্তও ছিলেন। এখানে দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে একটা করে প্লাকড সেকশন থাকত, সব কলেজের ফেল করা ছাত্ররা সেই প্লাকড সেকশনে ক্লাশ করত; ঐ ক্লাশে পড়াতে দেওয়া হত নতুন অধ্যাপকদের। তাঁর সেই সময়ের সহকর্মী অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের কথানুযায়ী, বুদ্ধদেব বসু সহ কয়েকজন নবীন অধ্যাপককে অনার্সের ক্লাস না দিয়ে ফেল করা ছাত্রদের পড়াতে বাধ্য করা হত। এছাড়া সে-সময়ে কলেজের আর্থিক অবস্থাও ভাল যাচ্ছিল না। জাপানি বোমার ভয়ে লোকজন কলকাতা থেকে পালাচ্ছিল। এসবের প্রেক্ষিতে দিনাজপুরে কলেজের একটি শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হলো। আয় বাড়াবার জন্য কমার্স ক্লাশও আরম্ভ হয়েছিল। আগে মাসের প্রথমেই শিক্ষকদের বেতন দিয়ে দেওয়া হত, আয় কমে যাবার কারণে বেতন প্রদানে কিস্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। কবি বিষ্ণু দে চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ বুদ্ধদেব বসুকে দিনাজপুরে বদলি করার চিন্তাভাবনা করছে শুনে বুদ্ধদেবও চাকরি ছেড়ে দিলেন।
আয় রোজগার নেই, স্বপ্ন-আশা ধূলিসাৎ হবার উপক্রম। সংসারের কাজে বুদ্ধদেব কখনো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু খরচের সংস্থান না হতে একেবারে ভেঙে পড়লেন। ছয় বছরের কন্যা দময়ন্তীর জন্মদিনে একটি উপহার দেবেন, সে টাকা নেই, বাধ্য হয়ে জন্মদিনে মেয়েকে উপহার দিলেন নিজের লেখা কবিতা। একপাতা চকোলেটের সঙ্গে কবিতাটি লুকিয়ে রেখে দেন মেয়ের বালিশের তলায়, দময়ন্তী সে-বস্তু আবিষ্কার করে কী যে খুশি!
'ও রুমি, ও রুমি, আমায় চিনবে না কো তুমি, আমি তোমার পরি-মা।'
লেখকের কল্পনার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় গল্পে কতো চরিত্র প্রাণ পায়, প্রতীকচিহ্ন দিয়ে জীবনকে আশ্চর্য জীবন্ত করেন লেখক, অথচ নিজের জীবনের ফাটলে জোড়া লাগাবার উপায় নেই। রোজগারের অসুবিধা মেটাতে বুদ্ধদেব স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে একদিন কলাম লেখার কাজ নিলেন। প্রতিভা বসুর সাংসারিক বুদ্ধি ছিল সাংঘাতিক। বিয়ের পর সংসার পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। 'কবিতা' পত্রিকা সহ বই পত্র প্রকাশের খরচ উৎরে বাড়তি কিছু জমা হত না বলে তখন ছাপাখানায় বাকীর খাতা ভারী হয়ে গিয়েছিল। স্টেটসম্যানে কলাম লিখে বুদ্ধদেবের উপার্জন ছিল ৩৫০ টাকা, যা আগের রিপন কলেজের চাকরির বেতনের তুলনায় অনেকটা বেশি। ধারদেনা কমে গেল। এখনকার 'কবিতাভবনে'র সংসার, সংসার তো নয়, যেন সুখের পাঁচালী।
রিপন কলেজ থেকে চাকরি ছাড়ার পর তাঁর সারাটি দিন যথার্থভাবে প্রতিবিম্বিত হত লেখালেখিতে। সকাল সাড়ে ন'টায় লিখতে বসা, সোয়া একটায় দুপুরের খাবার খেয়ে ফের টেবিলে। নিজের লেখা তৈরী, অন্যের লেখা সম্পাদনা করা, দিনটি যেন হারিয়ে যেত হাওয়ায় হাওয়ায়। সোয়া চারটায় হিন্দুস্থান পার্কের মোড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় লাল টুকটকে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে বাড়িতে ফিরতেন সোয়া চারটার পর-পর, ডাকের শেষ সময় ছিল সাড়ে চারটা। ফিরেই গভীর মনোযোগ লেখায়। সাড়ে পাঁচটায় বিছানায় যেতেন, তখনই যা বিশ্রাম।
