জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও লুটপাটের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের নয়টি অভিযোগ রয়েছে।
Published : 17 Feb 2015, 10:32 PM
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল বিকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি বহর পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সহায়তায় জ্বালাও-পোড়াও, গোলাবর্ষণ করে হত্যাকাণ্ড চালাতে চালাতে পাবনা শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করে। ওই দিনই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দল ঈশ্বরদী এসে এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচানোর জন্য জনাব মতলেব আহমেদ খান, নাজমুল হক খান, আ.ত.ম শহিদুজ্জামান নাসিম, মোয়াজ্জেম হোসেন, আজিজুল হক, বাবর আলী সরদার, আজহারউদ্দিন, রফিক পাটোয়ারী ও বারেক খলিফাসহ প্রায় দুইশ’ নিরীহ-নিরস্ত্র লোক ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আসরের নামাজের আগে আগে আসামী মওলানা সুবহান তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে একটি প্রাইভেটকারযোগে ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আসে। পাকিস্তানীদের স্থানীয় সহযোগী খোদাবক্স খানসহ বিহারীদের সাথে আলাপ-আলোচনা ও যুক্তি-পরামর্শ করার পরে আসামি সুবহান তাদেরকে নিয়ে আসরের নামাজের আগেই ওই মসজিদে ঢুকে। আসরের নামাজশেষে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বক্তব্য দেন এবং বলেন যে, যারা পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এরপর ওইদিন রাতে মওলানা সুবহান তার সহযোগিদের নিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া আওয়ামী লীগ সমর্থক মোয়াজ্জেম হোসেনকে সনাক্ত করে তাকে মসজিদ থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরদী রেলওয়ে কয়লার ডিপোতে নিয়ে ছুরি, চাকু ও তরবারি দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে পাবনা শহরের দিকে চলে যায়।
পরের দিন ১৮ এপ্রিল বেলা অনুমান ১১টার দিকে আসামী সুবহান পুনরায় উক্ত মসজিদে এসে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের মধ্যে হতে আওয়ামী লীগ সমর্থক মতলেব আহমেদ খান ও তার ছেলে নাজমুল হক খানকে মসজিদ থেকে পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরদী রেলওয়ে কয়লার ডিপোতে নিয়ে ছুরি, চাকু ও তরবারি দিয়ে আঘাত করে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া অন্তত ২০ জনকে সুবহানের নির্দেশে রেলওয়ে কয়লার ডিপো ও আশেপাশে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে ২০ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাবনার ঈশ্বরদীর থানার পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা, বাঘাইর ও গোপালপুর গ্রামে আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও বিহারীরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঈশ্বরদী থানাধীন গোপালপুর ও বাঘইর গ্রামে অভিযান চালিয়ে গোপালপুরের কোরবান আলীর বাড়িসহ আশেপাশে কয়েকটি বাড়িতে লুটপাটসহ বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং বাঘইর গ্রামের আইজউদ্দিনের বাড়ি হতে তার স্ত্রী তুলু খাতুন, ছেলে ইসরাইল ও ভাই তাইজউদ্দিনকে অপহরণ করে। এই সময় ওই গ্রামের নিরীহ-নিরস্ত্র লোকজন আর্মিদের ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে পালায়।
এরপর মওলানা তার নেতৃত্বে আর্মিরা বেলা আনুমানিক ১১টার দিকে পার্শ্ববর্তী যুক্তিতলা গ্রামে গিয়ে জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, রুস্তম আলী, হারেছ উদ্দিন প্রামাণিক ও ইসমাইল হোসেনদের ধরে ১৮ নং যুক্তিতলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে এসে লাইন ধরে দাঁড় করায়। পাকিস্তানী সেনারা আটককৃতদের উপর গুলি করলে জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, ইসমাইল হোসেন, হারেছউদ্দিন ও তাইজউদ্দিন মারা যায়। রুস্তম আলী, ইসরাইল ও তুলু খাতুন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।
এছাড়া সুবহান মওলানা ও আর্মিরা ওইদিন বেলা ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী গোপালপুর ও যুক্তিতলা গ্রামে সহ আশেপাশে গ্রামে অভিযান চালিয়ে অনেক লোকজনকে হত্যা করে ও অনেক বাড়িঘরের মালামাল লুটপাটসহ অনেকের বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালেল আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৪(১) ও ৪(২) ধারায় অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের নিয়ে ঈশ্বরদী থানাধীন অরণখোলা গ্রামে গিয়ে আলাউদ্দিন, রিয়াজউদ্দিন মণ্ডল,তার বাবা জয়নুদ্দীনদের খোঁজাখুঁজি করে। তাদের না পেয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ,অপহরণ,অবৈধ আটক ও নির্যাতন।তাদের ঘরে থাকা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, তামা-কাসার বাসনপত্রসহ অন্যান্য মালামাল লুটপাট করে বাড়িতে আগুন দিয়ে সবকয়টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। একইদিন থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তারা ঐ গ্রামের আছের আলী প্রামাণিক, জেহের আলী খাঁ, আব্দুর ছাত্তার বিশ্বাস, ময়েজউদ্দিনদের বাড়িসহ হিন্দুপাড়ার হিন্দুদের বাড়ির মালপত্র লুটপাট করে ও বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ সালে ১৬ মে বিকাল ৪টার দিকে আসামি সুবহান তার সহযোগী স্থানীয় বিহারীদের নিয়ে অরণখোলা গরুরহাট থেকে অরণখোলা গ্রামের জয়নুদ্দিন ও আনসার কমান্ডার আলাউদ্দিন মিয়াকে অপহরণ করে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোতে (ঈশ্বরদী, পাবনা) নিয়ে তিনদিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করে। তাদের পরিবারের লোকজনের অনুরোধ ও কান্নাকাটিতে সুবহান শ্বরদী ডাক বাংলা ক্যাম্পে আর্মি অফিসারের কাছে ফোন করে ওই দুইজনকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তার অনুরোধে জেলা পরিষদ ডাকবাংলা থেকে ১৯ মে বিকাল ৪টার দিকে তাদের মুক্তি দেয়া হয়।
এ ঘটনায় আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২) (জি), ৩(২) (এইচ), ৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় মতে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ২ মে ফজরের নামাজের পর থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামি আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে খোদাবক্স খান, স্থানীয় বিহারী ও পাকিস্তানী আর্মি বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঈশ্বরদী থানাধীন সাহাপুর গ্রামের গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ওইসময় গ্রামের লোকজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে পালাতে থাকে।
ওইদিন ফজরের নামাজের পর মওলানা সুবহানের উপস্থিতিতে পাকিস্তানী সেনারা সাহাপুরের হারু ব্যাপারীর বাড়ির সামনের রাস্তায় চাঁদআলী প্রামাণিক, আকতার প্রামাণিক, আনার প্রামাণিক ও হামেজ উদ্দিন প্রামাণিকদের গুলি করে হত্যা করে। তারা সকাল ৭টার দিকে রজব আলী বিশ্বাসের বাড়ির পাশে বাঁশবাগানে রজব আলীসহ তার বন্ধু শামসুল হককে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও ঐ দিন সাহাপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলী সরদারসহ অনেককে পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। ওইসময় চাঁদআলী প্রামাণিক, অধ্যক্ষ তৈয়ব হোসেন ও রহমান সরদারদের বাড়িসহ ১০/১৫টি বাড়িঘরের মালামাল লুটপাট করে ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এ ঘটনায় আসামি আব্দুস সুবহানের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩(২)(এ),৩(২) (জি),৩(২) (এইচ),৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ১১ মে সকাল ১০টার দিকে মওলানা সুবহান তার কয়েকজন সহযোগীসহ গাড়িযোগে দোগাছি ও কুলনিয়া গ্রামে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়ে পাবনা শহরে ফিরে আসে। ওইদিনই বেলা ১১টার দিকে মওলানা সুবহান পাবনা শহর থেকে প্রায় ১০/১২টি গাড়িযোগে অনুমান দুইশ’ পাকিস্তানী সেনা নিয়ে কুলনিয়া গ্রামের নিরীহ-নিরস্ত্র লোকজনের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানী সেনারা কুলনিয়া গ্রামের সমজুদ্দিন প্রামাণিক ও আমিনুদ্দিনের স্ত্রী হাসিনাকে তাদের বাড়ির পশ্চিম পাশে বাঁশবাগানে গুলি করে হত্যা করে। ওইসময় সেনাদের গুলিতে সমজুদ্দিনের স্ত্রী রাহাতন নেসা গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। কয়েকদিনের মধ্যে সে মারা যায়। সমজুদ্দিনের বাড়ির পাশেই তাকে দাফন করা হয়।
