টানা অবরোধ আর হরতালে হারিয়েছে রাজধানীর চেনা বাজারের ব্যস্ত চিত্র; কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব বাজারের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষগুলো।
Published : 04 Feb 2015, 02:14 PM
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি দল রাজধানীর চক বাজার, ইসলামপুর, বাবু বাজার, পাটুয়াটুলী, তাঁতী বাজারসহ প্রধান প্রধান পাইকারি বাজার ঘুরে ব্যবসা-বাণিজ্যের এই চিত্রই দেখেছে।
বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ, যেসব খোলা হচ্ছে সেসবেও বেচাকেনা খুব সামান্য।
পুরান ঢাকার এই বাজারগুলো প্রধানত থান কাপড়, পর্দা, থ্রি পিস, শার্ট-প্যান্টের কাপড়, বোরকা, পাঞ্জাবি, বিভিন্ন খেলনা, প্লাস্টিক পণ্য, মসলা, মনোহরী সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি বেচাকেনার জন্য দেশব্যাপী প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ক্রেতারা এসে মালামাল কিনে নিয়ে যায় এসব পাইকারি বাজার থেকে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে কেনাকাটা হয়। একেক এলাকা থেকে ছোট ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধভাবে কেনাকাটা করে ট্রাকে পণ্য তুলে দিয়ে চলে যান।
দিনরাত বিক্রেতা, হকার, কুলি, ভ্যান চালকদের হাঁক-ডাকে মুখর থাকে এই এলাকা। মানুষের ভিড়ে চলাচল করাও ছিল কষ্টসাধ্য। তবে টানা অবরোধে সেই চিত্র এখন ফিকে, যেন ফাঁকা এলাকায় ব্যস্ততা নেই কারও।
বেকায়দায় পড়েছেন এসব ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অন্যান্য ব্যবসায়ী ও দিনমজুররা। স্তিমিত হয়ে পড়েছে আবাসিক ও খাওয়ার হোটেল, ব্যাংকের লেনদেন ছাড়াও মহাব্যস্ত চা-পানের দোকানগুলো।
কাজ না থাকায় অনেকটা রুটি-রোজগারহীন হয়ে পড়েছেন কুলি, ভ্যান ও ঠ্যালাওয়ালাসহ দিনমজুরভিত্তির শ্রমিকরা।
বিএনপি জোটের লাগাতার অবরোধ মাস ধরে চলার পর সঙ্ক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা না দেখে উদ্বিগ্ন পুরান ঢাকার পাইকারি ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এসব মানুষ।
দৈনিক ক্ষতি গুণছেন কাপড় ব্যবসায়ীরা
ইসলামপুরের করিম ম্যানশনের রয়েছে ৩০ থেকে ৪০টি পর্দা ও থান কাপড়ের দোকান। বিক্রেতারা জানান, বিক্রি না হওয়ায় প্রতিদিনই ক্ষতির অঙ্ক গুণতে হচ্ছে তাদের।
করিম ম্যানশনের থ্রি স্টার ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপক মো. বিল্লাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। কোন কোন দিন ‘বউনি’ হয় না। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে কম করে হলেও ৬০ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। এহন পাঁচ হাজার টাকা হলেও আলহামদুলিল্লাহ।”
একই মার্কেটের সেফা বস্ত্র বিতানের উজ্জ্বলও একই কথা বললেন- “প্রতিদিন দোকান চালাতে যে খরচ, কর্মচারীদের বেতন কোনটিই উঠে আসছে না। পুরোটাই এখন লস।”
পাইকারি বিক্রেতারা বলেন, হরতাল ও অবরোধে নাশকতায় কারণে ভয়ে পাইকারি বাজারে আসছেন না মফস্বলের ক্রেতারাও।
যশোরের নাভারন এলাকার খুচরা বিক্রেতা আব্দুস সালামের সঙ্গে কথা হয় ইসলামপুরের টং মার্কেটে, যিনি পাইকারি দরে কাপড় কিনতে এসেছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি প্রতিমাসে অন্তত চারবার ঢাকায় আসি কাপড় কিনতে। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে এ মাসে একবারই এলাম।”
পর্দা ব্যবসায়ী কাজী লিয়াকত আলী বলেন, “আগে আমি প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক লাখ টাকার কেনাবেচা করতাম। সেটা এখন মাত্র ১০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। কারণ আমাদের প্রধান কাস্টমার দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা। হরতাল-অবরোধের কারণে ওইসব কাস্টমার এখন কম আসছেন।”
তিনি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, “আগে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ-ছয় জন বড় কাস্টমার মফস্বল থেকে আসতেন। তারা অনেক টাকার মাল কিনতেন। এখন সপ্তাহে এক-দুইজন আসছেন।”
জানুয়ারি মাসে দোকান খরচ নিজের পকেট থেকে দিতে হয়েছে বলে জানান সুইট হোমের মালিক লিয়াকত আলী।
লিয়াকত প্রধানত আমদানি করা পর্দার ব্যবসায়ী। তিনি চীন থেকে পর্দা আমদানি করে ইসলামপুরে পাইকারি দরে বিক্রি করেন।
এই আমদানিকারক বলেন, “হরতাল-অবরোধের কারণে আমদানি করা পণ্য পরিবহণে খরচ বেড়েছে। আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এক ট্রাক মাল ঢাকায় আনতে খরচ হতো ১৫ হাজার টাকা। যা এখন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায় পৌঁছেছে।”
থ্রি পিস বিক্রেতা লিজান ফ্যাশনের মালিক মোসলেমউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মূলতঃ ইসলামপুর চলে মফস্বলের কাস্টমারের মাধ্যমে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতারা আসতে পারছে না। এতে বেচাকেনা যেমন হচ্ছে না, তেমনি ক্রেতাদের কাছে বকেয়া টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমাদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।”
গত মাসে ৩০ হাজার টাকার মত লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেন এই ব্যবসায়ী।
মক্কা থ্রি পিসের মালিক মিজান বলেন, “বর্তমানে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। বলা যেতে পারে সময় কাটানোর জন্য দোকান খুলছি। আগে যেখানে দিনে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার কেনাবেচা করতাম, এখন সেটা ২ থেকে ৩ হাজার টাকা হচ্ছে। কোন কোন দিন হচ্ছেও না।”
স্থবির বাজারের প্রভাব ‘সবখানে’
পাইকারি কাপড়ের বাজারকে কেন্দ্র করে ইসলামপুরে গড়ে উঠেছে এমব্রয়ডারি শিল্প। এখানকার এমব্রয়ডারি কারখানাগুলো মফস্বলের ব্যবসায়ীদের পছন্দ অনুযায়ী কাপড়ে নকশা করে দেয়। কিন্তু হরতাল অবরোধে ক্রেতা না থাকায় ক্ষতির পাল্লা বাড়ছে তাদেরও।
এরকম একজন ব্যবসায়ী এ জে এম এমব্রয়ডারির মালিক আব্দুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে আমাদের প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দেড় লাখ টাকার কাজের অর্ডার আসত। কিন্তু এখন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার অর্ডার হচ্ছে। কিন্তু আমার আটজন শ্রমিকের কারখানা চালাতে প্রতি মাসে খরচ হয় ৯০ হাজার টাকা। এই অর্ডার দিয়ে কারখানা চালানো সম্ভব হচ্ছে না।”
কর্মচারীদের জানুয়ারি মাসের বেতন দেওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।
কেনাকেটার বিশাল আয়োজনকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে আবাসিক হোটেল ও খাওয়ার হোটেলের ব্যবসা জমজমাট। তবে হরতাল-অবরোধের বাধায় জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি অনেকটা কমে গেছে গত একমাসে। ফলে এসব আবাসিক ও খাওয়ার হোটেলের ব্যবসাও মন্দা।
‘বাবুর্চি খানা’ নামে একটি খাবার হোটেলের ব্যবস্থাপক আব্দুর রহিম বলেন, “আমাদের ব্যবসা একদম নেই। পাইকাররা আসছে না। ফলে দোকানে কাস্টমারও নেই। আগে প্রতিদিন হাজার-বারোশ’ লোক খাইত। এখন তো কোনো লোকই নেই।”
ডাচ বাংলা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার ব্যবস্থাপক এস এম আজহারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চলমান পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য কমেছে। ফলে আমাদের এখানেও লেনদেন কম।”
তিনি তথ্য দিয়ে বলেন, “স্বাভাবিক সময়ে আমার শাখায় ১২০০ থেকে ১৫০০ লেনদেন হতো। সেটা এখন কমে ৭০০ থেকে ৮০০ তে নেমে এসেছে। তবে আমরা রিটেইল ব্যাংকিং করি বলে আমাদের ব্যাংকে কিছু গ্রাহক আছে। কিন্তু ইসলামপুরে অবস্থিত অন্যান্য ব্যাংকে লেনদেন প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।”
ইসলামপুরের লায়ন টাওয়ারের নিচে ভ্যানচালক সাঈদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত একমাস ধইরা কাম নাই। কাইলকা (সোমবার) ১০০ টাকা ধার লইয়া আইছিলাম, পরে গেছিগা। আইজ (মঙ্গলবার) ১৫০ টাকার একটা খ্যাপ হইছে।”
এর আগে তার আয় ছিল দৈনিক কমপক্ষে হাজার টাকা- এ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “ঘরভাড়া দিতে পারছি না, চলতেও কষ্ট হচ্ছে।”
তিনি জানান, তার এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে পাঁচজনের সংসার। সংসার চালাতে মাসে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা লাগে। এই অবস্থায় পড়ে এখন তিনি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।
একই অবস্থা কুলি মনিরুল ইসলামের। মার্কেটগুলোতে কেনাবেচা না থাকায় তারও কোন আয় হচ্ছে না। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে মনিরুল গত এক মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা ধার করেছেন বলে জানান।
মুনিরুল বলেন, তার পাঁচ মেয়ে ও স্ত্রীসহ সাত জনের সংসার চালাতে হয়। সংসারের খরচের পুরোটাই তাকে আয় করতে হয় মার্কেটের ব্যবসায়ীদের পণ্য বহন করে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা না আসায় এখন বসে বসে দিন কাটাতে হচ্ছে।
মনিরুল জানান, “স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য চললে দিনে ৬ থেকে ৭’শ টাকা আয় হয়। এখন এক-দেড়শ’ টাকাও হয় না।”
‘ক্রেতা নেই মসলাবাজারেও’
ক্রেতার অভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে চকবাজারের মৌলভীবাজার এলাকার পাইকারি মসলা বাজার।
বাজারের নুরানী স্টোরের মালিক আব্দুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি সাধারণ দিনে এখানে এক একটি দোকানে বিক্রি হত ৪-৫ লাখ টাকা। এখন গড়ে ৪০ থেকে ৫০ হাজার বিক্রি হয়।
“এর মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে মসলার পরিবহন খরচ। আগে চট্রগ্রাম থেকে এক ট্রাক মাল আনতে খরচ পড়তো ১৫ হাজার টাকা। এখন এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার টাকায়।”
তার হিসেবে মার্কেটের প্রায় ২০টি দোকানেরই একই অবস্থা।
আকরাম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ম্যানেজার বাচ্চু মিয়া বলেন, “একদিন দোকান খুললে অন্তত ১২শ টাকা খরচ হয়, বেশির ভাগ দিনেই সে খরচ উঠছে না। গত ১০ বছরে এমন পরিস্থিতি হয়নি।”
আলাউদ্দিন অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক আলাউদ্দিনের মতে হরতাল ও অবরোধের কারনে মসলার বাজারের বিক্রি চার ভাগের এক ভাগে ঠেকেছে।
“আমাদের বেশির ভাগ ক্রেতাই আসে মফস্বল থেকে। হরতাল-অবরোধের কারণে তারা আসতে পারছেন না। আগে যেখানে একটি দোকানে ২০-২৫ জন ‘বড় ক্রেতা’ আসতো সেখানে এখন আসছেন একজন থেকে দুজন।”
মনোহরী বাজারেও মন্দা
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চরম হতাশা আর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চকবাজারের মনোহরী সামগ্রীর (খেলনা, ইমিটেশনের গহনা, কসমেটিকস) ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, জানুয়ারি মাস তাদের ব্যবসার অন্যতম মৌসুম। কারণ এসময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীতকালীন মেলা চলে। আর মেলাগুলোতে খেলনাসহ এসব পণ্যের চাহিদা থাকে সবচে বেশি। কিন্তু অবরোধ-হরতালের কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্রেতারা আসতে পারছে না বা আসতে চাচ্ছে না।
মেসার্স রিতু এন্টারপ্রাইজ চকবাজারে দেশী-বিদেশী খেলনা, কাগজের ফুল, বাঁশের বাঁশি, লাটিম ইত্যাদি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে।
এই দোকানের বিক্রেতা সুমন অবরোধকালীন সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “এই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শীতকালীন মেলা হয়। এটাই আমাদের বেচাবিক্রির প্রধান সময়। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না।”
সামনে বৈশাখী মেলার মৌসুমের বেচাবিক্রিও এসময় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এবার সেটাও শুরু হয়নি বলে জানান সুমন।
একই মার্কেটের ফিরোজা এন্টারপ্রাইজ যারা দেশে তৈরি স্কুল ব্যাগ, মানিব্যাগ, লেডিস ব্যাগ ও এলবাম পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে।
এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আবুল খায়ের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচাবিক্রি একদম নেই। দেশে যে কী হচ্ছে? যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, আমরা তো ট্যাক্স দেই। আমরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হব?”
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন,“পুলিশ পাহারায় ট্রাক চালানো সমস্যার সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য আসল জায়গায় হাত দিতে হবে। আমরা চাই স্বাভাবিকভাবে সব কাজ করব।”
একইধরনের ক্ষতির কথা তুলে ধরে চুড়ি ও ইমিটেশন জুয়েলারির বিক্রেতা পলাশ এন্টারপ্রাইজের মালিক কামরুজ্জামান পলাশ বলেন, “সমস্যা সমাধানে সরকারকেই আগে ভূমিকা নিতে হবে। কারণ সংসারের সমস্যা নিরসনে পিতাকে ছেলের তুলনায় বেশি ভূমিকা নিতে হয়। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তো সরকারই পিতার মতো।”