চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা এবারের বাজেটে পুরো অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশের বেশি।
Published : 05 Nov 2014, 03:45 PM
বাজেট ঘাটতি মেটাতে এবার সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নয় হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এর মধ্যে প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ছয় হাজার ৮২১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তিন গুণেরও বেশি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে দুই হাজার ৯৭ কোটি টাকার সিনট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের গত এক বছরের তথ্যে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ প্রতি মাসেই বাড়ছে, ভাঙছে আগের রেকর্ড।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে আড়াই হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা এক মাসের হিসাবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই এক মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে এতো বেশি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা পড়েনি।
অগাস্ট মাসে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৪৭০ কোটি টাকা, জুলাইয়ে বিক্রি হয় এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং অর্থনীতির গবেষক জায়েদ বখতের মতে, বিনিয়োগে ঝুঁকি না থাকায় এবং বেশি লাভের আশায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। এতে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও কমছে।
তবে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি হওয়ায় সরকারের দায়ও বাড়ছে বলে মনে করেন এই দুই অর্থনীতিবিদ।
জায়েদ বখত বলেন, “সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ার একটা খারাপ দিকও আছে। এর সুদের হার বেশি। এতো বেশি বিক্রি হলে সরকারের ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাবে।”
প্রতিদিন নতুন যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় তা থেকে আগের বিভিন্ন সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল শোধের পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই নিট বিক্রি।
সুদ-আসল পরিশোধের পর নিট বিক্রির টাকা সরকারের কোষাগারে থেকে যায়। প্রয়োজনে সেখান থেকে নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটায় সরকার।
গত এক বছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের নভেম্বরে নিট ৪৮৮ কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে তা এক লাফে বেড়ে এক হাজার ১২৫ কোটি ২৭ লাখ টাকায় ওঠে।
এরপর থেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতা অব্যাহত আছে। ফেব্রুয়ারি মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৬২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এপ্রিলে এক হাজার ২৭৩ কোটি। মে মাসে এক হাজার ২৮৪ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ মাস জুনে নিট বিক্রি বেড়ে এক হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এ অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরের (২০১৪-১৫) প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি আরও বেড়ে এক হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা হয়।
অগাস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি এক লাফে দুই হাজার ৪৭১ কোটি টাকায় পৌঁছায়। সেপ্টেম্বরে তা আরও বেড়ে দুই হাজার ৪৯২ কোটি ৫২ লাখ টাকা হয়।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পেনশনার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগের মুনাফা থেকে কোন কর না কাটার ঘোষণায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে বলে মনে করেন আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি ভালো সুযোগ দিয়েছে সরকার। সেই সুযোগ তারা নিচ্ছেন, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে।”
অন্যসব সঞ্চয়পত্রের মুনাফার উপর থেকে ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে রাখে সরকার।
গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে খুব বেশি ধার করতে হয়নি। পুরো অর্থবছরে মাত্র সাত হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল সরকার।
অথচ তার আগের বছরে (২০১২-১৩) এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, “শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকেই ঝুঁকেছেন সবাই।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকে ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ রাখলে ৯ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। আর পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে লাভ মেলে ১৩ শতাংশ।
“তাহলে মানুষ কেন ব্যাংকে টাকা রাখবে?”, প্রশ্ন করেন তিনি।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মাধ্যমে বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও প্রতিরক্ষা সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, ছয় মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই পরিবার সঞ্চয়পত্র। আর ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।