সত্তার নিজস্বতা নিয়ে বিরাজ করে লাজের আবরণ।
Published : 30 Jun 2024, 01:29 AM
একটি নীরব পথ বিছিয়ে রয়েছে এক অপেক্ষায়। এই পথের অন্তরে কথারহিত — তবু অভিব্যক্তিপ্রবণ — অজস্র শিহরণ নিয়ে চোখ মেলে রয় ধুলিকণাগুলো। পথ শেষে, পথের ওপারের আকাঙ্খায় স্থির এক সত্তা আর সেই সত্তার দিকে অগ্রসর হবে থরথর কম্পমান এক ধাবমান সত্তা। দ্বিধার টলমলে জলধির দিকে চোখ রেখে এগোয় সেই সত্তা। এই জলধির প্রকৃতি এমন যে তার পাড় ধরে পা ফেললেও দোলা লাগবে তার জলে—যেন তাকে দোলা দিতে নেই, কেননা দোলা দিলে ঝরে যাবে পা ফেলে চলতে থাকা পথিকেরই অস্তিত্বের আবরণ। সে আবরণ ঝরে গেলে উন্মুক্ত হয়ে পড়বে নাজুক একটি পৃথিবী। এ এক বিভাময় মুহূর্তের বিস্তার — যেখানে বিভার অলিন্দে আলো চোখ বোজে এবং একটি পলকের অন্তরালে নিজেকে দেখে নেয় বৈভবে। এই সম্পন্নতা আচ্ছন্ন করে হৃদয়-মুহূর্তকে—এর নাম দিই লাজ। তার স্বেদময় সত্তায় রচিত যত স্নানের আড়াল সেসবের কয়টি গল্পের দিশাই বা জানা রয়েছে আমার! সেসব স্নানবিন্দুর গড়িয়ে পড়ায় যত কদমফুল জেগে ওঠে তাদের শিরায় শিরায় কত বর্ণীল স্রোত তার দিশাহারা আনন্দের গোপন অভিসার কেবল লাজেরই অধিকার রয়। তবু কেন সে অধিকার করে আমার জগত? কেন সে আসন পায় চেতনা আর শরীর মিলে আমার যে অস্তিত্বকে রূপ দেয় তার পূর্ণ অবয়বে? কেন বা সে রূপান্তরিত করে একটি সম্পূর্ণ জীবনকে একটি মুহূর্তে ভিন্নতার স্বাদ ও সুবাসের সম্পন্নতায়! এই রূপান্তরের দ্বার অতিক্রম করে সে ছুঁতে চায় কোন আলোকে? কোন আঁধার নির্জনের পূর্ণতাকে?
আমরা স্পর্শ করতে বাসনা রাখছি একটি দেহরেখাকে। যদি আজ সেই বাসনার খোলা কালো চোখের দিকে চেয়ে নিজেরই কাছে স্বীকার করি ছুঁয়ে দেখবার প্রবল অভিপ্রায়! তাকে তো আমি স্পর্শ করি — সে কি স্পর্শ করে না? স্পর্শের বাস্তবতা তখনই জেগে ওঠে যখন স্পর্শকারী সাড়া পায় স্পর্শনীয়ের। সেখানে স্পর্শকারীর আমি আর স্পর্শিতের আমি মেশে একে অন্যের মাঝে। তার প্রতাপ অধিকার করে আমাকে। এই অধিকার করার মুহূর্তে যাকে সে অধিকার করল সে তো আমিই—সেখানে আমিতে বহাল থাকি, জীবন্ত—তার অধিকার আমারই উপস্থিতি নির্ভর। এমনকি তার অধিকারে নিজেকে হারিয়ে ফেলার অর্থও হয় আমারই একটি সপ্রাণ উপস্থিতির বিলয় ঘটে গিয়ে একটি বদলে যাওয়া সত্তায় ঠাঁই পাওয়া। সেই আমির কোন লয়প্রাপ্তি কিংবা ভিন্ন সত্তায় স্থিত