সরকার মাসুদের গল্প ‘চেনা অচেনা’

প্রথম দিনেই তাকে শিকারে পরিণত করতে চেয়েছিল বস। আজও সেই চেষ্টা করলো! দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শোয় রিনা।

সরকার মাসুদসরকার মাসুদ
Published : 17 March 2024, 06:56 AM
Updated : 17 March 2024, 06:56 AM

‘জাগরণী সংঘ’-এর পার্শ্ববর্তী ফলের দোকানের সামনে রাজীব সচরাচর দাঁড়ায় না। সেদিন কেন দাঁড়িয়েছিল কে বলবে? ক্লাবের সামনেই সি এন জি স্ট্যান্ড। গাড়িগুলো শ্রীনগর পর্যন্ত যায়। কোনো টাইম-টেবল নেই। পাঁচজন যাত্রী হলেই রওনা দেয় গন্তব্যের দিকে।

চারটা বারো মিনিট। চারটার ভেতর মিজানের ফোন করার কথা। দেরি করছে কেন? কোনও ঝামেলা হয়েছে কি? তা হলেও তো ওর জানানো উচিত, আসতে পারবে নাকি পারবে না। হারুনের টি-স্টলে গিয়ে বসার কথা ভাবে রাজীব। হারুন ‘যুগান্তর’ রাখে। আজ শুক্রবার। চা খেতে খেতে সাহিত্য সাময়িকী পাতাটা দেখা যাবে। টি-স্টলের দিকে পা বাড়াবে ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ে ঝলমলে থ্রি পিস পরা মাঝারি উচ্চতার মেয়েটিকে। একটু কাছে এলে রাজীব বুঝতে পারে রিনা আসছে। ও সামনে হাজির হওয়ার আগেই হারুনের দোকানে ঢুকে পড়বো নাকি? না থাক, এভাবে অ্যাভয়েড করার দরকার নাই। রাজীবের হাতে সিগারেট। সে বরং ক্লাবের ভেতর ঢুকে পড়ে। একটা চেয়ার টেনে নেয়। বাইরের দিকে পিঠ দিয়ে দরজার পাশে এমনভাবে বসে যেন তাকে দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু সে কাউকে না দ্যাখে। রাজীব ধীরে ধীরে সিগারেট টানে। ফোনে টাকা ভরতে হবে, তারপর মিজানকে কল করবো। ও তো এরকম করে না কখনো। হঠাৎ তার কানে আসে এক নারীকণ্ঠ, চেনা চেনা লাগছে!

রাজীব অন্যমনস্কতা থেকে জেগে ওই মিষ্টি গলার উৎস সন্ধান করতেই দ্যাখে, রিনা দাঁড়িয়ে আছে। হাসি মুখ। তার রহস্যময় চোখ দুটিতেও মৃদু হাসির আভা। চুল চূড়া করে বাধা। হেয়ারস্টাইলটা চোখে পড়ার মতো।

আরে রিনা! কি খবর? কোথা থেকে এলে?

আ-র খবর! মুন্সীগঞ্জ গিয়েছিলাম। ডি পি ই ও-র অফিসে। জানেন না বদলির চেষ্টা করছি।

বদলি? কোথায়?

বাসার কাছাকাছি কোনো স্কুলে। ছাতিয়ানতলী হলেও চলবে। ছাতিয়ানতলী স্কুলে পোস্ট ভেকেন্ট আছে?

আছে একটা, শীতল গলায় রিনা উত্তর দেয়।

তোমাদের জন্য এটা কঠিন কাজ না।

কঠিন নয় কেন?

রাজীব বলে, ডি পি ই ও সাহেবের সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো, মানে শুনি আর কি, উনি তোমাকে পছন্দ করেন। তাই অনুমান করি, ট্রান্সফার হতে তোমাকে বেগ পেতে হবে না।

রিনা কি যেন বলতে গিয়েও বললো না। কথা ঘুরিয়ে নেয় সে, যাকগে, কেমন আছেন? খবর কি আপনার?

চলছে! গত মাসে তেরো পর্বের একটা নাটক শেষ হলো।

এখন বুঝি ফ্রি?

