Published : 09 May 2017, 09:04 PM
জীবনানন্দ দাশ-এর লেখা সুবিখ্যাত কবিতা 'বনলতা সেন' সম্ভবত কবির চেয়েও জনপ্রিয়। এ কবিতাটি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোনো শেষ নেই। কবিতার বনলতা সেন নাম্নী এই নারী কে, এ-নিয়ে মানুষের খোঁড়া যুক্তি আর নানান অনুমানের বহু উদাহরণ এ-পর্যন্ত দেখা গেছে। তবে এ-কবিতা সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত এবং ভব্যতাবর্জিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন আকবর আলি খান। তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইতে "লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি" শিরোনামের প্রবন্ধে তিনি বনলতা সেনকে বিনোদবালা বলে চিহ্নিত করেছেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে তিনি রাজশাহীতে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হিসেবে চাকুরীরত অবস্থায় পেশাগত কাজের তাগিদে পনের দিনের জন্য নাটোর গিয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের পরিমাণ যেহেতু কম, তাই তিনি আর কি করবেন, ভাবলেন নাটোর যেহেতু এসেছি জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতার চরিত্র নাটোরের বনলতা সেনকে নিয়ে একটু গবেষণা করে যাই। প্রচলিত গল্প রয়েছে, বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার লোকেরা মামলা করতে খুবই পছন্দ করে। তারা নাকি বলে, গঞ্জে যখন এসেছি, চাচার নামে কেসটা করেই যাই। আকবর আলি খানের যেন হয়েছিল সেই দশা। তিনি সম্ভবত ভেবেছেন, নাটোরে যখন এলুম, জীবনানন্দের কবিতার রহস্যময় এই নারীর এসপার-ওসপার করেই যাই। মহকুমা প্রশাসনের Notes to Successors বা উত্তরসূরীদের অবগতির জন্য রক্ষিত স্মারক ঘেঁটে আকবর আলি খান দেখলেন, নাটোরে উত্তরবঙ্গের রূপোপজীবীদের একটি বড় কেন্দ্র ছিল। নাটোরের বারবিলাসিনীরাই উত্তরবঙ্গে বড় বড় জমিদারদের দু দণ্ডের শান্তি দিতেন। আকবর আলি খানকে আর পায় কে! তিনি দারুণ খনি পেয়ে গেছেন।
তিনি জানাচ্ছেন-
"বনলতা সেন পরিচয় কবিতাটিকে একটি সম্পূর্ণ নতুন দ্যোতনা দেয়। কেন আমরা বুঝতে পারি, বনলতা সেন কেন কবিকে 'দু'দণ্ডের শান্তি' দিয়েছিল, বুঝতে পারি কেন কবির অভিসার 'নিশীথের অন্ধকারে' এবং 'দূর দূরান্তরে'। এ পটভূমিতে দেখতে গেলে, এতদিন কোথায় ছিলেন' একটি সাধারণ প্রশ্ন নয়। বনলতা সেন যেন বলতে চাচ্ছে যে, সে ইচ্ছা করে রূপজীবার বৃত্তি গ্রহণ করে নি, তার জীবনে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে, সে দুঃসময়ে তার পাশে কেউ ছিল না। 'এতদিন কোথায় ছিলেন' একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন নয়, এ হচ্ছে বিপর্যস্ত নারীত্বের আর্তনাদ। বনলতার পরিচয় পেলেই আমরা বুঝতে পারি কবি কেন কবিতার শেষে বলেছেন 'সব পাখি ঘরে ফেরে'। বনলতাদের সাথে দু'দণ্ড সময় কাটালেও শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দদের (বিবাহিত পুরুষদের) লাবণ্যপ্রভাদের (স্ত্রীদের) কাছে ফিরে আসতে হয়। বনলতাকে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে প্রকাশ্যে পাওয়ার সুযোগ নেই। বনলতার কথা কাউকে বলারও উপায় নেই। বনলতাকে নীরবে নিভৃতে স্মরণ করতে হয় অপরাধবোধ নিয়ে। তাই কবি বলেছেন, 'থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।' এ অন্ধকার প্রাকৃতিক নয়, এ অন্ধকার মানসিক। আমার জানামতে নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ ও বেদনা এত সুন্দরভাবে আর কোন কবি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি।" (লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি, পরার্থপরতার অর্থনীতি, আকবর আলি খান, পৃষ্ঠা-৮২)।
তিনি আরো লেখেন-
