Published : 30 Sep 2019, 11:20 AM
প্রকৃত কবিতা কবির রচিত নয় কবিতারই স্বরচিত। সেই কবিতা, যে কবিতা পাঠককে কাঁদায় হাসায় ডোবায় ভাসায়, বাস্তবের বস্তুময়তা থেকে সরিয়ে নিয়ে স্বর্গমর্ত্যপাতাল শুধু নয়, আকাশের ওপারে আকাশের মতন, স্বর্গের ওপারের স্বর্গের, মর্ত্যের বাইরের পৃথিবী, পাতালের গভীরে অতল পাতালেও টেনে নেয়, ভ্রমণ করায়– সে কবিতা 'কবি' লিখতে পারেন না। গোটা কবিই হয়ে ওঠেন 'কবিতা'র কলম। কবিতা তখন এক শক্তিশালী চরিত্র, এক মহা ক্ষমতাধর প্রভু। কবি হয়ে ওঠেন কবিতার ক্রীতদাস। কবিতার হাতে উঠে আসে শাসনদণ্ডের মত এক কলমদণ্ড। সে কলম স্বয়ং কবি। কবিতা কবিকে দিয়ে লেখাতে থাকে। কবির তখন খুবই 'করুণ অবস্থা'! না লিখে উপায় নেই। তাকে লিখতেই হবে। তার মেধা, তার মন, মগজ, সব বিকিয়ে গেছে কবিতার কাছে। কবির মনমাটিতে কবিতা নীলপ্রভুদের মত নীলাভ শস্যবীজ ছিটিয়েছে। কবিতাঙ্কুর নীলিয়ে উঠছে, ঝিকিয়ে উঠছে! তৃণের মত, লতার মত, তরুর মত, বৃক্ষের মত ঝিলমিল করে, তরতর করে শাখাপ্রশাখা মেলে, কবিতা জন্মাতে থাকে, বাড় বাড়তে থাকে। তাকে সময়মত গুচ্ছে বাঁধতে হবে। আঁটি করতে হবে। সাজাতে হবে। কবিতার কৃষিকলায় কবি তখন ক্লান্ত কিন্তু তার প্রাঙ্গণ শস্যময়, তাই কবিও হাস্যময়। তাঁর দু হাত ভরে উঠে আসে কবিতাশস্য। শস্যের ঘ্রাণ কবিকে আকুল আঢুল করে তোলে। 'সপ্তর্ষির জন্যে কবিতা' কাব্যের কবিতাগুলোর জন্মের পেছনে এমনি শস্যলীন হর্ষকৃষির গল্প আছে। প্রথম কবিতাটিতেই আছে সে সংবাদ:
সপ্তর্ষির জন্যে কবি কৃষি কাজ করে
হালের লাঙলে কবি সপ্তর্ষিকে ধরে।
আকাশ বিরান করে নামায় মাটিতে
যদিও সে শুয়ে থাকে শীতল পাটিতে
কবি তার সর খায় দুধের বাটিতে –১
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদাকে তাই বলা যাবে না তিনি এ কাব্যের কবিতাগুলোর কবি, বলতে হবে তিনি সপ্তর্ষির সাত পঙক্তির কবিতাগুলো দ্বারা চালিত হয়েছেন, লিখিত, রচিত হয়েছেন। এ কাব্যের কবিতা পাঠের পর প্রকৃত কাব্যবোদ্ধা আর কবিতার রসগ্রাহীর মনে এমন অনুভূতি জাগবেই। সাত পঙক্তির এক একটা সংখ্যা শিরোনামীয় কবিতা পাঠ করে বলে উঠবেন, কবিকে ভর করেছে নক্ষত্র অথবা বীজমন্ত্র। তারাই লিখিয়েছে এ সমস্ত কবিতা। কারণ 'সপ্তর্ষির জন্যে কবিতা', ক্ষীণকায়, পকেট সাইজ সদ্য ফুলন্ত হওয়া কুঁড়ির মত আকৃতির বইখানা– সাত সংখ্যার জাদুলাগা এক কাব্য। কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম নেই। শীর্ষে শুধু সংখ্যা। ৭০টি কবিতা। প্রতি কবিতায় সাত পঙক্তি। কাজেই ছোট ছোট কবিতাগুলো পড়ে ফেলতে সময় লাগে না। কিন্তু আমার সময় লাগলো। মানে পাঠকেরও সময় লাগলো। এক-একটা কবিতা পড়ে পাঠককে ভ্রমণ করতে হচ্ছে বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড। কারণ কবিও সপ্তর্ষিকে নিয়ে ঘুরছেন। আকাশ থেকে পাতাল, মাটি থেকে অগ্নি, বাতাস থেকে জলধি — সর্বত্র কবি ঘুরছেন। কখনো সপ্তর্ষি উড়ে চলেছে, ঘুরে চলেছে, আর কবি ইথার-ভ্রামণিকের মত তার বয়ান দিয়ে চলেছেন। সপ্তপদী চিত্রপটে ছবির পর ছবি আঁকছেন, মনোজ শব্দতরঙ্গে ধ্বনির পর ধ্বনি সৃজন করছেন, মনোলীন নীরবতার ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছেন আরও গভীর মগ্ন নৈঃশব্দ্যের ভারি চাদর। এক একটা কবিতার ক্ষুদ্র কলেবরের ভেতর ভরে দেয়া আছে এই বহুমাত্রিক শব্দবর্ণদৃশ্যময় ভ্রামণিকতা। তাই কবিতাগুলো পড়তে সময় লাগে। সাত পঙক্তির পাঠের পর পাঠকের মনোজগতে 'সাতটি তারার একটি মীড়' এক অশ্রুত এক সংগীত সৃষ্টি করে। সে সুর শুধু মর্মে প্রবেশই যথেষ্ট নয়, তার ভেতরে ডুব দিতে হয়, ভাসতে হয়, অবগাহন করতে হয়। সপ্তর্ষির চরণে চরণে এই আলোড়ন। সপ্তর্ষিকে নিয়ে কবির স্বপ্নমগ্ন ভ্রমণ চলে আদিগন্তবিশ্ব। কবি আর সপ্তর্ষির এই নান্দনিক নীলিমান্তিক ভ্রমণে সমস্ত বিশ্ব অরূপ ইলিশের মত মহাকালের জালে আটকা পড়ে যায়। সেখানে জমে থাকে কবিতার রূপরসগন্ধ।
তারপর ডানা মেলে হঠাৎ উড়াল
আমাদের সঙ্গে ওড়ে দিকচক্রবাল
বনে বনে মনে মনে হিজল তমাল
উড়ে যেতে যেতে তারা ধরে থাকে হাল
সপ্তর্ষি সারস হয়ে ডানা মেলে পালে
প্রাবিশ^ ইলিশ মৎস্য ধরা পড়ে জালে
হারিনি জিতিনি কেউ সপ্তর্ষির চালে। — ৬১
কবির মনোবিশ্ব এক অপরূপ পাষাণগালা জলীয় ভুবন। সেখানে যেমন জলের রুপুলি শস্য ইলিশ অনন্ত সৌন্দর্যের চলিষ্ণুতায় সাঁতরে বেড়ায় তেমনি আবার জলের গভীরে মরমের অতল মাটিতে থাকে শোনিতের বীজ, যা থেকে ফুটে ওঠে হৃৎনিভৃতের নীল পদ্ম, সেই ইলিশতাড়িত পদ্মশোভিত নীল নদীতে কবি অমল ধবল পাল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকেন। কারণ তাঁর কণ্ঠে সপ্তর্ষির উড়াল মন্ত্রঃপুত ভাটিয়ালি। তাই সপ্তর্ষিকেও উড়িয়ে দেন। সপ্তর্ষি কবির ভেতরে এক মহাশক্তি এক