আরে না! এখন আরেকটার কাজ আরম্ভ হয়েছে। এটাও তেরো পর্বের। টানা আট দিন শ্যুটিং হলো। মাঝখানে দু’দিনের বিরতি। আবার শনিবার থেকে শুরু।

তার মানে তো এ মুহূর্তে কাজের চাপ নেই।

হ্যাঁ তা বলতে পারো।

সি এন জি স্ট্যান্ডে যাত্রী কম। এখন না-দুপুর না-বিকেল প্যাসেঞ্জার আসছে একজন দু’জন করে। যে গাড়িটা সিরিয়ালে আছে তাতে দু’জন যাত্রী উঠেছে। ড্রাইভার ডাকছে, তিনজন তিনজন। শ্রীনগর তিনজন।

রাজীব ভাবলো ছ’/সাত মাস হলো রিনা আমাকে ফোন করে না। আমি যদি কল করি ভদ্রতাবশত কিছুক্ষণ কথা বলে, কুশলাদি জিজ্ঞেস করে, কিন্তু সবই কেমন নিরুত্তাপ। অনেকদিন পর আজ দেখা। কিন্তু মেয়েটার কণ্ঠস্বরে বা ভাব-ভঙ্গিতে এতটুকু উষ্ণতা নেই। কথা বলছে কেমন ছাড়াছাড়া ভাবে। রাজীব আরও ভাবে, এখনো তিন জন প্যাসেঞ্জার বাকি। এ তিন জন মানুষ দু’মিনিটে এসে হাজির হতে পারে। আবার দশ/পনর মিনিটও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে কথা বলে টাইম কিল করা বেটার নয় কি? আর সে জন্যই কি রিনা আমার সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে? কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে গাড়ির দিকে লুক দিচ্ছে। এমন যদি হতো মেয়েটা স্ট্যান্ডে এসে পড়েছে, ড্রাইভার ডাকছে ‘শ্রীনগর দুইজন’ সেক্ষেত্রে কী করতো সে? আমার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে কিংবা আমাকে শুধুই ‘হাই হ্যালো’ বলে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠতো এবং পঞ্চম যাত্রী না আসা পর্যন্ত ওয়েট করতো।

একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজীব। এ মেয়েটা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ফোন করতো আমাকে। আমিও করতাম। রিনা অনেকক্ষণ কথা বলতো আমার সাথে। বেশ ক্রেজিই ছিল বলা চলে। আর এখন? মাসের পর মাস যায়। রাজীব আহমেদ নামে পৃথিবীতে কেউ বেঁচে আছে তার মনেও পড়ে না। নাকি মনে পড়ে ঠিকই ইচ্ছে করেই ফোন করে না? রাজীব এখন ভাবে, আমার কথা অ্যাবসলিউটলি ভুলে থাকা সম্ভব না ওর পক্ষে। জীবনের ছোট একটা চ্যাপ্টার আমরা উষ্ণ অনুভূতির ভেতর দিয়ে কাটিয়েছি। সেই অনুভূতি পারস্পরিক। দু’জনের আবেগ আর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে এক বিন্দুতে এসে মিলেছে কয়েক বার। আসঙ্গলিপ্সা কি প্রবলভাবে আমাকে তার কাছে ডেকে নেয়নি অথবা আমি তাকে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের ভেতর ডাকিনি হৃদয় দিয়ে? এটা খুবই সত্য। জীবিত মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো সত্য। এটাকে রিনা অস্বীকার করবে কিভাবে?

সিনেমা-থিয়েটারের লোকজন সাধারণত বইমেলায় যায় না। এমনিতেই তো মানুষ ওদের দেখলে এগিয়ে আসে। ভিড়ের মধ্যে গেলে অবস্থা আরও খারাপ। প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না। বেশির ভাগ মানুষ কী সব প্রশ্ন করে। রিডিকিউলাস! রাজীব তাই পারতপক্ষে বইমেলায় ঢোকে না। কদাচিত ঢুকলেও তা পাঁচটার আগে এবং বেশি সময় থাকে না। গত ফেব্রুয়ারিতে সে মেলায় দু’দিন গিয়েছিল; মানে না গিয়ে পারেনি।

বিকেলবেলা ওদের নতুন নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে টেবিলে বসেছে রাজীব। কয়েকটা জায়গা ঠিকঠাক করতে হবে। এক সপ্তাহ পরেই স্যুটিং। ফোন বেজে উঠলো। প্রথমবার ধরলো না। পরে রিসিভ করতেই ভেসে এলো রিনার গলা, ভাইয়া আপনি কোথায়?

