টিকার বাইরে ছিল সীতাকুণ্ডের গোত্রটি, শিশুদের মৃত্যু ‘হামে’

সীতাকুণ্ডের ত্রিপুরা পাড়ার নয় শিশুর মৃত্যুর কারণ হিসেবে হামকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2017, 12:30 PM
Updated : 24 July 2017, 01:42 PM

একই সঙ্গে দুর্গম ওই এলাকার শিশুরা কখনোই টিকার আওতায় আসেনি বলেও উঠে এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিশুমৃত্যুর কারণ উদঘাটনে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে এসব তথ্য জানান।

তবে সারা দেশে হাম ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নেই বলে জানান তিনি।

ত্রিপুরা পাড়ার ৮৫টি পরিবারের কাছে কয়েক দশকেও টিকা পৌঁছে দিতে না পারায় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে দুঃখও প্রকাশ করেন মহাপরিচালক।  

সীতাকুণ্ডের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, “দেশে হামের পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। এটি (ত্রিপুরা পাড়া) একটি ছোট বিচ্ছিন্ন এলাকা এবং তারা কখনোই আধুনিক চিকিৎসা নেয়নি।”

আধুনিক চিকিৎসা নিলে হয়ত এ প্রাণহানি ঠেকানো যেত বলে মনে করেন তিনি। 

গত মাসের শেষ দিক থেকে বারআউলিয়ার সোনাইছড়ি ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের মধ্যে জ্বর, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট ও  খিঁচুনির মত উপসর্গ দেখা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু অভিভাবকরা হাসপাতালে না যাওয়ায় চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি জানতে পারে গত বুধবার পর্যন্ত নয় শিশুর মৃত্যুর পর।

পরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আরো ৪৬ জনকে।

‘অজ্ঞাত’ রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)ওই এলাকায় যায়।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে ‘শিশুরা দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে এক ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছে’ বলে জানান আইইডিসিআরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকের কাছে যায় না গোত্রের লোকেরা

মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, তাদের দল প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখেছে এবং ওই এলাকায় নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষাও চালিয়েছে।

আইইডিসিআরের নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি জানান, ওই এলাকায় ৩৮৮ জন মানুষের বসবাস এবং শিশুদের মৃত্যুর পর তাদের মধ্যে থেকে মোট ৮৭ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

“আমরা বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করার পর থেকে আর কারো মৃত্যু হয়নি,” বলেন তিনি।

সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই এলাকায় গত ২২ জুন প্রথম হাম দেখা দেয়। কিন্তু প্রথম শিশুটির মৃত্যু হয় ৮ জুলাই। ১২ জুলাইর পর সেখানে চিকিৎসা শুরু হলে আর কেউ মারা যায়নি।

মহাপরিচালক বলেন, “প্রথম মৃত্যুর পর তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ৯ জুলাই আরো দুইজনের মৃত্যুর পর তারা একে ‘বালা-মুছিবত’ মনে করে ভীত হয়ে পড়ে। এরপর তারা নিজেদের প্রথা অনুযায়ী আগুন জ্বেলে প্রার্থণাও করেছে।

“পরদিন কোনো শিশু মারা যায়নি। কিন্তু ১১ জুলাই আরেকটি শিশু এবং পরদিন আরো চার শিশুর মৃত্যু হয়; অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেকেই। তাদের সবারই বয়স তিন থেকে ১২ বছরের মধ্যে।”

তিনি বলেন, “এরপরই ওই গোত্রের কিছু যুবক কাছাকাছি থাকা বাঙালিদের বিষয়টি জানায়। পরবর্তীতে সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কানে যায় বিষয়টি।

“কাছাকাছি বাঙালি জনগোষ্ঠির লোকজন থাকলেও তাদের সঙ্গে ওই গোত্রের মানুষের মেলামেশা নেই। তারা তাদের গোত্রপ্রধানের নির্দেশেই চলে।”

ওই গোত্রের শিশুরা স্কুলে যায় না জানিয়ে অধ্যাপক আজাদ বলেন, “তারা স্কুলে গেলে আমরা জানতাম যে তারা টিকার বাইরে রয়েছে। আমরা তাদের আমাদের (টিকার) আওতায় আনতে পারিনি, এটা দুর্ভাগ্যজনক।”

গোত্রের লোকেরা চিকিৎসকের কাছেও যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “দুঃখজনক এই ঘটনার পরও তাদেরকে চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে জোর করতে হয়েছে।”

তদন্ত হচ্ছে গাফিলতিরও

ত্রিপুরা পাড়ার ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত চলছে বলে জানান মহাপরিচালক অধ্যাপক আজাদ।

“আমি প্রতিবেদনটি দেখিনি, তারপরও কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সমীক্ষা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরেই ওইসব দুর্গম এলাকাগুলো সরকারের টিকাদান কর্মসূচির বাইরে রয়েছে।

“সেখানকার ৩৮৮ জনের কেউই হামের টিকা নেয়নি। তাদের মধ্যে ১৭৬ জনের বয়স ২০ এর নীচে, এটি যদি আমাদের (স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) গাফিলতি হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে গত ২০ বছর ধরেই এই ঘটনা ঘটছে।”

পুরো ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে চট্টগ্রাম জেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে তারা তাদের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাবেন, যাতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির মানুষগুলো এর আওতা থেকে বাদ না যায়।

হাম নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই

হাম একটি সংক্রামক রোগ। জ্বর, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া এবং চোখে লালচে ভাব- এই রোগের উপসর্গের মধ্যে অন্যতম। এই রোগের একমাত্র প্রতিরোধক হচ্ছে টিকা।

সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা বিষয়ক কর্মকর্তা স্টিফেন চাকো জানান, সীতাকুণ্ডের ঘটনায় আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশে ৮৫ শতাংশ শিশু হামের টিকার আওতায় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থা।

“কিন্তু সংক্রমণ ঠেকাতে ৯৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে, যা বেশ কঠিন। তবে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতেও হাম দেখা যায়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে এই অঞ্চল থেকে রোগটিকে নির্মূল করা।”

তিনি জানান, গত বছর তারা হামে আক্রান্ত হওয়ার ১৬৫টি ঘটনা পেয়েছেন, কিন্তু এতে কারো মৃত্যুর তথ্য নেই।

২০১৪ সালে ব্যাপকভাবে হামের টিকা দেওয়ার পর থেকে এই রোগের প্রকোপ কমে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে তাদের পরবর্তী টিকাদান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।