চট্টগ্রাম আদালতে আধা ঘণ্টা শুনানি, গণ্ডগোল আইনজীবীদের সভায়

২৬ বছরের অচলায়তন ভেঙে হরতালে দ্বিতীয় দিনের মতো এজলাসে উঠেছেন চট্টগ্রামের আদালতের বিচারকরা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2015, 10:38 AM
Updated : 2 March 2015, 10:38 AM

সোমবার সকালে বেশ কয়েকটি আদালতের বিচারকরা শুনানি নিলেও এক পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদের বাধায় তারা এজলাস ছেড়ে যান।

অন্যদিকে হরতালে বিচারকাজ চালাতে আইনজীবী সমিতিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা তলবি সভা করতে গেলেও তা ভণ্ডুল হয়ে যায় সরকারবিরোধী আইনজীবীদের বাধায়।

সরকার সমর্থক আইনজীবীরা হরতালে শুনানিতে অংশ না নেওয়ার পুরনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে জেলা আইনজীবী সমিতিকে পাঁচ দিন সময় বেঁধে দিয়েছেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির এক সিদ্ধান্ত অনুসারে হরতালে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন না। তাই বিচারকরাও এজলাসে বসেন না।

বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকা অবরোধের মধ্যে হরতাল আহ্বানের পর থেকে চট্টগ্রামের আদালতে বিচারকাজ চলছিল না; যদিও এর মধ্যেই বিভিন্ন জেলা আদালতের পাশাপাশি উচ্চ আদালতেও চলছে বিচারকাজ।

এরপর রোববার চট্টগ্রাম আদালতের জেলা ও দায়রা জজ এবং বিভাগীয় বিশেষ জজ এজলাসে উঠলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদের বাধার মুখে পড়েছিলেন।

আগের দিনের মতো সোমবার সকাল ১০টায়ও এজলাসে ওঠেন মহানগর দায়রা জজ ওবায়দুস সোবহান, জেলা ও দায়রা জজ নুরুল হুদা, বিভাগীয় বিশেষ জজ আতাউর রহমান, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক রেজা তারিক আহমেদসহ বেশ কয়েকজন বিচারক। এসময় পুলিশ প্রহরাও ছিল।

চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফখরুদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আধা ঘণ্টা ধরে তারা (বিচারকরা) বিভিন্ন মামলার শুনানি করেন।

“পরে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবীরা এসে মহানগর দায়রা জজকে জানান, মঙ্গলবার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সভা আহ্বান করা হয়েছে। তাদের অনুরোধে বিচারক এজলাস ত্যাগ করেন।”

বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ নেতা মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনিসহ বিভিন্ন মামলায় আসামি পক্ষের বেশ কয়েকজন আইনজীবী এজলাসে ছিলেন।

“আদালত কার্য তালিকায় থাকা অধিকাংশ মামলার শুনানি করেছেন। পরে কয়েকজন আইনজীবী এসে অনুরোধ জানালে তিনি এজলাস ছেড়ে যান।”

আইনজীবী এবং আদালতের নাজির ও পেশকাররদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার চট্টগ্রাম আদালত ভবনের ৬৪টি আদালতের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিচারক অল্প সময়ের জন্য হলেও এজলাসে উঠেছিলেন।

রোববার আদালত প্রাঙ্গণে সরকারবিরোধী আইনজীবীদের মিছিল

রোববার এজলাসে বিচারকরা বসায় হট্টগোল, মিছিল ও সমাবেশ করলেও সোমবার বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সকালে আদালতে দেখা যায়নি।

ঐক্য পরিষদ নেতা এ কিউ এম নুরুল ইসলাম পৌনে ১১টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখনও আদালতে যাইনি।”

আরেক নেতা আবদুস সাত্তার একই সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি রাস্তায়। আদালতের দিকে যাচ্ছি।”

তলবি সভায় গণ্ডগোল

হরতালে আদালতের কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে সমিতির সরকার সমর্থক আইনজীবীদের ডাকা তলবি সভা বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের বাধায় ভণ্ডুল হয়ে গেছে।

সোমবার দুপুর সোয়া ১টায় চট্টগ্রাম আদালত ভবনের ৩ নম্বর বার মিলনায়তনে এ সভা শুরু হয়। দেড়টার দিকে সরকারবিরোধী আইনজীবীরা গিয়ে সভা ভণ্ডুল করে দেন।

ওই তলবি সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন আইনজীবী মঈনুল হক চৌধুরী খোকন। সভাপতির বক্তব্যে সভা শুরুর পর অন্য দুই জন আইনজীবী বক্তব্য দেন। এরপরই সভা পণ্ড হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগ সমর্থক এক আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সমিতির গঠনতন্ত্রের ৪৬ ধারা অনুসারে ১০০ জন আইনজীবী সমিতি বরাবরে আবেদন করে তলবি সভা আহ্বান করতে পারে।

“নিয়ম অনুসরণ করেই তলবি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা সভায় প্রবেশ করে হামলা চালায়।”

সমন্বয় পরিষদ নেতা মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “সভায় ওই আইনজীবীরা বক্তব্য রাখতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা সভার কার্যক্রমে বাধা দিয়েছেন।”

এ বিষয়ে আইনজীবী ঐক্য পরিষদ নেতা আবদুস সাত্তার বলেন, “মঙ্গলবার এ বিষয়ে সভা আছে, এর মধ্যে তলবি সভা আহ্বান করায় সাধারণ আইনজীবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তলবি সভা ভণ্ডুল করে দিয়েছেন।”

সভায় উপস্থিত একাধিক আইনজীবী জানান, বেলা দেড়টার দিকে ৭০-৮০ জনের আইনজীবীদের একটি দল তলবি সভাস্থলে আসেন। তারা কোনোরকম কথাবার্তা না বলেই সভাস্থলে থাকা চেয়ার ভাংচুর করেন এবং মাইক সরিয়ে নেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশানর (প্রশিকিউশন) কাজী মুত্তাকি ইবনু মিনান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সভার বিষয়ে বা ভণ্ডুল হওয়ার বিষয়ে আইনজীবীদের কোনো পক্ষই তাদের কিছু জানায়নি।

তলবি সভার আগে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা আরেকটি সভা করে, যাতে হরতালে আদালতের কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে আইনজীবী সমিতিকে ৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম আদালতের ১ নম্বর বার মিলনায়তনে ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা আদালতের পিপি আবুল হাশেম।

উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পিপি নুরুল আলম চৌধুরী, অনুপম চক্রবর্তী, বিধান কুমার বিশ্বাস, পিপি জেসমিনা আক্তার, আইনজীবী মো. হাসানসহ সমন্বয় পরিষদের প্রায় দেড়শ আইনজীবী।

পিপি আবুল হাশেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাধারণ আইনজীবীরা আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রমের পক্ষে। প্রায় দুই মাস ধরে বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

“এ কারণে বিচার প্রার্থীরা বিচারের সুযোগ বঞ্চিত আর আইনজীবী উপার্জন বন্ধ হওয়ায় কষ্টে দিন যাপন করছেন। অবরোধ-হরতাল তো সারাদেশে হচ্ছে। এর মধ্যে হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে বিএনপির আইনজীবীরাও তো অংশ নিচ্ছেন।”

“বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও দলের শীর্ষ নেতারা আইনজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতে যাচ্ছেন। তাহলে চট্টগ্রামে কেন তারা আদালতের কাজে অংশ নিতে পারবেন না?”

পুরনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সমিতিকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জানিয়ে আবুল হাশেম বলেন, এর মধ্যে এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা না এলে ৮ মার্চ থেকে সাধারণ আইনজীবীরা আদালতের কাজে যোগ দেবেন।

গত ৬ জানুয়ারি থেকে ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধের দিনগুলোতে আদালতের কার্যক্রম চললেও হরতালের দিনগুলোতে কার্যত অচল ছিল চট্টগ্রাম আদালত।

পুরো ফেব্রুয়ারি মাস হরতাল থাকার পর ১ মার্চ ২৬ বছরের রীতি ভেঙে এজলাসে আসেন বিচারকরা।

এ অবস্থার নিরসনে গত ২২ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি সমিতির সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবীদের বিভিন্ন পক্ষের নেতারা বৈঠক করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মঙ্গলবার এ বিষয়ে পরবর্তী বৈঠক হবে।

সমিতির নেতা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, ২৬ বছর আগের ওই সিদ্ধান্ত ছিল ‘মৌখিক’। এর কোনো লিখিত অনুলিপির সন্ধান পাচ্ছে ‍না সমিতি।