বাসায়। হ্যাঁ, বলো।

বইমেলায় এসেছি আমি। একা একা হাঁটছি। একদম ভাল্লাগছে না। আপনি চলে আসেন।

রিনা, আমি তো এখন বেরোতো পারবো না। কাজে বসেছি। স্যরি। মোবাইল রেখে দেয় রাজীব। স্ক্রিপ্টে মনোযোগ দেয়। তিন/চার পৃষ্ঠা ওল্টানোর পর তার মনে হয় আজ আর ফোন করবে না। ওদিকে রিনার নিশ্চয়ই খারাপ লাগছিল। হতে পারে জেদও চেপে গিয়েছিল। অতএব আবার ফোন। রাজীব একবার ভাবে, অফ করে রাখবে। ওর একটু লেসন হওয়া দরকার। আরেকবার ভাবে, নাহ্ এবার অন্তত ধরি তারপর না হয় বন্ধ করে রাখবো। রিসিভ করেই গম্ভীর গলায় রাজীব বলে, কী হলো তোমার?

কী আর হবে? আপনাকে তো বললাম আমার খুব খারাপ লাগছে। চলে আসেন; কিছু হবে না।

তুমি তো বলেই খালাস! আমি জানি আমার অবস্থা! ক’দিন পরেই আমাদের...

স্যুটিং, তাই তো? হোক। আপনি চলে আসেন।

আচ্ছা রিনা, কেন ছেলেমানুষের মতো করছো? তিন/চার দিন পর আমরা মিট করি? মেলাতেই না হয় দেখা হবে, তারপর অন্য জায়গায় যাবো আমরা?

না, আজই! আপনি রওনা দিন। এই আমি সিঁড়িতে বসলাম। না এলে দেখবেন কি করি।

রাজীব ভাবে, ভীষণ জেদি মেয়ে রিনা। না গেলে বর্ধমান হাউজের সিঁড়িতে ঠায় বসে থাকবে মন খারাপ করে। তারপর-যে কি করবে বোঝা মুশকিল। অগত্যা সে বেরিয়ে পড়ে এবং ছ’টার দিকে মেলাপ্রাঙ্গণে ঢোকে। ইতোমধ্যে প্রচুর লোক এসেছে। ঘণ্টাখানেক পর স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটাই যাবে না। তার উপর আছে জনপ্রিয়তার বিড়ম্বনা। কখন ভক্তরা এসে হ্যাংলার মতো চারপাশে দাঁড়াবে তার ঠিক আছে? রাজীব মনে-মনে বলে, ঘণ্টাখানেকের ভেতর বেরিয়ে যেতে হবে। তারপর ভাবে, বহেরাতলায় গিয়ে ফোন দেবো। কিন্তু ‘সালাম-বরকত চত্বর’-এর কাছাকাছি যেতেই তার মোবাইল বেজে ওঠে। রিসিভ করেই রাজীব বলে, আমি এসে গেছি। তুমি কোথায়?

রিনা তার অবস্থান সম্বন্ধে জানায়। কয়েক কদম এগিয়ে বাম দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ে একটা স্টলে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে মেয়েটা। ওটা বুকস্টল নয়, মিডিয়া কর্মীদের বিশ্রাম নেয়ার জায়গা। রাজীব দেখতে পেলো রিনার বিপরীত দিকে বসা সালামকে। তার ডানে-বামে দুটি কম বয়সী ছেলে। রহমান ওখানে অনুপস্থিত। অবশ্য আজহার আছে। আজহার ব্যস্ত। ক্যামেরাম্যানকে কি যেন বলছে সে। আধ ঘণ্টা পরে প্রোগ্রাম শুরু হবে। লেখক ও তার নতুন বই নিয়ে প্রোগ্রাম। রাজীব ভাবে, এদের সার্কেলে রিনা ঢুকলো কি করে? ওখানে যারা বসে তারা তো এক একজন মহা ধান্ধাবাজ। মেয়েটাকে ওরা খুব একটা পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। তারপরেও ও এদের সাথে মিশতে চায়।

