এবং নজরুলের লাঙল

manikm_razzak
Published : 27 August 2017, 10:44 AM
Updated : 27 August 2017, 10:44 AM

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক ও সংগীতসহ সাহিত্য ধারার নানামাত্রিক সৃষ্টিশীলতার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জীবনের একটি অধ্যায়ে যুক্ত ছিলেন সাংবাদপত্রের সাথে। সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনা করেছেন একাধিক পত্রিকা। এই সম্পাদনার সুবাদে তিনি জাতীয় জাগরণের কবি হিসেবে জনগণকর্তৃক নন্দিত হয়েছেন। এ সমস্ত পত্রিকায় সাহিত্যকর্ম ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ। সেনাবাহিনীতে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর ছাত্র জীবনের ইতি ঘটলেও এ সময়েই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পন করেন। করাচি সেনানিবাস থেকে প্রেরিত তাঁর গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সওগাত, প্রবাসী ও বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি পল্টন ভেঙে দেয়া হলে নজরুল আর আসানসোলে ফিরে যাননি, স্কুলের দিকেও পা বাড়াননি। কলকাতায় এসে বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দের হোস্টেলে ওঠেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফফর আহমদের আস্তানায় স্থিত হন। এই মহান কমরেডের সান্নিধ্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবেশ করেন পত্রিকার পরিমণ্ডলে। এ সময়, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই এ. কে. ফজলুল হকের অর্থায়নে ও সম্পাদনায় 'দৈনিক নবযুগ' নামের সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশ করা হলে, তার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয় কমরেড মুজফফর আহমদ এবং নজরুল ইসলামের উপর। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যুক্ত হন যথাক্রমে ধুমকেতু ও 'লাঙল' এর সাথে।

লাঙল পত্রিকা–লাঙল ছিল 'শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়' নামে শ্রমিক শ্রেণীর একটি সংগঠনের মুখপত্র। নজরুল এর সম্পাদক হলেও পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর নাম ছাপা হত মুখ্য পরিচালক হিসেবে, আর সম্পাদক হিসেবে ছাপা হত মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম। এছাড়া পত্রিকার প্রচ্ছদে কাঁধে লাঙলবাহী একজন কৃষকের ছবিও থাকত। পত্রিকার প্রথম পাতায় মানুষের মহত্ত্ব প্রচারের উদ্দেশ্যে চন্ডীদাসের একটি উক্তি মুদ্রিত হত।
লাঙলের প্রথম সংখ্যার প্রধান আকর্ষণ ছিল 'সাম্যবাদী' শিরোনামে এগারোটি কবিতার সমাহার। কৃষক, নারী, দিনমজুর, কুলি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর পীড়িত ও নির্যাতিত জীবনের বর্ণনাত্মক এ কবিতাগুলি পরবর্তীকালে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার এই বিশেষ সংখ্যার প্রায় পাঁচ হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল, কিন্তু এর চাহিদা এতই ব্যাপক ছিল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব কপিই বিক্রি হয়ে যায়। নজরুল 'কৃষক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের আহবায়ক হিসেবে এ সংখ্যায়ই সংগঠনের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন।

নজরুল লাঙলের অন্যান্য সংখ্যায়ও নিজের কিছু বিখ্যাত কবিতা প্রকাশ করেন, যেমন 'কৃষাণের গান', 'সব্যসাচী' এবং 'সর্বহারা'। লাঙলে অন্যান্য লেখকের রচনাসমূহের বিষয়বস্তু ছিল তৎকালীন সমাজতন্ত্রী নেতা কার্ল মার্কস, লেনিন বা সোভিয়েত রাশিয়ার রাজনৈতিক গতিধারা, চীনের পুনর্জাগরণ ইত্যাদি।
১৯২৬ সালের ২১ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লাঙলের একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তাতে তাঁর জীবনী এবং অপ্রকাশিত কয়েকটি চিঠি স্থান পায়। পত্রিকার লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সৌম্যেন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়কৃত গোর্কির মা উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ এ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিল লাঙলের পঞ্চদশ ও শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এ বছরের ১২ আগস্ট মুজাফ্ফর আহমেদ গণবাণী নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, যার সঙ্গে লাঙল একীভূত হয়ে যায়। গণবাণীও ছিল 'বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলে'র মুখপত্র।
লাঙল একটি সংগঠনের মুখপত্র হলেও এর অবস্থান ছিল সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, শান্তি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পক্ষে। এটি ছিল নজরুলের রাজনৈতিক সচেতনতার একটি প্রতীক। [মোহাম্মদ আবদুল কাইউম]১

পত্রিকাটি সূচনা থেকেই একটি সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণের প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। একারণে ছুৎমার্গের হীন সংস্কৃতি ও বর্ণবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। তারা এ বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রতিবেদন বা বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে জনমানসে প্রগতিশীল চেতনা বিকাশে ছিল যতœশীল। এ লক্ষেই পত্রিকার প্রথম খন্ডের বিশেষ সংখ্যায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়, যে বক্তব্যে তিনি বর্ণাশ্রয়ী সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করত খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের স্বপক্ষে লিখেন যাঁহারা বর্ত্তমানে বাঙ্গালার চার কোটী ষাট লক্ষের মধ্যে চার কোটী, যাহারা দেশের সার রক্ত, যাহারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া মাটী বর্ষণ করিয়া আমাদের জন্য শষ্য উৎপাদন করে, যাহারা ঘোর দারিদ্র্যের মধ্যেও মরিতে মরিতে বাঙ্গালার নিজের সভ্যতা ও সাধনাকে সজাগ রাখিয়াছে, যাহারা সর্ব্ব প্রকার সেবায় নিরত থাকিয়া আজিও বাঙ্গালার ধর্ম্মকে অটুট রাখিয়াছে, যাহারা আজিও শুদ্ধচিত্তে সরল প্রাণে মর্ম্মে মর্ম্মে বাঙ্গালার মন্দিরে মন্দিরে পূজা দেয়, মসজিদে মসজিদে প্রার্থনা করে, যাহাদের জন্য বাঙ্গালী আজিও বাঙ্গালী, যাহারা মাটী ও বাঙ্গালার জলের সঙ্গে এক হইয়া বাঙ্গালীর জাতীয়তা জ্ঞানে কি অজ্ঞানে সাগ্নিকের অগ্নির মত জ্বালাইয়া জাগাইয়া রাখিয়াছে, যাহাদের আমরা বিলাতি শিক্ষা মোহে, আইন-আদালতের প্রভাবে, জমিদারের খাজনা ন্যায্যভাবে কি অন্যায্যভাবে বাড়াইয়া, প্রলোভন দেখাইয়া, শত অত্যাচার করিয়াও একেবারে নষ্ট করিতে পারি নাই, যাহারা বাস্তবিকই বলীদের একবারে রক্ত মাংস প্রাণ, তাহারা বড় না আমরা বড়? কোন সাহসে কি অহঙ্কারে, তাহাদের জল স্পর্শ করি না? কাছে আসিলে ঘৃণিত কুকুরের-মত তাড়াইয়া দিই? এত অহঙ্কার কিসের? দাম্ভিকতা কেন? ঐ যে বাঙ্গালার কৃষক সমস্ত দিন বাঙ্গালার মাঠে আপনার কাজ ও আমাদের কাজ শেষ করিয়া দিবাবসানে ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে বাঙ্গালার কুটীরে বাঙ্গালায় গান গাহিতে গাহিতে ফিরিতেছে, তাহারা মুসলমান হউক, শূদ্র হউক, চন্ডাল হউক, উহারা প্রত্যেকেই যে সাক্ষাৎ নারায়ণ। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন।২

এ পত্রিকার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল নজরুলের কবিতা। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে এটিও একটি কারণ ছিল। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় প্রকাশ করা হত নজরুলের সব সামাজিক সচেতনতামূলক কবিতা। সূচনা সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নজরুলের সাম্যবাদী, ঈশ্বর, মানুষ, পাপ, চোর ডাকাত, বারাঙ্গনা, মিথ্যাবাদী, নারী, রাজা প্রজা, সাম্য ও কুলি-মজুর কবিতা। এখানে যথাক্রমে মানুষ ও চোর-ডাকাত কবিতার কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরা হল:
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম্ম জাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি।

চোর-ডাকাত
কে তোমার বলে ডাকাত বন্ধু, কে তোমায় চোর বলে ?
চারিদিকে বাজে ডাকাতী ডঙ্কা, চোরেরি রাজ্য চলে!
চোর ডাকাতের করিছে বিচার কোন্ সে ধর্ম্মরাজ ?
জিজ্ঞাসা কর, বিশ্ব জূড়িয়া কে নহে দস্যু বাজ ?

বলাবাহুল্য এসব কবিতায় ছিল জাগরণের আহ্বান। মানুষকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আহ্বান। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের আহ্বান। উপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান। কুসংস্কারের দেয়াল ভাঙার আহ্বান। সর্বপরি খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষক ও মজুরের রাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান।

পত্রিকাটিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রশ্নে মত ও পথের উপরও করা হত প্রয়োজনীয় আলোকপাত। শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়, উদ্দ্যেশ্য ও নিয়মাবলী, গঠন প্রণালীর উদ্বৃতিক্রমে তৎকালীন স্বদেশীদের চলমান সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করত গণআন্দোলনের মাধ্যমে অভীষ্ট তথা স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এ প্রসঙ্গে বলা হয় যেহেতু অসহযোগ আন্দোলনের একমাত্র ধারা যাহাতে সাক্ষাৎ প্রতিরোধ ক্রিয়ার সর্ব্বজনীন প্রয়োগ দেশব্যাপী ধর্ম্মঘট ও খাজনা বন্ধের দ্বারা হইতে পারিত এবং তদ্বারা শাসন-যন্ত্র ও শোষণ-যন্ত্র হইতে হাত সরাইয়া লওয়া হইত, সেই ধারার প্রয়োগ বিষয়ে ভারতের সমস্ত অগ্রগামী রাজনৈতিক দলই বিরোধী বা নিশ্চেষ্ট হইয়াছেন।

যেহেতু দেখা গিয়াছে যে গলাবজি অথবা ত্রাস-নীতিতে অনিচ্ছুক আমলা-তন্ত্রের হাত হইতে স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা অতীতে কেবলই বিফল হইয়াছে; আমলা-তন্ত্রের নিকট খোসামুদি দ্বারা ভারতবর্ষের লোকের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি আনয়ন সম্ভব নয়, কিম্বা সহস্র বন্ধনে আবদ্ধ স্বদেশীয়গণের সাহায্যেই নিয়স্ত্রীকৃত জনসাধারণের স্বাধীনতা গুপ্ত হত্যার সাহায্যে আসিতে পারে না; বোমা এবং পিস্তলের শক্তি অপেক্ষা বহুগুণে শক্তিশালী গণ-আন্দোলনের চলমান শক্তির প্রয়োগ দ্বারাই নিরস্ত্র জাতির পক্ষে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় বলিয়া বোধ হইতেছে।৫

ভারতীয় সমাজের যে অচলায়তন, সে অচলায়তন ভেঙে ব্রাত্যজনের অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ প্রসূত পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় 'মাটির মোহ' নামে এক প্রবন্ধ। শ্রীগিরিজাকান্ত মুখোপাধ্যায়ের সে লিখনিতে লেখা হয়Ñমাটীর বন্ধনই তার সমাজের বেষ্টনী হ'য়েছে। মাটীর প্রেমেই তার রাজনীতির ভিত্তি, তার জাতি-বোধের পটভূমি অঙ্কিত হ'য়েছে। Geographical limit, natural boundary, এগুলোই অনেকগুলো মানুষকে একত্র হবার প্রেরণা দেয় নাই। তার পায়ের তলায় যে প্রেমের পরশ, হাস্যোজ্জ্বল প্রেয়সীর যে আলিঙ্গন–তাই তাকে ধরণীর সমস্ত সুখ দুঃখের সঙ্গে জড়িয়েছে। মাটীর কণ্ঠে যে ঐক্যের আহ্বান, মিলনের গীতি, তারই মাঝে জাতির বেদ, জাতীয়তার নান্দীপাঠ লুকিয়ে ছিল। আদিম মানুষ political advantage -এর জন্ম জাতি-গঠন করে নাই। তার পায়ের নীচে যে নির্ব্বাক জগৎ, শুধু একত্র হবার আকাক্সক্ষা নিয়ে উন্মুখ হ'য়ে ছিল, জাতিস্রষ্টাদের কাছে তা স্পষ্ট হ'য়েছিল। মাটীর নিশ্চলতার মধ্যে ঐক্যের বাণী তাঁরা শু'নেছিলেন। আমরা তাই আজ এই অভ্যন্ত সভ্যতার যুগেও সেই tradition মেনেই চলছি। আমাদের আগে যারা গেছেন তাঁরাও শুধু এই রকম একটা ভাবের দ্বারা চালিত হ'য়েই মানুষের ইতিহাস রচনা ক'রে গেছেন।৬

