কিংবদন্তি বাঙালি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে নিন্দুকদের অনেক বড় অভিযোগ- সমকালীন রাজনীতি সবসময়ই অনুপস্থিত ছিল তার সিনেমায়। এবারে তার ‘তিন কন্যা’ দিয়ে অভিনয়ে কেরিয়ার শুরু করা অপর্ণা সেন।
Published : 02 May 2017, 08:22 PM
সত্যজিৎ রায়-এর কর্ম সংরক্ষণ সংঘের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই খ্যাতনামা অভিনেত্রী ও নির্মাতা আরও জানান, ১৯৬৬ সালের পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে শহরজুড়ে যে নীরব প্রতিবাদ হয়েছিল, সত্যজিৎ রায় ছিলেন তার সর্বাগ্রে।
“সত্যজিৎ-এর অনেক সমালোচকই তাকে শহুরে নীচুতলার মানুষদের প্রতি উদাসীন এবং অরাজনৈতিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সত্যজিৎ অরাজনৈতিক ছিলেন না একেবারেই। কোনো মানুষই তা নয়। তার রাজনীতি কেবল প্রতিনিয়তই যেসব রাজনৈতিক দল একে অন্যের গলা চেপে ধরে, তাদেরকে ঘিরে ছিল না,” বলেন অপর্ণা।
অপর্ণা জানান, ১৯৫৮ সালে খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যের প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভিক্ষ দূরীকরণ কমিটি, কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্য বাম দলগুলোর আন্দোলনকে সমর্থন করতেন সত্যজিৎ, যার ছাপ তার সিনেমাগুলোতেও দেখা যায়।
তিনি বলেন,“ ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর ‘ওরে বাবা দেখ চেয়ে’ গানের পটভূমিতে ক্ষুধার্ত সৈন্যদের মিছিলের পর ‘অশনি সংকেত’-এ দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামের মানুষদের শহরের দিকে যাত্রাটা কিন্তু আরও বড় হয়েছিল।”
অপর্ণা’র বক্তব্যে ১৯৭১ সালের সিনেমা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র কথাও উঠে আসে। অপর্ণা মনে করেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের সেই উত্তাল সময়টাকে ফ্রেমবন্দী করাতে সত্যজিৎ-এর সেটাই ছিল ‘সত্যিকারের প্রয়াস’।
তিনি বলেন,“সমস্যটা হলো, সিদ্ধার্থ (সিনেমার মূল চরিত্র, যার ছোটভাই একজন নকশালপন্থী) সত্যজিৎ-এর মতোই প্রশাসনের প্রতি বিতৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও এর সম্ভাব্য সমাধানগুলোর উল্টোপিঠও দেখতে পেতো। সিদ্ধার্থের মতোই সত্যজিৎ নিজেও জানতেন না, সমাধানটা আসলে কী; এরপরও ওইসময়কার যুবসমাজের প্রতি ছিল তার গভীর সহানুভূতি, যাদের আসলে যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।”
অপর্ণা আরও বলেন, কেরিয়ার জুড়েই নানান সিনেমার মাধ্যমে সত্যজিৎ মৃত্যুকে এক অনন্য উপায়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার দর্শকদের সঙ্গে।
“সত্যজিৎকে সিনেমায় মৃত্যুদৃশ্যের গুরু বলা যেতে পারে। তা সে ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দির ঠাকরুন আর দুর্গাই হোক, ‘অপরাজিত’তে হরিহর আর সর্বজয়াই হোক কিংবা হোক ‘জলসাঘর’-এ বিশ্বম্ভর রায়-এর মৃত্যু- সবগুলোই এব্যাপারে সত্যজিৎ-এর মুন্সিয়ানার সাক্ষর বহন করে,” তিনি বলেন।
সত্যজিৎ-এর ‘অপু ত্রয়ী’র শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’-এর শেষে অপুর স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যুদৃশ্য না দেখানোর প্রসঙ্গও এখানে টেনে আনেন ‘পারমিতার একদিন’ খ্যাত এই নির্মাতা।
তিনি বলেন, “অপর্ণার মৃত্যু ছিল এতটাই অচিন্ত্যনীয় যে এটা আসলে দেখানো যায় না; কল্পনা করে নিতে হয়। অপু যা হারিয়েছে, তা কোনো নির্মাতাই পারবেন না নির্মাণ করতে, কোনো অভিনেতা পারবেন না অভিনয় করে দেখাতে, কোনো চিত্রগ্রাহকও পারবেন না দৃশ্যটি ধারণ করতে।”
“আমার মনে হয়, এটা আঁচ করতে পেরেই সত্যজিৎ অপর্ণার মৃত্যুশয্যা দর্শকদের দেখানো থেকে বিরত ছিলেন।”
সবশেষে অপর্ণা বলে দেন বাংলা সিনেমার অমোঘ সত্যিটি।
“আমাদের, অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের নির্মাতাদের সত্যজিৎ-এর কাছ থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। তাকে আমরা উত্তরাধিকারে পেয়েছি, তিনি যেমন পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।”