নিলুফা বেগম থাকেন সাভারের রাজাশন এলাকার পলোয়ান পাড়ায়। স্বামী আর এক সন্তান নিয়ে তার সংসার। তার স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তান রিফাত পাটওয়ারীকে (১০) ভাল স্কুলে লেখাপড়া করিয়ে ‘মানুষের মতো মানুষ’ করবেন।
Published : 23 Apr 2016, 11:50 PM
কিন্তু রানা প্লাজার ধসে তার সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এখন ছেলে লেখাপড়া তো দূরের কথা দু বেলা দুমুঠো ঠিকমতো খেতেও পারে না তারা।
এক স্কুলে প্রথম শ্রেনিতে লেখাপড়া করছে তার সন্তান। কিন্ত গত তিন মাস যাবত স্কুলের বেতন, কোচিং ফি বাকি পড়েছে বলে জানান তিনি।
বিভিন্ন হাসপাতালে নয় মাসের বেশি চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে চাইলে তিনি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তা কাটতে দেননি।
নিলুফা জানান, সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন মেয়াদে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা ও সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্য জায়গা থেকে আরও এক লাখ ৪৫ হাজার টাকাসহ মোট ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। কিন্তু তার চিকিৎসায় খরচ করতে হয়েছে সাড়ে চার লাখ টাকা।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। পায়ের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারি না।
“এখন মনে হচ্ছে পা কেটে ফেললেই ভালো হতো।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “সরকার যে টাকা দিয়েছে তা ফিরত নিয়ে যাক, তবুও আমার পা খানা ভালো করে দিক।”
কষ্টের কথা বলতে গিয়ে নিলুফা কেঁদে ফেলেন।
“ছেলের বাবা তৌহিদুল ইসলাম রিকশা চালিয়ে যা রোজগার করে তা দিয়ে লেখাপড়া করানো, নাকি সংসার চালাব, নাকি নিজের পায়ের চিকিৎসা করাব”, বলেন নিলুফা।
আশরাফুল ইসলাম সুজন (৩২) কাজ করতেন রানা প্লাজার ষষ্ঠ তলায় ইথার টেক্স কারখানায়।
ভবন ধসের দিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সাভার সিআরপিতে চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি।
আশরাফুল ইসলাম সুজন ক্ষোভের সাথে বলেন, “সরকারিভাবে ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা পেয়েছি। প্রথমে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার পরে আবার হাসপাতালে রিকিৎসার জন্য গেলে টাকা দাবী করে।”
তবে টাকার অভাবে তিনি আর চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানান।
ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে আশরাফুল বলেন, “প্রথমে মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে গিয়ে বাম হাতের ভিতরে রড ঢুকে বেরিয়ে যায়। পরে ভবনের একটি বিম ভেঙে বাম পায়ের উপর পরে।
সে থেকেই বাম পা একেবারেই অচল, ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, হাসপাতাল থেকে বাসায় আসার পর আর কেউ খোঁজ নেয়নি।
স্ত্রী, দুই সন্তান আশামনি (১০) ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে (১৯ মাস) নিয়ে তার সংসার। থাকেন সাভার পৌর এলাকার রেডিওকলোনীর ভাটপাড়া মহল্লায়।
মেয়ে আশামনি বাড়ির পাশে ভাটপাড়া মডেল স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “এমনকি স্কুলের একটি ‘ডাইরি’ এখন পর্যন্ত কিনে দিতে পারিনি।”
বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি মুদি দোকান দিয়ে খুবই কষ্টে তাদের সংসার চলছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্বজুড়ে আলোচিত এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের একজন আফরোজা আক্তার নীলা। তার মায়ের নাম পিংকী।
কিন্তু নীলা জানায়, তার মায়ের নাম নাজমা বেগম। প্রকৃতপক্ষে নাজমা তার খালা।
জন্মের এক বছরের মাথায় মাকে হারায় নীলা। মায়ের মৃত্যুর পর খালা নাজমার কাছে বড় হচ্ছে এই শিশু। ইমান্দিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নীলা।
নাজমা জানালেন, নীলার মা পিংকী রানা প্লাজায় অষ্টম তলায় নিউ ওয়েভ বটমস কারখানায় চাকরি করতেন। ঘটনার দিন ভোর সাড়ে ৭টায় ইমান্দিপুরের বাসা থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। লাশের জন্য দিনের পর দিন ছোটাছুটি করেছেন তিনি। কিন্তু পাননি।
বর্তমানে নীলাকে নিজের মেয়ের মতোই লালন পালন করছেন তিনি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজার বহুতল ভবন ধসে এগারশোর বেশি মানুষ নিহত হয়। আহত হয় অসংখ্য পোশাক কারখানার কর্মী।