গাধার শিল্পী হওয়ার শহরে

ব্রেমেনে একটা জনপ্রিয় লোককাহিনী আছে। মালিকের অত্যাচারে খামার থেকে পালিয়ে যাওয়া গাধা, কুকুর, বেড়াল আর মুরগির কাহিনী। তারা ব্রেমেনের দিকে যাত্রা করেছিল বড় শিল্পী হবার আশায়।

অমৃতা পারভেজ, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2016, 12:07 PM
Updated : 13 Nov 2016, 08:40 AM

যাহোক, গল্পের চরিত্রগুলোকে ব্রেমেন অবধি আর যেতে হয়নি। পথিমধ্যে এক কুঁড়েঘরে আস্তানা গেড়ে বসা ডাকাতদের বুদ্ধি করে তাড়িয়ে ওরা সেখানেই থেকে যায় আর প্রাণ খুলে গান গায় বাকি জীবন।

জনপ্রিয় এই গল্পের ভাস্কর্যের দেখা মিলবে জার্মানির ব্রেমেন শহরে এলে। ভাস্কর্যটির নাম ‘টাউন মিউজিশিয়ানিস অফ ব্রেমেন’।

ব্রেমেন শহরটা বন এর চেয়ে বেশ বড়। আছে সমুদ্র বন্দর, সিটি সেন্টারটাও বেশ সুন্দর।

ব্রেমেনে যাওয়ার দ্বিতীয় দিন রোববার ছিল বন্ধু দিবস। আটু আমাকে নিয়ে ব্রেমেন শহর ঘুরে দেখাচ্ছিল।

আমার বন্ধু আটু কখনো জ্ঞান দিতে ভোলে না। আমি জার্মানিতে নতুন। তাই এক্ষেত্রেও সে জ্ঞান দেয়া থেকে বিরত থাকলো না। জার্মানিতে কোন দোকানে শাক-সবজি, খাবার দাবার ভালো এবং সস্তা, কোন ব্র্যান্ড কেনা উচিত, বছরের কখন কখন কোন জিনিসটা কিনলে কম টাকায় কেনা যায়- সব জানালো সে।

‘টাউন মিউজিশিয়ানিস অফ ব্রেমেন’ ভাস্কর্য

জার্মানিতে সব শহরেই রেভে (আরইডব্লিউই), ডিএম, আলদি- এই তিনটি চেইন শপ দেখা যায়। এদের পণ্য ভালো এবং তুলনামূলক সস্তা।

আমরা শহর ঘুরে, ‘নর্থ সি পোর্ট’ বা উত্তর সমুদ্র বন্দরের কাছে কিছুক্ষণ বসে আটুর বাসার দিকে রওনা দিলাম। বাস থেকে নেমে দেখি কয়েকটি বাসার সামনে নানা ধরনের আসবাব রাখা। পুরনো টেলিভিশন, ম্যাটট্রেস, টেবিল, চেয়ার কী নেই! উইন্ডো শপিং করার মত আমরা একটু সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম।

আটু জানালো, বছরের বিশেষ একটা সময়ে প্রত্যেকটি বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, তাদের ফেলে দেয়ার মত আসবাব থাকলে যেন বাড়ির সামনে একটা নির্দিষ্ট দিনে রেখে দেয়। অনেকের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে নিয়ে যেতে পারে। যেগুলো পড়ে থাকে রাতে গাড়ি এসে সেগুলো উঠিয়ে নিয়ে যায়।

পরদিন সকালে আমার অফিস। ট্রেনের টিকেট কাটার কথা বলতেই আটু জানালো, ও আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে গাড়িতে।

জার্মান ভাষায় ওই গাড়িকে সংক্ষেপে বলে ‘মিট ফার’। অর্থাৎ একজন ব্রেমেন থেকে বনে যাচ্ছে একা। আমি তাকে ২০ ইউরো দিলে সে আমাকে একেবারে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দিবে।

ব্রেমেন সেন্টারের সামনে লেখক

আমি তো অবাক ! চিনি না, জানি না, একটা গাড়িতে উঠে বসবো ? তাও আবার ভোর সাড়ে ৪টায় !

আটু জানালো, এটা এখানে খুবই সাধারণ ব্যাপার। অনেকে কাজের জন্য বা ঘোরাঘুরির জন্যও এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগায়।

ভোর চারটায় ট্রামে চেপে ব্রেমেন সেন্টারে পৌঁছে ভাবছি কীভাবে আটু চিনবে কোন গাড়ি ?

ওখানে পৌঁছাতেই ওর মোবাইলে কল এলো। আটু হাত দেখাতেই দেখলাম একটা কালো গাড়ি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়ি থেকে বেশ মোটা হাসিখুশি এক নারী নেমে এলেন। আটুকে বিদায় জানিয়ে চড়ে বসলাম গাড়িতে।

শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের জন্যই এরা যাত্রী নেয়, এমনটা না। আসলে তারা চায় এই দীর্ঘ পথে কথা বলার মত একজন সঙ্গী পেতে। তাই কথা শুরু হলো। সে ইংরেজি মোটামুটি জানে।

যথারীতি জিজ্ঞেস করলো, জার্মানিতে কেন আসা, কোন দেশ থেকে এসেছি ? পথে দুইবার তেল নেয়া ও টয়লেটে যাওয়ার জন্য গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছিল। দু’বারই সে আমার জন্য কফি এবং স্ন্যাক্স নিয়ে এলো। আমি ভাবলাম নামার সময় টাকা দিয়ে দেব।

ধীরে ধীরে দিনের আলো ফুটে উঠলো। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজের সমারোহ।

জার্মানিতে গাড়ি চালানোর গতির কোন সীমা বেঁধে দেয়া নেই। তাই প্রায় উড়ে চলছিলো আমাদের গাড়ি।

ব্রেমেন সিটি সেন্টার

ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। না পেরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একটু গান ছাড়ি। বাংলা গানে তোমার অসুবিধা নেই তো ?

সে বললো, না তোমাদের দেশের গান কেমন শোনাও।

গান ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম, দেখলাম কোন ভাবান্তর নেই। খালি একবার বললো, ‘ভালো’।

সকাল সাড়ে আটটায় ঠিক অফিসের সামনে গিয়ে গাড়ি থামলো।

আমি তাকে দশ ইউরো বের করে বললাম, তুমি আমাকে কফি খাইয়েছো, টাকাটা রাখো।

সে বললো, রেখে দাও। তুমি আমার সঙ্গে এতোটা পথে এসেছো, তাতেই আমি খুশি।

সে জানালো, এক সপ্তাহের মধ্যে আবার সে ব্রেমেন যাবে। যদি আমি যেতে চাই, তাকে ফোন দিলেই সে নিয়ে যাবে।

জার্মানরা আসলে যতটা শুনেছিলাম তার চেয়ে ভাল।

(চলবে)

লেখক: অমৃতা পারভেজ, এডিটর অ্যান্ড মডারেটর, ডয়েচে ভেলে, বাংলা বিভাগ, amrita.modak81@gmail.com