মহাবিশ^, মহাকাশ আর মহাবারিধির নাম। তাই কখনো কবির মন থেকে সমস্ত উৎকণ্ঠা সংশয় আর বেদনারা বাষ্পের মত মিলিয়ে যায়। সপ্তর্ষিকে উড়িয়ে দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে সরিয়ে দিয়েও তিনি এক অদৃশ্য টানাপড়েনে তাকে বুনে যেতে থাকেন অদৃশ্য তাঁতে। তার রক্তকণায় থাকে সৃষ্টি বীজের মন্ত্র। সেখানেই সপ্তর্ষির অধিষ্ঠান।
তোমাকে উড়িয়ে দিয়ে
বসে আছি উড়বো না বলে
আমি তো বসেই আছি
পাল মেলে অমলে ধবলে
আমার ক্ষরণ আমি নিজে
ছড়িয়ে দিয়েছি আজ শোনিতের বীজে
মেলেছি অনন্ত দল ব্রক্ষাণ্ডের নীল সরসিজে। — ২৩
সপ্তর্ষী কবিকে ক্রমশ বহুবিস্তারী এক ভুবনে নিয়ে যায়। কবিতার কৃষিকলা থেকে রুপুলি ইলিশের বিশ্বে অথবা নীল সরসিজের অমল জলে। আবার কবির বসত গড়ে ওঠে এক অন্তহীন তপোবনে। সেখানে কবি কখনও ঋষি কখনো মগ্ন সন্ন্যাসী কখনো কৃষিকলা প্রত্যাশী এক আদিম মুনি। সপ্তর্ষি সেই অরূপ তপোবনে এক ঋষিকন্যা। তবে এই কন্যা সর্ববিদ্যা পারদর্শী। জ্ঞানবিজ্ঞান শাস্ত্রের সারাৎসাররূপী এক উৎসনারী সপ্তর্ষি। কবি থাকেন তারই অপেক্ষায়। তার মেধাপাত্র আর জ্ঞানভাণ্ডার পূর্ণ করে দিতে পারে সে।
ঋষিতনয়ার জন্যে তুমিও প্রতীক্ষমাণ অন্য এক ঋষি
এর্ববিদ্যাপারদর্শী যদিও পারোনি হতে হায় অদ্যাবধি
যে পেরেছে তার কাছে শিখে নাও মৎস্য শস্য কৃষি
সমুদ্র বিজ্ঞান থেকে নভোশাস্ত্র কাব্যনীতি নদী আর গদি। –২৮
সপ্তর্ষির কবিতাগুলো এক পাঠে তার সমস্ত অর্থ প্রকাশ করে না। পঙক্তিতে পঙক্তিতে রয়েছে স্তরীভূত অর্থ। শব্দের স্তরে স্তরে লুকানো প্রত্ন অর্থ আর রত্ন অর্থ। বহুকৌণিক হিরকের মত দ্যুতিময় সে অর্থ। শব্দকে একটু নাড়াচাড়া দিলেই তার ভেতর থেকে বহুরশ্মিময় আলো ঠিকরাতে থাকে। অভাবিত চমকিত মঞ্জুরিত নিমীলিত ফুটন্ত মগ্ন ভগ্ন দীপান্বিত মনোলীন অতলান্ত এক-একটা শব্দের অর্থ কখনো বিবশ করে, কখনো উদাস করে, কখনো মগ্ন করে কখনো ধ্যানস্থ করে তোলে। কোনো কোনো শব্দের অর্থ মনকে নিস্তার দেয় না, মন অস্থির হয়ে ওঠে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সপ্তর্ষির ব্যানারে এক অনন্ত অস্থির চলিষ্ণু কালপ্রবাহকে যেন সাত তারার বাঁধনে বেঁধেছেন। কবিকে দিয়ে কবিতার কপালে কপোলে ত্বকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জিভের ফালে শব্দচাষ করেছেন। সে শব্দের অর্থ তো এমন বহুমাত্রিকই হবে!
