বনানী কবরস্থানে শেষ ঘুমে রাজ্জাক

ঢাকার বনানী কবরস্থানে শায়িত হলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2017, 04:53 AM
Updated : 23 August 2017, 09:54 AM

মেজ ছেলে বাপ্পী কানাডা থেকে বুধবার ভোরে ঢাকায় ফেরার পর সকাল সোয়া ১০টার দিকে রাজ্জাকের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে।

পাঁচ দশকের বেশি সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন শাসন করে যাওয়া এই অভিনেতাকে যখন ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে কবরে শোয়ানো হয়, তিন ছেলে রেজাউল করিম বাপ্পারাজ, রওশন হোসাইন বাপ্পী ও খালিদ হোসাইন সম্রাট, আত্মীয়-বন্ধু আর চলচ্চিত্র অঙ্গনের কলা-কুশলীরা উপস্থিত ছিলেন সেখানে।  

পাঁচশর বেশি চলচ্চিত্রের অভিনেতা আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের মানুষের কাছে খ্যাত ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক নামে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সাদা কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন যুগ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন তিনি।

বেশ কিছুদিন ধরে নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন ৭৫ বছর বয়সী রাজ্জাক। সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে তার মৃত্যু হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া।

মঙ্গলবার সকালে রাজ্জাকের কফিন নেওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখানে জানাজার পর দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষ কিংবদন্তী এই অভিনেতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায়। 

মঙ্গলবার বিকালে গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজার পর রাজ্জাককে দাফন করার কথা থাকলেও কানাডাপ্রবাসী মেজ ছেলে রওশন হোসাইন বাপ্পীর ফেরার অপেক্ষায় সেই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়। বুধবার ভোর ৪টায় ঢাকায় পৌঁছানোর পর শেষবার বাবাকে দেখার সুযোগ হয় বাপ্পীর।

তিনি জানান, শুক্রবার বিকাল ৫টায় পরিবারের পক্ষ থেকে গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে দোয়া-মাহফিল হবে। শনিবার সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী আলোচনা সভা ও কাঙালিভোজের আয়োজন করা হবে এফডিসিতে।

 

বুধবার সকালে বৃষ্টির মধ্যেই বনানী কবরস্থানে রাজ্জাকের মরদেহ নিয়ে আসেন তার তিন ছেলে। তাদের সঙ্গে আসেন চিত্রনায়ক উজ্জ্বল, শাকিব খান, ফেরদৌস, চলচ্চিত্র পরিচালক ওয়াকিল আহমেদ ও প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু।

দাফন শেষে রাজ্জাকের ছোট ছেলে সম্রাট বলেন, “আমার বাবা আমার হাতেই মারা গেছেন। তিনি বড় শান্তিতেই চলে গেছেন।”

পরে সমবেতদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমার বাবা জানা অজানায় যদি কারও মনে কোনো কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাহলে তাকে ক্ষমা করবেন। সকলে দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তার কবরের আজাব ক্ষমা করে দেন।”

বাপ্পী বলেন, “বাবাকে নিয়ে আমাদের গর্ব হয়। তার মৃত্যুতে সারা দেশের মানুষ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, আমরা গোটা পরিবার বড় কৃতজ্ঞ।” 

চলচ্চিত্র পরিবারের পক্ষে অভিনেতা শাকিব খান বলেন, “অভিনেতা রাজ্জাক ছিলেন গোটা বাঙালির সম্পদ। তার মৃত্যুতে এ দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে যে ক্ষতি হল, তা অপূরণীয়। তার মৃত্যুর পর যত নায়ক বা সুপারস্টার আসবেন, তার সবাই তার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাবেন।”

বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করেই প্রিয় ‘নায়করাজ’-এর কবরে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউবা শ্রমজীবী মানুষ।

হবিগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী টুটুল দাশ, গাজীপুরের কালীগঞ্জের হাফেজ ফরহাদ হোসেন, স্কুলছাত্র মঈন ও জসিম, বংশালের ব্যবসায়ী হাজী মো. হোসেনকে কবরের পাশে বসে চোখ মুছতে দেখা যায়।

বনানীর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন লাকী বলেন, “মনে হইতাসে আজকে জিন্দেগিরে কবর দিয়া থুইয়া গেলাম। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারতাসি না, তিনি তো আর কোনো দিন আসবেন না।”

‘রাজ্জাক-ভক্ত’ ষাটোর্ধ্ব এম এম সাহেদ মাহমুদ বলেন, “রাজ্জাক চলে গেলেও বাংলার মানুষ তাকে বাঁচিয়ে রাখবে তাদের মনে। রাজ্জাকের মৃত্যু নাই।”

