আজকে অন্তত কাজ থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগল সে।
Published : 08 Nov 2024, 06:00 PM
সকাল ধরে একনাগাড়ে ফোন বেজে যাচ্ছে।
শারমিন চৌধুরীর কোনো সাড়া নেই। ঘড়ির কাটা যখন ১২ টা ছুঁই ছুঁই দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলো কাজের মহিলা খাদিজা। খাদিজা তার বাম হাতের একটা আঙ্গুল থেকে চুন গালে দিয়ে আঙ্গুলটা শাড়ির পিছনের অংশে মুছে এগিয়ে গেলো শোবার ঘরের দরজার দিকে, আফাকে ঘুম থেকে উঠাতে। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করে উপায় না পেয়ে ডাইনিং রুমের গোপন জায়গা থেকে চাবি বের করে খাদিজা এগিয়ে গেলো বেড রুমের দরজার দিকে। চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল এবং মশারির দিকে চোখ দিতেই খাদিজা হোঁচট খেয়ে দুম করে মাটিতে বসে পড়ল। তার চোখ ছলছল করছে আর চাপা গোঙানির মতো একটা শব্দ উচ্চারিত হয়ে মিশে যায় ঘরের ভিতরের হাড় কণকণে ঠান্ডায়।
"এসির টেম্পারেচার ১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস, আদ্রতা তুলনামূলক বেশি, নো সাইন অব ব্লাড, কোনো জোরপূর্বক প্রবেশের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, ভিক্টিম তার শোবার ঘরে একা প্রবেশ করে এবং রাতে ওষুধ সেবন করে, গ্লাসে অর্ধেক পানি পাওয়া গেছে, ইনসোমনিয়ার ওষুধ খাচ্ছিলেন," একনাগাড়ে রিপোর্ট করছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের জুনিয়র অফিসার, সাদাত। "এভিডেন্সগুলো কালেক্ট করা হয়ে গেলে লাশটিকে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবা আর পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করবা"। সাদাত মাথা চুলকে জবাব দিলো, স্যার এই ঘটনাটা তো ন্যাচারাল ডেথ বলে মনে হচ্ছে। এস আই পারুল মিত্র উত্তরে কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন, “এটা আমরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনার করার পর বলতে পারব।” সাদাত "ইয়েস স্যার।" বলে, তারপর শোবার ঘরের দরজার বাইরের বড় ফুলদানীর ভিতরে রাখা নীল রঙের সবুজ পাতা বিশিষ্ট অপরাজিতার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখতে থাকে। মানুষের অসাধ্য কিছু নাই, সকল কিছুর মাইক্রো টু মেক্রো মডেল চাইলেই বানিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু, তুমি চাইলেই ঘুম থেকে উঠতে পারবে না। মাগরিবের আজানের সাথে নভেম্বরের শীত শীত আবহাওয়ার সুবাস ছড়িয়ে গেছে পুরো এলাকাজুড়ে।
ঘরের ভিতর এখন দুইজন ব্যক্তি শারমিনকে সাদা রঙের জিপ লক ব্যাগে ঢুকিয়ে বিছানা থেকে সোজা লাশবাহী গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। গেটের পাশের গন্ধরাজ গাছের এক তোড়া ফুল থেকে মেঘলা সুরভী ছড়িয়ে পড়েছে গোধুলির আলোয় রাঙা ইটের ফোঁকড়ে। সাদাত তার কালো ফ্রেমের চশমাটা খুলে মোটরসাইকেলের উপরে রেখে একমনে লুকিং গ্লাসে গাড়িটির চলে যাওয়া দেখল তারপর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে গ্যাস লাইট খুঁজতে পকেটে হাত না দিতেই দেখল পারুল স্যার কল দিচ্ছেন, রিসিভার টা চেপে রাহাত কথা বলতে থাকলো।
শারমিন চৌধুরী এই ঘরে আছেন এখন প্রায় চার ঘন্টা হয়ে গেছে, এখন তার ময়নাতদন্তের কাজ শুরু হয়েছে, ঘরটি ঠান্ডা। নভেম্বর এর শীতের মতো নয়, বরফের দেশের মতো ঠান্ডা। অপেক্ষা! সাদাত অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছে, আর ভাবছে ফলাফল জানার পরে পারুল স্যারকে রিপোর্ট করতে হবে। যেহেতু জবরদস্তির আলামত পাওয়া যায়নি তাই একপ্রকার ধরেই নিয়েছে সাদাত তার ধারণাই সঠিক। নেহাৎ শারমিন চৌধুরী একজন সমাজকর্মী এবং একসময়কার ফেসবুক সেলিব্রিটি ছিলেন, অনেকদিন যাবত তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তবুও ঘর এর অতিরিক্ত ঠান্ডা থাকার ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দেওয়া যাচ্ছে না। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে সাদাতের কপালে, মাথার উপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে চোখগুলো বুলিয়ে ঘুম আসে, সে দাড়িয়ে ছিলো নাকি বসে যখন চোখ বন্ধ করেছে? এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় সাদাত। আজকে অন্তত কাজ থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগল সে।
সাদাত মিসেস চৌধুরীকে সরাসরি কয়েকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলতে শুনেছেন তবে তখন সে ছিলো একজন অনার্সের ছাত্র। সাদাতের ফোনটা আবার বেজে ওঠে, এস আই পারুল মিত্র রিসিভ করতেই বলে ওঠে "সাদাত, তুমি কোথায়? ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসতে সময় লাগবে কমপক্ষে একদিন তুমি জানো, তুমি এখন ওখানে কি করছ?" সাদাত কিছুটা বিচলিত হয়ে একমুহূর্ত সময় নিয়ে বলে, "স্যার আমি জানি ঘুমের জন্য কিছু কিছু মানুষের জীবন কিভাবে বদলে যায়, তাদের জন্য প্রয়োজন শুধু নিয়মমাফিক ঘুম। এখানে এসেছিলাম ময়নতদন্তের পর ডাক্তার বের হলে কিছু তথ্য মিলিয়ে দেখার জন্য স্যার! এই কেসটা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। " ফোনের ও পাশ থেকে ভেসে আসল, " আচ্ছা, রাত ১২ টার পর আমাকে ব্রিফ করবে।" ফোন রেখে দিয়ে সাদাত ঘড়ির দিকে তাকায়, হাতঘড়িতে সময় দেখতে সে বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তার একপ্রকার নিশ্চিত মনে হয়।
সময়ের সাথে নিজের ছুটে চলাকে সাদাত তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য মনে করে, তবে আমাদের জীবন চলছে চক্রাকারে, ঘড়ির কাটার মতো, ঘড়ির কাটার নির্দিষ্ট কিছু সময় ঘুমানো আর বাকি সময়টা কাজে লাগানোই হলো সময়ের পাশাপাশি চলা, কিন্তু অনেকদিন হলো সাদাতের রাতে ঘুম আসে না সময়মতো,ঘুমের পরিমাণ কমে গেছে, তার চশমার নিচে একটা হালকা বাদামি আভা। শারমিন চৌধুরীর কেসটার ব্যাপারে তার ধারণা হয়তো সঠিক নয়, সাদাত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে।
"শারমিন চৌধুরী আত্মহত্যা করেছিলেন, তার পাকস্থলীতে আলামত পাওয়া গেছে।", ডাক্তার মতিউর ঠান্ডা ঘর থেকে বের হয়ে সাদাতকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "মিস্টার সাদাত, আপনি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। সরি ফর দ্যাট। দয়াকরে প্রতিদিন ঠিকমতো ঘুমান, চোখের নিচে কালো দাগ নিমিষেই কমে যাবে।"
সাদাতের এখন সময়ের পাশাপাশি চলতে হবে, সময়ের দিকে ছুটে চলার চেষ্টা থেকে মুক্তি পেতে হবে।