চুম্বন এঁকেছে কবি চকিত কপালে
জিভের লাঙল নিয়ে ত্বকের আড়ালে
মাটিতে করেছি চাষ সব শস্যকণা
বহুদিন আমাদের নেই বনিবনা।–২
সপ্তর্ষিকে সাধারণভাবে জানি আকাশের এক তারকামণ্ডল রূপে। তার আকার প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত। সাপের ফণার মত সেই বঙ্কিম প্রশ্নমুখে মহাদ্যুতিময় এক ধ্রুবনক্ষত্র। কবির সপ্তর্ষিও পাঠকের মনে নাক্ষত্রিক প্রশ্নের ফণা তুলে যায়। এই সপ্তর্ষি কী বা কে? সে কি নক্ষত্র না নারী, সে কি কবির প্রেমিকা না জীবনদেবিকা? সে কি নারী রূপী পরমাত্মা না কি কন্যা জায়া কিংবা জননী! সেই নারী সপ্তর্ষি দেখতে কেমন? সে কোথায় থাকে? কী পরিধান করে? কেমন করে সাজে? সে কি কাউকে ভালোবাসে? কেমন করে ভালোবাসে? কবির কাছে জলের মত সহজ স্বচ্ছ তার উত্তর।
সপ্তর্ষি আকাশে থাকে কবিও আকাশে
সপ্তর্ষি কবিকে বাঁধে মেঘকেশপাশে
সপ্তর্ষি আমাকে দেখে খুব করে হাসে
সপ্তর্ষির ভালোবাসা হাসে ঘাসে ঘাসে।– ৭
অনেক কবিতায়ই সপ্তর্ষির নারী রূপ চিত্রিত হয়েছে। চিত্রিত হয়েছে তার শাড়ি, পোশাক, গহনা, কেশপাশ। অঙ্কিত হয়েছে তার হাত পা ঠোঁট চিবুক কোমর নিতম্ব। এই নারী শাদা বা সবুজ শাড়ি পরেছে, তাতে ঘোর লাল পাড়। গলায় তার হীরের গয়না। তখন মনে হয় সপ্তর্ষি আছে এই নগরেই, হয়তো বা কোনো বিজয়ের অনুষ্ঠানে অথবা কোনো বিবাহ বাসরে। তার সাথে ইচ্ছে করলেই গল্প করে আসা যাবে।
লাল পাড় আর সবুজ জমিন ঠোঁটে ঝিলিক বিদ্যুৎ
টকটকে লাল কৌটো বুকে নকশাকাটা নেই খুঁত
আর কতকাল মনময়ূরী পেখম খোলা ডুবুরি
দেখে দেখে ভিরমি খেয়ে চুপ হয়ে যায় দেবদূত।— ৩৪
কিন্তু সত্যিই কি সপ্তর্ষি নারী? প্রেমিকা নারী। নারী-রূপ ব্যতীত প্রেমাস্পদের কি অন্য রূপ নেই? কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর প্রেমীশ^রীকে দিয়েছেন জগতে সমস্ত রূপময় আর অরূপের মিশ্রণে একাধারে মন্ময় ও চিন্ময় সৌন্দর্যের সত্তা। এ সৌন্দর্য সাত রঙের মিশ্রণে এক অনশ^র অনন্তমোহন রঙে আঁকা। তখন উদয় হয় আরও প্রশ্ন! এই সপ্তবর্ণা সপ্তর্ষি কি ওড়ে না হাঁটে, জলীয় না রৌদ্রময়, নাক্ষত্রিক না শস্যলতাকীর্ণ, জলজ না অগ্নিজ, বায়ুজ না মৃত্তিকাজ? তার রঙের উদ্ভাস কবিকেই বিভ্রান্ত করে। তাকে মনে হয় পরী, অপ্সরী। যে নিজে ওড়ে আর কবিকে বসিয়ে রাখে স্থিরতায় কখনো নিজেই স্থির থেকে কবিকে নিয়ে যায় অনন্ত ছুটোছুটির জগতে।
গগনে গগনে যখন ওড়ার প্রস্তুতি
সাত আসমানে জে¦লেছো তোমার সব দ্যুতি
রূপে ও অরূপে যুগল ডাানার এক জুটি
আদম হাওয়ার আদিম জোড়ায় নেই কোনো ত্রুটি— ৬১
সপ্তর্ষি কবিকে ছুটিয়ে মারে। কবি স্থির হতে পারেন না। উড়িয়ে দিয়ে বসে থাকেন বটে কিন্তু সপ্তর্ষির ধ্যান তাঁর রুহকে ফানা ফানা করে দেয়। বিশ্বব্রক্ষা-, অক্ষ-বক্ষ ঘুরে কবি দেখেন, সপ্তর্ষির হাত ধরে, তার আলো নিয়ে, তার পথে পা রেখে, বা সাদা সম্ভারে আলোকিত অথবা সাদা কাফনে আত্মাকে মুড়িয়ে নিয়ে এক অনন্ত সাদার দূত হয়ে যেন তিনি ঘুরেছেন। যাবেন সপ্তর্ষির শুভ্রতার দরবারে। কিন্তু সপ্তর্ষি যেন এক অরূপ অধরা অরূপ প্রেমাস্পদ।
মুখ শাদা বুক শাদা শাড়ি শাদা পাড়ে ভাঁজে শাদা কারুকাজ
শাদার ভিতরে শাদা, শাদার বাহিরে শাদা, শাদায় শাদায় আজ সব রং সাজ
গভীরে অধীর শাদা অধীরে গভীর শাদা, শিরোশোভা শাদা রং স্বরাজের তাজ
শাদায় শাদায় ভাঁজ, শাদা মনে শাদা সাজ, শাদা কাজে নেই কোনো লাজ।
সপ্তর্ষির শাদা ডানা শাদা আবছায়া, কালো চুলে শাদা ছায়া আলো ঝিকমিক
লাল নীল হলুদ বেগুনি সব শাদা হলে গোলাপি থাকে না আর গোলাপি সঠিক।
সাত রঙে এক রঙ শাদা রঙ, শাদা পরী হে অপ্সরী, সপ্তর্ষিও শাদার অধিক।— ৪০
তবে সমস্ত কাব্যের গহন গোপন স্তরে আছে এক গূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্বের বীজ। এ বীজ কবিতার গর্ভাশয়ের অমরায় গূঢ়তম সাধনতত্ত্বের প্রাণবীর্য হয়ে ঝুলে থাকে। তাই দেখা যায় কবির সপ্তর্ষিতে ঈশ^র আর প্রেমাস্পদ একীভূত হয়ে গিয়েছে। গূঢ় তত্ত্বের আধারে রক্ষিত এ সমস্ত পঙক্তির অর্থ আবিষ্কার অনেক সময়ই দুরূহ বলে মনে হয়। মরমীবাদ বা সুফিবাদী রহস্যময়তায় কবিতাগুলোর ভিন্ন পাঠ দরকার হয়ে পড়ে। সপ্তর্ষি তখন আর লাল পাড় সবুজ জমিন বা সাদা পাড়ের শাড়ি পরা অপসরীতুল্য কোনো চেনা নারী হয়ে থাকে না, সপ্তর্ষির আলো অলক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। সে হয়ে ওঠে আরও বেশি অলখ, আলেক সাঁই! সপ্তর্ষি অনঙ্গও। তবে কবি আর কবিতা একাঙ্গ। সেখানেই সপ্তর্ষিকে লক্ষ করা যায় স্পর্শও করা যায়। আর সে অলখ প্রেমীশ্বরের সে রূপ মনকে স্নিগ্ধ করে, নফসকে পুড়িয়ে দেয়।