একে তো পত্রিকাটি ছিল শ্রমিক মজুরদের মুখপাত্র, এর সাথে কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ যুক্ত থাকায় এতে কার্ল মার্কস বিষয়ক আলোচনাও স্থান পেত। কার্ল মার্কস সম্পর্কে প্রকাশিত হত ধারাবাহিক প্রতিবেদন। লিখতেন শ্রীদেবব্রত বসু। 'কার্ল মার্কস' শিরোনাম সম্বলিত এ ধরনের একটি লিখার কিয়দংশ এখানে তুলে ধরা হল–এই যে শোষণনীতি ও বানিজ্যপ্রথা মনুষ্যত্বকে শুধু দোহন করে নিচ্ছে সংকলনের বিপুল লোভে একদিন শ্রীঘই সমাজের ভিতর থেকে এর ভিতরে যুদ্ধ ঘোষণা হবে। এবং এই দুর্নীতির প্রসার প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিরোধও করতে পারছে না, উপশমও আনতে পারছে না।"
উপরিউক্ত চিঠিতে মার্কস-নীতির বীজ অন্তনির্হিত রয়েছে। এই সময় ১৮৪৩ খৃঃ অঃ মার্কস সস্ত্রীক প্যারিসে আসেন এবং Franco German Year Book এর সম্পাদক হন। এই সম্পাদন কার্যের সূত্র মার্কসের সহিত মার্কসের জীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ও জ্ঞানী সহচর এঙ্গেলসের পরিচয় হয়। অনেকে বলেন এঙ্গেলসের সঙ্গে এই মৈত্রী-বন্ধন না হলে হয়ত মার্কসের কথা জগৎ তেমনভাবে পেত না। মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলসই মার্কসের বিখ্যাত পুস্তক "Capital" এর প্রকাশ ও সম্পাদন ভার নেন। তার পরের কয়েক বছরের মধ্যেই কবি ও দার্শনিক মার্কস রাজনীতির মূল প্রবর্ত্তনকারী মার্কস রূপে পরিণত হন। এইখানে আর একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক সাম্যবাদীর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনিও মার্কসের মতন জগতে এক নূতন রাজনীতির তন্ত্র প্রচারে ও তাহার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর নাম Proudhon. তিনিই প্রথম প্রচার করেন যে Property is robbery ব্যক্তির সঞ্চিত ধনভারের অপর নাম দস্যুতা। মার্কসের বিপ্লবপন্থার অনেকখানি অসুপ্রেরণা ছিল ফরাসী বিপ্লবের মধ্যে। সেই সময় ইংলন্ড, জার্মাণী ও ফ্রান্সে সাম্যবাদী সাহিত্যের প্রচুর প্রসার ও বৃদ্ধি লাভ ঘটে। ১৮৪২ খৃঃ ইংলন্ডে প্রথম সর্ব্ব বৃহৎ ধর্ম্মঘটের সূচনা হয়। এই সময় বিজ্ঞান-জগতের শ্রীবৃদ্ধির ফলে চারিদিকে রেল, টেলিগ্রাফ, কল, কারখানাও ঠিক তাহাদেরি পদাঙ্ক অনুসরণ করে' সমষ্টিগত মানবের দুঃখ, দারিদ্র্য বেড়ে চলে। চারিদিকে একটা অশান্ত বাণী যেন বহুস্বরে বিকৃত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীর মানবের এই বহুধা বিভক্ত অশান্তির মূর্ত্ত বিগ্রহ হইয়া মার্কস নীতি জন্মগ্রহণ করে।

এই সময় মার্কস কলের মজুরদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন এবং তাঁদের সঙ্গে বাস করে তাদের মধ্যে প্রচার কার্য্য চালাতে থাকেন। এই রকম করে ক্রমশঃশ্রমজীবি সঙ্ঘ মূর্ত্তি-পরিগ্রহ করে। এবং ইউরোপের প্রত্যেক বড় বড় নগরে শ্রমজীবি-সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৪৭ খৃঃ অঃ প্রথম ল-নে কম্যুনিষ্টদের কংগ্রেস বসে। সেই কংগ্রেসেই মার্কস ও এঙ্গেলস একটী কার্য্য পদ্ধতির বিবরণ দেন। তাহাই মার্কসনীতির ভিত্তি। তাহার নামই বিখ্যাত Communist Manifesto. এই কার্য্য-পদ্ধতিতে ছিল প্রথম, সামাজিক বিবর্ত্তনের ফলে সমাজের অন্যায় শ্রেণীভাগের কথা, মূলধন-ওয়ালা ও শ্রমিকের অধিকার; দ্বিতীয়তঃ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং শ্রমজীবি বিপ্লবের কথা, তৃতীয়–কম্যুনিষ্টদের বিপ্লব-ঘোষণা; চতুর্থ–অন্য সব সাম্যবাদী মতামত খন্ডন।৭

পত্রিকাটিতে বাংলার ভূমি ব্যবস্থার উপরও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হত। এ প্রসঙ্গে 'প্রজাস্বত্ত্ব আইন' বিষয়ে শ্রীযুক্ত হৃষীকেশ সেনের 'বাঙলার কৃষকের কথা' হতে সঙ্কলিত লেখা প্রকাশ করা হয়, সে লিখনির অংশবিশেষ তুলে ধরা হল–ওয়ারেন হেষ্টিংসের পাঁচশালা বন্দোবস্তের মধ্যে ঠিকাদার বা জমিদারের সঙ্গে প্রজার সম্বন্ধটা স্থির হ'ল না। কাজেও এর অনেক ত্রুটি দেখা যেতে লাগল। নূতন বন্দোবস্তের জন্য বিলেতে লিখে জবাব না পেয়ে কোম্পানির কর্মচারীরা ১৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত বাৎসরিক বন্দোবস্ত করতে লাগলেন।
এর মধ্যে রাজস্ব সম্বন্ধে আরও তথ্য অনুসন্ধান করবার জন্য হেষ্টিংস এক কমিশন নিযুক্ত করলেন। এই কমিশনের রিপোর্টের ফলে প্রাদেশিক রেভেনিউ কমিটিগুলি উঠে গেল। তার পরিবর্ত্তে মেট্টোপলিটান রেভেনিউ কমিটি নিযুক্ত হ'ল। এরা রিপোর্ট করলেন, জমিদারদের সঙ্গে সুবন্দোবস্ত ক'রে তাঁদের হাতে জমি দেওয়াই কোম্পানির সর্ব্বাপেক্ষা সুবিধাজনক ও নিরাপদ এবং রায়তের পক্ষে ও দেশের পক্ষেও মঙ্গলজনক। ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে পার্লামেণ্ট এক আইন পাশ করেন। তা দ্বারা আদেশ করা হ'ল, হিন্দুরাজত্বের ও মুসলমান রাজত্বের সময়ে জমিদার, তালুকদার ও জায়গিরদারের যে সকল স্বত্ত্ব ও অধিকার ছিল এবং তাঁরা কি পরিমাণে খাজনা দিতে বাধ্য ছিলেন, তার একটা অনুসন্ধান হোক। আরও আদেশ হ'ল যে, যাদের স্বত্ত্বাধিকার লোপ করা হয়েছে তাদের তার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে কিনা তা'ও দেখা হোক। কোর্ট-অব-ডিরেক্টার অভিপ্রায় প্রকাশ করলেন, জমিদারদের সঙ্গেই বন্দোবস্ত করা হোক। কিন্তু অন্য সকল লোকের স্বত্ত্বাধিকারও যেন রক্ষা করা হয়।৮

'পত্রিকাটিতে খবরদারি' শিরোনামে একটি বিশেষ অংশে সমাজের বিভিন্ন ধরনের অসঙ্গতি ও অনাচার প্রকাশ করা হত। এ ধরনের এক প্রতিবেদনে শেতাঙ্গ এক সাহেবের নির্যাতনের কথা প্রকাশ করা হয়। 'গরুর মেলায় শেতাঙ্গের লাথি' নামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে লিখা হয়–একদিন কোনও জায়গায় প্রশ্ন হ'য়েছিল সাহেবদের বড় একটা ম্যালেরিয়া হ'তে দেখা যায় না কেন? তার উত্তরে একজন অকালপক্ক ছোকড়া ব'লে উঠলো–"কারণ শ্বেতাদের পীলে কৃষ্ণাঙ্গের চাইতে ঢের বেশী শক্ত; যদিও তোমরা তার পরখ করবার সুযোগ আজ পর্য্যন্ত পাও নি, কিন্তু আমি সেটা ঠিকই জানি।"
সম্প্রতি রংপুর জেলার ফুলছরি গ্রাম থেকে এই রকমের একটি সংবাদ সহযোগী "বসুমতী" ছেপেছেন। ব্যাপারটা হ'য়েছিল এই যে,ফুলছরিতে প্রতি পৌঁষ মাসে একটি করে' মেলা বসে। মেলায় গরু মোষ ইত্যাদি বিক্রী হয়। ফুলেশ্বর নামে একজন ২০/২২ বছরের গোয়ালা সেই মেলায় গিয়েছিল গরু বিক্রী করতে। গত ১০ই ডিসেম্বর ফুলেশ্বর গোয়ালা নিকটবর্ত্তী নদীর ঘাটে জলপান করতে যায়। সেই ঘাটে এক শ্বেতাঙ্গের ফ্লাট বাঁধা ছিল। সাহেব কালা-আদমীর এই অসভ্য ব্যবহার দেখে চটে' কাঁই হ'য়ে ফুলেশ্বরের উপর চড়াও হ'য়ে বেচারীকে বুটের আঘাত করতে থাকে। ক্রমশঃ লোক সমাগমের সম্ভাবনা দেখে বুদ্ধিমান শ্বেতাঙ্গ তার ফ্লাটে ফিরে যায়। ঠাকুর ষ্টেটের ম্যানেজার মহাশয় ঘটনা শুনে' স্থানীয় ডাক্তার শ্রীযুক্ত প্রফুল্লচন্দ্র মজুমদার মহাশয়কে নিয়ে ঘটনা স্থলে হাজির হন। ডাক্তার বাবু ফুলেশ্বরকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে গাইবাঁধা মহকুমার সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।৯

শোষণহীন সমাজ তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে যে পত্রিকার পথচলা, সে পত্রিকায় ম্যাক্সিম গোর্কির অনুপস্থিতি কাম্য হতে পারে না। এ কারণেই পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত গোর্কির 'মা'। শ্রীনৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদকৃত সে উপন্যাসের অংশ বিশেষে এখানে তুলে ধরা হল–প্রতিদিন প্রভাতে কারখানার বাঁশী বাজিয়া ওঠে। একটী কম্পিত-কর্কশ দীর্ঘ শব্দ শ্রমজীবিদের আবাসের উপরের ধূম-ধূসর পরিষ্কার আকাশকে ছাইয়া ফেলে। বাষ্পযন্ত্র-দানবের এই আহ্বানে অসংখ্য নর-নারী ধূসর গৃহগুলি হইতে পথে দলে দলে বাহিয়া চলে। বিশুষ্ক বিষন্ন-মুখে সস্ত্রস্ত জন্তুর মত তাহারা আগাইয়া চলে, অল্পনিদ্রায় দেহ কাঠ হইয়া থাকে। শীত প্রভাতের মন্দ আলোকে কর্দ্দমাক্ত পথে অসংখ্য পরিম্লান রক্তহীন নয়নের অর্থহীন দৃষ্টি লইয়া সঙ্কীর্ণ খোয়ার পথ বাহিয়া তাহারা চলে যেখানে তাহাদের জন্য হিম-স্নেহে অপেক্ষায় রহিয়াছে দীর্ঘ প্রস্তরের পিঞ্জরগুলি। তাহাদের পায়ের তলায় কাদায় চলার শব্দ হয়–মনে হয় যেন কাহারও ব্যঙ্গ দয়ার অভিনয়ের শব্দ। তন্দ্রাচ্ছন্ন গভীর কর্কশ শব্দ ওঠে। ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট, আক্রোশের ও গালাগালের শব্দ আকাশ ছাইয়া ফেলে। আর এই শব্দকে অতিক্রম করিয়া তাহাদের অভ্যর্থনার জন্য গভীর বধির গতি-রোলে যন্ত্রের পীড়িত আর্ত্তনাদ তাহাদের চতুর্দিকে পরিক্রমণ করিতে থাকে। নির্দ্দয় অনিবার্য্যতায় ও অহঙ্কারে আচ্ছন্ন হইয়া কারখানার চিমণীগুলি গ্রামের উপরে দীর্ঘ সরলভাবে দাঁড়াইয়া থাকে।

