আমি ও আমার গার্লফ্রেন্ডরা

জার্মানিতে আমার অ্যাপার্টমেন্টটা যে জায়গায় তার নাম স্টাইনভেগ। জায়গাটার নাম কিছুতেই মনে রাখতে পারছিলাম না। ডয়চে ভেলে'র সিনিয়র এডিটর সঞ্জীব বর্মনদা বললেন- আইনস্টাইন এর কথা মনে করলেই জায়গাটার নাম মনে থাকবে।

অমৃতা পারভেজ, জার্মানির বন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Dec 2016, 09:22 AM
Updated : 3 Dec 2016, 10:07 AM

এরপর থেকে সত্যিই আর ভুল হয়নি। স্টাইনভেগে দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। ওই অ্যাপার্টমেন্টটা আসলে শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই জেসিকা আমার জন্য বাসা দেখা শুরু করেছে। স্টাইনভেগে সৌন্দর্যের কোন ঘাটতি ছিল না।

অফিস থেকে ফিরে অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে দেখতে পেতাম সূর্যমুখির ক্ষেত, যবের ক্ষেত, ফুলকপি, গাজর সব আছে।

হাঁটতে হাঁটতে একদিন অনেকটা দূরে গিয়ে দেখি একটা খামার বাড়ির মত, যেখানে ঘোড়া বাঁধা আছে। আছে সারি সারি আপেল, পিচ, আলুবোখারার গাছ। দেখে ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। একটা বেঞ্চে বসে প্রকৃতির অপূর্ব এই সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।

তারপর আবার হাঁটতে হাঁটতে রেল লাইন পর্যন্ত পৌঁছে যেতাম, নিজেকে পথের পাঁচালীর অপুর মত মনে হত।

কিন্তু বাসায় ফিরলেই সেই ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। আমি ২০১৩ সালেও স্মার্টফোন ব্যবহার করতাম না। ওয়াই ফাই থাকলেও তা ল্যাপটপে কানেক্ট করিনি। মা জার্মানির সঙ্গে সময়ের ব্যবধানটা মনে রাখতে পারে না। তাই প্রায়ই ভোর রাতে তার ফোনে আমার ঘুম ভাঙে।

অথবা দিনে একবার বর-এর ফোন৷ এছাড়া পুরোটা সময় নিস্তব্ধতা। এখানে কোন ঝিঁঝি পোকার ডাক নেই। নেই গাড়ির হর্ন বা মানুষের কথার আওয়াজ। এই নিস্তব্ধতা যে কত ভয়াবহ তা ক্রিসমাসের সময় টের পায় জার্মানরা। এসময় অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে। কিন্তু আমাকে সেই ভয়াবহ পথে যাওয়া থেকে রক্ষা করলো দুটি মেয়ে।

আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাস থেকে নেমে অফিসের পথে হাঁটছি। দেখি একটা মেয়ে ছাতা ছাড়া জোরে জোরে হাঁটছে। আমি তাকে বললাম তুমি আমার সঙ্গে ছাতা শেয়ার করতে পারো।

সে মিষ্টি হাসলো, তার সেই হাসিতে মোহিত হলাম। ভীষণ সুন্দর দেখতে মেয়েটি, ভারতের কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে এসেছে। যদিও সে নিজেকে ভারতীয় বলার চেয়ে কাশ্মীরি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার নাম ইসরা। সে জানালো আরও একটি মেয়ে এসেছে 'উইমেন টক অনলাইন' বলে ডয়চে ভেলের একটি ওয়েবসাইট আছে, সেটাতে কাজ করার জন্য৷ দুই মাস তারা জার্মানিতে থাকবে।

সেদিন অফিস শেষে মেয়েটি আমার কাছে এসে বললো- মার্কেটে যাবে?

আমি কেনাকাটা করতে খুব একটা পছন্দ করি না বলে সেন্টারে খুব একটা যাওয়া হয় না। তাও রাজি হয়ে গেলাম। কথা বলার মানুষ তো পাওয়া গেল! এই আমাদের বন্ধুত্বের শুরু যা আজও অটুট আছে। এই বন্ধুত্বের জেরে আমি এ বছর কাশ্মীরে ওদের বাড়িতেও ঘুরে এসেছি।

ইসরার সঙ্গে পরিচয়ের দু'দিন পরই ওদের অ্যাপার্টমেন্টে আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। ওদের দুই রুমের অ্যাপার্টমেন্টটি ভীষণ সুন্দর। পেছনে একটা বাগান আছে। আর মজার ব্যাপার হলো, ওই সপ্তাহে আমাকে নিয়ে জেসিকা যখন বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলো, তখন আমার যে বাড়িটা পছন্দ হল, সেটা ওদের ওখান থেকে বেশ কাছে।

বাড়ি দেখতে যাওয়াটাও মজার৷ জেসিকা তিনটা বাড়ি আমার জন্য পছন্দ করেছে৷ প্রথম বাড়িটা দেখাতে নিয়ে গেলো ওবারকাসেলে৷ এক ৮০ বছরের বুড়ো এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে কুশল বিনিময় করলো, যা আমাকে কিছুটা হলেও বিস্মিত করলো৷ কেননা এখানকার তরুণরা ইংরেজিতে কথা বললেও বৃদ্ধদের কাছে এ একেবারে অপ্রত্যাশিত৷

তিনি আমাকে তিনটা ঘর দেখালেন, মানে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট৷ প্রথম দুটো দেখেই মুষড়ে পড়লাম, কারণ একদম আলো বাতাস কম৷ আমার ঘর ছোট হলেও চলবে কিন্তু আলো বাতাস চাই৷ তিন নম্বর ঘরটা পছন্দ হলো৷ দোতলা, একেবারে রাস্তার ধারে৷ খুবই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট ১৮ বর্গমিটার৷ দুটো বড় জানলা৷ তাই দেখেই শান্তি৷

জেসিকা বললো, "চলো অন্য বাসা দুটো দেখি৷"

আমি বললাম, "আর কোথাও যাব না৷ এটাই ফাইনাল৷"

বুড়োকে বললাম- পরে জানাচ্ছি৷

পরের দিন অফিসে এসে সঞ্জীবদা’র সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হলো, লোকেশন, ট্রাম, প্রকৃতি এবং ভাড়া৷ সব মিলিয়ে এটাই চূড়ান্ত করা হলো৷

ট্রাম লাইনটা বাড়ির একদম পেছনে৷ বাসা থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে রাইন নদী, পার্ক, উল্টো দিকে পাহাড়-জঙ্গল৷ অফিস ৫ টা স্টপ পরে, অর্থাৎ ৯ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায়৷ দাদার বাসাটাও কাছে৷ সঞ্জীবদা নিজে বাড়ির মালিকের সঙ্গে দিন ঠিক করে ফেললেন আমরা কবে বাড়িতে উঠবো৷

এর মধ্যে আমার দুই বান্ধবীর বেশ আনন্দ৷ কারণ আমার নতুন বাসা থেকে হেঁটেই তাদের ওখানে যাওয়া যায়৷ তাদের পাড়ার নাম রামাসডর্ফ অর্থাৎ রামের গ্রাম৷ আর আমার নতুন পাড়া সেই ওবার কাসেল-এ এখনও আমি আছি৷ ওবার কাসেলের গল্প শোনাবো পরের পর্বে৷   

লেখক: এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ

ইমেইল: amrita.modak81@gmail.com