ভাসতে ভাসতে কবি দরিয়ানগরে
তরঙ্গ ফণায় চড়ে গূঢ় ফণা ধরে
সপ্তর্ষি-নিশিথ রাতে নামে বজ্রধারা
তারপর জলেস্থলে মনকেলি করে।
একাঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকি আমি আর কবি
কলিদাস সেবাদাস ফোটায় করবী
সপ্তর্ষির রূপে পুড়ে আঁকে মনছবি।— ১৩
বিপরীত বিন্যাসে প্রতি তুলনায় প্রেমকে আর নিবিড় করে গভীর করে দেখেছেন কবি। সপ্তর্ষির ছত্রে ছত্রে এই বৈপরিত্যের চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে। প্রতিচিত্রের ক্যানভাসে কবি সপ্তর্ষিকে জটিল তাঁতে আলোর সুতোয় বোনা এক সূক্ষ্ম মসলিনের রূপে এঁকেছেন। অনঙ্গের অঙ্গাবরণী আলো দিয়েই বুনতে হয়। প্রকৃতির পঞ্চভূতের সাথে সপ্তর্ষি এক মিলিত মিশ্রিত একাধারে রূপান্তরমগ্ন অবিনশ্বর সত্তা।
মাটি ও জলের সঙ্গে তারও আনাগোনা
অনঙ্গের অঙ্গে অঙ্গে শুধু আলো বোনা
বিপরীত নৃত্যে-চিত্তে নিত্য আনাগোনা।— ৩
তাই সপ্তর্ষিময়তার জন্য কবির চিত্তই সব। চিত্তই সর্বময়তায় তাকে ধারণ করে লালন করে পালন করে এবং মননও করে। কাজেই প্রতিচিত্রের বৈপরিত্য আপাত বিচ্ছেদের বয়ান। প্রকৃতপক্ষে তা মিলনের অধিক।
গোপনে করেছি ত্যাগ যখন তোমাকে
প্রকাশ্যে করোনি ত্যাগ তখনও আমাকে
না- গোপনে না-প্রকাশ্যে ঘর করি ঘর
ত্রিভুবনে প্রতি বাঁক কবিদের ডাকে।— ৪
এ কাব্যের গঠন শৈলির কথা শুরুতে একটু উল্লেখ করেছিলাম। তাকে এ শৈলীরও একটা গূঢ়ার্থ আছে। সপ্তর্ষির কবিতাগুলো প্রতিটিই সাত পঙক্তি সংবলিত। এই সপ্ত পঙক্তি সাত নক্ষত্রের রশ্মির মতো দ্যুতি বিকীর্ণ করেছে। ফলে ছোট্ট পরিসরে এক একটি কবিতা বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড ভ্রমণ করিয়ে আনে। জলস্থলঅতলপ্রসারি হয়ে ওঠে তার অর্থ। প্রতিটি কবিতাই অন্ত্যমিলযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিল বিন্যাস কক খখ গগগ কিংবা কককক খখখ। আবার কক খক গগগ এমনও আছে। এমন মিলবিন্যাসে প্রথম চার পঙক্তির স্তবক অনেকটাই রুবাইধর্মি পূর্ণতা পেয়েছে। যেমন:
কত দূরে নেবে তুমি আকাশ সুন্দরী!
