ভ্রমণে, অন্য ভুবনে

দেবাশিস চক্রবর্তী
Published : 5 Oct 2018, 01:48 PM
Updated : 5 Oct 2018, 01:48 PM


ভ্রমণ মানব চৈতন্যের এক পরিবর্তিত অবস্থা। তা কিসের সাপেক্ষে এই পরিবর্তন? প্রতিদিন স্বাভাবিক ভেবে আমি যেই বাস্তবতায় বসবাস করি, যে রূপে বাস্তবতা আমার মানসে ধরা দেয় তা থেকে ঘটে এই পরিবর্তন। প্রতিদিনকার এই স্বাভাবিক জীবনের ধরা-বাঁধা-নিয়মিত যে কাঠামোটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে তারই ধস নামে ভ্রমণের সময়। সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষ কম-বেশি এক ধাঁচেই তার নিজের জীবনকে আবদ্ধ করে ফেলেছে। তা সে নিজের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাতেই করুক বা বেঁচে থাকার তাগিদেই করে থাকুক না কেন পুনরাবৃত্তির এক ভীষণ আবর্তে আজ ঘূর্ণায়মান বেশিরভাগ মানুষের জীবন। ছুটে চলাই হল এখন জীবনের মূল মন্ত্র। থামলে কিন্তু চলবে না। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিষেধ আছে। এর নিজের কোন সীমানা নেই। অসীমের দিকে তার চোখ। সসীম এক গ্রহে অসীম মুনাফার দিকে রক্ত চক্ষু করে তাকিয়ে আছে মানুষ এই মহাব্যবস্থাটির প্ররোচনায়। মানুষ তার চারপাশ ছারখার করে ছাড়ছে। কিন্তু সে নিজেকে কি বাদ দিয়েছে? মানুষ নিজের অজান্তেই চোরাবালির অতল গহ্বরের তলিয়ে যে যাচ্ছে না তার হিসেব কজনের কাছেই বা আছে। এই উপলব্ধিতে পৌঁছাবার সুযোগই বা কজন পায়। মুনাফার ঘোরে আক্রান্ত মানুষ পৌঁছুতে চায় উন্নতির চরম শিখরে। মানুষের প্রবৃত্তির অন্ধকার যেসব দিক, তার যে অসীম চাহিদা এই সবের দারুণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে ব্যবস্থাটি। মানুষ হয়েছে কর্মতৎপর। শুধু তাই হলে কি চলে? ব্যতিব্যস্ত থাকা চাই। এটা চাই সেটা চাই। চোখের সামনে রংবেরঙের ঝালর ঝুলিয়ে কানে কানে কুমধুর মন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে ছুটিয়ে বেড়ানো হচ্ছে। সাফল্যের এমন কিছু মাপকাঠি চালু করে রাখা হয়েছে যে সেসব পূরণ করতে করতেই মানুষের মধ্যকার সবটুকু প্রাণশক্তির কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এতে আখেরে কার লাভ হচ্ছে সেটা চিন্তা করবার প্রশ্নই উঠছে না। ভাবার অবসরটা কোথায়? জন্মের পর থেকেই মানবশিশুকে ক্রমে ক্রমে প্রস্তুত করা হয়েছে। তার মনের আবহাওয়াটাও তৈরি করা। এর থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ কাজ নয়। কারণ পরাধীনতার উপলব্ধি হলেই না মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নটি আসছে। তার আগে নয় নিশ্চয়ই। পরম প্রতাপশালী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাটি আজ এই গ্রহে তার রাজত্ব কায়েম করেছে এবং তাকে নিছক এক ব্যাবস্থা মাত্র ভাবার কোন কারণ কি আর অবশিষ্ট আছে? এর অস্থিরতা, প্রবল স্রোত ছড়িয়ে গেছে আমাদের মস্তিষ্কে-রক্তের কণায় কণায়। এর প্রভাব গিয়ে পড়ছে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে। তার সকল নির্মান, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানে। তারপরও এই মহাব্যাবস্থা হয়তো কিছুটা করুনাবশতই কালেভদ্রে-বছরান্তে খানিক সময়ের জন্য আমাদের মুক্তি দেয়। তার লাগাম কয়েকদিনের জন্য হলেও খুলে যায়। ভ্রমণের মত "বিলাসিতা"র সুযোগ হয় তখন।

আচ্ছা যখন আমরা ভ্রমণ করি তখন আমরা কি খুঁজে বেড়াই? আমরা কি প্রকৃত অর্থে ভিন্নতাকেই খুঁজে ফিরি? আমরা আসলে অপরিচিতের যে ভীষণ ধাক্কা তার পেছনেই ধেয়ে চলি। এ এমন ধাক্কা যা নান্দনিক রসাস্বাদনের জন্য খুব জরুরী। এই অবস্থায় আমরা অদেখাকে দেখবার আশায় এগিয়ে যাই। ফলে হয় কি, আমাদের যে প্রতিদিনকার দিনযাপনের দৃষ্টিভঙ্গি তা অনেকখানি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরে। কারণ আমি যখন ভ্রমণ করি তখন ফেলে আসি মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাস্তবতার মানচিত্রগুলো আর আমার চেনা জগতটাকে। আমি চাই বা না চাই স্বাভাবিক পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত সকল নিয়ম এবং কাঠামো উপড়ে যায় যখন আমি এক নতুন সংস্কৃতি, এক নতুন ভাষা অথবা এক নতুন ভূমির সামনে এসে দাঁড়াই। হঠাৎ পরিচিতের হাত থেকে পাওয়া মুক্তি এবং নতুনকে জানার প্রথম অনুভূতি আমাকে সজোরে টেনে নিয়ে আসে বর্তমানে। বর্তমান, এই মুহূর্তে। যদি বর্তমান বলে আদপেই কিছু থেকে থাকে । অতীতের অনুতাপ অথবা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রতিনিয়ত আমার মনে যে চিন্তার স্রোত বয়ে চলে তার থেকে উঠে আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও, পাড়ে এসে দাঁড়াই। অবশেষে আমি বয়ে চলা স্রোতকে দেখার অবকাশটুকু পাই। সাবালক মনের অবারিত পূর্বকল্পনার পর্দা নামে।


প্রতিদিনকার জীবনের বিপরীতে ভ্রমণ এক যাদুময় অবস্থার সৃষ্টি করে, ঠিক জাদুঘরের মতো। জাদুঘর বা শিল্প প্রদর্শনী যেমনটা আটপৌরে-সাধারণ-সামান্য কোন ধারণা বা বস্তুকে তার নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত থেকে তুলে নিয়ে এসে এক নতুন অবস্থায় পরিবেশন করে । সকল শিল্পকর্মই এই কাজটি করে। আটপৌরে-সাধারণ বস্তু তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাদের চোখে নতুন রূপে ধরা দেয়। এমনভাবে ধরা দেয় যে তা দেখে মনে হয় যেন প্রথম বার দেখছি। তখন সেই ধারণা বা বস্তুটিকে তার গতানুগতিক-স্বভাবসিদ্ধ আবরণ ও প্রেক্ষাপটের অনুপস্থিতে দেখাবার সুযোগ হয়। আর কোন সমতল শহরবাসী যখন জীবনে প্রথমবার উপত্যকায় এসে দাঁড়ান, মেঘ যখন পাহারের গা বেয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে ধেয়ে আসে তখন কি তিনি তাকে মেঘ হিসেবে চিনতে পারেন? ক্ষণিকের জন্য হয়তবা তিনি ধন্দে পড়ে যান। কারণ এমন সাদাটে কোমল বস্তুর সাথে এত কাছ থেকে তার পরিচয়তো আগে ঘটেনি। তিনি চেনেন গাড়ির ধোঁয়া। মেঘ তিনি আগেও দেখেছেন তবে আকাশে তীব্র সূর্যের আশপাশটায় ছড়ানো অবস্থায়। জনমানুষ-গাড়িঘোড়া কোলাহল থেকে অনেক দূরের এই শান্ত নিবিড় পরিবেশে তিনি যে অনেকে বেমানান।


তবে শেষ পর্যন্ত সে আদ্র মেঘকে চিনে নেন ঠিকই। হঠাৎ মেঘ তার কাছে বিস্ময়কর এক নতুন রূপে ধরা পড়ে। মেঘ তার প্রতিদিনের পরিচয়ের আবরণটা ঝেড়ে ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সময় চলে ধীরে। আদৌ চলে কি? আরও পরিষ্কারভাবে তার ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে আলোর সূক্ষ্ম তারতম্য, বাতাসের ওঠা-নামা, কত পাখির ডাক। তখন কৌতূহল জেগে ওঠে। জেগে ওঠে বিস্ময়। এক ধ্যানমগ্ন অন্তর্দৃষ্টির জন্ম নেয়। অথচ তাকে ধ্যানী পুরুষ বলে চিনতেন না কেউ কখনো। আর সময়? সময় তখন কোথায়? অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ? কোন ঘরটায় সময় তখন থাকে?