"প্রশাসকদের দলির দস্তাবেজ হতে দেখা যায় যে, এ শতাব্দীর প্রথম দিকে নাটোর শুধু কাঁচাগোল্লা বা জমিদারদের জন্য বিখ্যাত ছিল না, নাটোর ছিল উত্তর বঙ্গের রূপাজীবাদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। আমার মনে হয় 'নাটোর' শব্দটির দ্বারা তার পেশা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে দেখলে বনলতা সেন নামটির তাৎপর্যও সহজে বোঝা যায়। সেন পদবী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সে ভদ্রবংশ উদ্ভূত। বনলতা বাংলাদেশে ব্যবহৃত কোন সাধারণ নাম নয়। তার স্খলনের পর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য সে হয়ত ছদ্মনাম নিয়েছে।"
…………………………………………
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতোদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
…………………………………………
আকবর আলি খানের এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মোঃ আবু তাহের মজুমদার তাঁর 'জীবনানন্দ' নামক গ্রন্থে বনলতা সেন নামের এক নিবন্ধে বনলতা সেন সম্পর্কিত আকবর আলি খানের গবেষণা কাজকে বিরক্তিকর, স্থূল, দূরান্বয়ী, এবং নান্দনিক ধ্যানধারণা-বিযুক্ত বলে মতামত দেন। আবু তাহের মজুমদার তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে বারোটি পয়েন্ট তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেন।
১.জীবনানন্দ পদস্খলনের পূর্বেকার বনলতা সেনকে চিনতেন, কিন্তু বহুদিন আর তার কাছে যাননি; পরে যখন যান তখন তার পদস্খলন হয়ে গেছে; তাই প্রশ্ন 'এতদিন কোথায় ছিলেন?', আপনি আসলে তো আর আমার পদস্খলন হতো না, আমি রূপাজীবা হবার অধঃপতন থেকে রক্ষা পেতাম;
২.জীবনানন্দ কি তাকে প্রেমিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা রাখতে দেরি হলো বলে বনলতা সেন এখন দুর্ভাগ্যের শিকার;
৩.এসবের একটা মানে হলো জীবনানন্দ বরিশাল থেকে নাটোর যাতায়াত করেছেন এবং এর কোন এক পর্যায়েই বনলতা সেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে, তখনও তার অধঃপতন হয়নি, ও পরে, অধঃপতনের পর খবর সংগ্রহ করে, তিনি নাটোরের নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করেই ক্ষান্ত হননি তার সঙ্গে দৈহিকভাবেও মিলিত হয়েছেন আর এসব কিছুই হয়েছে অন্ধকারে;
৪.নাটোরে রূপাজীবাদের এই বড় কেন্দ্রটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল বলেই জীবনানন্দ তাকে অন্ধকারেও খুঁজে পেয়েছিলেন এবং দু'দণ্ডের শান্তিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন অর্থাৎ 'এতদিন কোথায় ছিলেন' বলেই আর্তনাদ করে বনলতা সেন কালবিলম্ব না করে নিজেকে নিবেদন করেছেন;
৫.জীবনানন্দ কি দু'দণ্ডের শান্তির বিনিময়ে বনলতা সেনকে কোন সম্মানী দিয়েছিলেন, নাকি পূর্বপ্রেম বা পরিচয়ের কারণে বনলতা সেন শান্তির বিনিময়ে কোন সম্মানী গ্রহণ করেন নি? কিন্তু গ্রহণ না করলে তার চলবে কি করে? তাছাড়া;
৬.পথ খরচ দিয়ে আবার বনলতাকে দেবার মত টাকা জীবনানন্দ কোথায় পেলেন? তিনি তো সারাজীবনই দারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন;
৭.নাটোর গিয়ে থাকলে কখন গিয়েছিলেন? বিয়ের কতদিন পর? বাসায় বা লাবণ্যকে কি কারণে যাচ্ছেন বলে অবহিত করেছিলেন;
৮.জীবনানন্দের নাটোর যাওয়ার উল্লেখ কোথাও নেই কেন?
৯.নিশীথের অন্ধকার নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক, প্রবন্ধকারের মত গ্রহণ করলে বা মেনে নিলে তা মানসিকও; বিদ্যুৎহীন (তখন নাটোরে বিদ্যুৎ ছিল না) কৃৃষ্ণপক্ষের রাত ঘন অন্ধকার, কেরোসিনের আলোতে তা উজ্জ্বল হয় না; জীবনানন্দের অভিসার নিশীথের অন্ধকারে হয়ে থাকলে অন্ধকার প্রাকৃতিক, তার কোন লেখাতে এ পর্যন্ত এ ধরনের কোন মানসিক অন্ধকারের ছাপ পরিলক্ষিত হয়নি;
১০.প্রবন্ধকারের মতামত মেনে নিলে এ কথাও মেনে নিতে হবে যে জীবনানন্দ বনলতা সেনকে দেখেছেন, তার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন এবং পরে তার মুখোমুখি বসেছেন কেরোসিনের বাতির বা হারিকেনের আলোয়; এ কারণেই বনলতা সেনের বর্ণনা অস্পষ্ট; লাবণ্য দাশ কি বনলতা সেন সম্পর্কে একেবারেই অনবহিত ছিলেন? নাকি জেনেও কখনো উচ্চবাচ্য করেননি?