কবিতা যে লিখতেন, সেখানেও আয়োজন। কবিতা লেখার কাজে ব্যবহার করতেন আলাদা রকমের সরু নিবের কুচকুচে কালো পার্কার কলম, সঙ্গে প্রতিভা বসুর নিজের হাতে সিল্কের টুকরো দিয়ে বাঁধানো খাতা। লেখক, সাহিত্য-সমালোচক, কবি হিসেবে বুদ্ধদেব হৃদয়ের বৃত্তিগুলোকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনি যেন তাঁর জীবনের এই পর্বে শীর্ষে পৌঁছেছেন। 'কবিতা' পত্রিকায় ভালো কবিতা পাওয়া যাচ্ছে না- এর কারণ অনুসন্ধানে এবং সমাধানে বুদ্ধদেব ১৩ পৃষ্ঠাব্যাপী সম্পাদকীয় লিখলেন 'কবিতা'র ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। অধীর হয়ে বুদ্ধদেব লিখলেন, প্রথম পাঁচ-ছ বছর কবিতা পত্রিকায় যে-পরিমাণে উৎকৃষ্ট কবিতা ছাপা হয়েছিল সে অনুপাত এখন আর আশাপ্রদ নয়। স্থান ও কালের ঐক্যকে কবিরা যেন উপেক্ষা করছেন। মাসিক পত্রিকাগুলোতে কবিতার সম্মান নেই। বুদ্ধদেবের মতে, তরুণরা কোনো রকমে একটি কবিতা দাঁড় করিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে, ঠিক মত চর্চা করছে না। কেবল মায়াবী প্রতিভার ওপর ভর করে নয়, টানা কয়েক বছর তারা যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুকরণ করেও নিজের কবিতার একটি স্বতন্ত্র রূপ দিতে চাইতো, তবে একটা পর্যায়ে কবিতার একটি পথ তারা খুঁজে পেত। কিন্তু অত পরিশ্রমও তরুণরা করেন না। বুদ্ধদেবের মনে হল, জীবনানন্দ দাশ ধ্রুপদী সাহিত্যকে অসঙ্কোচে লঙ্ঘন করছেন। প্রথম বারের মত বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের কবিতার প্রতি বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে লিখলেন, জীবনানন্দ আজকাল কী লিখছেন? নিজের বিষয় বাদ দিয়ে আন্দামান, আন্দোলন, বন্দি এসব বিষয়কে আশ্রয় করে কবিতা রচনায় মনোনিবেশ করছেন, যার কারণে জীবনানন্দের লেখা ক্রমাগত দুর্বোধ্যও হচ্ছে। বুদ্ধদেব ব্যগ্রভাবে লিখলেন, জীবনানন্দের লেখা নিঃসাড় হয়ে যাচ্ছে।
রিপন কলেজ ছাড়ার বছরই, ১৯৪৫ সালে বুদ্ধদেবের তুলনারহিত কলম থেকে বেরিয়ে এল 'তিথিডোর'। যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক, ফরাসিভাষী বেলজিয়ান ফাদার ফাঁল বলেছিলেন, তাঁদের সহপাদ্রিরা যখন প্রথম বাংলায় আসেন তখন তাঁদের দুটি বাংলা উপন্যাস পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, একটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের পাঁচালী', অন্যটি বুদ্ধদেব বসুর লেখা 'তিথিডোর'। অভিব্যক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ ও রচনারীতির কারণে তীক্ষ্ণতর, উজ্জ্বলতর এই উপন্যাসটি শেষ করতে তাঁর তিন বছর সময় লেগেছিল। উপস্থাপনার বিষয় ছাড়াও কাহিনীর সুবোধ্য রীতির কারণে এটিকে বাংলার 'চেতনাপ্রবাহের ধারা'য় লেখা প্রথম উপন্যাস বলে চিহ্নিত করা হয়। লেখকের জ্যেষ্ঠ কন্যা মীনাক্ষীর ওপর ভার পড়েছিল 'তিথিডোর' নকল করার। পিতা লিখছেন, কন্যা সমান্তরালে সেটি কপি করছেন। এভাবে নারী-পুরুষের প্রেম, মিলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখা 'তিথিডোরে'র সহ রচয়িতা হয়ে পড়েছিলেন মীনাক্ষী। সাড়ে পাঁচশো পাতার সেই সাহিত্যকর্মটির লেখক কপি নয়, প্রেসে যেত মীনাক্ষীর কপিটিই। এ-কারণে মূল পাণ্ডুলিপিটি বেঁচে গিয়েছিল। গতানুগতিক বাস্তবতাবর্জিত আঙ্গিকে লেখা এই উপন্যাস সে-সময় যেভাবে আলোড়ন তুলেছিল, এখনো এটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে আছে। 'তিথিডোর' এর মূল পাণ্ডুলিপিটি বুদ্ধদেবের আরও অনেক পাণ্ডুলিপির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে।