কবিকে বসিয়ে রাখে সূর্যচন্দ্রঘড়ি
কলসি গলায় বেঁধে জলে ডোবে কবি
চম্পকনগরে দাম নেই কানাকড়ি –১২
ছন্দবৈচিত্র্যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা সবসময়ই সমৃদ্ধ। ছন্দকে ঐশর্যশালী শব্দ আর ধ্বনির বাঁধনে নতুন বিভঙ্গে বাঁধতে জানেন তিনি। এ কাব্যে অধিকাংশ কবিতাই অক্ষরবৃত্তের নিগড়ে বাঁধা। এ নিগড়কে নিজেই তিনি বলেছেন ফাঁদ। পঙক্তিগুলো যেন আপনি এসে ধরা পড়ে অক্ষরবৃত্তের ফাঁদে।
দখলের রাজনীতি কী করে অক্ষরবৃত্তে ফাঁদ পেতে অন্য
সব ছন্দে অলংকারে বাঘিনী সাজাতে হয়; তপোবনে বন্য
হরিণীও মানে পোষ; কন্যাদানশিখা জে¦লেছেন ঋষি কন্ব।–২৮
স্বরবৃত্তের ঝংকারেও কম ফাঁদ পাতেননি। সপ্তর্ষির মত গহন গভীর অধ্যাত্ম ভাবসমৃদ্ধ কবিতাকে স্বরবৃত্তের চটুল ছন্দে নিয়ে আসতে পারাটা রীতিমত দুঃসাহসিক। কিন্তু আমরা যখন স্বরবৃত্তের দোলনা দুলতে দুলতে দিব্যি সপ্তর্ষির ঘর গেরস্থালি এমন কি সুখের ময়না পাখিটিকেও দেখে ফেলি তখন কিন্তু সব কিছু স্বাভাকিই লাগে। আর এই 'স্বাভাবিকতা' দেখে বরঞ্চ গহন গভীর আকাশের ওপারে আকাশের দেবদূতেরাই ভিরমি খেয়ে মাটিতে পড়ে।
কথা যখন কথার কথা কথা তখন হয় না
যুগল বুকে নীড় বেঁধেছে দুঃখী যুগল ময়না
ময়না যখন সুখের ডালে উড়াল আঁকে গগনে
তুমি তখন খুব সেজেছো গলায় হীরের গয়না।— ৩৩
লাল পাড় আর সবুজ জমিন ঠোঁটে ঝিলিক বিদ্যুৎ
টকটকে লাল কৌটো বুকে নকশাকাটা নেই খুঁত
আর কতকাল মনময়ূরী পেখম খোলা ডবুরি
দেখে দেখে ভিরমি খেয়ে চুপ হয়ে যায় দেবদূত। –৩৪
সপ্তর্ষি কবির মনোবিশ্বে দিগন্তস্পর্শী এক উড়ন্ত ঘুড়ি। আর কবি তার উড়াল রাখাল। সপ্তর্ষির সাথে চলে কবির এক 'বিরাট শিশু'রূপী আনন্দখেলা। যেমন থাকে বালকের হাতে লাটাই আর ঘুড়ি, সুতোয় বেধে বালক ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আকাশে, লক্ষ্য তার ঘুড়িকে পাঠিয়ে দেবে দিগন্তের ওপারে। যত উঁচুতে উড়বে ঘুড়ি ততই তার আনন্দ, কিন্তু ঘুড়ির প্রাণততন্তুটি রেখে দেয় নিজের হাতে, তাকে আবার ফিরিয়ে আনে নিজের কাছে। হয় তো তখন ঘুড়ির গায়ে লেগে থাকা দিগন্তের নীল আর আকাশের আলো মেঘের ফোঁটা বাতাসের ছোঁয়া এই বালকের স্বপ্নালু মনকে আরও স্বপ্নাতুর করে তোলে। সেখানেই তার আনন্দ। একই সঙ্গে ঘুড়ি তার নিজের আবার আকাশেরও! কবির চিত্তাকাশের সপ্তর্ষিও কবির জন্য এই হর্ষ এই বিষাদ এই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির গভীর অনুভূতিকে লগ্ন করে রাখে। তাই 'সপ্তর্ষির জন্যে কবিতা' লেখা ছাড়া কবির উপায় নেই। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে এই কৃষিকলা চলতেই থাকবে।