১১.বনলতা সেন কবিতায় অপরাধবোধ খুঁজতে যাওয়া একটি ব্যর্থশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ এ ধরনের কোন বোধের লেশমাত্রও কবিতাটির কোন ছত্রে বা শব্দে আভাসিত বলে মনে হয় না;
১২. জীবনানন্দ দীর্ঘ যাত্রা শেষে প্রাক-উষালগ্নে বনলতা সেনকে দেখেন, দিনটা কাটে সম্ভবত তার সঙ্গেই এবং সন্ধ্যার পর দুজনে আবার মুখোমুখি বসেন; সব পাখি ঘরে ফিরলেও জীবনানন্দ কিন্তু ঘরে ফেরার ভাবনায় কাতর নন, বরং ধীরে সুস্থে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসেন; কাজেই প্রবন্ধকার বিবাহিত পুরুষদের ঘরে ফেরার যে কথা বলেছেন তা অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষিদ্ধ প্রেমের যে আনন্দ ও বেদনার কথা বলা হয়েছে তাও অপ্রাসঙ্গিক। মোটকথা, বনলতা সেন একজন রূপাজীবা এ ধরনের বিবেচনা শুধু বিতর্কমূলকই নয়- বিভ্রান্তকর বলেই মনে হয়।
(বনলতা সেন, জীবনানন্দ, মোঃ আবু তাহের মজুমদার, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫)।
আবু তাহের মজুমদারের নিজের ব্যাখ্যা হল, বনলতা সেন আসলে বরিশালের ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাঁর বর্ণনা জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসে রয়েছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের পাশের বাড়ির একজন নারী।
আবু তাহের মজুমদারের এ-লেখার পর আকবর আলি খান আবার কলম ধরেন। এবার ছোটখাট নয়, বিশদভাবে, আগের চেয়ে শানিত কলমে তিনি তাঁর লেখা অন্ধকারের উৎস হতে বইতে "অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো : নতুন আলোকে বনলতা সেন"-এর মাধ্যমে মোঃ আবু তাহের মজুমদারের যুক্তিগুলো যে ভুল, তিনিই যে সঠিক সেটি পুণরায় পুরনো সেই অনুমাননির্ভর যুক্তি এবং নতুন আরও কিছু যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন। পূর্বের বক্তব্য সেই একই, অর্থাৎ, বনলতা সেন একজন বারবণিতা এবং দু'দণ্ড শান্তির খোঁজে জীবনানন্দ তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। নতুন অনুধাবনগুলো আরও বিভ্রান্তিকর। এ-বার তিনি বনলতা সেন কবিতার তাৎপর্যভিত্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। সেই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে আমরা যাব না। সেটি উদ্ভট এবং সময় নষ্টকারী। কবিতা পড়ে সেটির রস গ্রহণ করাই পাঠকের দায়িত্ব। অপরের মুখে ঝাল খেয়ে কবিতা বুঝতে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। সেই লেখায় তিনি অন্য যারা এই কবিতা নিয়ে নানান অনুধাবন রেখে গেছেন সেটিরও সমালোচনা করেন। মোটকথা, তিনি যা বলেছেন সেটিই সঠিক। বাকীদের পঠন এবং গবেষণার কোনো মূল্য নেই।
জীবনানন্দের জীবনীকারদের বরাতে আমরা বলতে পারি, জীবনানন্দ দাশ কখনো নাটোর যান নি। বরিশালের বাইরে তিনি কেবলমাত্র ১৯২৯ সালে বাগেরহাট জেলায়, (তৎকালীন খুলনা জেলা, বাগেরহাট মহকুমা) প্রফুল্লচন্দ্র কলেজে মাস তিনেক চাকুরী করেছিলেন। আকবর আলি খানের কথা হচ্ছে, দিল্লীতে তিনি বেপাড়ায় গেছেন এরকম উদাহরণ যেহেতু রয়েছে, সেহেতু তিনি বাংলাদেশেও এ-কাজ করে বেড়িয়েছেন। এবং সেটা নাটোরেই। কারণ, কবিতায় লেখা আছে, নাটোরের বনলতা সেন তাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল। জীবনানন্দ জীবনে কোনোদিন বাইরের কোনো দেশে ভ্রমণ করেন নি, কিন্তু তিনি বিশ্বভূগোল ঘুরে দেখার মতো প্রচুর শব্দ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তাহলে কী তর্কের খাতিরে আমরা বলবো, এসব জিনিস তিনি যেহেতু লিখেছেন, সম্ভবত দেশগুলো তিনি ভ্রমণ করেছিলেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এসব জ্ঞানী লোকেরা যে করলেন, তাঁরা কী বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অশোক মিত্রের বনলতা সেন বিষয়ক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো অনুসরণ করেছিলেন? অশোক মিত্র স্বয়ং জীবনানন্দের ভাষ্যে বনলতা সেনের পরিচয় সংক্রান্ত একটি ইঙ্গিত রেখে গেছেন। এ সংক্রান্ত আলোচনা অশোক মিত্র তাঁর জীবনীগ্রন্থ আপিলা চাপিলাতে স্বল্প পরিসরে বিবৃত করে অন্যত্র এ নিয়ে গোটা একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধের নাম "বনলতা সেন।" বনলতা সেন কবিতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে অশোক মিত্র লিখেছেন, "এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেইসঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল, রাজশাহি থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাকস্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তাঁর সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্রেয়। (পৃ:-৫, বনলতা সেন/বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক/অশোক মিত্র)
যেখানে কবি স্বয়ং বনলতা সেন কে ছিলেন, সেটি নিয়ে নিজের খানিকটা মতামত দিয়ে গেছেন সেখানে কবিতার এই চরিত্রটি নিয়ে আকাশকুসুম কল্পনা করার বিষয়গুলোর অবসান উচিত। জীবনানন্দ-তো এই কবিতায়, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে-মালয় সাগরে, ভারতের প্রাচীন ইতিহাসে ঘুরে এসেছেন। তাহলে কী আমাদের ভাবতে হবে তিনি সে-সময়েরই মানুষ আসলে, ভুল করে আমরা ভাবছি জীবনানন্দ আমাদের কালের কবি।
আকবর আলি খান তাঁর পরের বইটিতে, অর্থাৎ, অন্ধকারের উৎস হতে বইতে এক জায়গায় লিখেছেন, বনলতা সেন সম্পর্কে কবি নীরব: এই অংশে আকবর আলি খান বলতে চেয়েছেন, এ কবিতা নিয়ে জীবনানন্দ নিজে কোনো বক্তব্য দেন নি। এ কবিতাটি নিয়ে নানা ভুল ধারণার সৃষ্টি হলেও তিনি সেটি অপনোদনের চেষ্টা করেন নি।
বোঝা যাচ্ছে, বনলতা সেন চরিত্রটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এসব লেখকরা ঠিকভাবে খোঁজ খবরও করেন নি, কিন্তু তিনি করেছেন! আকবর আলি খানের অন্ধকারের উৎস হতে প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে, অশোক মিত্রের আপিলা চাপিলা প্রকাশিত হয়েছে ২০০৩ সালে। এবং ২১ ডিসেম্বর ২০১০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় অশোক মিত্রের 'রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন এক বনলতা সেন' নামে যে লেখাটি প্রকাশিত হয় সেটি অশোক মিত্র বনলতা সেন কবিতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন, যেটি আগেই বলা হয়েছে।
জীবনানন্দ দাশ সারাটি জীবন দারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কবিতা পাঠিয়ে বা পাঠাবার সময় টাকা চেয়ে নানান অনুনয় করে চিঠি লিখতেন। টাকার জন্য ছদ্মনামে উপন্যাস ছাপানোর কথাও একবার বলেছেন। জীবনের লম্বা একটা সময় বেকার থেকেছেন। সারা জীবনে সাতটি কলেজে স্বল্প বেতনে অনিয়মিতভাবে উনিশ বছরের মত শিক্ষকতা পেশায় জড়িত থাকতে পেরেছেন। এরকম একজন মানুষ বারবণিতাদের পেছনে টাকা ঢালার কথা চিন্তা করতে পারেন এটা যারা ভাবতে পারে তারা আসলে মহান। এই মহান লোকেরা জীবনানন্দের চরিত্র কলঙ্কিত করার মিশনে নেমেছেন। এরা সজনীকান্ত দাস-এর মত লোকদের চাইতেও অধম। সজনীকান্ত-তো শেষে 'মানুষ' হয়েছিলেন।
আশা করি দেরিতে হলেও আকবর আলি খান তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবেন। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা থাকবে, শুদ্ধ-সুন্দর কবি জীবনানন্দ দাশ বিষয়ে কারো মনে অশোভন এবং বিকৃত ভাবনা যেন জাগ্রত না হয়। সবার মনে শুদ্ধচিন্তা বহমান থাকুক।