গতানুগতিক চাকরি না করলেও, বুদ্ধদেব যেন এতদিনে তাঁর যথার্থ কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন। সময়টা অন্যরকম। একটিকে মানুষের বৃহত্তর মুক্তির জন্য বর্হিজগতে টানাপোড়েন চলছে অন্যদিকে শাসক-শাসিত, শোষক-শোষিতের মাঝখানে নবোদ্ভূত নানান উপাদান আত্মবিকাশের সুযোগ নিয়ে অবাধে বিস্তার লাভ করা সুযোগ খুঁজছে, এর সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন বুদ্ধদেব বসু। এক সম্মোহনী শক্তিতে উপলব্ধ বিষয়কে শৈল্পিক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেবার এক কঠিন দায়িত্ব তো আগেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। পৃথিবী যাদের হতাশ করেছে, ব্যথা-বেদনা দিয়েছে, তাদের জন্য লিখতে প্রলুব্ধ হন তিনি। তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে নিষ্পাপ, শুভ্র, নিষ্কলঙ্ক জীবনের ছবি। কপট, অলীক, মিথ্যা সত্তার বিপরীতে এক মুক্ত প্রাণ, যিনি জীবনের প্রকৃত মূল্যবোধগুলি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।
বহির্বাস্তবের সঙ্গে এক অন্তর্লীন সুন্দর বুদ্ধদেবের কবিতার শরীর তৈরি করে। 'মায়াবী টেবিল' কবিতায় বুদ্ধদেব লেখেন–
তাহ'লে উজ্জ্বলতর করো দীপ, মায়াবী টেবিলে
সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হও, যে-আলোর বীজ
জন্ম দেয় সুন্দরীর, যার গান সমুদ্রের নীলে
কাঁপায়, জ্যোছনায় যার ঝিলিমিলি-স্বপ্নের শেমিজ
দিগ্বিজয়ী জাহাজেরে ভাঙে এনে পুরোনো পাথরে।
পত্রিকা চালাতে গেলে বিজ্ঞাপন লাগে, কিন্তু জীবনটা যেন কলে ধরা ইঁদুরের মতো, কেবল আটকা পড়ে থাকা; বেরুনো যায় না। এক মনে শুধু নিজের সৃষ্টির কাজ না করে এই যে কয়েকটা বছর পত্রিকা চালানো, পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন চাওয়া, নিরাশ হওয়া, ভরসা না পাওয়া এসব কৈফিয়তে নিজেকে নিয়ে হতাশ আর প্রবঞ্চিত হতে হয়। খরচ চালাতে বিরাট আত্মত্যাগের পরও পত্রিকাটা যখন আর চলছেই না, সম্পাদকীয়তে লিখলেন সব, অনেক কথার মধ্যে একটি লাইন তাঁর অন্তর্গত মনস্তাপ সম্পর্কে ধারণা দেবে– 'কবিতা খুব কষ্টে চলছে।'
'কবিতা' পত্রিকায় বিজ্ঞাপনকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে অভিনব ভাষার ব্যবহার অনেকসময় অনন্য এবং আলাদা হয়ে উঠতো। বিজ্ঞাপনগুলো লেখা হত বুদ্ধদেব বসুর নিজস্ব সম্পাদনায়, এর ভাষা অনেকটা কাব্যের অনুশীলনের মতো ছাপা হত। একবার বেঙ্গল কেমিক্যালের 'ঊষসী পাউডার' এর বিজ্ঞাপন ভিন্ন এক উচ্চারণে প্রকাশিত হল। বিজ্ঞাপনের প্রথাগত ভাষা নয়, পাউডারের নাম লেখা হল 'অভিজাত প্রসাধন রেণু', পাউডার নয়, প্রসাধন রেণু, এভাবে কবিতার একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনেও যেন পাঠকের অন্য এক সংলগ্নতা তৈরি হল। বস্তুত, শিল্পের নন্দনতত্ত্ব তাঁর সমগ্র জীবনের শর্তেই প্রকাশিত। তাই বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও থাকে শুদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। বুদ্ধদেব কোনো কিছুতে আগেকার ধারার অনুসরক নন, সমস্তকিছুতে নিজেকে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে ত্যাগী, মহৎ, সম্ভবত মহত্তম হতে তাঁর জুড়ি ছিল না। এমন স্বতন্ত্র ভাবনা থেকেই 'কবিতা'য় 'বিদেশি সাহিত্য' নামে একটি বিভাগ চালু হল। বৈচিত্র্য আনতে এবং বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠককে পরিচিত করতে এ উদ্যোগ তাঁর স্বাভাবিক প্রবণতা বললে ভুল হবে না। 'বিদেশী সাহিত্য' বিভাগে মূলত সম্পাদকই লিখতেন, অন্য কেউ লিখলে তাঁর নামোল্লেখ থাকতো, বাকিগুলি যথারীতি অস্বাক্ষরিত। কিপলিঙ, হাউজম্যান, জি.কে চেস্টারটন, ইয়েটস, এলিয়ট, দেমেত্রিয়স কাপেতানাকিস, পল ভালেরি, গেব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, টমসন, বানার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, এজরা পাউণ্ড, এমিল ভেআরন, পাস্তেরনাক প্রমূখের সাহিত্য নিয়ে বুদ্ধদেব প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখলেন একটানা। বোদলেয়ার, রিলকে, হ্যোল্ডার্লিনের কবিতা অনুবাদ করলেন। এই তিন কবির কবিতার ছাঁচ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা প্রকাশ করতে এবং বাঙালি পাঠকমানসে তাঁদের স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে বুদ্ধদেব বসুর লেখা আর অনুবাদ যুগল সন্নিপাতের কাজ করেছিল। এঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর মানসিক যোগাযোগ ছিল অনেকখানিই। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি চীনে, জাপানি, আরবি কবিতার সঙ্গেও পাঠকের পরিচয় ঘটান। শুধু তো অনুবাদের রস নয়, কবিতা অনুবাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের জাতীয় বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরতে নতুন চিন্তাও পুনঃস্থাপিত হয়েছিল। কোথাও সংক্ষিপ্তসারে, কোথাও বিস্তারিতভাবে। যেমন, চীন দেশে কবিতা বিষয় বা আঙ্গিকের দিক থেকে বিশ্বের বাকি কাব্য থেকে অনেকটাই ভিন্ন, তাঁর এমন মতামত লেখাটিকে বুদ্ধিনির্ভর রচনায় পরিণত করে। তার কারণ, একসময় চীনে সরকারি পরীক্ষার অঙ্গ ছিল কাব্য রচনা। এ-জাতীয় কবিতার বেশির ভাগ প্রথম শ্রেণীর ছিল না, বলাইবাহুল্য। বুদ্ধদেব মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বয়ং মাও সে তুং একজন কবি ছিলেন। ফরাসিরা গদ্যে পারঙ্গম, কবিতায় পিছপা, তাদের জাতীয় চরিত্রই এরকম, লিখলেন বুদ্ধদেব। বোদলেয়ারের দর্শন সম্বন্ধে বুদ্ধদেবের বিশ্লেষণ– ইউরোপীয় এবং বিশ্বসাহিত্যে তাঁর (বোদলেয়ারের) স্থান নিয়ে আলোচনাগুলো ছিল প্রাণবন্ত এবং মনোজ্ঞ।
১৯৪৯ সাল। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার পরও বাহ্যজগতে খুব একটা পরিবর্তন এসেছে বলা যাবে না। তাঁর নিজের আয় ক্রমশ কমে যাচ্ছে। সংসারের খরচ থেমে নেই। পূর্ববঙ্গ থেকে প্রতিভা বসুর পরিবার মিলিয়ে দুটি ঘরের বাড়িতে থাকেন প্রায় একান্নবর্তী পরিবারটি। তবু সাহিত্যের শুদ্ধচর্চা হচ্ছে না বলে স্টেটসম্যানের কাজটি ছেড়ে দিতে চান। এ সময় নরেশ গুহকে একটি চিঠিতে লেখেন, সাংবাদিকতা সাহিত্যের শত্রু। এ চিঠিতেই আয়ের জন্য বি.এ ক্লাশের ছাত্রছাত্রী পড়াতে চেয়েছেন। নিদারুণ অর্থসংকটের মধ্যে সহৃদয়তার পরিচয় পেলেন হুমায়ুন কবিরের কাছ থেকে। হুমায়ুন কবির দুই দফায় ভারতের শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বুদ্ধদেব বসুকে ইউনেস্কোর একটি প্রকল্পের সঙ্গে ছ-মাসের জন্য যুক্ত করে দিলেন। প্রকল্পের কাজটি ছিল বয়স্কদের যাঁরা শিক্ষক হবেন তাদের শিক্ষাদান করা। বুদ্ধদেব বসুর কাজ ছিল শিক্ষাদানের পদ্ধতি স্থির করা। কাজটি ছিল ছয় মাসের। তিনমাস দিল্লিতে, তিনমাস মহিশূরে। এ সময়ই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর বহুল প্রশংসিত উপন্যাস–'মৌলিনাথ'।
১৯৫৬ সালে বুদ্ধদেব বসু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবনের শেষ এবং দ্বিতীয় চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৯৫৬ সাল থেকে তাতে শুরু হল নতুন এক সাহিত্যপাঠক্রম, নাম তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ। সংক্ষেপে তু.সা। তুলনামূলক সাহিত্য জাতিগত, মাধ্যমগত ও সংস্কৃতিগত সীমারেখাকে অতিক্রম করে। এতে 'সাহিত্য' কথাটির আওতায় সাহিত্যের সনাতনী বিভিন্ন ধারা যেমন উপন্যাস, নাটক, কবিতার পাশাপাশি সংস্কৃতির দৃশ্যনির্ভর উপাদান এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত। তুলনামূলক সাহিত্য নানা দেশে চর্চা হয়েছে। ফরাসি ঘরানার মতো জার্মান তুলনামূলক সাহিত্যের উৎপত্তিও উনিশ শতকের শেষার্ধে। এটির ব্যাপক বিকাশ ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এবং এর সিংহভাগ কৃতিত্ব একজন পণ্ডিত– ফ্রি ইউনিভার্সিটি অব বার্লিনের শিক্ষক পিটার জোন্ডি (১৯২৯-১৯৭১)-এর ঘাড়ে বর্তায়। হার্ভার্ড-এর তুলনামূলক সাহিত্য-বিশেষজ্ঞ জ্যান এম. জিওলকোস্কি-র জানান, 'তুলনামূলক সাহিত্য' অভিধাটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ফরাসি ভাষায়, ১৮১৬ সালে। রোম্যান্স ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য পণ্ডিতেরাও পরবর্তীতে এটির ব্যবহার শুরু করেন। ইংরেজি ভাষায় প্রথম ব্যবহার করেন ম্যাথু আর্নল্ড, ১৮৪৮ সালে, তিনি বহুবাচক অর্থে শব্দবন্ধটির প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। সাহিত্যের পাঠককে ভাষিক ব্যবধানকে অতিক্রম করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রধান একটি প্রবণতা এবং জাতীয় বা জাতিভিত্তিক সাহিত্য যে সমস্ত বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয় না সেগুলোকে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হচ্ছে এর অন্যতম লক্ষ্য।
সদ্যোজাত স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে যখন সত্যিকার খোলা হাওয়া বইছে, তখনই অগ্রণী আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসুর পৌরোহিত্যে খোলা হলো বিভাগটি। অন্য যেসব অধ্যাপক প্রথম থেকে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন ফাদার ফাঁঁল, ফাদার আঁতোয়ান, গৌরীনাথ শাস্ত্রী এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। নরেশ গুহ যোগ দেন কিছুদিন পরে।