স্টলের সামনে এসে রিনাকে ডাকার দরকার পড়েনি রাজীবের। রিনাই দেখেছে রাজীবকে এবং নিঃশব্দে উঠে এসেছে তার কাছে। এখন দুজনই হাঁটছে পাশাপাশি। রিনা আজ শাড়ি পরে এসেছে। কাঁধে ঝুলিয়েছে চমৎকার একটা কাপড়ের ব্যাগ। রিনার মেজাজ এখন ফুরফুরে। মাথার ভেতর উড়ছে অসংখ্য প্রজাপতি। রাজীব বলে, আসো তো, লিটল ম্যাগ চত্বরের দিকে যাই। বদরুলকে একটু দরকার।

বদরুল কে?

বদরুল হায়দার। কবি। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

জানো, ওর একটা বইয়ের নাম ‘কালো সিল্কের অন্ধকার’।

রিনা বলে, বাহ! ভালো তো!

তারপর বহেরাতলা ঘুরে এসে যেদিকে বাংলা একাডেমির নতুন বহুতল ভবন উঠেছে সেদিকে হাঁটছিল ওরা। ‘শোভা প্রকাশ’-এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কে একজন ‘রাজীব ভাই!’ বলে ডাক দিলো।

জবাবে রাজীব শুধু হাত উঁচু করলো।

ফেরার তাড়া ছিল দু’জনেরই। রিনাকে তো আবার অনেকটা পথ যেতে হয় বাসে করে। তা ছাড়া ওর টুকটাক কেনাকাটাও আছে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে ‘মওলা ব্রাদার্স’-এ ঢুঁ দেয় ওরা। রাজীব আগে থেকে কোনো বইয়ের কথা ভেবে রাখেনি। চোখের সামনে ‘কাইফি আজমী’ নামটা দেখে বইটা হাতে তুলে নেয়। কয়েকটা পৃষ্ঠায় চোখ বুলায়। তারপর ওই কাব্যগ্রন্থের দুটো কপি দিতে বলে সেলসম্যানকে। একটা নিজের জন্য, অন্যটা রিনার জন্য। রাজীব বইয়ের প্যাকেট রিনার হাতে তুলে দিলে সে থ্যাঙ্কস জানায়। জবাবে রাজীব কেবল স্মিত হাসে। আরও কিছু সময় ওই স্টলের সামনে ওরা থাকে। সদ্য বেরোনো ঝকঝকে বইগুলোর দিকে লুক দেয়। রিনা দু’একটা বই উল্টেপাল্টে দ্যাখে। তারপর গেটের দিকে পা বাড়ায়।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রাজীবের মনে পড়ে ওই সার্কেলটার কথা যেখানে রিনা বসে ছিল। সেই সূত্রে মাথায় এসে যায় রহমান, সালাম প্রমুখের কথা। এরাও লেখক। তবে লেখার মান বাড়ানো যাবে কিভাবে সেদিকে মনোযোগী না হয়ে লেখকপরিচয় ভাঙিয়ে বৈষয়িক সুবিধা বাগিয়ে নেয়ার ব্যাপারেই বেশি তৎপর। রাজীব যদিও সিনেমার মানুষ তবু এদেরকে কাছে থেকে দেখেছে। এসব লোককে বুঝতে বাকি নেই তার। সালাম এমনিতে সদালাপী। দেখা হলে হেসে কথা বলে। সেটা বাইরের রূপ। ভেতরে একটা অন্য মানুষ আছে। একদিন আজিজ মার্কেটে দেখা। ওর সঙ্গে কে একজন ছিল, নবীন কবি হবে হয়তো। হঠাৎ সে মুখের ওপর বলে বসে, শালা সফল লোক। তারপর থেকে রাজীব তাকে এড়িয়ে চলে। কথাটা ভালো লাগেনি তার। কেননা কথাটার ভেতর দিয়ে ঈর্ষা ফুটে উঠেছিল।

