সঞ্চয়পত্র: গত বছরের বিক্রির দ্বিগুণ এক মাসেই

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছিল বলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর জানিয়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 April 2014, 04:52 AM
Updated : 13 April 2014, 04:53 PM

ফেব্রুয়ারি মাসে এক হাজার ২৬২ কোটি ১৭ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত পুরো অর্থবছরের বিক্রির তুলনায় দ্বিগুণ। একক মাস হিসাবে চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে ২০০৯ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।  

তুলনামূলকভাবে সুদের হার বেশি হওয়ায় সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তিনি বলেন, “সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্তি বেশি হওয়ায় ব্যাংক ঋণের ওপর চাপ কমেছে।”

এবার ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে গতবারের মত এবারো অর্থবছরের শেষদিকে এসে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলে আশঙ্কা  আজিজুল ইসলামের।

চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মেটাতে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পগুলো থেকে ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ধার নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। এরমধ্যে প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৪৬ কোটি টাকা, যা বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বেশি। আর গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে এর পরিমাণ ১২ গুণ এবং পুরো সময়ের চেয়ে আট গুণ বেশি।

কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর গত বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় বিক্রি বেড়েছে সাত গুণেরও বেশি।

২০১২-১৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৭২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরের প্রতি মাসেই এই বিক্রির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি বা বেশি ছিল। বিশেষ করে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এর পরিমাণ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

২০১০-১১ অর্থবছরে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে দুই হাজার ৫৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরো কমে ৪৭৯ কোটি টাকা হয়।

নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগের বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্টাংশকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়।

আজিজুল ইসলাম বলেন, “সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বৃদ্ধি ভালো দিক। সরকার এই খাতের টাকা উন্নয়ন কাজে খরচ করছে। গত দুই-তিন বছরের মতো ব্যাংক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হবে না।”

তবে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় অর্থবছরের শেষদিকে ব্যাংক ঋণ বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।  

তিনি বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বছরের শেষদিকে সরকারের এডিপি বাস্তবায়নের গতি বেড়ে যায়। খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয় সরকারকে।

“একথা ঠিক যে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে বেশি টাকা আসছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় বছরের শেষদিকে এসে সরকারকে ঠিকই ব্যাংকের ওপর নির্ভর হতে হবে।”

সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সহিংস রাজনীতির কারণে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি বেশ মন্থর ছিল। সে কারণে সরকারের খরচও কম ছিল।

“যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তার একটি বড় অংশ সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়ায় সরকারকে আর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে খুব বেশি ঋণ নিতে হয়নি।”

ঝুঁকিমুক্ত বলেই মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে আনায় এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দা পরিস্থিতি থাকায় ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়েছে।

“মানুষ এখন একটু বেশি মুনাফার আশায় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র কিনছে।”

চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “ব্যাংক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সীমিত রাখতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ব্যাংক বহির্ভূত উৎস (জাতীয় সঞ্চয়পত্র) হতে প্রাপ্তি বেশি হওয়ায় ব্যাংক ঋণের ওপর চাপ হ্রাস পেয়েছে।”

চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই পরিবার সঞ্চয়পত্র, ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।

পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় এর বিক্রি বাড়ছে বলে মনে করছেন আজিজুল ইসলাম।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ শতাংশের কাছাকাছি। ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার যেখানে ১০ শতাংশের নিচে।

শুধু নারীদের জন্য এই পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। এরপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তা বন্ধ করে দিলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় চালু করা হয়।

বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ছয় মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৬২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, অগাস্টে ৬৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৭৮০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, অক্টোবরে ৬০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা ছিল।

নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯০৯ কোটি ১৮ লাখ এবং ৯৫৭ কোটি টাকা।

জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে তা আরো বেড়ে এক হাজার ২৪৬ কোটি হয়েছে।

গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকা ধার করবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। অর্থবছর শেষে তা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল।

ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার প্রভাব পড়ে বেসরকারি বিনিয়োগে। সেজন্য সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়েই ‘উষ্মা’ প্রকাশ করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।

কিন্তু এবার এ নিয়ে তেমন সমালোচনা নেই। ব্যাংকগুলোতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মত ‘অলস’ অর্থ পড়ে আছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬ শতাংশের কাছাকাছি।

চলতি জানুয়ারিতে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় ১ শতাংশ কমেছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ২২ শতাংশের মত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা পুনর্নির্ধারণে করেছে এনবিআর।