ফাদার রবের আঁতোয়ান এস, জে (১৯১৪-১৯৮১) জন্মসূত্রে বেলজিয়ান। লুঁবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে এম এ পাশ করে ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। জেসুইট ধর্মযাজক হিসেবে তিনি ভারতে আসেন ১৯৩৯ সালে। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে এম এ পাশ করেন এবং সেই বছরই ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথের গান খুব ভালো গাইতেন। রামায়ণ বিষয়ে তাঁর রচিত গবেষণাগ্রন্থের নাম 'রাম অ্যান্ড দ্য বার্ড'। ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করতেন, তিনি অনেকের বিয়েতে আচার্যের কাজ করেছেন। ফাদার পিয়ের ফাঁল (১৯০৭?-১৯৮৩?) ফরাসিভাষী বেলজিয়ান।
গৌরীনাথ শাস্ত্রী (ভট্টাচার্য) (১৯০৯-১৯৯২) বাগবাজারের বিখ্যাত শাস্ত্রী বংশের সন্তান। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে যখন অধ্যাপনা করছেন তখন তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অধ্যাপনা করার মতো উপযুক্ত ডিগ্রি সুধীন্দ্রনাথের ছিল না, তাঁর নিয়োগে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর ব্যক্তিত্বের প্রভাবের কারণে সুধীন্দ্রনাথের নিয়োগে সমস্যা হলো না।
তখন যাদবপুরে এত বাড়িঘর ছিল না। ইউনিভার্সিটির ভিতরে খোলা ফাঁকা মাঠ। শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রের সম্পর্ক ছিল খুবই খোলামেলা। সুধীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সিগারেটও অফার করতেন। মূলত মদ এবং সিগারেট এই দুই মধ্যবিত্ত ট্যাবুকে তু.সা বিভাগে যেন প্রতীক হিসাবে নেওয়া হয়েছিল–ভাঙবার জন্য।
আধুনিক ধরনে সাহিত্য বুঝতে ছাত্রদের জন্য মন্ত্রের মতো সাহায্য করতো বুদ্ধদেবের ক্লাশগুলি। তাঁর নির্দেশ থাকতো, ক্লাশে আসার আগে ছাত্ররা একবার বইটি পড়ে নেবে। পড়ানো শেষ হয়ে গেলে আরেকবার পড়বে। তিনি ক্লাশে এমনভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতেন, যে, সেই লেখকের সমস্ত গুপ্ত কৌশল ও পরিপ্রেক্ষিত আর লুকানো থাকতো না। সাহিত্য জিনিসটা যে খোপ কাটা কোনো পদার্থ নয়, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য বা জার্মান সাহিত্য বলতে যে আলাদা কিছু নেই, সারা পৃথিবী ভরে আছে যে সাহিত্যের স্রোতে তা যে এক ও অবিভাজ্য, সাহিত্যের এই মূল তত্ত্বটি এখনকার সময়ে যতটা প্রচলিত তখন সেভাবে সহজ ছিল না। বুদ্ধদেব ছাত্রদের এসব তত্ত্ব পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতেন। মানুষের মনের কল্পনাপ্রবণ অংশের যে কোনো সৃষ্টিই আসলে একই মাত্রা দিয়ে বিচার করতে হবে, বাঙালির শিল্পচিন্তার ইতিহাসে এই ধারণারও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুদ্ধদেব বসু।
ছাত্রদের পরীক্ষার খাতায় নম্বর দিতে চাইতেন না। তাদের টিউটোরিয়ালের খাতা রক্তাক্ত দাগে ছিন্নভিন্ন করে ফেরত দিতেন। তিনি বলতেন : সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে– তাই বিদ্যা, যা মুক্তি দেয়।
ভুবন জুড়ে সাহিত্যপাঠের এই আধুনিকতম ভঙ্গিটি ভারতে চালু হওয়া মাত্র যাঁরা সাহসের সঙ্গে এই নবীন ধারায় দীক্ষিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন স্বনামেই খ্যাত। মোট ছ'জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এম এ প্রথম বর্ষের কার্যক্রম আরম্ভ হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে তুসার প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা এম এ পাশ করে বের হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন, অমিয় দেব, নবনীতা দেব সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রনবেন্দু দাশগুপ্ত।
তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগকে বুদ্ধদেব বসু নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে অনন্য করে তুলেছিলেন। তাঁর ছাত্র অমিয় দেবের লেখায় জানা যায়, এটি ছিল এক নতুন সাহিত্য-পাঠাদর্শ। এতে প্রত্যক্ষ প্রণোদনা তিনি পেয়েছিলেন প্রতীচী থেকে, আন্তর প্রেরণায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯৫৯ সালে বুদ্ধদেব বসু মার্কিন তুলনামূলক সাহিত্যবার্ষিকীতে 'কম্পারেটিভ লিটারেচার ইন ইন্ডিয়া' নিয়ে যে-প্রবন্ধ লেখেন তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল প্রণোদনা আর আন্তরপ্রেরণার উৎসভূমি। যাদবপুরের কথা বলতে গিয়ে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গে তথা বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের জন্মলগ্নে যার উত্তরাধিকারী যাদবপুর। আর তার সূত্র ধরে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন সেই বক্তৃতায় যা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল 'কম্পারেটিভ লিটারেচার', রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন 'বিশ্বসাহিত্য'। সেই বিশ্বসাহিত্যেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। পাশ্চাত্যের তুলনামূলক সাহিত্যের অঙ্গনে যে-আন্দোলন তখন চলছিল–প্রত্যক্ষবাদই মুখ্য না অপ্রত্যক্ষেরও আসন আছে এই পাঠাদর্শে, প্রভাব-পরিগ্রহণ ব্যতিরেকী মিল-অমিলের ভাবনা কতটা ব্যাকরণসাপেক্ষ, সাহিত্যপাঠ কি নিতান্তই তার রন্ধন-বিষয়ক জ্ঞানার্জন না কি রসাস্বাদন ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নে যে আন্দোলন চলছিল তিনি তাতে মনোযোগ না দিয়ে ইংরেজির জর্জর থেকে সাহিত্য পাঠকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এত করেও তুসা থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল। নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ফেডারেশন অব মর্ডান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড লিটরেচারস' নামের সংস্থাটি তাঁদের নবম আন্তর্জাতিক অধিবেশনে বুদ্ধদেবকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তুলনামূলক সাহিত্যের জন্যেই এই অধিবেশন অনুষ্ঠান। আরেকটি নিমন্ত্রণ পান ইন্ডিয়ানা বি্শ্ববিদ্যালয়ে এক সেমেস্টারের জন্য অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়াবার জন্য। তিনি যাদবপুরে ছুটির আবেদন করেছিলেন আগেই কিন্তু প্রথমে অনুমতি প্রদান করলেও রাজনীতিতে লিপ্ত কিছু শিক্ষকের কারণে সেই ছুটি বাতিল হয়ে যায়, এর পরম্পরায় ১৯৬৩ সালে বুদ্ধদেব বসু যাদবপুর থেকে পদত্যাগ করেন।
যাদবপুরের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের বুদ্ধদেব বসুর একসময়ের ছাত্র সমীর সেনগুপ্ত লিখেছিলেন,''বুদ্ধদেব অকালে বিভাগ থেকে বিদায় না নিলে তুলনামূলক সাহিত্য হয়তো একটা আন্দোলনে পরিণত হত। তা হয়নি। কিন্তু না হলেও, আজ বাংলায় তুলনামূলক আলোচনা সাহিত্যপাঠের অবশ্যপালনীয় পন্থা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, বিশুদ্ধ বাংলা সাহিত্য পড়তে গেলেও অন্য দেশের সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করে পড়তে হয়–১৯৫৫ সালে এই ধারণাটা অকল্পনীয় ছিল।"