প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় যখন আবার সূর্য্য অস্ত যায়, অস্ত সূর্যের বিলম্বিত রক্ত-আলো যখন বাতায়নে বাতায়নে আসিয়া পড়ে, তখন আবার কারখানা হইতে দাহ-অন্তে ভষ্মের মত অসংখ্য নর-নারী পথে আসিয়া দলে দলে পড়ে। অন্ধকারে ভরা মুখ, ধোঁয়ায় ধূসর সারা দেহে কল-চালনর তেলের তীব্র গন্ধ, গোধূলির ঈষৎ আলোকে ক্ষুধার্ত্ত দাঁতগুলির রক্তগুলির রক্তহীন শ্বেত আভা জলে। ফিরিবার সময় কিন্তু তাহাদের ভাষা একটু যেন সতেজ হয়–একটু আনন্দের আভাস থাকে। একটি দিনের দীর্ঘ শ্রমের অবসান ত'হইল ঘরেতে আহার আছে, তাহার সঙ্গে আছে বিরাম।১০

পত্রিকাটিতে সমাজের অসঙ্গতির উপর যেমন আলোকপাত করা হত। তেমনি নানামাত্রিক লেখনির মাধ্যমে গণজাগরণের জন্য করা হত অনুপ্রাণিত। আলস্যের নিদ্রা ভঙ্গের জন্য বাজানো হত সংগ্রামের সিঙ্গা। কটাক্ষের তীরও তাক করা হত প্রযোজ্য ক্ষেত্রে। এ নিরিখেই প্রকাশ করা হয় নজরুল ইসলামের সব্যসাচী কবিতা। কবিতার শেষাংশে লিখা হয়:
মশা মেরে ঐ গরজে কামান 'বিপ্লব মারিয়াছি!'
আমাদের ডানহাতে হাতকড়া, বামহাতে মারি মাছি!
মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি
টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি!
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,
যাহোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার মরে বাঁচি
!১১

ঔপনিবেশিক সমাজে, একদিকে যেমন ছিল ব্রিটিশদের নেটিভ বিদ্বেষ, তেমনি ছিল বর্ণভিত্তিক সমাজের নানাবিধ অভ্যন্তরীণ উপাচার। যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে সমাজের গরিষ্ঠ অংশ ছিল উপেক্ষিত, অনাদৃত ও লাঞ্ছনায় নিপতিত। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে এ ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন তথাকথিত নীতি-নৈতিকতা এক পাথুরে দেয়াল হয়ে জাতিকে করে রেখেছিল স্থবির-চলৎশক্তিহীন। এ কারণে জাতীয় জাগরণের প্রশ্নে এই বর্ণবাদী-বৈষম্যের দেয়াল ভাঙা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। এ ধরনের চেতনাবোধ থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হয়েছিল শ্রেণীগত শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান। যা প্রকশিত হয়েছিল লাঙলে। এ বিষয়ে লিখা হয়েছিলÑতোমরা শুন্যে বিলীন হও, আর নূতন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধরে', চাষার কুটীর ভেদ করে', জেলে মালো, মুচি মেথরের ঝুপ্ড়ির মধ্য হ'তে। বেরুক মুদীর দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে। বেরুক ঝোড় জঙ্গল পাহাড় পর্ব্বত থেকে স্বামী বিবেকানন্দ।১২

লাঙল সবসময় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ়-পতিজ্ঞ ছিল। কংগ্রেসের মত তারা তথাকথিত স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসনের মরিচিকার পেছনে ছুটতে ছিল সম্পূর্ণ নারাজ। কংগ্রেসের গান্ধী বা নেহেরুর আপোষমুখী ভূমিকা কখনো তাদের দ্বারা সমর্থিত হয়নি। বুর্জোয়া নেতৃত্বের এহেন প্রকৃতির কথাবার্তাও লাঙলের কাছে রাজনৈতিক ভাওতাবাজি বলে বিবেচিত হত। দেশের কৃষক শ্রমিক ও খেটে খাওয়া জনগণের অধিকারের বিষয়টি আমলে না নিলে যে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ অধরাই রয়ে যাবে, সে কথা বারবার তারা উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে লাঙলের 'পলিটিক্যাল তুবড়িবাজি' প্রবন্ধে লিখা হয়েছিল–কৃষক ও শ্রমিককে সংবদ্ধ না করে তাদের প্রয়োজনে তাদের অধিকারে জনগণকে সচেতন না করে আর আমাদের লম্বা লম্বা কথা কওয়া উচিত নয়। পণ্ডিত মতিলালের মতলব দেশের লোককে চমক লাগিয়ে দিয়ে ফিরে ইলেকসনে আবার দলবেঁধে কাউন্সিলে প্রবেশ করা? কিন্তু অতঃপর? মহাত্মার এক বৎসরের স্বরাজের ধাক্কা এখনও আমরা সামলাতে পারিনি আর চমক লাগানোর প্রয়োজন কি? পণ্ডিতজীর রেজোলিউশন প'ড়ে আমাদের মনে হয় সেই লোকটার জলে ডোবার কথা। সে সংসার জ্বালায় জ্বলে পুড়ে বিরক্ত হয়ে জ্বলে ডুবে মরবে বলে ঠিক করল। কিন্তু ঘাটে যাওয়ার আগে গামছা খানি ও তেল চাইল। তেলমাখা ও গামছার কথা যে না ভুলেছে, সে যে জলে ডুবে মরবে না এটা বেশ বোঝা যায়।১৩

