Published : 15 Jun 2008, 07:23 PM
আমরা সাধারণতঃ মনে করে থাকি যে প্রতিটি ভাষার অন্তর্গত শব্দ এবং বাক্যের নির্দিষ্ট অর্থ আছে যা তার ব্যবহারকারীরা জানে এবং সেই ধারণার ভিত্তিতে ব্যবহার করে থাকে। এটা সত্য কেবল ভাষার সেই ব্যবহারকারীদের
…….
হাসনাত আবদুল হাই (জন্ম. ১৯৩৯)
……
ক্ষেত্রে যাদের মাতৃভাষা আর লিখিত বা মুখের ব্যবহৃত ভাষা এক। তাদের কাছে একটি শব্দের কেবল নির্দিষ্ট অর্থই থাকে, অন্য কিছু নয়। কিন্তু সেই ভাষার ব্যবহারকারীর মাতৃভাষা যদি হয় অন্য ভাষা তাহলে একই শব্দ তার কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে, অন্ততঃ কিছু ক্ষেত্রে। এমন হতে পারে যে একটি শব্দ বাক্য গঠনে ব্যবহৃত হয়ে এই ব্যবহারকারীর কাছে ভিন্ন অর্থের প্রতিনিধিত্ব করে। মাতৃভাষা আর ব্যবহৃত ভাষা এক না হলে এমন দ্ব্যর্থবোধকতা এসে যেতে পারে, সব শব্দের ক্ষেত্রে না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে।
কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে বিদেশী ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে অর্থের অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থবোধকতা এসে যেতে পারে তার একটা নির্দেশিকা হতে পারে অনুভবের শক্তি ও তার ব্যবহারে পরম্পরা। প্রত্যেক ব্যক্তি বা ভাষা-ভিত্তিক গোষ্ঠী অনুভব প্রকাশের ক্ষেত্রে তার/তাদের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এবং দৈনন্দিন জীবনে ভাবের আদান-প্রদানের পদ্ধতি ও উপকরণের উপর নির্ভরশীল। কোন ভাষা-ভিত্তিক গোষ্ঠীর অনুভব করার ক্ষমতা (সেনসিবিলিটি) তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের (বৃহৎ অর্থে) পটভূমি নিরপেক্ষ নয়। তার সংস্কৃতিই বলে দিচ্ছে প্রতিটি শব্দের অর্থ কী হতে পারে এবং সেই ভাষাভাষি ব্যক্তি যখন শব্দগুলি ব্যবহার করে তাদের কাছে সংস্কৃতি-নির্দিষ্ট এই অর্থই প্রধান এবং কার্যকর হয়। এতে কোনো সমস্যা হয় না, কেননা ব্যবহারের পরম্পরায় একটি ভাষা-ভিত্তিক গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিটি শব্দের অর্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত থাকে যেহেতু তার সঙ্গে তাদের অনুভবের/উপলব্ধির প্রক্রিয়া জড়িত। সমস্যা দেখা দেয় যখন মাতৃভাষা ছেড়ে ভিন্ন ভাষায় কেউ কথা বলতে বা লিখতে যায়। সেখানে শব্দ চয়নে মাঝে মাঝে ইতস্ততঃ ভাব এসে যায় যখন বিদেশী কোনো শব্দের অনুবাদে যে অর্থ মাতৃভাষায় তা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। অর্থাৎ অনুভব/উপলব্ধির অভ্যাসের ভিত্তিতে মাতৃভাষায় যে শব্দ ব্যবহার অনুপযোগী মনে হয় সেই বিদেশী শব্দ বিদেশী ভাষাতে লিখতে গিয়েও ইতস্ততঃ করতে হয় অথবা তা প্রত্যাখ্যানই করতে হয়। এর কারণ অনুভব/উপলব্ধি, যা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে লালিত ও নির্ধারিত, তার সঙ্গে বিদেশী শব্দের অনুদিত অর্থটি সঠিক ধারণা বহন করে না। এখানে অনুভব বা উপলব্ধির শক্তিই প্রাধান্য পায় আর এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে একটি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির। একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমিতে অবস্থানরত (বসবাসকারী) কারো পক্ষে বিদেশী ভাষা হুবহু ব্যবহার করা সম্ভব হয় না যদি না সেই কথোপকথন বা লেখার উদ্দীষ্ট শ্রোতা বা পাঠক বিদেশী ভাষা-ভাষী হয়।