শুধু তো অধ্যাপনা করেন নি, তিনি এখানে বিশ্বসাহিত্য পাঠের তাত্ত্বিক ভাবনার মজবুত ভিতও রচনা করেছেন। কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, 'বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্যাদর্শে কারুর বিশ্বাস থাক বা না থাক, যে বুদ্ধদেব বসুর সব রচনা পড়বে না, সে বাংলা ভাষার অনেক কিছ্ইু শিখবে না। সে দরিদ্র থেকে যাবে।'
বিভাগ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু অনেকের হৃদয়ে তাঁকে ঘিরে অনেক অম্ল-মধুর স্মৃতি রয়ে গেছে। তাঁর পদত্যাগপত্র নাকি ছিল এক আশ্চর্য দলিল। বুদ্ধদেব বসুর অনুপস্থিতিকালে বিভাগে কী কী করণীয় আছে, সমস্ত কাজের তালিকা করে, প্রতিটি কাজ তাঁর উপযুক্ত সহকর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সবশেষে লিখেছিলেন, যদি এর কোনোটাই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণযোগ্য বলে মনে না করে, তাহলে এই চিঠিকে যেন তাঁর পদত্যাগপত্র বলে ধরে নেয়া হয়।
স্থায়ী কাজ থেকে অবসরের পর স্বল্পায়তনের অধ্যাপনার কাজ করেছেন বিদেশে, কিন্তু তু.সা থেকে বিদায়ের বিষণ্ণতা যেন তাঁকে ঘিরে ছিল আমৃত্যু। সেই বিষণ্ণতার ছায়া পড়েছে তাঁর উত্তরকালের কবিতাতেও–
যেমন বেঁচে থাকে কেন্নো, কেঁচো, আর মাটিতে বুক টেনে পন্নগ,
যোজন পার হ'য়ে ক্লান্ত ক‚র্মেরা আবার ফিরে পায় সিন্ধু,
তেমনি ঋতু আর শ্রমের আশ্রয়ে চিন্তাহীন বাঁচি আমরা–
অথচ বিনা কাজে বিহান কাটে আজ, নামে না সন্ধ্যায় শান্তি।
অঙ্গরাজ ! বলো, করেছি কোন পাপ, এ কোন অভিশাপ লাগলো !
জননী বসুমতী, ভুলো না আমরাও তোমারই গর্ভের পরিণাম।
হে দেব, ঐরেশ ! মহান ! মঘবান ! এবার দয়া করো, বৃষ্টি দাও
বৃষ্টি দাও !
গ্রন্থপঞ্জি:
বুদ্ধদেব বসু, আত্মজৈবনিক, বাতিঘর, এপ্রিল ২০১৮।
প্রতিভা বসু, জীবনের জলছবি, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, বৈশাখ-১৪০০।
মীনাক্ষী দত্ত, স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু ও তাঁর সারস্বত গোষ্ঠী, প্রতিভাস, এপ্রিল ২০১১।
জ্যোতির্ময় দত্ত, আমার নাই বা হল পারে যাওয়া, অন্বয়, ডিসেম্বর ২০১৭।
স্মরণগ্রন্থ: স্বাগত সংলাপ: বুদ্ধদেব বসুকে নিবেদিত, দে'জ, নভেম্বর, ২০০৮।
সমীর সেনগুপ্ত বুদ্ধদেব বসুর জীবন, প্রথম প্রতিভাস সংস্করণ, জানুয়ারি ২০১৯।
সমীর সেনগুপ্ত অমল আমার সময়?, প্রথম প্রতিভাস সংস্করণ, জানুয়ারি ২০২০।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কল্লোলযুগ, ডি এম লাইব্রেরি, আশি^ন ১৩৩৭।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার এবং অন্যান্য, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, জানুয়ারি ১৯৯৯।
সুদক্ষিণা ঘোষ, সঙ্গ নিঃসঙ্গতা : বুদ্ধদেব বসু, দে'জ পাবলিশিং, এপ্রিল ২০১৩।
সম্পাদনা: দময়ন্তী বসু সিং, বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য 'কবিতা' থেকে: দ্বিতীয় খণ্ড রবীন্দ্রনাথ, বিকল্প, আগস্ট ২০১১
নবনীতা দেব সেন ও তুলনামূলক সাহিত্য, দিলীপকুমার চক্রবর্তী: নবনীতা দেব সেন: সম্মাননা প্রণতি পত্র: অহর্নিশ, ২০১৯।
বিদেশী ফুলের মালঞ্চে বুদ্ধদেব বসু: সুদেষ্ণা চক্রবর্তী