করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে বিভিন্ন পোশাক কারখানা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রমিকদের বাড়ি থেকে বের করার ফলে রোগ ছড়ানোর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তার জন্য বিজিএমইএকে দুষছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
Published : 05 Apr 2020, 12:44 AM
মহামারী ঠেকাতে সরকার যখন দেশকে লকডাউন করার অবস্থায় গেছে, তখন কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে বিজিএমইএর এভাবে পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
দেশে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিলেও পোশাক কারখানার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়নি।
তখন পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ অধিকাংশ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান।
সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ৪ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়লেও শনি ও রোববার কিছু পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত শোনার পর শুক্রবার থেকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের পথে রওনা হন অনেক পোশাক শ্রমিক। লকডাউনের মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বেশিরভাগই হেঁটে রওনা হন।
গণমাধ্যমে এই খবর দেখে পোশাক মালিকদের বড় সংগঠন বিজিএমইএর সমালোচনা শুরু হয় সোশাল মিডিয়ায়।
সৈকত ভৌমিক নামে একজন তার ফেইসবুক পাতায় লেখেন- “সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করতে গিয়ে গার্মেন্টস মালিকরা খেলে গেল। সরকার বসে বসে পুরা খেলা দেখে গেল। ঝুঁকির মুখে পড়লো বাংলাদেশ। দেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলে বিজিএমইএ কী ভাবছে নিজেরাও বেঁচে যাবে?”
মাজহারুল ইমন নামে আরেকজন লেখেন, “একদিকে জনগণকে পিটিয়ে ঘরে ঢুকানো হচ্ছে অন্য দিকে তৈরি পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে!”
সমালোচনার মধ্যে শনিবার রাতে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক পোশাক কারখানাগুলো ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান। পরে পোশাক মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএও একই সিদ্ধান্ত জানায়।
এখন বেরিয়ে পড়া এই শ্রমিকরা যদি ফিরতি বাড়ির পথ ধরে, সেটাও নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেওয়া কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সেজন্য ঢাকায় আসা শ্রমিকরা যেন আর ফেরত না যায় সে ব্যবস্থা তৈরি করতে পোশাক মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন, যিনি কোভিড-১৯ মহামারী ঠেকাতে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিজিএমইএর ভুল সিদ্ধান্তের দায় তাদেরই নিতে হবে।
“আমার পরামর্শ হল, তারা যদি বাড়ি ফিরে যায়, তাহলে তারা যেন সেইফলি পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রেখে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
“আর যদি তারা ঢাকায় থাকে তাহলে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলে তারা আর গ্রামে যাবে না।”
বিএমএ’র কার্যকরি পরিষদের সদস্য মুশতাক হোসেন বলেন, “শ্রমিকরা বাড়ি যাওয়ার সময় একবার একটা ঝুঁকি তৈরি করেছে। এখন আসার পথে আরেকবার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
“এখন তারা যদি আবার গ্রামে যায়, আবার ফিরে আসে তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি তো আরও বেশি বেড়ে যাবে।”
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ ড. তৌফিক জোয়ার্দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাস ঠেকাতে সরকারের উদ্যোগের সঙ্গে বিজিএমইএর এসব কাজ সাংঘর্ষিক।
“একবার তারা আসতে বলা, থাকতে বলা, আদৌ তাদের যেতে বলা হবে কি না-এই পুরো বিষয়টি নিয়ে সমন্বয়হীতার ব্যাপার। যে কোনো মহামারীকে যুদ্ধের মতো চিন্তা করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্তহীনতা খারাপ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।”
তিনি বলেন, “মহামারী কোনো প্রশাসনিক ইস্যু নয়, হেলথ ইস্যু। এখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ খাতের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটা বিজিএমইএ নিলেও এটা জেনে বুঝে নিতে হবে।”
হাজার হাজার শ্রমিকদের এই যাতায়াত চলমান পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ড. জোয়ার্দার।
তিনি বলেন, “তারা যতবার যাতায়াত করবে, ততবার সামাজিক দূরত্ব ভেঙে কাছাকাছি চলে আসবে। ততবারই জীবাণুটা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ বেড়ে যাবে।
“এই যে হাজার হাজার শ্রমিক আসলো, এদের মধ্যে কেউ যদি সংক্রমিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা তার মধ্যে আর থাকবে না। আরও অনেকের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। এই শ্রমিকরা কিন্তু এক জায়গায় বসে থাকবে না। তাদেরকে চাল-ডাল কেনাসহ নানা কাজে বের হতে হবে। সেখানেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
যেসব শ্রমিক ঢাকায় চলে এসেছে, তাদের ঢাকার রাখার ব্যবস্থা করতে বিজিএমইএর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
“ভুল সিদ্ধান্ত যদি বিজিএমইএ নিয়ে থাকে, তার মাশুল তাদেরই দিতে হবে। পাঁচ দিন যদি শ্রমিকরা বসে থাকে, তাহলে এর কমপেনসেশন বিজিএমইএকে দিতে হবে। এর দায় তো শ্রমিকরা নিতে পারে না।”
করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে পড়া রপ্তানি খাত বিশেষ করে পোশাক শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে গার্মেন্ট মালিকরা ২ শতাংশ সুদে এই তহবিল থেকে ঋণ পাবেন।
শনিবার রাতে গার্মেন্ট বন্ধ রাখার আহ্বান জানানোর পর আবু সালেহ রনী নামে একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “শ্রমিকদের ঢাকায় এনে অবশেষে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্টস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ। বিলম্বিত সিদ্ধান্ত, তবুও যদি রক্ষা হয়।”
এদিকে সমালোচনার মুখে থাকা বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক শনিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, কারখানা খোলা কিংবা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক তার সংগঠন নয়।
“বিজিএমইএর কোনো ক্ষমতা নেই ফ্যাক্টরি খোলা বা বন্ধ করার। তারপরেও গতবার আমি অনুরোধ করেছিলাম। তখনও সাথে সাথে এটাও বলতে হয়েছে যে যারা পিপিই বানান এবং যাদের ক্রয়াদেশ রয়েছে তারা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে কারখানা চালাতে পারেন। শ্রম মন্ত্রণালয়, কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরও একই কথা বলেছে।”
শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হেঁটে আসার মতো পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, “আমি শ্রমিকদের উপর কোনো অত্যাচার-অবিচার করিনি, আমার উপর এর দায় চাপাবেন না।
“দয়া করে এবিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকুন। আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে সমস্যার সমাধান করা, কারও দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলা আমাদের লক্ষ্য নয়। এখন আমাদের টিকে থাকার প্রশ্ন, দয়াকরে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না।”
হেঁটে আসা সবাই পোশাক শ্রমিক কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন রুবানা।
“২৫ তারিখে গণপরিবহণ বন্ধ হয়েছে, আমরা কারখানা বন্ধ দিয়েছি ২৬ তারিখে। অধিকাংশ শ্রমিকরা ফ্যাক্টরির আশেপাশে থাকে। যারা ঢাকায় ফিরছে তারা যে পোশাক শ্রমিক এমনটি ধরে নেবেন না।”