ওপরের সমস্যাটা মনে এলো ছোট দু'টো ঘটনা থেকে; ঘটনা না বলে অভিজ্ঞতা বলাই ভালো। আমার আত্ম-জীবনী এইড মেমোয়ারের ভূমিকা লেখার জন্য রবীন্দ্র-গবেষক উইলিয়াম রাদিচিকে অনুরোধ জানানোর পর তিনি লন্ডন থেকে ই-মেইলে ছোট একটা ভূমিকা লিখে পাঠান। লেখার এক অংশে ছিল "I suspect when the writer completes his other two volumes we will say …." আমি তাঁকে suspect শব্দটির পরিবর্তে can well imagine কথাটি ব্যবহার করতে বলি। কারণ হিসেবে জানাই যে ইংরেজ ভাষা-ভাষীরা যে অর্থে ও প্রেক্ষিতে suspect কথাটি ব্যবহার করে বাংলা ভাষা-ভাষী ইংরেজী লেখক-পাঠক হয়তো সেই অর্থে নেবে না। তারা ইংরেজী এই শব্দটির ব্যবহার প্রণালী (ইউসেজ) মনে না রেখে এর আক্ষরিক অনুবাদ করে suspect এর অর্থ বার করবেন 'সন্দেহ করা', যার ফলে রাদিচি যা বলতে চেয়েছেন তার শুধু ভাষান্তর নয়, ভাবান্তরও হয়ে যেতে পারে। বাংলা ভাষাভাষী suspect কথাটির বঙ্গানুবাদ করে 'সন্দেহ করি' ব্যবহার করবেন এবং ভাববেন রাদিচি মন্দ অর্থেই 'সন্দেহ' করছেন যে আমি আরো দু'টি ভল্যুম লেখার পর পাঠকরা একটি উপসংহারে আসবেন। অর্থাৎ রাদিচি শুধু সাহিত্যিক ভাষায় ভাল অর্থে (মুখের ভাষাতেও হতে পারে) suspect শব্দটি ব্যবহার করলেও বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে সেটি মন্দ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে যাবার সম্ভাবনা। অবশ্য যারা শুদ্ধ ইংরেজীতে শব্দটির ব্যবহার-প্রথা (ইউসেজ) জানেন তারা হয়তো এই ভুলটি করবেন না। রাদিচি সমস্যাটি বুঝে ভূমিকায় I suspect না বলে I can imagine কথাটি ব্যবহার করেন। এ নিয়ে তিনি গভীরভাবে কিছু চিন্তা করেছেন কিনা জানি না কিন্তু একজন অনুবাদক হিসাবে শব্দের এই সব সূক্ষ্ম ম্যারপ্যাচ (নুয়ান্স?) সম্বন্ধে তার অবহিত হওয়ার কথা।
রাদিচির সঙ্গেই ঢাকায় কিছুদিন পর ব্রিটিশ কাউন্সিলের প্রধানের বাসায় এক নৈশভোজে মিলিত হই এবং যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করি যে তিনি গ্রীষ্মে লন্ডনে থাকবেন কিনা তখন তিনি এই বলে উত্তর দেন, I cannot promise. কথাটি শুনে সঙ্গে সঙ্গে রূঢ় মনে হয় এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাকে সহাস্যে বলি, you don't have to promise. আমার মাতৃভাষা ইংরেজী হলে আমি কখনই I cannot promise কথাটিকে রূঢ় বা অসৌজন্যমূলক মনে করতাম না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমার যে অমন মনে হয়েছিল তার কারণ বাংলাভাষায় 'আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না' এই কথাটি বেশ লৌকিক এবং দায়বদ্ধতার প্রতি ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ইংরেজী মাতৃভাষা-ভাষীদের কাছে I cannot promise এর অর্থ I am not sure জাতীয় বক্তব্য যার নেতিবাচক বা প্রভাবশালী কিছু অর্থ নেই। এটি বেশ নিরপেক্ষ।
দু'টি সংক্ষিপ্ত অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবিত করে এবং আমি এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। কারণটা এত সোজা যে এর জন্য গবেষণা তো নয়ই, বিশেষ ভাবনারও প্রয়োজন পড়ে না। রাদিচি ইংরেজ ভাষাভাষী হয়ে কোনো ইংরেজী শব্দ বা শব্দবন্ধের যে অর্থ করেন বা ধরে নেন তার সঙ্গে তাঁর অনুভব বা উপলব্ধির প্রক্রিয়া জডিত। আর এই উপলব্ধি বা অনুভবের উৎস রয়েছে যে সংস্কৃতিতে তিনি মানুষ হয়েছেন, সেখানে। আমি ইংরেজী যতই পড়ি বা লিখি না কেন বাংলা আমার মাতৃভাষা হওয়ায় এবং এই ভাষাতেই দৈনন্দিনের যোগাযোগ সম্পন্ন হওয়ার কারণে আমার অনুভব শক্তি বাংলাভাষার ব্যবহার এবং বাঙালীর সংস্কৃতি অর্থাৎ জীবন-যাপনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। আমি ইংরেজী অথবা কোনো বিদেশী শব্দের অনুদিত বাংলা অর্থকে বাঙালী হিসেবে আমার অনুভবের প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে প্রচলিত ইংরেজীর তুলনায় ভিন্ন অর্থ এনে দাঁড় করাই।
বিদেশী (ইংরেজী) ভাষা ব্যবহারে এই যদি হয় বাস্তবতা তাহলে আমরা কেমনভাবে বিদেশী ভাষা ব্যবহার করবো এই প্রশ্ন এসে যায়। ইংরেজী এখানে দৃষ্টান্ত মাত্র, একই সমস্যা অন্য ভাষার ক্ষেত্রেও দেখা দেবে। প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় আমরা যখন ইংরেজী ভাষাভাষীর জন্য ইংরেজী লিখবো তখন তার মত করেই লিখতে পারি। অর্থাৎ তিনি শব্দের যে অর্থ করেন সেটা না পরিবর্তন করে হুবহু ব্যবহার করলে অসুবিধা হবে না, বরং সুবিধাই বেশি। কিন্তু যখন দেশী পাঠকদের জন্য লিখবো তখন মনে রাখতে হবে যে কোনো ইংরেজী শব্দের বঙ্গানুবাদ ভিন্ন অর্থের দ্যোতক হতে পারে কেননা বাংলা ভাষাভাষী লেখকের বা (কথকের) অনুভব শক্তি ভিন্ন, কারণ তিনি ইংরেজী যার মাতৃভাষা তার মত একই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠেননি।
অনেকেই কিন্তু এখন ইংরেজী লিখতে গিয়ে নিজেদের ভাষা, তার অর্থ এবং অনুভবশক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ইংরেজী লিখছেন। সালমান রুশদি এদের পুরোধা। তিনি ভারতীয় ভাষার সংমিশ্রণে এক নতুন ইংরেজী ভাষার সৃষ্টি করেছেন যা শুধু ভারতীয় পাঠক নয়, ইংরেজ ভাষাভাষী পাঠকদের জন্যও লেখা। একে কেউ উত্তর-ঔপনিবেশিক জনপদের মানুষের (শেক্সপিয়ারের চরিত্র ক্যালিবানের দৃষ্টান্ত দিতে দিতে এরা ক্লান্ত!) প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। এই সঙ্কর ভাষার উৎস রুশদীর মত লেখকদের অনুভব শক্তির ভিন্নতায়। ভারতে জন্ম না নিয়ে বিদেশে জন্মগ্রহণ করে লিখতে শুরু করলে সালমান রুশদি অবশ্যই ইংরেজ লেখকদের মত লিখতেন, তাকে শব্দের অর্থ নিয়ে অথবা তার যথার্থতা বা উপযোগিতা নিয়ে ভাবতে হতো না যেমন হয়েছে ভি এস নইপলের ক্ষেত্রে। রুশদী কিংবা অরুন্ধতী রায় যে ভারতীয়করণের মাধ্যমে ইংরেজী লেখেন তার কারণ তাদের অনুভবশক্তি (সেনসিবিলিটি) ইংরেজী যাদের মাতৃভাষা তাদের চেয়ে ভিন্ন, কেননা এই অনুভবশক্তির সঙ্গে তাদের দেশের ইতিহাস, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সম্পর্ক রয়েছে।
ভারতের মত বাংলাদেশেও এক সময়ে ইংরেজী গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী লেখা বিস্তৃত হবে। সেই সব লেখকের আদর্শ দৃষ্টান্ত হতে পারে রুশদী যার বিপরীতে রয়েছেন ভি এস নইপল। এর সঙ্গে উত্তর-ঔপনিবেশিকতার তেমন সম্পর্ক নেই এবং ক্যালিবান বেচারাকে নিয়েও টানা হেচড়া করতে হবে না। রুশদী যদি পরাধীন ভারতেও লেখা শুরু করতেন তাহলেও তার পক্ষে নিজের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা অনুভব শক্তির ভিত্তিতে মিশ্র ইংরেজী লেখা স্বাভাবিক হতো। অবশ্য তখন প্রকাশকরা বা পাঠকরা এখন যেমন বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বজনীন মানসিকতা সম্পন্ন তেমন না থাকার কারণে সে ধরনের লেখা সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করতেন না। ঔপনিবেশিক ভারতে কিংস্ ইংলিশই প্রমিত ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত প্রচলিত অভ্যাস এবং একাডেমিক নিয়ম কানুনের কারণে। ক্যালিবান প্রভুর ভাষা দিয়েই প্রভুকে সমালোচনা করতে পারতো সেই ভাষাকে আত্তীকরণ করার প্রয়োজন হতো না।
জুন ২০০৮
বন্ধুদের কাছে লেখাটি ইমেইল করতে নিচের tell a friend বাটন ক্লিক করুন: