সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ‘উল্লম্ফন’

প্রতি মাসেই বাড়ছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, ভাঙছে আগের রেকর্ড। অগাস্ট মাসে আড়াই হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা এক মাসের হিসাবে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2014, 05:20 AM
Updated : 4 Oct 2014, 10:23 AM

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এতো বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা থাকেনি।

জুলাই মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, তাও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ছিল বেশি।

‘কোন ধরনের ঝুঁকি না থাকায় এবং বেশি লাভের জন্য সবাই এ খাতে ঝুঁকছেন’ বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

তবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় তা বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর একটা খারাপ দিকও আছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। এতো বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে।”

আবার সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়লে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাপ কমবে, যাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জায়েদ বখত।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-অগাস্ট) চার হাজার ৩২৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি।

প্রতিদিন নতুন যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তা থেকে আগের বিভিন্ন সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই নিট বিক্রি।

সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট বিক্রির টাকা সরকারের কোষাগারে থেকে যায়। প্রয়োজনে সেখান থেকে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটায় সরকার।

গত নয় মাসের সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে তা এক লাফে বেড়ে এক হাজার ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকায় উঠে।

এরপর থেকে বেড়েই চলেছে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ। ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৬২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এপ্রিলে এক হাজার ২৭৩ কোটি। মে মাসে এক হাজার ২৮৪ কোটি টাকা।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ মাস জুনে নিট বিক্রি বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়। এই অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরও বেড়ে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।

সর্বশেষ অগাস্ট মাসে এক লাফে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ গিয়ে উঠে দুই হাজার ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকায়।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের মুনাফা থেকে কোন কর না কাটার ঘোষণায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।

“অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটা ভালো সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগ তারা নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে,” বলেন তিনি।

অন্য সব সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর থেকে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখে সরকার।

গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। পুরো অর্থবছরে মাত্র সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।

অথচ তার আগের বছরে (২০১২-১৩) এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।

জায়েদ বখত বলেন, “শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই।”

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকে ডিপোজিট রাখলে ৯ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে লাভ মেলে ১৩ শতাংশ।

“তাহলে মানুষ কেন ব্যাংকে টাকা রাখবে?,” প্রশ্ন করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের ঋণ অনিয়মসহ সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতের অন্য কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গও টানেন জায়েদ বখত।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে।

গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দুই গুণ বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকা করা হয়।

জায়েদ বখত বলেন, “সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। তাই এর বিক্রি যতো বাড়বে সরকারের ঋণের বোঝাও ততো বাড়বে।”

নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগের বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্টাংকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত (নিট) বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ছয় মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-অগাস্ট সময়ে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই পরিবার সঞ্চয়পত্র। ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।