টিকার আওতায় আসছে ত্রিপুরা পাড়ার শিশুরা

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পাড়ায় শিশুমৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে ওই এলাকা টিকার বাইরে থাকার তথ্য বেরিয়ে আসার পর সেখানে দুটি অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্র হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2017, 12:52 PM
Updated : 18 July 2017, 03:50 PM

বুধবার থেকে টিকাদান কেন্দ্র দুটির কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে ত্রিপুরা পাড়ায় স্যাটেলাইট ক্লিনিকও স্থাপন করা হবে বলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি।

সিভিল সার্জন বলেন, “মধ্যম সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ায় বীরেন্দ্র ত্রিপুরার বাড়িতে এবং দক্ষিণ সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার মগরাম ত্রিপুরার বাড়িতে অস্থায়ী টিকা কেন্দ্র হবে।

“নির্ধারিত দিনগুলোতে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে।”

যেহেতু অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের টিকা দিলে মারাত্মক ঝুঁকি থাকে, তাই সুস্থ শিশু চিহ্নিত করে টিকা দেওয়ার কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।

“আগামীকাল আমরা সেখানে যাব। যদি একজনও সুস্থ শিশু পাই তার মাধ্যমেই টিকা কার্যক্রম শুরু করতে চাই। অপুষ্টিতে ভোগা শিশু থাকলে তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করে তারপর টিকা দেওয়া হবে।”

গত মাসের শেষ দিক থেকে বারআউলিয়ার সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের মধ্যে জ্বর, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট ও খিঁচুনির মত উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। কিন্তু অভিভাবকরা হাসপাতালে না যাওয়ায় চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি জানতে পারে গত বুধবার পর্যন্ত নয় শিশুর মৃত্যুর পর।

পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আরো ৪৬ জনকে।

‘অজ্ঞাত’ রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষক দল ওই এলাকায় যায়।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে ‘শিশুরা দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে এক ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে’ বলে জানান আইইডিসিআরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

তবে শেষ পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর পেছনে ‘হামকে’ চিহ্নিত করার কথা জানায় সরকার।

একইসঙ্গে ওই গোত্রের শিশুরা কখনোই টিকার আওতায় ছিল না বলেও সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী জানান, সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় মোট নয়টি ত্রিপুরা পাড়া আছে। অন্য সাত পাহাড়ে বসবাসকারীরা মোটামুটি টিকা নিলেও এই দুই পাহাড়ের বাসিন্দারা নিত না।

তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য কর্মীরা জানিয়েছেন টিকা দিতে গেলে বাসিন্দারা তাদের তাড়া করত। তাদের মধ্যে ভুল ধারণা ছিল। এখন তারা কথা দিয়েছে টিকা নেবে।”

সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী

ত্রিপুরা পাড়ার বাসিন্দাদের টিকা নিতে ‘অনীহা’র বিষয়টি মাঠ কর্মীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাননি বলে দাবি করেন সিভিল সার্জন।

“তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে জানালে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম।

সিভিল সার্জন বলেন, “চট্টগ্রামের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে পাহাড়ি এলাকা ও দুর্গম চরাঞ্চলসহ সব ‘পকেট’গুলোতে গিয়ে সাত দিনের মধ্যে টিকা পায় কিনা সেই প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছি। 

“চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলাতেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক আবুল হাশেম খান প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার বাইরে থাকায় নিজেদেরও দায়ও স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, “ত্রিপুরা পাড়ায় দ্রুততম সময়ে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হবে। তারও আগে জরুরি ভিত্তিতে স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা হবে।”

মৃত শিশুর পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কোনো মৃত্যুরই ক্ষতি পূরণীয় নয়। অবশ্যই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানাব, যেন সহায়তার হাত বাড়ান। আশাকরি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী করবেন।”

দেশের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে শিগগিরই বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহায়তায় পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ট্রাইবাল হেলথ প্রকল্প’ চালু হবে বলেও জানান আবুল হাশেম খান।

ছয় স্বাস্থ্যকর্মী বদলি

ত্রিপুরা পাড়ার শিশুরা টিকা বঞ্চিত থাকার ঘটনায় গাফিলতির প্রমাণ মেলায় ছয় স্বাস্থ্যকর্মীকে মঙ্গলবার বদলি করা হয়েছে বলে জানান সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী।

এরা হলেন- সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক খালেদ মো. হুমায়ন, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক রেবা মহাজন, স্বাস্থ্য সহকারী নিলুফার আক্তার, বদরুন নাহার বেগম, তফুরা বেগম ও নুরুল করিম।

অসুস্থ পাঁচ শিশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার বিআইটিআইডি হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়।

গাফিলতির দায় শুধু মাঠকর্মীদের কি না জানতে চাইলে আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “দায় আমাদের সবার, সেটা স্বীকার করছি।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মঙ্গলবার পর্যন্ত ত্রিপুরা পাড়ার মোট ৯২ জন শিশু অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ও বিআইটিআইডি হাসপাতালে ভর্তি হয়।

মঙ্গলবারও বিআইটিআইডি হাসপাতাল থেকে পাঁচ শিশুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়।

বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ৬৩ জন এবং বিআইটিআইডি হাসপাতালে ২৯ জন শিশু চিকিৎসাধীন ছিল।

এদের মধ্যে সুস্থ হওয়ায় বিআইটিআইডি থেকে ২০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক এমএ হাসান চৌধুরী।