বংশালের বাসিন্দা হাজী মোহাম্মদ হোসেন স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাজ্জাক অভিনীত সিনেমা দেখতে গুলিস্তানের শাবিস্তান ও ইসলামপুরের লায়ন সিনেমা হলে ছুটে যাওয়ার কথা স্মরণ করেন।

“এফডিসিতে গিয়ে একবার দেখা করেছিলাম। সেই দিনের কথা তো কোনোদিন ভুলতে পারব না। কত খাতির করেছিলেন তিনি।”

মাদ্রাসাশিক্ষক এম এম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “তিনিই আমাদের মহানায়ক। তার মত অভিনয় শৈলী নিয়ে আর কোনো নায়ক আসবেন কি না জানা নেই। ঢাকাই চলচ্চিত্রে তিনি অদ্বিতীয়।”

অভিনেতা  রাজ্জাকের রাজলক্ষ্মী প্রডাকশনে চাকরিরত মিজানুর রহমান বিমর্ষ কণ্ঠে বলেন, “হাসিমাখা মুখটি আর কোনোদিন দেখতে পাব না।”

অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাকের জন্ম। টালিগঞ্জের খানপুর হাইস্কুলে পড়ার সময় নাটকের মধ্যে দিয়ে অভিনয় শুরু। কলেজে পড়ার সময় ‘রতন লাল বাঙালি’ নামে একটি সিনেমার অভিনয় করেন তিনি।

অভিনেতা হওয়ার মানসে ১৯৬১ সালে কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমালেও সেখানে সফল না হওয়ায় টালিগঞ্জে ফেরেন রাজ্জাক। কিন্তু কলকাতায়ও পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় চলে আসেন।

১৯৬৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলে সেখানে অভিনয়ের সুযোগ নেন রাজ্জাক। তখন ধারাবাহিক নাটক ‘ঘরোয়া’য় অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্রে অভিনয় করা। আবদুল জব্বার খানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান তিনি তবে নায়ক হিসেবে নয়। সহকারী পরিচালক হিসেবে।

সেই সময়ের সংগ্রামের কথা রাজ্জাক নিজেই বলে গেছেন এভাবে- “আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি, না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি।”

সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মধ্যেই ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগার লেন’ চলচ্চিত্রে ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরপর ‘ডাকবাবু’, উর্দু ছবি ‘আখেরি স্টেশন’সহ কয়েকটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।

এক সময় জহির রায়হানের নজরে পড়েন রাজ্জাক। তিনি ‘বেহুলা’য় লখিন্দরের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ দিলেন রাজ্জাককে, সুচন্দার বিপরীতে। ‘বেহুলা’ ব্যবসাসফল হওয়ায় আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি রাজ্জাককে।

সুদর্শন রাজ্জাক সুচন্দার পর শবনম, কবরী, ববিতা, শাবানাসহ তখনকার প্রায় সব অভিনেত্রীকে নিয়ে একের পর এক ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র দেন ঢালিউডকে। এর মধ্যে রাজ্জাক-কবরী জুটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয়।

সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজ্জাক-কবরী জুটির শুরু। এরপর একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন তারা। ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘ঢেউ এর পরে ঢেউ’ এবং স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’, ‘বেঈমান’সহ বেশ কিছু চলচ্চিত্র উপহার দেন এই জুটি।

রাজ্জাকের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আনোয়ারা’, ‘সুয়োরাণী-দুয়োরাণী’, ‘দুই ভাই’, ‘মনের মতো বউ’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘ময়নামতি’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বেঈমান’।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ‘রংবাজ’ দিয়ে বাংলাদেশে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের সূচনা ঘটান রাজ্জাক। এরপর ‘পিচ ঢালা পথ’, ‘স্বরলিপি’, ‘কি যে করি’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বাঁদী থেকে বেগম’, ‘আনার কলি’, ‘বাজিমাত’, ‘লাইলি মজনু’, ‘নাতবউ’, ‘মধুমিলন’, ‘অবুঝ মন’, ‘সাধু শয়তান’, ‘পাগলা রাজা’, ‘মাটির ঘর’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘কালো গোলাপ’, ‘নাজমা’সহ অসংখ্য ব্যবসা সফল চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে রাজ্জাককে পর্দায় দেখেছে দর্শক।

তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র কার্তুজ, পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র আয়না কাহিনী।

অভিনয়ের জন্য রাজ্জাক পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় তাকে। ২০১৫ সালে তিনি পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার।

বদনাম, সৎ ভাই, চাপা ডাঙ্গার বউসহ প্রায় ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রাজ্জাক। তার মালিকানার রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন থেকে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।

অভিনয় জীবনের বাইরে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবেও কাজ করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক।