আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের শুনানি শুরু হবে ১ এপ্রিল।
Published : 09 Mar 2015, 08:22 AM
সোমবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ শুনানির এই তারিখ ঠিক করে দেয়।
এই বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
আসামিপক্ষে এ সময় আদালতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মৌলভী ওয়াহেদ উল্লাহ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রিভিউ শুনানির জন্য চার সপ্তাহ সময় চেয়ে রোববারই একটি আবেদন সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছিলেন আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
ওয়াহেদ উল্লাহ শুনানিতে বলেন, “আমি অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নাল আবেদীনের পক্ষে এসেছি। আমাদের সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে শুনানি করতে পারছেন না।”
এ পর্যায়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, “বিচার রিভিউ দায়েরের জন্য ১৫ দিন সময় দিয়েছি। এরপরও সময় চান কেন? শুনানি মুলতবির কোনো সুযোগ নেই।”
বিচারক প্রশ্ন করেন, “অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড কোথায়? এটাতো প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে দেওয়া দায়িত্ব।
“সংসদ আইনে ৬০ দিনের সময় দিয়েছে। যদিও এটা বাধ্যতামূলক না। কিন্তু এটা তাদের একটা প্রকাশ ছিল।”
আদালত এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের মত চাইলে তিনি বলেন, “এখানে দ্রুত শেষ করার নিয়ম আছে। সিনিয়র অ্যাডভোকেটের অসুবিধা আছে। এ মামলায় এসএম শাহজাহান সাহেব ছিলেন। উনিওতো সিনিয়র।”
এ সময় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, আবেদনে খন্দকার মাহবুব হোসেনকেই দায়িত্ব দেওয়া আছে।
এরপর তিনি রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য ১ এপ্রিল দিন রাখেন।
গতবছর ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের এই বেঞ্চই ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখে। ২০১৩ সালের ৯ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজার আদেশ দেয়।
একাত্তরে ময়মনসিংহের আল বদর নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় এসেছে শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুরে ১২০ জন পুরুষকে ধরে নিয়ে হত্যার দায়ে।
জামায়াতে ইসলামীর আজকের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের আগে রিভিউয়ের পর্যায়ে এসেছে।
আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর তিন বিচারক। এরপর মৃত্যু পরোয়ানা পাঠিয়ে দেওয়া হয় কারাগারে, কামারুজ্জামানকে তা পড়ে শোনানো হয়।
মৃত্যু পরোয়ানা জারির চতুর্দশ দিনে গত ৫ মার্চ আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিভিউ আবেদন জমা দেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী জয়নাল আমিন তুহিন। ৪৫ পৃষ্ঠার এই আবেদনে ৪৪টি যুক্তি দেখিয়ে কামারুজ্জামানের খালাস চাওয়া হয়।
কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আপিল বিভাগের রায়ে একজন বিচারক দণ্ডের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তার পয়েন্টগুলো ধরেই এই রিভিউ আবেদন করা হয়েছে।
আসামিপক্ষ রিভিউয়ের আবেদন করায় কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ইতোমধ্যে জানিয়েছেন।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারে। কামারুজ্জামান তেমন কোনো আবেদন করলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
মাহবুবে আলম বলেন, যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না। কাদের মোল্লার রিভিউয়ের রায়েও এ কথাই বলা আছে।
যে অভিযোগে ফাঁসির রায়
জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মোট সাতটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এর মধ্যে তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গণহত্যা ও ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফা তালুকদারের হত্যার ঘটনা রয়েছে।
প্রথম অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ির কালীনগরের বদিউজ্জামানকে হত্যা এবং সপ্তম অভিযোগে রোজার দিনে টেপা মিয়ার ছেলেসহ পাঁচজনকে হত্যার কথা রয়েছে। এ দুই অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন দেয়।
এছাড়া শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতনের ঘটনায় দ্বিতীয় অভিযোগে তার ১০ বছরের সাজা হয়।
পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।
আপিলের রায়ে প্রথম অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দ্বিতীয় ও সপ্তম অভিযোগে সাজা বহাল থাকে।
তৃতীয় অভিযোগে আসামির অপরাধের বিষয়ে চার বিচারপতি একমত হলেও মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।
বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া সোহাগপুর গণহত্যায় কামারুজ্জামানকে অভিযুক্ত করলেও এ অভিযোগে তিনি তাকে যাবজ্জীবন দণ্ডের পক্ষে মত দেন। সেই সঙ্গে ১, ২, ৪, ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া দণ্ড থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়ার পক্ষে মত দেন তিনি।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) এসকে সিনহা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে মত দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আসামির দণ্ড নির্ধারিত হয় মৃত্যুদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়।
এর আগে আপিল বিভাগে আসা যুদ্ধাপরাধের প্রথম মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের সাজা বাড়িয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেলে দণ্ড কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।
আর আপিলে আসা দ্বিতীয় মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি এখনো প্রকাশিত হয়নি।
কামারুজ্জামানের ‘রিভিউ’ পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আসছে সোমবার
কামারুজ্জামানের রিভিউ: শুনানির তারিখ জানা যাবে রোববার
শুনানিতে ‘তাড়াহুড়া’ চান না কামারুজ্জামানের কৌঁসুলিরা
কামারুজ্জামানের সঙ্গে পরিবারের সাক্ষাৎ
‘কামারুজ্জামানের দাফন শেরপুরে নয়’
লাল সালুতে মোড়া কামারুজ্জামানের মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে