গত কয়েক দিনে দিনে বিপরীতমুখী বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন শেষে বাইরে গিয়ে চোখের পানি ঝরানো, এর পর ম্যাচে নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ অধিনায়ক খুলে দিলেন নিজের মনের দুয়ার।
Published : 23 Mar 2016, 02:12 AM
সেদিন আপনার ওভাবে ভেঙে পড়া অবাক করেছে অনেককেই। অনেক কথাও হচ্ছে। ইতিবাচক কথাই বেশি, তবে নেতিবাচক কথাও আছে।
মাশরাফি বিন মুর্তজা: ইতিবাচক বা নেতিবাচক, এসব ভাবছি না। তবে আমি কিন্তু পেশাদারিত্বের সঙ্গে আপোশ করিনি। আপনি ছিলেন প্রেস কনফারেন্সে, আরও অনেকে ছিল। আমি কিন্তু প্রেস কনফারেন্সে ভেঙে পড়িনি। হ্যাঁ, অনেকবারই গলা ধরে এসেছে; কিন্তু আমি সামলেছি। কারণ জানতাম, ওটা আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্স, ওখানে এসব কিছু করা যাবে না। করিওনি, সামলেছি নিজেকে।
প্রেস কনফারেন্স থেকে বের হওয়ার পর নিজেকে সামলে রাখা একটু কঠিন ছিল। আপনারা অনেকে এলেন। তখন হয়ত আবেগটা আরেকটু বেশিই পেয়ে বসেছিল। এজন্য হয়ত চোখের পানি থামাতে পারিনি। তবে আমি চাইনি, লোকে এসব সেভাবে জানুক। আপনি দেখেছেন, একজন ফটোগ্রাফার তখন ছবি তুলতে এসেছিল, আমি না করেছি। লোক দেখানো কোনো ব্যাপারে আমার কখনও আগ্রহ ছিল না, এখনও নেই।
দলের অন্যদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল এসব জানার পর?
মাশরাফি: বাড়তি কিছু নয়। কেউ তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তামিম অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল কি হয়েছে। আমি বলেছিলাম, ‘প্রেস কনফারেন্সে একের পর এক প্রশ্ন হচ্ছিল তাসকিনকে নিয়ে। তাসকিনের মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল। প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল। ছেলেটা এর মধ্যেই ৩-৪টা ইনজুরি কাটিয়ে এসেছে অনেক কষ্ট করে, তার পর আবার এত বড় ধাক্কা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ওর জন্য। বাচ্চা একটা ছেলে, এই বয়সেই জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব ভাবনা মাথায় খেলা করছিল। পরে একটা সময় নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।’ তবে ওদেরকেও বলেছি যে প্রেস কনফারেন্সে নয়, চোখের পানি ঝরেছে বাইরে এসে।
অনেকে বলছে, কান্না করা আপনার সঙ্গে যায় না, হয়ত অন্যভাবেও সামলাতে পারতেন।
দেখুন বিভিন্ন পরিস্থিতি একেক জন মানুষ একেক সময় একেকভাবে সামলায়। ওই সময়ে ছেলেটার জন্য আমার সত্যিই প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। প্রেস কনফারেন্সেও আমি বলেছি যে ঘরের দুটি ছেলেকে কোনো কারণে হারালে উদ্যম এমনিতেই কমে যায়। আমাদের দলটা তো একটা পরিবার। সেখান থেকে দুজনকে হঠাৎ সরে যেতে বাধ্য হলে খারাপ লাগারই কথা। বিশেষ করে আমাদের বিশ্বাস যে তাসকিনের অ্যাকশনে সমস্যা নেই, কিন্তু আমরা কিছু করতে পারছি না। এই অসহায়ত্বটাও ছিল। সব মিলিয়েই এমনটা হয়েছে।
তাসকিনের ব্যাপারটা আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছিল। কষ্ট নিশ্চয়ই দলের সবারই হচ্ছিল। একেকজন একেক ভাবে সামলেছে।
ম্যাচের আগের দিন আপনার আবেগ নিয়ে তোলপাড়, ম্যাচে দল হারার পর আবার নিশ্চয়ই অন্য অভিজ্ঞতা হলো। আপনার নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা…
মাশরাফি: আজকে সকালে (ম্যাচের পরদিন সকালে) দেশ থেকে অনেক ফোন পেয়েছি। সবাই দেখি নানা কিছু জিজ্ঞেস করে, খোঁজ খবর নেয়। আমি বললাম, ঘটনা কি! তখন সবাই আস্তে আস্তে বলা শুরু করল, গাভাস্কার নাকি প্রশ্ন তুলেছে আমার নেতৃত্ব নিয়ে, দলে আমার ভূমিকা কি। আমি উল্টো সবাইকে বলেছি এসব নিয়ে না ভাবতে।
ধারাভাষ্যকারদের কাজই হলো ভালো-মন্দ যা তাদের মনে হয়, সেটা বলবে। লোকেও তাদের যা মনে হয় বলবে। এসব নিয়ে রিঅ্যাক্ট করার কিছু নেই। হারলে প্রশ্ন উঠবেই, জিতলে হয়ত উঠত না।
একটা ম্যাচ নিয়ে যদিও এত হইচই করার কিছু নেই, তারপরও যদি একদম ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রশ্ন করা হয়, ষোড়শ ওভারে সাকলাইন সজিবকে বল দেওয়ার পেছনে ভাবনা কি ছিল?
মাশরাফি: ভাবনা খুব সিম্পল ছিল। মাত্রই তখন ওয়ার্নার আউট হলো। ম্যাক্সওয়েল সেট হয়নি, ৬ বল খেলেছে মাত্র। মিচেল মার্শ ক্রিজে এসেছে কেবল। দুজনই ডানহাতি। উইকেট তখন গ্রিপ করছে। আমরা দেখেছিলাম, ম্যাক্সওয়েল স্পিনে বেশ ভুগেছে আগের ম্যাচগুলোয়। আমি কি আমার স্পেশালিস্ট স্পিনার এবং উইকেট শিকারি বোলারকে কাজে লাগাতে চাইব না?
গাভাস্কারের মত যারা প্রশ্ন করছে, মাশরাফি কেন নিজেকে আরও বেশি বোলিংয়ে আনলেন না? কেন আল আমিনকে আরও বোলিং দেওয়া হলো না?
এসব আমি এখন স্রেফ যুক্তির খাতিরে বলছি। কিন্তু লোকে কি ভাবতে পারে, সেটা আমরা মাঠে ভাবি না। যেটা বললাম, বল গ্রিপ করছিল, স্পিনাররা উইকেট পাচ্ছিল, এসব কারণেই সাকলাইনকে এনেছিলাম। ওই ওভারের আগে ৩০ বলে ৩৫ রান দরকার ছিল অস্ট্রেলিয়ার, ৬ উইকেট ছিল হাতে। ম্যাচ কিন্তু বেরিয়ে গেছে প্রায়। জিততে হলে উইকেট নিতে হতো আমাদের। সাকলাইন ছিল উইকেট শিকারি অপশন।
ওই ওভারটি বাদ দিলেও, সাকলাইনকে কি ম্যাচে একটু বেশিই বোলিং করানো হয়েছে ম্যাচে?
মাশরাফি: দলে যখন একজনকে নেওয়া হয়েছে মূল বোলার হিসেবে এবং যে একজন স্পিনার, স্পিনিং কন্ডিশনে তাকে কাজে লাগানোর চাওয়া তো থাকবেই। একাদশে যখন আছে, প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেছে বলে তো তাকে আড়ালে রাখার কিছু নেই। তারপরও যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি ওকে কম চাপ দিতে। পাওয়ার প্লের শেষে, উইকেট পড়ার পর, এসব সময়ে ওকে বোলিংয়ে এনেছি।
একাদশে রাখা কি জরুরি ছিল? দল নির্বাচন নিয়েও টুকটাক প্রশ্ন উঠছে। মিঠুনের খেলা, নাসিরের না খেলা, দলে যোগ দিয়েই সাকলাইন-শুভাগতর খেলা...
মাশরাফি: আমি বারবারই বলে আসছি টিম কম্বিনেশনের কথা। আমরা যে ভাবনা থেকে কম্বিনেশন সাজাই, সেটা কিন্তু সবাই জানে না। আমরাই জানি, সেভাবেই দল সাজানো হয়। কখনো ভাবনামতো কাজ হয়, কখনো হয় না। আরেকটা কথা, সব সিদ্ধান্ত কিন্তু আমি একা নেই না। টিম মানেজমেন্ট বলে ব্যাপার আছে। শুধু দল সাজানো নয়, অনেক সময় খেলার সময়ও মাঠের বাইরে থেকে নির্দেশনা আসে। সব কিছুই মাথায় রাখতে হয়। কখনো কাজে লাগে, কখনো লাগে না। এর বেশি কিছু আর বলতে চাইছি না।
দলে আপনার ভূমিকা নিয়ে গাভাস্কারদের প্রশ্ন…
মাশরাফি: গাভাস্কার সবসময়ের সেরা ব্যাটসমানদের একজন, তার প্রতি আমার সর্বোচ্চ সম্মান আছে। তবে আমি ক্রিকেট খেলি আমার দেশের জন্য; অন্য দেশের কে কি বলল, তাতে যায়-আসে সামান্যই। তারা তাদের কাজ করবেন, আমি আমার।
আপনাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেই আমি দেখেছি, এই দফায় অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট আমার। তবে এসব নিয়ে আমি কখনোই উচ্চাবাচ্য করি না। আমি ভালো করলে প্রেস কনফারেন্সেও যখন আপনারা প্রশংসা করেছেন, আমি সব সময়ই এড়িয়ে গিয়ে দলের কথাই বলেছি। নিজেকে কখনোই বড় করতে চাইনি, ভবিষ্যতেও করতে চাই না। দলের যখন আমাকে প্রয়োজন হবে না, দল আমাকে চাইবে না, আমিও তখন থাকব না।
গাভাস্কার না হয় অন্য দেশের; কিন্তু স্রেফ একটা ম্যাচে আপনার কয়েকটি সিদ্ধান্ত কাজে না লাগায় নিজ দেশেও যে প্রতিক্রিয়া-সমালোচনা হচ্ছে, অবাক হয়েছেন?
একটা ঘটনা বলি। তাসকিনরা নিষিদ্ধ হওয়ার পরদিন, মানে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগের দিন দলের ঐচ্ছিক অনুশীলন, আমার যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু পরে মনে হলো, আজকের দিনে আমি মাঠে না গেলে অনেকে ভুল বার্তা পেতে পারে। পরে ঠিকই গিয়েছি এবং প্রেসের মুখোমুখি হয়েছি। দলের অনেকেই অবাক হয়েছে। এ রকমই, আমি জীবনে কখনো বাস্তবতার মুখোমুখি হতে ভয় পাইনি। ওই ভয়টা পেলে আজও ক্রিকেট খেলে যেতে পারতাম না। ভবিষ্যতেও কখনো পিছপা হবো না।
যতদিন খেলব, নিজের গাট ফিলিং যা বলবে, মন আর মাথা যেটা বলবে, যা দলের জন্য সবচেয়ে ভালো, সেটিই করে যাব।
শেষ প্রশ্ন, খর্বশক্তির এই দল নিয়ে ভারতকে হারানো সম্ভব?
মাশরাফি: কঠিন, কিন্তু খুবই সম্ভব। দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই বোলারকে ছাড়া, সবচেয়ে ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যানকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমরা যেভাবে খেলেছি, একটু নির্মোহভাবে ভাবুন, সেটা কিন্তু কম নয়! এই তো, এশিয়া কাপের আগেও আমরা টি-টোয়েন্টিতে পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এখন এশিয়া কাপ ফাইনাল খেলেছি বলেই রাতারাতি বিশ্বজয়ী দল হয়ে যাইনি! টি-টোয়েন্টিতে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সে সব মাথায় রাখতে হবে।
তার পরও ক্রিকেটে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আমরা যদি দল হিসেবে খেলতে পারি, দিনটা যদি আমাদের থাকে, তাহলে ভারতকে না হারাতে পারার কারণ নেই। আমাদের চেষ্টার কমতি থাকবে না।