রহমানের পুরো নাম রোকন হাবীব। তার কথা না তোলাই ভালো। এ লোক করতে পারে না এমন কাজ নেই। একবার রাহমানকে অপদস্থ করেছিল। ১৯৮৭/৮৮-এর দিকের একটা ঘটনা মনে আছে। রাজু তিন/চারজন বন্ধুর সঙ্গে বাংলা একাডেমির বইমেলায় আড্ডা দিচ্ছিল। কিভাবে যেন রহমান সেদিন ওদের মধ্যে এসে পড়েছিল। রাজীবের কবি বন্ধু কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার স্পষ্টবাদী। ও বলে ফেলে, আপনার কবিতা খুব বেশি খোলামেলা। অনেক সময় শ্লোগানের মতো। আর যায় কোথা! মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে রহমান। ‘আপনি আমার ক’টা কবিতা পড়েছেন? শ্লোগান বলতে কী বোঝাচ্ছেন আপনি?’ ...এসব বলতে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে হাতাহাতি হবার উপক্রম হয়। তখন কিশওয়ারের পক্ষ নেয় রাজীব ও তার বন্ধুরা। বেকায়দা দেখে রহমান কেটে পড়ে।

রাজীব এখন ভাবে, রিনা কেন-যে এসব লোকের মাঝখানে যায়। এদের সঙ্গে মিশে কী পাবে ও? বড়জোর মঞ্চে একটা-দুটো কবিতা পড়ার সুযোগ অথবা টি.ভি তে কাব্যগ্রন্থের এক মিনিটের প্রচার। ও কি জানে এসবে কিচ্ছু হয় না? আসল কথা হচ্ছে, ভালো লেখা। ক্রমশ লেখার উন্নতি করা। এর কোনো বিকল্প নেই। আচ্ছা এ লোকগুলোর সাথে রিনার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কে? কে সেই গ্রেট ম্যান? ভাবতে ভাবতে একাডেমির গেট পার হয় রাজীক।

দোয়েল চত্বর পর্যন্ত এসে রাজীব দাঁড়ায়। রিনাও থামে। রাজীব একটা সিগারেট কেনে। সিগারেটটা ধরিয়ে কয়েকটা পাফ দিয়েই বলে, তুমি কি এখনই বাসায় যাবে?

-হ্যাঁ।

-রাজীব বলে, ৭-২০ বাজে।

এখন রওনা দেয়াই বেটার। সাড়ে আটটার মধ্যে না ফিরলে মা বকে।

রাজীব বলে, কী বলো! তুমি একটা সার্ভিস হোল্ডার মেয়ে। তোমার ফ্রিডম থাকবে না?

সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মফস্বলে থাকি; বোঝেনই তো!

রাজীব আর কথা বাড়ায় না। পাশেই কয়েকটা দোকানে মাটি আর বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র এবং ঘর সাজানোর এটা-ওটা সামগ্রী বিক্রি হয়। রিনা তেমনি একটা দোকানে ঢোকে। দুটো গাছ এবং ঝুলিয়ে রাখা চলে এরকম সবুজ লতাপাতা কেনে। সবই আর্টিফিশিয়াল তবে দৃষ্টিনন্দন নিঃসন্দেহে। মেয়েটার পছন্দ দেখে খুশি হয় রাজীব। রিকশা ঠিক করার পর রিনা আহ্বান করে রাজীবকে, চলেন আমার সাথে।

তোমার সাথে! কোথায়?

বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত।

রাজীব একটু অবাক হয়। মনে-মনে বলে, কাজ ফেলে রেখে মেয়েটাকে সঙ্গ দিতে মেলায় এলাম। এখন আবার সাথে যেতে বলছে।

রিনা বলে, কী হলো? চলেন না! যেতে যেতে গল্প করবো।

রাজীব বলে, পাগল হয়েছ? আমার কাজ আছে।

রিনা মনঃক্ষুন্ন হয়। আর কিছু বলে না।

রাজীব বলে, তুমি যাও। আমি সপ্তাহ দুই পরে তোমাদের বাসায় আসবো।

মুন্সিগঞ্জ থেকে ফিরে ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখেই বিছানায় সটান হলো রিনা। শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। সেই সকাল বেলায় বেরিয়েছিল। এখন বিকেল পাঁচটা। চোখ বন্ধ করে অনেকটা সময় চিৎ হয়ে থাকে সে। তারপর চোখ খোলে। তার মনে পড়ে বাবার কথা। আব্বা কি এসেছে? আব্বা আজকাল প্রায়ই অনেক দেরি করে বাসায় ফেরে। কোথায় যায় আল্লাহ জানে।

পর মুহূর্তেই রিনার মাথায় ভেতর একটা অফিসের চেম্বার। নতুন ডি পি ই ও খুব মুডে সিগারেট টানছেন। কী একটা আপত্তিকর কথায় চুপসে আছে রিনা। রুমে আর কেউ নেই। রিনার গুটিসুটি বসে থাকার ভঙ্গিটা বোধ হয় ভালো লাগে না বসের। তিনি মেয়েটাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করেন। আরে, তুমি দেখি সিরিয়াসলি নিছো আমার কথাটা! আমি একটু মজা করলাম আর কি! রিনা কিন্তু যা বোঝার বুঝে গেছে। বেজার মুখে বসে আছে সে। অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি এখন বসের মগজে। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। দেয়াল ঘড়ির কটাক কটাক শব্দটা যেন দ্বিগুণ হয়ে ঢুকছে তার মাথায়। আর কোনো শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে না। রিনা... তুমি এত ভালো মেয়ে! তোমার যা দরকার সংকোচ না করে আমাকে বলবে। বলেই তার পিছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে চাপ দিচ্ছে লোকটা। রিনা খুব আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে চোরাবালিতে।

প্রথম দিনেই তাকে শিকারে পরিণত করতে চেয়েছিল বস। আজও সেই চেষ্টা করলো! দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শোয় রিনা। মাথার ভেতরটা টগবগ করছে। অস্ফুট স্বরে বলে, শয়তান! লুচ্চা! ভেবেছে আমি ওর মিষ্টি কথার মানে বুঝিনি? কুত্তা! ‘কুত্তা’ কথাটা অজান্তেই সশব্দে বেরিয়ে যায়। ঠিক সে মুহূর্তে পর্দা ঠেলে ঘরে ঢোকে মিনা, কারে বকতাছো আপা?

রিনা অসহিষ্ণু গলায় বলে, আমার কপালরে। যা ভাগ আমার সামনে থেকে!

মিনা নড়ে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিশ সেকেন্ড পর মিনা আবার কথা বলে, আপা। রোকন ভাই আইছিল। আইসা একটু পরেই গ্যাছে গা। কইলো, তোমার নম্বরটা হ্যার কাছে নাই। মোবাইল হারায়া গ্যাছে। তোমারে কল দিতে কইছে।

রিনা নির্বিকার। তার মুখ থেকে কথা বেরোয় না। রিনা বিরক্ত। বিকেল আস্তে আস্তে সন্ধ্যার দিকে এগোচ্ছে। রোদ এখন নিস্তেজ। মাথার কাছের জানালাটার একটা কপাট আধখোলা ছিল। রিনা জানালাটা ভালো করে খুলে দেয়। তারপর সিলিংয়ের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে। তারপর খেয়াল করে ফ্যানটা আস্তে আস্তে ঘুরছে। ফ্যানটা ইদানীং স্লো হয়ে গেছে। ক্যাপাসিটরে সমস্যা হয়েছে নাকি? তার চোখ যায় দেয়ালের কোণে ঝুলন্ত মাকড়সার জালের দিকে। জালের ভেতর আটক পড়েছে একটা নিরীহ পোকা। ছোট পোকা। পোকাটা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিছুতেই পারছে না। অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যটা দ্যাখে রিনা। হাত-পা ছড়িয়ে একভাবেই শুয়ে থাকে মেয়েটা। এভাবে আরও কিছু সময় পড়ে থাকবে সে। তারপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকবে।

