এক মাসে ৩৫৭৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

সঞ্চয়পত্র বিক্রি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ধার করার প্রয়োজন পড়ছে না।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2015, 03:28 PM
Updated : 15 March 2015, 03:28 PM

বাজেট ঘাটতির প্রয়োজনীয় খরচ মেটানো হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে আসা অর্থ দিয়ে।

সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে তিন হাজার ৫৭৪ কোটি ১৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল বাবদ ৯৭০ কোটি ৭১ লাখ টাকা শোধ করা হয়েছে।

এ হিসাবে নিট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৬০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

আর চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে চার হাজার ৯৮৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।

হরতাল-অবরোধসহ সহিংস রাজনীতির কারণে দেশে ছোট-ছোট বিনিয়োগের সুযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সবাই এখন ‘নিরাপদ বিনিয়োগ’ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখত।

এছাড়া পুঁজিবাজারে মন্দা এবং ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায়র কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২২ হাজার ৯৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে মোট বিক্রি থেকে বিভিন্ন সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধ করা হয়েছে সাত হাজার ২০৬ কোটি ২১ লাখ টাকা। নিট বিক্রির পরিমাণ হচ্ছে ১৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা।

নিট বিক্রির এই বিশাল অংকের টাকা সরকারের কোষাগারে জমা আছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় এর জন্য মোটা অংকের সুদ নিতে হচ্ছে সরকারকে।

প্রয়োজন পড়লে এখান থেকে টাকা নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজসহ অন্যান্য কাজে খরচ করে সরকার।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। কিন্তু সাত মাসেই এই খাত থেকে সরকার প্রায় দ্বিগুণ; ১৫ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

সুদ-আসল পরিশোধের পর যে নিট অর্থ জমা থাকে সেটাকেই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ বা ধার বলে হিসাব করা হয়। কেননা, এর জন্য সরকারকে সুদ গুণতে হয়।

তথ্য পর‌্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অগাস্টে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৭১ কোটি টাকা।

সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫২ লাখ, দুই হাজার ২৫৬ কোটি ৬১ লাখ এবং দুই হাজার ১৬৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

ডিসেম্বরে তা কমে এক হাজার ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় নেমে অসে।

চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে নিট বিক্রি ফের বেড়ে দুই হাজার ৬০৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জায়েদ বখত বলেন, “হরতাল-অবরোধসহ সহিংসতার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের। ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) শিল্প খাতে যে ছোট ছোট বিনিয়োগ হতো সেটাও আর হচ্ছে না।

“এ পরিস্থিতিতে যাদের হাতে সঞ্চয় আছে তারা কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে একটু বেশি লাভের আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন।”

তবে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি হওয়ায় তা বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

“এর একটা খারাপ দিকও আছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি। এতো বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে।”

চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের মুনাফা থেকে কোনো কর না কাটার ঘোষণায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।

অন্য সব সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর থেকে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখে সরকার।

গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। পুরো অর্থবছরে মাত্র সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।

অথচ তার আগের বছরে (২০১২-১৩) এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।

নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগের বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্টাংকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত (নিট) বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ছয় মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।

জুলাই-জানুয়ারি সময়ে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই পরিবার সঞ্চয়পত্র। ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।

পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১৩ শতাংশের বেশি। অন্যান্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও ১২ থেকে ১৩ শতাংশের মধ্যে।

ব্যাংক থেকে ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে না সরকারের

বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার।

কিন্তু ফেব্রুয়ারি পর‌্যন্ত নিট হিসাবে ব্যাংকিং খাত থেকে কোন অর্থ ধার করেনি সরকার।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজেট ঘাটতির প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে সরকারের যে অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে তা সঞ্চয়পত্র থেকে নিয়েই চলে যাচ্ছে। এখন পর‌্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সরকার ব্যাংক ব্যাংবস্থা থেকে মোট যতো টাকা ঋণ নিয়েছে তার থেকে বেশি আগের নেয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণ ছয় হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণাত্মক (-) হয়েছে।

অর্থ্যাৎ এই সময়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া আগের ঋণের সুদ-আসল বাবদ নয় হা্জার ৪৭৩ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে এই সময়ে সরকার প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

এই হিসাবে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছয় হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণাত্মক হয়েছে।

ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ না নেওয়ায় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর‌্যায়ে রয়েছে বলে জানান মুহিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে এ হার ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ।

টানা আট মাস (গত বছরের জুলাই থেকে) নিম্মমুখী থাকার পর ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি সামান বেড়েছে।

অর্থনীতির পরিভাষায়, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়লে বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।