সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বৃদ্ধিই এখন সরকারের কাঁটা

সঞ্চয়পত্র বিক্রির উল্লম্ফনে ঋণের ভার বেড়ে যাওয়ায় বেশি সুদ গুনতে হবে বলে তা নিয়ে এখন চিন্তায় পড়েছে সরকার।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 April 2015, 12:57 PM
Updated : 2 April 2015, 03:48 PM

এতে বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে বলে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বললেও এখনই সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই সরকারের; যদিও বিষয়টি নিয়ে বিচলিত খোদ অর্থমন্ত্রী।

ব্যাংকের আমানতের তুলনায় সুদ বেশি দেওয়া এবং পুঁজিবাজারে পড়তি ভাবে অনেকেই ঝুঁকে পড়েন নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে। সম্প্রতি ব্যাংকের সুদহার আরও কমে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির পালেও হাওয়া লাগে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট ২৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই সময়ে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের আসল-সুদ বাবদ ৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে সরকার।

ফলে সঞ্চয়কারীদের নিট বিনিয়োগ অর্থ্যাৎ সরকারের এ খাতে ঋণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২০০ শতাংশ বেশি।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৯ হাজার ৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরে। তবে আট মাসেই তার দ্বিগুণেরও বেশি ঋণ নেওয়া হয়ে গেছে।

আর এই ঋণের ভার নিয়ে বিচলিত সরকার, যা স্পষ্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কথায়।

“বাজারে বিদ্যমান অন্যান্য সঞ্চয় উপকরণগুলোর চেয়ে তুলনামূলক আকর্ষণীয় সুদের হার জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়াচ্ছে, যা সরকারের সুদ ব্যয় ভবিষ্যতে বাড়াতে পারে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।       

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিদেশি উৎসের পাশাপাশি দেশীয় উৎস থেকেও ঋণের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ব্যাংক এবং ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে এ ঋণ নেওয়া হয়। ব্যাংকবহির্ভূত উৎসের বেশির ভাগ ঋণই সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হয়।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে। এবার ব্যাংক খাত থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করেছে তার তুলনায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বেশি।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি ছিল ১৪ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এবার একই সময়ে মোট বিক্রি তার চেয়েও ১১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা বেশি হয়েছে।

একক মাস হিসাবে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এখান থেকে এক হাজার ৪৪ কোটি টাকার সুদ-আসল পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা।

আগের অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা বিক্রি থেকে ৯৯১ কোটি টাকার আসল-সুদ পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছিল ১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। এ হিসাবে একক মাস হিসেবেও গত ফেব্রুয়ারিতে নিট বিক্রি আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।

জানুয়ারি মাসেও নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

এভাবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়লে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা চাপের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদের হার কম এবং শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দার কারণে সবাই নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু এর বিক্রি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় এখন বিপাকে পড়েছে সরকার।

“সোস্যাল সেফটিনেটের (সামাজিক নিরাপত্তা) বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকার এর সুদের হার কমাতে পারছে না। অন্যদিকে বেশি লাভের আশায় সবাই এ খাতে বিনিয়োগ করায় সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে।”

ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা কমাতে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হতে পারে- এ ধারণা থেকেও অনেকে আগেভাগেই এ খাতে টাকা লগ্নি করছেন বলে মনে করছেন জায়েদ বখত।

এ অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হবে কি না- প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, “বিষয়টি স্পর্শকাতর। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।”

২০১৪ সালের শেষের দিকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো নিয়ে আলোচনা উঠেছিল। ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি দাবি তুললেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ সময়ে ব্যাংকগুলো মেয়াদি আমানতে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ দিলেও এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ১ মার্চ থেকে সরকারি ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছে।

অন্যদিকে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদ বা মুনাফা হচ্ছে ১৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ । পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ ও তিন বছর মেয়াদি তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ সুদ দেওয়া হচ্ছে। আর তিন বছর মেয়াদি ডাকঘর সঞ্চয় ও ব্যাংক মেয়াদি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। আট মাসে এর নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। পর্যায়ক্রমে বিক্রির শীর্ষে থাকা তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের বিক্রি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৯৭০ কোটি, পোস্ট অফিসের মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ১ হাজার ৪০৪ কোটি এবং ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড ২৫৯ কোটি টাকা।

নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগের বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্টাংশকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি বলা হয়।

নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়। সুদ-আসল পরিশোধের পর যে নিট অর্থ জমা থাকে সেটাকেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বা ধার বলে হিসাব করা হয়। এর জন্য সরকারকে সুদ গুণতে হয়।