সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের সাঁওতালদের ‘উচ্ছেদ, হামলা ও হত্যার’ প্রতিবাদে গাইবান্ধায় মানববন্ধনে অংশ নিতে আসা গোবিন্দগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট এলাকার সাঁওতালদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় সাংসদের লোকজনের বিরুদ্ধে।
Published : 28 Nov 2016, 10:34 PM
ওই সময় তাদের হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ করে সাঁওতালরা।
তবে বাধা উপেক্ষা করে সোমবার গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডে মুখে কালো কাপড় বেঁধে সমাবেশ ও মানববন্ধন করেন তারা।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ণ সংস্থা জন উদ্যোগ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও ছাত্র ইউনিয়ন এই কর্মসূচির আয়োজন করে।
কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া রংপুর বিভাগীয় আদিবাসী ফেডারেশনের সভাপতি নরেণ বাসকে বলেন, গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর, জয়পুরপাড়া ও পার্শ্ববর্তী দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সাঁওতালরা একত্রিত হয়ে বাসযোগে গাইবান্ধা আসছিল।
“পথে গোবিন্দগঞ্জের কাটামোড় এলাকায় এমপি আবুল কালাম আজাদের লোকজন তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি অভিমুখে পাঠিয়ে দেয় এবং এই কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়।”
পরে ওই বাধা এড়িয়ে বিকল্প পথে কিছু সংখ্যক আদিবাসী মোটরসাইকেল ও অন্যান্য যানবাহনযোগে গাইবান্ধায় এসে এই কর্মসূচিতে যোগ দেন বলে তিনি জানান।
বক্তারা সাঁওতালদের গত ২৫ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ থানায় দাখিল করা এজাহারের পরিপ্রেক্ষিতে গোবিন্দগঞ্জের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল, সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান শাকিল আহমেদ বুলবুল ও কাটাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ তাদের সহযোগিদের অতিসত্তর গ্রেফতারের দাবি জানান। এছাড়া তারা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান ও থানার ওর্সি সুব্রত কুমার সরকারকে অবিলম্বে প্রত্যাহার এবং ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।
পরে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জনউদ্যোগের সদস্য সচিব প্রবীর চক্রবর্ত্তী ঘোষণা করেন, ঘটনার এক মাস পূর্তি উপলক্ষে সারাদেশের শহীদ মিনারের আগামী ৬ ডিসেম্বর বিকাল ৫টায় সমাবেশ ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হবে।
গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার বলেন, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি।
অভিযোগ অস্বীকার করে গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় করতে এটি একটি পক্ষের ষড়যন্ত্র।
সোমবার যে গাইবান্ধায় আদিবাসীদের সমাবেশ ও মানববন্ধন আছে এটাও তিনি জানতেন না বলে দাবি করেন।
আরেকজন গ্রেপ্তার
সাঁওতালদের উপর হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাঁওতালদের পক্ষে স্বপন মুরমুর করা মামলায় সোমবার ভোরে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করেচে পুরিশ।
গ্রেপ্তার শফিউল আলম উপজেলার গুমানিগঞ্জ ইউনিয়নের কুন্দখালাসপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে। এনিয়ে মোট ২১ জনকে আটক করা হলো।
এদিকে গত শনিবার (২৬ নভেম্বর) গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিণমারী নতুন পল্লী (ইক্ষু খামারের ভিতরে) গ্রামের থোমাস হেমরমের করা এজাহার সম্পর্কে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, বিষয়টি আদালতে অবগত করে পুলিশ তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
“একই ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ায় পরের এজাহারটি তদন্ত সাপেক্ষে স্বপন মরমুর মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে।”
সাঁওতালদের সোমবার দেওয়া হল ১০৪ বস্তা ধান
ইক্ষু খামারের চাষি সাঁওতালরদের সোমবার ১০৪ বস্তা দিয়েছে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
এর আগে বৃহস্পতিবার ২৬ বস্তা, শুক্রবার ৫৬ বস্তা, শনিবার ৬৭ বস্তা ও রোববার ১৪৪ ধান তাদের দেয় মিল কতৃপক্ষ। এ পর্যন্ত প্রতি বস্তা ২ মন ওজনের মোট ৩৯৭ বস্তা ধান সাঁওতালদের দেওয়া হয়েছে বলে মিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল আওয়াল বলেন, মেশিন দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই করার পর বস্তায় ভরে সাঁওতালদের দেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৩০ একর জমির পাকা ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাকি জমির ধান পাকার পর কাটা হবে।
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওইসব জমি ইজারা দিলে তাতে ধান-পাটসহ বিভিন্ন ফসলেরর চাষ করা হয়। ফলে চিনিকলের বিরুদ্ধে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ এনে গত দুই বছর আগে সাঁওতালরা তাদের বাপ-দাদার জমি ফেরত পওয়ার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে।
চলতি বছরের ১ জুলাই সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে বসতি স্থাপন করে সাঁওতালরা এবং ওই খামারের একশ একর জমিতে ধান এবং প্রায় আটশ একর জমিতে মাস কালাই, সরিষা ও পাট চাষ করে। বাকি জমিতে ছিল মিলের ইক্ষু ক্ষেত।
গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের ওই খামারের জমিতে আখ কাটাতে গেলে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। পরে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাদেরকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। তখন ধান ছাড়া সব ফসল লুট হয়ে য়ায়। এছাড়া এসময় ৯ পুলিশ তীরবিদ্ধ হয়। নিহত হয় তিনজন সাঁওতাল। অনেক আহত হয়।
পরবর্তীতে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১১ নভেম্বর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাই কোর্ট বেঞ্চ ওই জমিতে সাঁওতালদের চাষের ধান তাদের কাটতে দিতে অথবা চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ধান কেটে সাঁওতালদের বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়।