সদ্য জাগ্রত সোভিয়েত সমাজ ও তার নেতৃবৃন্দের চরিত্র হননের জন্য পশ্চিমা সমালোচকদের অপপ্রচারের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। তারা ওই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে যেমন নানা ধরনের অবান্তর গালগল্প ছড়াত, তেমনি দেশটির নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন সম্পর্কেও নানা ধরনের কুৎসা রটাতে পিছ পা হত না। এসব অপপ্রচার ও কুৎসার বিরুদ্ধে লাঙলের ভূমিকা ছিল জোরালো। তারা এসব অপপ্রচারের দাঁত ভাঙা জবাব দানে সবসময়ে সচেতন থাকত। এ ধরনের একটি লিখা 'লেনিন ও সোভিয়েত রুষিয়া' শিরোনামে পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হত। শ্রীদেবব্রত বসু লিখিত ওই লেখনিতে (অংশ বিশেষে) লিখা হয়েছিল–লেনিনকে জগতের কাছে ভয়াবহ মিথ্যায় অঙ্কিত করা হইয়াছিল এবং যে কোন স্থিরধী ব্যক্তি সেই সমস্ত মিথ্যা চিত্রগুলি যদি একত্রে দেখেন তিনিই বুঝিতে পারিবেন যে প্রত্যেক মিথ্যাটি অপর কোন মিথ্যার প্রতিবাদ এবং আসলে এ যে সব কল্পিত চিত্র তা স্পষ্ট ধরা পড়ে। কোনও কাগজে সকাল বেলা দেখা গেল যে লেনিন সাইবেরিয়াতে কোনও রকমে শত্রুর গুপ্ত আঘাতের হাত হইতে বাঁচিয়া গিয়াছেন, অন্য কোনও কাগজে প্রচার হইল লেনিন মস্কোর জেলে বন্দী হইয়া আছেন। আর একটী কাগজ প্রকাশ করিল লেনিন গুপ্তচর সাজিয়া স্পেনে চলিয়া গিয়াছেন। এখনও যন্ত্র বিজ্ঞান এত দূর সক্ষম হয় নাই যে একজন লোককে একই দিনে ঘন্টা কয়েকের মধ্যে সাইবেরিয়া হইতে মস্কোর জেল হইয়া তাকে আবার স্পেনের মাটীতে পৌঁছে দেবে। লেনিনের শত্রুরা লেনিনকে ভেবেছিলেন সর্ব্বময়।
ঈশ্বরের যতগুলি গুণ আমরা সাধারণত দিয়া থাকি লেনিনের শত্রুগণ শত্রুতার ছলে লেনিনকে সেই সমস্ত গুণগুলি দিয়ে বিভূষিত করেছিলেন। ভবিষ্যতে যদি কোনও লোক খবরের কাগজের খবরের উপর নির্ভর করিয়া লেনিনের জীবনী লিখিতে বলেন তাহা হইলে তিনি দেখিবেন, লেনিন ঈশ্বরের মতই সর্বময়, সর্ব্বশক্তিশালী সর্ব্বজ্ঞ ও অমর।১৪

নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গও ছিল পত্রিকাটির পাঠক খোরাক। পরজীবী ঈর্ষাপরায়ণ নাগরিক জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতি চিত্রিত হত ওই পত্রিকায়। বঙ্গবন্ধু যেমন বাঙালি জাতির পরশ্রীকাতরতার এক অন্ধকার দিকের প্রতি কটাক্ষ করেছিলেন, তেমনি তাঁরও অনেক আগে এই পত্রিকাটিও কলকাতার নাগরিক জীবনের পরশ্রীকাতরতাসহ বাঙালি চরিত্রের বহুমাত্রিক নেতিবাচক চরিত্রের খোলস উন্মোচনে সচেষ্ট ছিল। 'নাগরিক' শিরানামে শ্রীইন্দ্রজিৎ শর্ম্মা কর্তৃক লিখিত এ ধরনের একটি লেখায় লেখা হয়েছিল–আদতে আমি কিছুই দেখিনা ঘত খোলার খর বস্তি ঘুরিয়া বেড়াই তাহাদের দুঃখের জীবনের করুণ দৃশ্য আমার চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে কোথায় কোন যুবতী ধোপানী তাহার বৃদ্ধ পতির সহিত বচসা করিতেছে বা বড় জোর কোন তরুণী মেথরাণীর ঝাটা হাতে লীলায়িত যৌবনের গতিভঙ্গি।
আমার এই অসহ্য একঘেয়ে জীবনের কারণ খুঁজিতে গেলে মনে হয় আমি নিজেকে সকলের অপেক্ষা চতুর ও খুব বড় ভাবি। আমি কাহারও ভাল দেখিতে পারিনা, যদি শুনি কেহ কোন কাজে সফলকাম হইয়াছে বা যশোলাভ করিয়াছে, অম্নি আমার হৃদয়ে ঈর্ষ্যার সুতীক্ষ্ণ কুশাঙ্কুর বিদ্ধ হয়।
আমি সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া তাহার কুৎসা রচনা করিয়া তবে ছাড়ি। যদি দেখি কোন গ্রন্থকারের কোন বই বিক্রী হইতেছে, আমি বলিয়া বেড়াই যে সে খবরের কাগজের সম্পাদকদের নিয়মিত ভোজ দেয়। কোন থিয়েটারে কোন বই চলিলে বলিয়া বেড়াই ঐ থিয়েটারের কর্ত্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে কাগজের সম্পাদক ও সমালোচকদের পাশ দেয়। আর যখন কুৎসার কোন কারণই খুঁজিয়া পাইনা তখন বলি ঐ লোকটা দুশ্চরিত্র না হয় তো গুপ্তচর।
সময় সময় আমার লেখা প্রকাশ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগি। কোন সম্পাদক আমার লেখা ছাপিতে দেরী করিলে তার বাড়ি দুবেলা ধর্ণা দিয়া তাহাকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলি ও মুখে সততা সম্বন্ধে লম্বাচৌড়া বক্তৃতা দি।-সংক্ষেপিত।১৫