রূপ লাভ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে তো সেই সত্তা যে আমারই। তার পরিচিতির বলয়টিও আমারই অন্তর্গত। যখন আমাকে সে অধিকার করে তখন সে আমাকে তার বলয়ে, তার আবরণে বরণ করে। সেই স্বর্ণ শেকলের পেলবতাকে আজ ছুঁয়ে দেখতে চাই। তাকে বুঝতে চাই কি? বোধগম্যতার বাইরের জগৎটাই তো বিস্তৃত ও পরিব্যপ্ত যেখানে চোখ দিয়ে তাকিয়ে এগুনোর চেয়ে চোখের ভেতর সেই জগৎকে হরণ করাই আনন্দের এবং হৃত হওয়ার সুখ আরও বেশি।
সত্তার নিজস্বতা নিয়ে বিরাজ করে লাজের আবরণ। এই আবরণের সুরভী বিকীর্ণ হয়ে বদলে দেয় আবরণের নিজেরই মুখখানি। বলা ভাল, আবরণের অকর্মক—তবু—সক্রিয় প্রকৃতিকেই এই সুরভী বদলে দিতে থাকে। বদলে না গেলে অবশ্য আবরণটি হয়ত এক পর্যায়ে নিজেকে প্রকাশ করেই দিত—উন্মোচিত হয়ে পড়ত সে। লাজাবরণের প্রকৃতির বদল ঘটতে থাকে—সেই প্রকৃতিতে আবরণ একটি মাত্র কাজ কিংবা উদ্দেশ্যকে নিয়ে তার নিজ নিষ্ঠাকে বজায় রাখে—অর্থাৎ যে কাজকে সে আড়াল করতে থাকে সেই কাজটি—এই প্রকৃতিকে বদলে দেয়। আবরণখানি হয়ে ওঠে অপেক্ষার স্মারক। প্রতীক্ষার ব্যক্তিত্ব নিয়ে ভাস্বর হয়ে রয় আবরণ—তার দেহ জুড়ে অস্ফুট স্বননে ঝরতে থাকে আহ্বান। সেই আহ্বানের নিবিড় বাতাসে শুনি তার নিজ ভূমিকে সজ্জিত করে আমিকে অপরে এবং অপরকে আমিতে স্থিত দেয়ার যাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার গান গাইছে কেউ।
একটি ক্রমপ্রসারমান অভিজ্ঞতা তরঙ্গের সপ্রাণ প্রখর সত্যকে গ্রহণ করি চলুন। একটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের সত্য, যে ভেদ্যতা বিদ্ধ হয়ে জন্ম নেয় রোমাঞ্চ তার আধো বাসনার অধোবদন, আধো ভয়ের মুহূর্ত যখন স্থান আর সময়কে সংকুচিত করে আনে তখন এক স্বেদাক্ত স্বচ্ছ বিজন ফুটে ওঠে—এই পরিক্রমায় আধার হয়ে সজীব হয়ে রয় লাজ। যে ক্ষণে আমাদের বেঁচে উঠতে হয়, মরেও যেতে হয়। আমাদের বাস করতে হয় তার অধিকারে। তার প্রতাপের কাছে প্রণত হতে হয়। রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তের রোমশ উল্লাসময় বিস্ময়কে নিজ স্নায়ুর বৃত্তে বয়ে যেতে দিয়ে দেখতে হয় গতির বিকিরণ।