চা-বিস্কুট খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রিনা ঘর থেকে বেরোয়। বাসার পাশ দিয়ে একটা ক্যানেল চলে গেছে। একটা ছোট সুন্দর কালভার্ট আছে। ওটার দু’পাশে বসা যায়। এদিকটায় বাইরের লোক আসে না। কোন কোনদিন সন্ধ্যার মুখে ওই নির্জন কালভার্টে গিয়ে বসে রিনা। আজও তাই করলো। অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। তার চোখ গাছপালার মাথা ছুঁয়ে এখন সিকি সন্ধ্যার অনুজ্জ্বল আকাশের দিকে। তার মন ঝুঁকে আছে আত্মচিন্তার শান্ত এক ছোট্ট জলাশয়ে। কতজনকে তো দেখলাম। কে ভালো? কেউ ভালো না। সবাই নিজের সুবিধাটা খোঁজে আগে, আমার নিঃসঙ্গতা কাউকে স্পর্শ করে না। রাজীব ভাই বরং অনেক বেটার। কিন্তু উনিও কি আমাকে বুঝেছেন? কোনোদিন জানতে চেয়েছেন আমি কী চাই। কবিতা লিখি। বড় কাগজে ছাপাছাপির জন্য দৌড়ঝাঁপ করি না। কিন্তু আমারও তো ইচ্ছে করে নামিদামি পত্রিকায় লিখতে। সম্পাদক পরিচালক, ডি.জি, বিখ্যাত ও ক্ষমতাবান কতো মানুষের সঙ্গে রাজীব ভাইয়ের ওঠা-বসা। কই, কোনদিন তো বললো না রিনা চলো অমুকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তবু মানুষটা অনেক ভালো। মেয়েদেরকে কাছে পেলে ছোক ছোক করে না। অন্য দশটা পুরুষের মতো লোভীও নয়। ক্যানেলের পানি ছুঁয়ে ঝুঁকে থাকা বউন্না গাছের ডালপালার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে রিনা।

সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গিয়েছিল। রাত সোয়া নটা পর্যন্ত তো বাইরেই থাকলো। মিজান চলে যাওয়ার পর আর কোথাও দাঁড়ায়নি, সোজা চলে এসেছে। সাড়ে বারোটার আগে রাজীব বিছানায় যায় না। ডিনারের পর দেড় দু’ঘণ্টা পড়ালেখা করে। দু’টো ফাইল বের করে সে কাগজ-পত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলো। টুকটাক আরও কিছু কাজ সেরে সে বুকসেল্ফসংলগ্ন টেবিলে বসে। হাত বাড়িয়ে ‘আমার পৃথিবী’ বইটা টেনে নেয়। কাব্যগ্রন্থ। রিনার লেখা। তিন/চারটা কবিতা পড়ে রাজীব। মাঝখানের ও শেষের পৃষ্ঠাগুলো থেকে কয়েকটা পড়ার চেষ্টা করে। তারপর ‘ওফ!’ করে ওঠে। বইটা টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রাজীব মনে-মনে বলে, হচ্ছে না। একদম হচ্ছে না। আধুনিক কবিতার ভাষাটাই আয়ত্ত করতে পারছে না মেয়েটা। এবার ব্যক্তি রিনার কথা ভাবে সে। আজব মেয়ে। লেখার বেলা ঢুঁ ঢুঁ অথচ ইগোর বেলা ষোলো আনা! রিনার ওদিক থেকে রাজীবের ফোনে কল আসেনি পাঁচ মাস হলো। রাজীব অবশ্য মাঝে মাঝে ফোন করতো। দু’মাস ধরে সেও কল করছে না। সে কথা মনে হয় তার। মেয়েটা ভালো। বোকাও। এ জন্যই তো ওর সাথে আমার হলো না, আর হবেও না। রাজীবের মাথায় আবার জেগে উঠেছে জেদি ভাব। ‘আমার পৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদের খয়েরি অক্ষরগুলো বড় অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।