পার্থ টেস্টের চতুর্থ দিনে ২৯০ রানে আউট হয়েছেন রস টেইলর। নিউ জিল্যান্ডের এই ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ‘নার্ভাস ২৯০’-এর কোটায় আউট হওয়া ব্যাটসম্যান এখন সাত জন। সবারই আছে আলাদা গল্প!
Published : 16 Nov 2015, 01:15 PM
টেইলরের ‘মেন্টর’, সাবেক নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক মার্টিন ক্রো একবার আউট হয়েছিলেন ২৯৯ রানে। পরে ক্রো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এটা যেন এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে গিয়ে শেষ পদক্ষেপের আগে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগা!”
শেষ পদক্ষেপে না গেলেও টেইলর ছিলেন মাত্র কয়েকটি পদক্ষেপ দূরে। স্রেফ দুটি শটেও হতে পারত আরাধ্য তিনশ’। কিন্তু সেই চেষ্টাতেই আবার হয়েছেন আউট। ‘২৯০’ এমনই এক গল্প, যেখানে মেলবন্ধন ঠিক বিপরীত দুটি অনুভূতির। প্রাপ্তির তৃপ্তি ও আনন্দ যেমন আছে, তেমনি আছে অপ্রাপ্তির আক্ষেপ ও হতাশা!
ডন ব্র্যাডম্যান, ২৯৯*, অ্যাডিলেড ১৯৩২, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা
ট্রিপল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ১ রান দূরে থমকে যাওয়া, সেটিও অন্য প্রান্তে শেষ ব্যাটসম্যান রান আউট হয়ে যাওয়ায় - এই আক্ষেপের কি সীমা থাকে! অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যান স্বাদ পেয়েছিলেন সেই অনুভূতিরই।
ট্রিপল সেঞ্চুরির স্বাদ ২ বছর আগেই একবার পেয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। এবারও গেলেন খুব কাছাকাছি। দ্বিতীয় উইকেটে ১৭৬ রানের জুটির পর ৮২ রানে আউট হলেন বিল উডফুল। এরপর এক প্রান্তে ব্যাটসম্যানদের নিয়মিত আসা-যাওয়া, আরেক পাশে ব্র্যাডম্যানের স্ট্রোকের ফোয়ারা।
প্রোটিয়া পেসার স্যান্ডি বেল নিলেন ৫ উইকেট। শেষ ব্যাটসম্যান হিউ থার্লোকে নিয়ে ট্রিপলের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন ব্র্যাডম্যান। কিন্তু ৩০০তম রান নেওয়ার চেষ্টাতেই রান আউট থার্লো! দায়টা অবশ্য ব্র্যাডম্যানেরই বেশি ছিল, ট্রিপল সেঞ্চুরির আশায় ছটফট করে চেয়েছিলেন তাড়াহুড়ো করে রানটি নিতে। শেষ পর্যন্ত ৩৯৬ মিনিটে অপরাজিত ২৯৯।
এখনও পর্যন্ত ২৯০ -এর কোটায় একমাত্র অপরাজিত ইনিংস এটি। ২ বছর পর অবশ্য ঠিকই দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরি করে ইতিহাস গড়েছিলেন ব্র্যাডম্যান।
দুর্দান্ত ফর্মে থেকে ওই ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন ভিভ রিচার্ডস। সিরিজে তার আগের কয়েকটি ইনিংস ছিল ২৩২, ৬৩, ১৩৫, ৬৬! এই ম্যাচে তাকে নামতে হয়েছিল শুরুতেই, শূন্য রানে আউট হয়েছিলেন ওপেনার গর্ডন গ্রিনিজ।
নেমেই ইংলিশ বোলারদের তুলোধুনো করতে শুরু করলেন রিচার্ডস। প্রথম দিন শেষে অপরাজিত ছিলেন ২০০ রানে। খুনে সব শটে ইংলিশ বোলারদের মনোবলই ভেঙে দিয়েছিলেন রিচার্ডস। পর দিনও দারুণ খেলে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ট্রিপল সেঞ্চুরির দিকে। লাঞ্চের পর পর টনি গ্রেগকে উড়িয়ে চার মেরে পা রাখলেন ২৯০-এর ঘরে। পরের বলেও একই চেষ্টা, এবার ব্যাটের কোনায় লেগে বল চুমু খেল স্টাম্পে। ৩৮ চারে ৩৮৬ বলে ২৯১!
তখন মাত্র ৩ উইকেট পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের, হাতে ছিল অনেক সময়ও। কিন্তু নিজের সহজাত স্ট্রোক প্রবৃত্তিই এবার বঞ্চিত করল রিচার্ডসকে।
এমন এক ইনিংস, যখন ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর আফসোস করেছিল, বিরক্ত হয়েছিল প্রতিপক্ষও!
প্রথম ইনিংসে ৩২৩ রান পিছিয়ে থাকলেও দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল নিউ জিল্যান্ড। তৃতীয় উইকেটে ৪৬৭ রানের রেকর্ড জুটি গড়লেন মার্টিন ক্রো ও অ্যান্ড্রু জোন্স। নিশ্চিত ড্রয়ের পথে টেস্ট। শেষ দিনে শেষ ওভার পর্যন্ত খেলা চলছিল স্রেফ ক্রোর ট্রিপল সেঞ্চুরির জন্যই। কিন্তু ৬১০ মিনিটের প্রচেষ্টার আক্ষেপময় সমাপ্তি মুহূর্তের ভুলে। শেষ ওভারের তৃতীয় বলে অনিয়মিত বোলার অর্জুনা রানাতুঙ্গার বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন ক্রো। ৫২৩ বলে ২৯৯।
পরে এক সাক্ষাৎকারে ক্রো জানিয়েছিলেন তার সেই সময়ের মানসিক অবস্থা, “১০ ঘণ্টা ব্যাট করেছি, একটুও মনোযোগ নষ্ট হয়নি। ২৯৯ রানে হঠাৎ মনে হলো, নিউ জিল্যান্ডের হয়ে প্রথম তিনশ’ করব আমি, ওয়াও! এতেই মনোযোগ নড়ে গেল। অর্জুনা যখন বল করতে ছুটে আসছিল, নিজেকে বলছিলাম যে বলে চোখ রাখতে হবে। কিন্তু মুহূর্তের জন্য সব ঝাপসা হয়ে গেল। বল দেখলাম না, সম্মোহিতের মতো ব্যাট বাড়িয়ে দিলাম। ব্যাটের কোনা স্পর্শ করল বল, মাটির ইঞ্চিখানেক ওপর থেকে ক্যাচ নিল উইকেটকিপার। ঝড়ের গতিতে মাঠ ছেড়েছিলাম আমি, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম পরে। এটা যেন ছিল এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে গিয়ে শেষ পদক্ষেপের আগে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান!”
রামনরেশ সারওয়ান, ২৯১, ব্রিজটাউস ২০০৯, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড
৫ বছর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৬১ রানে অপরাজিত ছিলেন সারওয়ান। এবার আরেকটি সুযোগ এসেছিল তার সামনে। কিন্তু থমকে যেতে হয়েছে আরও কাছে গিয়ে।
ব্রিজটাউনের ব্যাটিং স্বর্গে ইংল্যান্ডের ৬০০ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজও গড়েছিল রানের পাহাড়। সাড়ে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় জুড়ে ধৈর্য্যের প্রতিমূর্তি ছিলেন সারওয়ান, যথারীতি অফ সাইডে খেলেছেন চোখ ধাঁধানো সব শট। মাইলফলক যখন হাতের নাগালে, বাঁহাতি পেসার রায়ান সাইডবটমের দেরিতে সুইং করা দারুণ এক ডেলিভারিতে বোল্ড সারওয়ান। ৩০ চার ও ২ ছক্কায় ৪৫২ বলে ২৯১।
বিরেন্দর শেবাগের সামনে ছিল অমরত্বের হাতছানি। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার ট্রিপল সেঞ্চুরির ‘ট্রিপল’ করার সম্ভাবনা। কিন্তু সুবাস পেয়েও হারিয়ে ফেললেন তৃতীয় ট্রিপল!
২০০৪ ও ২০০৮ সালে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিলেন শেবাগ। এই টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষ করেছিলেন ২৮৪ রানে। তৃতীয় দিন সকালে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কাঙ্ক্ষিত মাইলফলকের পথে। কিন্তু মুত্তিয়া মুরালিধরনের লুপে তুলে দিলেন ফিরতি ক্যাচ। প্রথম দফায় ধরতে না পারলেও পরে ঠিকই মুঠোবন্দি করলেন মুরালিধরন। ৪০ চার ও ৭ ছক্কায় মাত্র ২৫৪ বলে ২৯৩।
পরে স্বভাবজাত ঢংয়েই শেবাগ বলেছিলেন, “দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি ও আরেকটি ২৯০ খুব বেশি লোকে করতে পারেনি। হতাশার তাই কিছু নেই। আমি ২৯৩ করতে পেরেই খুশি!”
ক’দিন আগেই অ্যাশেজে অপরাজিত ২৩৫ রান করে এসেছিলেন কুক। ভারতের বিপক্ষে এই টেস্টে ছিল সময়, সুযোগ সবই। প্রায় ১৩ ঘণ্টা উইকেটে ছিলেন ইংলিশ ওপেনার। কিন্তু মাইলফলকের খুব কাছে গিয়ে হঠাৎ আত্মঘাতী শট। ইশান্ত শর্মার অনেক বাইরের বল তাড়া করে ক্যাচ দিলেন ডিপ পয়েন্টে। সুরেশ রায়নার হাত থেকে কাচ ফসকায় কমই! ৭৭৩ মিনিটে ৫৪৫ বলে ২৯৪।
২৩৫ রানে চতুর্থ দিন শুরু করেছিলেন রস টেইলর। যথারীতি ব্যাট করছিলেন নির্ভরতায়, তবে আরেক পাশে উইকেট পড়ছিল নিয়মিত। সকালেই আউট হলেন আগের দিনের অপরাজিত মার্ক ক্রেইগ, ফিরে গেলেন ম্যাট হেনরিও। টিম সাউদি কিছুক্ষণ সঙ্গ দিয়েছেন টেলরকে। কিন্তু ২১ রান করে মিচেল স্টার্ককে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন সাউদিও।
শেষ ব্যাটসম্যান ট্রেন্ট বোল্ট যখন উইকেটে গেলেন, টেইলরের রান ২৭৭। বোল্ট কিন্তু ভালোই নির্ভরতা যোগাচ্ছিলেন। শেষ জুটিতে ৩৭ রান উঠে গিয়েছিল; বোল্ট নিজে করলেন ২৩। কিন্তু আরেক প্রান্তে শেষ ব্যাটসম্যানকে দেখে হয়ত খুব একটা ভরসা পাচ্ছিলেন না টেইলর। নাথান লায়নকে স্লগ সুইপে উড়িয়ে মারতে গিয়ে তাই ক্যাচ দিলেন মিড উইকেটে। দারুণ এক স্লাইডিং ক্যাচ নিয়ে বাকি জীবন গল্প করার রসদ পেয়ে গেলেন অতিরিক্ত ফিল্ডার জোনাথন ওয়েলস। ৩৭৪ বলে ২৯০!