সত্তার প্রকাশমানতার কিংবা ব্যক্ত হবার স্বাভাবিকতার সামনে একটি পথকে আঁকতে থাকে আবরণ। আর যুগপৎ সেই পথ ও সেই আবরণের রূপ হয়ে নিজেকে সামনে আনে লাজ। সে হল পূর্ণ সূর্যের উদয়ের পূর্বে ভোরের রাগ—একটি আলো—রাগটি লুপ্ত হয়ে গড়ে তুলছে একটি মুহূর্তকে—অবলোকনের প্রাকৃত অধিকারে তাকিয়ে আমরা গ্রহণ করি সেই মুহূর্তের নির্যাস, শিশির শাসিত স্পন্দনময় এক আবির্ভাব আমাদের অন্তরে ফুটে থাকে—যদিও সেই পূর্ণ সূর্যের দিনমান স্বরূপের প্রকটতার সামনে নিজের নিটোল শুদ্ধতাকে উপস্থিত করতে সে আগ্রহী নয়। বরং তার জন্য আমাদের কালযাপন করতে হয় প্রতীক্ষা ও তিতিক্ষায়। এই কাল যাপনের ধারায় তার নিরামল পথকে আমাদের মাঝে ধারন করার একটি উপলক্ষকে পাই আমরা, তাকে জন্ম দিই—এইই এক প্রাপ্তি।
নৈকট্য ও প্রাপ্তির এবং সংযোগের কিংবা মিলনের রুদ্ধবাক বাসনা ও প্রবল বিশ্বাসের জোর—যার গতি থেকে জাগে ভেদরেখা ভেঙে যাবার আনন্দ। এই গতিকে আবদ্ধ করা হয়েছে একটি ঘরে—যার ঘেরাওকে অনুভব করা, তবু দৃষ্টিকে সে ধরা দেয় না।
আমরা স্পর্শ করি একটি প্রভাকে। এই প্রভার আঙুল আমাদের বুকের অস্পর্শিত অন্তর্পরিধিকে পূর্ণ করে, তবু সে নির্ভার করে দেয়, ভরে দেয় সে, গ্রাস করে হৃদয়কে, তবু সে কেবলই শূন্য করে তোলে আমাদের। আমরা সেই শূন্যের বশ হয় বিভাময় অন্তহীনতায় পর্যবসিত হই। সে এক নতুন, যার মাঝে হারানো আমি এক অন্য নতুন।
দুই নতুনের যখন দেখা হয় তখন দুইয়ের কেউ অথবা তারা উভয়েই আক্রান্ত হতে পারে সেই পূর্বরাগে যার রয়েছে একটি দেশ এবং দিশা। এই দেশ তথা এই ভূমি এক ঈপ্সিতকে অপর ঈপ্সিতের সাথে বুক রাখার ঘরটি গড়ে দেয়। শিশির ধোয়া, দোলায়মান, ছায়াময়, বর্ণিল, শোভাময় এই ঘর। স্বস্থ, প্রাকৃত, আরাধ্য এই গৃহকোণ, এর দোলা থেকে ছায়ার কলরবে ধ্বনি আলিঙ্গন করে নতুন নির্জনতাকে। এখানে আঁধার একটি অমল আলোর ঘেরাটোপ খুঁজে পায় নিজেকে।
বিলীন হবার টান এবং নিবেদিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছের মাঝে দুলতে থাকে একটি মায়াবী পর্দা। সেই পর্দা কী লুকাতে চায়? প্রাণের কোথাও একটি গোলাপের পাপড়ি কি নাজুক দশায় অপেক্ষা করে? আলো ও হাওয়ার যুগল ডাক আর উচ্ছল অভ্যর্থনার সামনে সে কি কাঁপতে থাকে? কোন করপুটের ত্বকের ছোঁয়ায় সে কি লীন হয়? নিজ ত্বকের পেলবতা হারিয়ে সে কি খুঁজে পেল লাবণ্যের নতুন একটি পথ—যেখানে বিলয়, বিনয় আর হারানোর মাঝে নতুন জন্মের অধরা সুখ তাকে গ্রাস করে চলে প্রতিক্ষণে? যদিও গ্রাস হওয়ার প্রতিটি অণুক্ষণে তার পূর্ব রূপের প্রতি গাঢ় ভালবাসাকেও অনুভব করকে থাকে তীব্রতরভাবে।