‘শোলে’ ছবির একটি দৃশ্যে হেমা মালিনীকে জড়িয়ে ধরার কথা ছিল ধর্মেন্দ্রর। সে দৃশ্যটি যেন বারে বারে ধারণ করতে হয় সেজন্য লাইটবয়কে ঘুষ দিয়েছিলেন ধর্মেন্দ্র। লাইটের গণ্ডগোলে বার বার শট খারাপ হচ্ছিল আর মনে মনে হাসছিলেন তিনি। বলিউডের ড্রিম গার্ল হেমা আর হি ম্যান ধর্মেন্দ্রর প্রেমকাহিনী ছিল এমনই চমকপ্রদ।
Published : 16 Oct 2015, 10:58 AM
বিয়ে করার জন্য হেমা মালিনী ও ধর্মেন্দ্র দুজনকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। কারণ ধর্মেন্দ্র ছিলেন বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। ভারতের হিন্দু বিবাহ আইনে এক পুরুষের একাধিক স্ত্রী গ্রহণ নিষিদ্ধ। তাই বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হন তারা। নিকাহ নামায় তাদের নাম হয় দিলওয়ার খান কেওয়াল কৃষন এবং আয়শা বি আর চক্রবর্তী। তারা বিয়ে করেন ১৯৭৯ সালের ২১ আগস্ট।
দক্ষিণ ভারতের মেয়ে হেমা মালিনী আর উত্তর ভারতের ধর্মেন্দ্রর রোমান্স হিন্দি চলচ্চিত্র পাড়ার অন্যতম আলোচিত প্রেমকাহিনী। হেমার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৬ অক্টোবর তামিলনাড়ুর আয়াংগার পরিবারে। পুরো নাম হেমা মালিনী চক্রবর্তী। ১৯৬১ সালে তামিল ছবি ‘ইধু সাথিয়াম’-এ ছোট একটি ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। ১৯৬৮ সালে ‘স্বপ্ন কা সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে রূপালি পর্দায় অভিষেক হয় তার। ছবিতে তিনি ছিলেন রাজ কাপুরের বিপরীতে। অসামান্য সুন্দরী হেমা প্রথম ছবিতেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। বাঘা বাঘা পরিচালক ও প্রতিষ্ঠিত নায়করা তার সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। দেবানন্দ তো এই সুন্দরী নায়িকার বিপরীতে অভিনয় করার জন্য নতুন ছবির কাজে হাত দেন। ১৯৭০ সালে মুক্তি পায় দেবানন্দের বিপরীতে হেমা অভিনীত ‘জনি মেরা নাম’। সুপার ডুপার হিট হয় ছবিটি। ১৯৭০ সালেই প্রথম ধর্মেন্দ্রর বিপরীতে ‘শারাফাত’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়েন ধর্মেন্দ্র।
হেমা ছিলেন ধর্মেন্দ্রর চেয়ে ১৩ বছরের ছোট। ধর্মেন্দ্রর বয়স তখন ৩৫ বছর। তিনি মুম্বাইয়ে মারদাঙ্গা ছবির নায়ক হিসেবে খ্যাত। বলিউডের ‘হি-ম্যান’ ডাকা হতো তাকে। ধর্মেন্দ্র বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সে পারিবারিক চাপে। তার স্ত্রী প্রকাশ কাউর থাকতেন পাঞ্জাবে। তাদের দুই ছেলে সানি ও ববি দেওল এখন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা, এছাড়া তাদের দুটি মেয়েও রয়েছে।
মুম্বাইয়ে আসার পর সুদর্শন ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে প্রেম জমে ওঠে সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত নায়িকা ও কবি মীনা কুমারীর। তবে ৬৯-৭০ সালের দিকে মীনা কুমারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় ও পরে ইতি ঘটে। ‘শারাফাত’ ছবির কাজ চলার সময় ধর্মেন্দ্র নানাভাবে হেমার প্রতি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু হেমা এই বিবাহিত মানুষটিকে তেমন পাত্তা দেননি। এদিকে সে সময়ের অন্য দুই উঠতি নায়ক জিতেন্দ্র ও সঞ্জীব কুমারও তার প্রেমে পড়েন। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সীতা আউর গীতা’ ছবিতে সঞ্জীব ও ধর্মেন্দ্র দুজনের বিপরীতেই নায়িকা ছিলেন হেমা। সে সময় নিভৃতচারী ও গম্ভীর প্রকৃতির সঞ্জীবের বিপরীতে বলশালী ও হাসি খুশি ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে ওঠে তার। তবে তখনও তিনি তার সঙ্গে প্রেমে পড়াকে এড়িয়ে চলেছেন।
হেমা মালিনীর ক্যারিয়ার তখন তরতর করে এগিয়ে চলেছে। বলিউডের স্বপ্নকন্যা হয়ে উঠেছেন তিনি। একের পর এক মুক্তি পাচ্ছে তার অভিনীত ছবি। বাণিজ্যিক সফলতাও পাচ্ছে। ‘নয়া জমানা’, ‘আন্দাজ’, ‘গোরা আউর কালা’, ‘শরীফ বদমাস’, ‘ছুপা রুস্তম’, ‘জুগনু’, ‘জোশিলা’, ‘গেহরি চাল’, ‘আমির গরীব’সহ অধিকাংশ ছবিই বাণিজ্যিক সফলতা পেয়েছে। রাজেন্দ্র কুমার, রাজেশ খান্না, রাজ কুমারের মতো নায়কদের বিপরীতে কাজ করছেন। অন্যদিকে ‘লাল পাত্থর’ ছবিতে তার অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে সমালোচকদেরও। সুপার হিট ‘জুগনু’সহ বিভিন্ন ছবিতে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গে তার জুটিও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ধর্মেন্দ্র-হেমা জুটি জনপ্রিয়তা পাওয়ায় দুজনের মধ্যে সৃষ্টি হয় বন্ধুত্ব।
এরই মধ্যে শুরু হয় ‘শোলে’ ছবির কাজ। এ ছবিতে ধর্মেন্দ্র ইচ্ছা করেই পরিচালকের কাছ থেকে ভিরুর ভূমিকা চেয়ে নেন যাতে বাসন্তীর সঙ্গে প্রেমের দৃশ্যে অভিনয়ের সময় হেমার মন জয় করা যায়।
‘শোলে’র কাজ চলার সময় হেমা ধর্মেন্দ্রর প্রেমে সাড়া দেন। সে সময় থেকেই তাদের রোমান্স চলতে থাকে। ১৯৭৬ সালে ‘শোলে’ মুক্তি পাওয়ার পর বাসন্তীরূপী হেমা দর্শকদের হৃদয়ে ঝড় তোলেন। বলিউডের শীর্ষ নায়িকার আসন দখল করেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় ‘ড্রিম গার্ল’। সত্যিকারভাবেই হিন্দি ছবির ড্রিম গার্ল হয়ে ওঠেন হেমা মালিনী।
১৯৭৯ সালে গাঁটছড়া বাঁধেন এই জুটি। এই বিয়েতে হেমার পরিবারের সদস্যরা রাজি ছিলেন না। কারণটা খুবই স্বাভাবিক। বিবাহিত পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে হেমার বাবা-মা ছিলেন ভীষণ গররাজি। এদিকে ধর্মেন্দ্রও তার দুই সন্তানের মাকে তালাক দিতে রাজি হননি। কারণ তাহলে গোড়া পাঞ্জাবী পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার হুমকি দিয়েছিল। যাই হোক, সব প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা সংসার শুরু করেন।
বিয়ের পরও অবশ্য হেমা মালিনীর ক্যারিয়ারে ভাটা পড়েনি। তিনি নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করে চলেন। ‘রাজিয়া সুলতান’, ‘ত্রিশূল’, ‘মেহবুবা’, ‘দেশপ্রেমী’, ‘আন্ধা কানুন’, ‘নসীব’-এর মতো বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবিতে নায়িকার ভূমিকাতে অভিনয় করেন। রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চনের মতো সেরা নায়কের বিপরীতে হেমা মালিনী তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখেন। ‘মীরা’ ছবিতে মীরা বাইয়ের ভূমিকায় তার অভিনয় প্রশংসা কুড়ায়। ‘মেহবুবা’ ছবিতেও তিনি প্রশংসিত হন। ছবিটি দারুণ বাণিজ্যিক সফলতাও পায়। পরবর্তীতে তিনি চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় চালিয়ে যান। ‘লেকিন’, ‘জামাই রাজা’ ইত্যাদি ছবিতে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে সফল হন তিনি। অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে ‘বাগবান’, ছবিতেও তিনি দারুণ প্রশংসিত হন। ২০০০ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মাননা পেয়েছেন।
হেমা শুধু সুন্দরী সুঅভিনেত্রী নন, তার নৃত্যকুশলতারও দারুণ খ্যাতি রয়েছে। তিনি ভরতনাট্যম ও উড়িষ্যা নৃত্যের একজন শীর্ষ স্থানীয় শিল্পী। সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত রয়েছেন।
ধর্মেন্দ্র-হেমা দম্পতির দুই কন্যা এশা ও অহনা দেওল। ধর্মেন্দ্র ও হেমা মালিনী সুখী দম্পতি হিসেবে বলিউডে পরিচিত। বিভিন্ন ফিল্মি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে হেমা মালিনী বলেছেন, ধর্মেন্দ্র এখনও তার চোখে বীরপুরুষ। আর ধর্মেন্দ্র মনে করেন হেমা মালিনী এখনও তার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী।