গভীর রাতে রাজধানীতে সাংসদপুত্রের এলোপাতাড়ি ‘গুলিতে’ প্রাণ হারানো রিকশা ও অটোরিকশাচালককে হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েছে তাদের পরিবার।
Published : 28 Jun 2015, 10:46 PM
নিহত রিকশাচালক আবদুল হাকিম বাবা-মা ও ছোটভাইকে নিয়ে থাকতেন মধুবাগের একটি গলিতে টিনশেডের ঘরে। পাঁচ বছর আগে বগুড়ায় এক লাখ টাকায় বসতভিটা বেঁচে বোনকে বিয়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন এই যুবক।
হাকিমের (২৫) বাবা ষাটোর্ধ্ব দুদু মিয়াও রিকশা চালাতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজের ক্ষমতা হারিয়েছেন বেশ কিছু দিন। বর্তমানে বগুড়ায় মেয়ের বাসায় আছেন তিনি।
১০ বছর বয়সী ছেলে মঞ্জুরুলকে নিয়ে মধুবাগের ওই বাসায় আছেন হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম (৬০)।
ছেলের মৃত্যুর আগে এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সংসার চালাতে এখন তিন বাসায় কাজ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
তা দিয়েও চলে না সংসার। তাই ছোট ছেলে মঞ্জুরুলকে মধুবাগের একটি রিকশা গ্যারেজে কাজে দিয়েছেন মাসে দেড় হাজার টাকায়।
ছেলের চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বাবা, ট্যাকা যখন লিসি, ফেরত তো দিয়া লাগপেই। কেমনে ট্যাকা ফেরত দিবু জানি না। তয় চেইষ্টা করব।”
গত ১৩ এপ্রিল রাত ২টার দিকে নিউ ইস্কাটনে গুলিতে জনকণ্ঠের অটোরিকশা চালক ইয়াকুব আলীর (৪০) সঙ্গে আহত হয়েছিলেন হাকিম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলা করেছিলেন মনোয়ারা বেগম।
ওই মামলার তদন্তে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে (৪২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ছেলে হত্যার বিচার নিয়ে মনোয়ারা বেগম বলেন, “আমি বাবা মামলা সম্পর্কে তেমন বুঝি না। মামলা তো সরকারে চালেইচ্ছে। ভালো কিসু হইবেক আশা রাখি। যদি ভাল কিসু ফল না পাই তাইলেও তো করার কিসু নাই। আমাগো তো টেকা পয়সা নাই। আমরা মামলায় ভালো ফল না পাইলে কী কইরতে পারি?”
এ মামলায় এক এমপির ছেলেকে গ্রেপ্তারের কথা শুনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পুলিশ ভালো কাম করিসে।”
ছেলে-মা মিলে মনোয়ারা টিকে থাকার লড়াইয়ে থাকলেও অনেকটা উদ্বাস্তু জীবন পার করছেন নিহত অটোচালক ইয়াকুবের স্ত্রী সালমা বেগম (৩৫)।
বাসাবোর নন্দীপাড়ার বটতলা এলাকায় একমাত্র মেয়ে রুনি ও ছোট বোন আসমা বেগমদের বাসার কাছাকাছি ছোট একটি বাসায় স্বামীর সঙ্গে থাকতেন সালমা।
কিন্তু স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর বাসা ভাড়া কে দেবে? সংসার চালানোর খরচই বা আসবে কোথা থেকে? তাই দুই হাজার টাকা ভাড়ার ঘরটি ছেড়ে দেন সালমা।
এরপর মেয়ে রুনীর সংসারে আশ্রয় নেন তিনি। সেখান থেকেই ঢাকা মেডিকেলে স্বামীর দেখাশোনা করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন কোথায় থাকবেন তা নিয়েই উদ্বিগ্ন তিনি।
কয়েক বছর আগে একবার ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “শারীরিক সমস্যার কারণে কাজ করতে পারতাম না। স্বামী আমারে কখনোই কষ্ট দেয় নাই। প্রতিদিন ২০০, ৫০০ যা পারসে দিসে। বাজার সদাই সব কইরা দিসে। কোনো খারাপ অভ্যাস তার ছিল না। এখন আমি কার কাছে যামু? পড়াশোনাও তো জানি না। কী চাকরি করমু?”
সালমা বেগম বলেন, তার স্বামী জনকণ্ঠ পত্রিকার অটোরিকশা চালাতেন। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পত্রিকাটি ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। মারা যাওয়ার পর আরও পাঁচ হাজার টাকা দেয়।
“কিন্তু এই টেকা দিয়া কি কারও চিকিৎসার খরচ মিটে? আমার দেনা হইসে এখন ৭০ হাজার। কেউ এক টেকা দিয়াও সাহায্য করে না।”
ওই রাতে সাংসদপুত্র রনি তার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন জানিয়ে সাংসদপুত্রের সঙ্গে সে সময় গাড়িতে থাকা তিন বন্ধু ও গাড়িচালক ইমরান ফকির আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলায় দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে রনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তৃতীয় দফায় আবারও হেফাজতে পেতে রোববার আবার আদালতে আবেদন করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
“পুলিশ তার পেশাদারি মনোভাব নিয়ে মামলাটি তদন্ত করেছে। মামলাটির তদন্ত প্রক্রিয়া এখন শেষ পর্যায়ে আছে,” বলেছেন মামলার তদারক কর্মকর্তা ডিবির ডিসি মাশরেকুর রহমান খালেদ।