সাধারণ প্রজাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি পত্রিকাটিতে প্রকাশ করা হত গুরুত্বের সাথে। এ বিষয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হত ধারাবাহিকভাবে। এরই এক অংশে 'প্রজাস্বত্ব আইন, প্রজার কথা' উপ শিরোনামে লিখা হয়:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ২২ বৎসর পরে (১৮১৫ খৃষ্টাব্দে) বাংলার ভূ-সম্পত্তির প্রায় অর্দ্ধেক বিক্রী হ'য়ে গিয়েছিল। এই বাকী খাজনার জন্য দায়ী জমিদারদের মধ্যে নদীয়া, রাজশাহী, বিষ্ণুপুর ও কালীজোড়ার রাজের নাম উল্লেখযোগ্য। সুচতুর বর্দ্ধমানাধিপতি জমিদারারি পত্তনিদারের সহিত বন্দোবস্ত করলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ছিল জমিদার জমিদারির ও জমিদারিভুক্ত কৃষকের উন্নতি করন। বর্দ্ধমানের রাজা তা না ক'রে নিজের সম্পূর্ণ লাভ রেখে অন্যকে জমিদারির লাভের অংশ যথাসম্ভব দিয়ে দিলেন। কাজেই কোম্পানি তাঁর এই আচরণে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হ'লেন। কিন্তু কোম্পানির অসন্তোষ সত্ত্বেও দেখা গেল নিলাম বিক্রী আইনের কবল থেকে জমিদারি রক্ষা করবার এই একমাত্র উপায়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ২২ বৎসর পরে ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে এইরূপ জমিদারি হস্তান্তর করাকে আইনসঙ্গত ক'রে নেওয়া হ'ল। এর ফলে অনেক বড় জমিদার প্রজার সঙ্গে সম্পর্কশূন্য হ'য়ে কেবল পত্তনিদারের বৃত্তিভোগী হয়ে পড়লেন। ওদিকে পত্তনিদারেরা আবার দর-পত্তনিদার দরপত্তনিদারেরা আবার সে-পত্তনিদার নিযুক্ত করলেন। সকলেই অবশ্য কিছু লাভ করতে লাগলেন। জমিদার ও কৃষকের মধ্যে কখন কখন বার জন পত্তনিদার থাকত। নিজের লাভ ছাড়া প্রজার অবস্থার এদের কোনও স্বার্থ নেই। তাঁদের শোষণে গ্রাম শুষ্ক ও নীরস হয়েছে এবং প্রজার দারিদ্র এত বেড়েছে। কেবল মাত্র প্রাণধারণের জন্য যা আবশ্যক তাও থাকে না। তথাপি প্রজার রক্তশোষক এই ব্যবস্থা কোম্পানি বাহাদুর বৈধ করে দিলেন।১৬

পত্রিকাটিতে 'খড়কুটো' শিরোনামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ খবরের সার সংক্ষেপ প্রকাশ করা হত। এছাড়া এ অংশে বিভিন্ন সাংগঠনিক সংবাদও ছাপা হত। এ ধরনের তিনটি খবর এখানে তুলে ধরা হল:
গাইবাঁধার (সম্ভবত এখনকার গাইবান্ধা জেলা) প্রজাসভা সম্পর্কে পত্রিকাটিতে লিখা হয়েছিল–গত ২০শে ডিসেম্বর তারিখে রংপুর জেলার গাইবাঁধা গ্রামে প্রজাবর্গের এক সভা হয়ে গেছে। প্রজাস্বত্ব আইন সম্বন্ধে আলোচনা হয় এবং ঐ আইনের জন্য গঠিত সিলেক্ট কমিটিতে জমিদার প্রাধান্য হওয়া বিষয়ে গভর্ণমেন্ট ও স্বরাজ্য দল দায়ী বলে প্রতিবাদ করা হয়।১৭

জামালপুরের মেষ্টা বাজারে অনুষ্ঠিত রায়ত সম্মেলনের সংবাদ প্রসঙ্গে লিখা হয়–গত ২০ শে ডিসেম্বর রবিবার বেলা ৪টার সময় ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরের অন্তর্গত মেষ্টা বাজার সংলগ্ন মাঠে প্রজাস্বত্ব আইনের আলোচনার জন্য একটি রায়ত সম্মিলনীর অধিবেশন হয়েছিল। যাতে নিম্ন লিখিত প্রজাস্বত্ব আইনরূপে পাশ হয়, তার জন্য সাধারণের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উপস্থাপিত করা হয়।
(১) প্রজার দখলী স্বত্ববিশিষ্ট জোতগুলি হস্তান্তর করবার অধিকার প্রজাকে দেওয়া হোক, আর জমিদারের পত্তনী নজরের প্রথা তুলে' দেওয়া হোক।
(২) দখলী জমির গাছ কাটবার অধিকার প্রজাকে দেওয়া হোক।
(৩) নিজের দখলী জমীতে পুকুর ও দালান দেওয়ার অধিকার প্রজাকে দেওয়া হোক।
(৪) প্রজার দখলী জোতের উপর জমিদারের জমাবৃদ্ধির অধিকার রহিত করা হোক।
(৫) জমিদারের নির্দ্দিষ্ট কর ব্যতীত অতিরিক্ত খরচ আদায়ের প্রথা রহিত করা হোক।১৮

বগুড়ায় অনুষ্ঠিত প্রজা সম্মেলনের সংবাদ প্রসঙ্গে লিখা হয়–২৭শে ডিসেম্বর বগুড়ার এডোয়ার্ড পার্কে বগুড়া-জেলা-প্রজা সম্মিলনীর একটি অধিবেশন হয়েছিল। সেখানে ব্যবস্থাপক সভার প্রজাস্বত্ব আইনের সিকেলট কমিটিকে প্রজাদের উন্নতির দিকে দৃষ্টি রাখবার জন্য কতকগুলো প্রস্তাব সর্ব্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হ'য়েছে।১৯

যুগে যুগে বাঙালি জাতি যেমন শোষিত হয়েছে, নিষ্পেষিত হয়েছে, তেমনি প্রতিবাদ প্রতিরোধেও হয়েছে মুখর। প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে দুরবস্থায় নিপতিত হয়ে যেমন স্রষ্টার উপর দায় চাপিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে, তেমনি আবার অন্যায় অসঙ্গতির বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে প্রতিনিয়ত। আজ থেকে ৯১ বছর আগে, ব্রিটিশ শাসনামলে যখন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো শাসককুলের কাছে ছিল অস্বীকৃত, চেতনাগত দিক দিয়েও যখন সাধারণ লোকেরা ছিল অনেকটাই পিছিয়ে, তখনও বাঙালিরা প্রতিবাদ প্রতিরোধে ছিল সোচ্চার, বেঁচে থাকার প্রশ্নে কণ্ঠ করেছিল উচ্চকিত। এ ধরনের প্রতিবাদী সভা সমাবেশের ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাঙালিরা ছিল অনেক বেশি অগ্রগামী। এ ধরনেরই একটি সম্মেলনের খবর প্রকাশিত হয়েছিল লাঙলের দ্বাদশ সংখ্যায়।
'লিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রদেশীয় মৎস্যজীবী সম্মিলনী' শিরোনাম সম্বলিত ওই প্রতিবেদনে লিখা হয়েছিল–গত ১১ই ও ১২ই মার্চ্চ তারিখে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সহরে মৎস্যজীবী সম্মিলনীর তৃতীয় অধিবেশন হয়। ১০ ই মার্চ্চ সন্ধায় সভাপতি শ্রীযুক্ত হেমন্ত কুমার সরকার মহাশয় ষ্টীমার যোগে আসেন। তাঁর সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম শ্রীযুত বসন্ত কুমার মজুমদার ও শ্রীমতী হেমপ্রভা মজুমদার ছিলেন। ষ্টীমার ঘাটে অভ্যর্থনার জন্য প্রায় ৫ হাজার লোক উপস্থিত হইয়াছিলেন। সম্মিলনীতে বঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ৫ শত প্রতিনিধি এসেছিলেন। সভায় শ্রোতার সংখ্যা ৫ হাজারের উপরে হয়েছিল। সভাপতি হেমন্ত বাবুর বক্তৃতা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং মৌলিক ধরণের হয়েছিল। কাজী সাহেবের গানে সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র গুহ রায় ও সম্পাদক শ্রীকার্ত্তিক চন্দ্র মল্ল বর্ম্মণ মহাশয়ের বক্তৃতাও হৃদয় গ্রাহী হয়েছিল। মৎস্য জীবিগণের হিতকারক নানা প্রস্তাব গৃহীত হয়। শা সৈয়দ এমদাদুল হকের মৎস্যের পোনা সংরক্ষণ আইনের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। হেমন্ত বাবুর "বেঙ্গল ফিসারিস বিল" এর সম্পূর্ণ সমর্থন করা হয়। আগামী সংখ্যায় সম্মিলনীর পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হইবে।২০

ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি জাতিকে ত্রিমুখী শাসন শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হত। একদিকে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের রাজদন্ড, অন্যদিকে স্থানীয় জমিদার শ্রেণীর নানামুখী নিগ্রহ নির্যাতন এবং এ দুয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল ছুৎমার্গের অন্যায্য উত্তাপ। জমিদারদের জমিদারিতে সাধারণ প্রজার গাছ কাটা, পুকুর কাটা, ইমারত নির্মাণের অধিকারগুলো ছিল অবদমিত। এ ধরনের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়েই সাধারণ জনগণকে ভূস্বামীদের দাসত্বের শৃঙ্খলে কালাতিপাত করতে হত। এর পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় উদারচেতা জমিদারের বদান্যতায় সাধারণ লোকেরা এহেন ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা ভোগে সক্ষম হতেন। এ ধরনের এক জমিদার ছিলেন ময়মনসিংহের চাঁদ মিঞা। তাঁর এ ধরনের উদারতা প্রশংসিত হয়েছিল লাঙলে। এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটিতে 'চাঁদ মিঞার দান' শিরোনামে এক প্রতিবেদনে লিখা হয়–ময়মনসিংহের সুপ্রসিদ্ধ জমিদার চাঁদমিঞা সাহেব অসহযোগ আন্দোলনে জেলে পর্য্যন্ত গিয়াছিলেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর জমিদারির প্রভুত আয় নানা সৎকার্য্যে বায়ের বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু সব চেয়ে সুখের কথা এই যে তিনি প্রজাগণকে গাছ কাটা, পুকুর কাটা, ইমারত তৈয়ার করা ইত্যাদি অধিকার দিয়েছেন। বাংলার অন্যান্য জমিদারেরা যদি চাঁদ মিঞার আদর্শ অনুসরণ করিতেন, তাহলে দেশে প্রজা জমিদারে বিরোধ বাধিত না, বা কউশিলে গিয়ে গবর্মেন্টের কাছ থেকে আইন পাশ করাতে হত না। জাপানের জমিদার সামুরাইগণ যেমন দেশের হিতার্থে নিজেদের সমস্ত অধিকার জাতির হাতে দিয়ে ছিলেন–আমাদের দেশের জমিদারগণের নিকট প্রজারা কি সে ত্যাগ আশা করতে পারে না? এই ত্যাগ সম্ভব না হ'লে শ্রেণী-সংগ্রাম যে অবশ্যম্ভাবী এ কথা সকলে বুঝেছেন কি?২১

ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই ছিল কৃষিনির্ভর, শিল্পখাত বিকশিত হতে না দেয়ায় প্রলেতারিয়েত শ্রেণী বিকশিত হতে পারেনি। তারপরও কৃষক শ্রমিকের উদ্যোগে শ্রেণী চেতনা সৃষ্টির প্রয়াস থেমে থাকেনি। সেই মুক্তাগাছার মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সে সময়ের কৃষক শ্রমিকের সম্মেলনের আয়োজন রীতিমত বিস্ময়করই বটে। বাঙালি জাতি যে প্রতিবাদ প্রতিরোধে অপ্রতিরোধ্য এসব উদ্যোগ তারই সাক্ষ্য যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মুখ্যত এ সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসই পাকিস্তান আন্দোলনে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও চেতনার চালক হিসেবে এ জাতিকে প্রভাবিত করেছিল। এ ধরনের একটি সম্মেলনের সংবাদ প্রসঙ্গে লাঙল লিখেছিল–আগামী ১৪ই ও ১৫ই চৈত্র তারিখে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা নামক স্থানে কৃষক ও শ্রমিক কনফারেন্স হবে। জাতি ধর্ম্ম নির্ব্বিশেষে এ কনফারেন্সে সকলের যোগদান করা আবশ্যক। বোগার গাজী মাহমূদ সরকার অভ্যর্থনা সমিতির সেক্রেটরী মনোনীত হয়েছেন।২২

তথ্য নির্দেশ
১।বাংলাপিডিয়া-বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ।
২। লাঙল। প্রথম খন্ড। ১ লা পৌষ, ১৩৩২। বিশেষ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৪
৩। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৫
৪। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৭
৫। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১২
৬। লাঙল। প্রথম খন্ড। ৮ই পৌষ, ১৩৩২। দ্বিতীয় সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৩
৭। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৭
৮। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৯
৯। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১০
১০। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৩
১১। লাঙল। প্রথম খন্ড। ৮ই পৌষ, ১৩৩২। তৃতীয় সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ৪
১২। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৪
১৩। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৫
১৪। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ৭
১৫। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১২
১৬। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৩
১৭। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৪
১৮। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৪
১৯। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৪
২০। লাঙল। প্রথম খন্ড। ৪ঠা চৈত্র ১৩৩২। ১৮ ই মার্চ্চ ১৯২৬। দ্বাদশ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ১৪
২১। প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা: ১৫
২২। প্রাগুক্ত। ১১ ই চৈত্র ১৩৩২। ২৫ শে মার্চ্চ ১৯২৬। ত্রয়োদশ সংখ্যা। পৃষ্ঠা: ২২