পরে বেলা ১২টার দিকে পার্শ্ববর্তী দোগাছি গ্রামে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ চালায়। তারা হরিপদ সাহার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গিরিপদ সাহাকে গুলি করে হত্যা করে এবং হরিপদের বাড়ি ও মন্দির আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে দোগাছি বাজারের রাস্তার উপর বেনু সাহা ও হরিপদ সাহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর মওলানা সোবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী আর্মিরা দোগাছি পশ্চিম পাড়া গিয়ে চাঁদ আলী প্রামাণিকের বাড়ির পাশে অবস্থিত দোগাছি জামে মসজিদে চাঁদ আলী প্রামাণিকসহ অন্য কয়েকজনকে হত্যা করে এবং চাঁদ আলী প্রামাণিকের বাড়িঘর পোড়াইয়া দেয়। চাঁদ আলী প্রামাণিককে তাদের বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। অন্যান্যদের লাশ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ে দাফন করে।
এ ঘটনায় আসামি সুবহানের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) (এইচ),৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ১২ মে ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাবনার সুজানগর থানাধীন সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের মোমরাজপুর, কুড়িপাড়া, তারাবাড়িয়া, ফকিৎপুর, সাতবাড়িয়া, কন্দর্পপুর, সিন্দুরপুর, নিশ্চিন্তপুর, গুপিনপুর, হরিরামপুর, শ্যামনগর, নাড়–হাটি, সিংহনগর, ভাটপাড়া ও গুপিনপুর গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতাকামী নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ জনগনের উপর অভিযান চালিয়ে অনুমান ৪ ’শ লোককে অপহরণ, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় মওলানা সোবহানের নেতৃত্বে আনুমানিক তিনশ’ পাকিস্তানি সেনা।
মওলানা সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী আর্মিরা সাতবাড়িয়া ইউনিয়নে অভিযান চালিয়ে চলে গেলে স্থানীয় লোকজন পদ্মা নদীর পাড় হতে আহতদের উদ্ধার করে। নিহত অনেকের লাশ তার আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে নিয়ে দাফন করে এবং জ্ঞাত-অজ্ঞাত অনেকের লাশ কন্দর্পপুর গ্রামে গণকবর দেয়। সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে নিহতদের লাশ ঐ স্থানেই গণকবর দেওয়া হয় এবং কুড়িপাড়া প্রাইমারী স্কুলের সামনে পড়ে থাকা নিহতদের লাশ তাদের আত্মীয়-স্বজন ঐ গ্রামেই দাফন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মওলানা সুবহান ও পাকিস্তানী বাহিনীর ভয়ে সাতবাড়িয়া এলাকার হাজার হাজার নিরীহ জনতা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
এ ঘটনায় আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) (এইচ), ৩(২)(সি)(জি)(এইচ,৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা এবং গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ২০ মে সকাল ৮টার থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পাবনা জেলার সদর থানাধীন ভাড়ারা গ্রামের শহীদ রুস্তম শেখের বাড়িসহ অন্যান্যদের বাড়ি, ভাড়ারা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ, নূরপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আটঘরিয়া থানাধীন দেবত্তোর বাজারের দক্ষিণ পাশের বাঁশঝাড়ে মওলানা সুবহান নেতৃত্বে আনুমানিক অনুমান দুইশ’ পাকিস্তানী সেনা হত্যা, ও গণহত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন চালায়। এসময় আবদুস সুবহানের সহযোগিতায় পাকিস্তানী সেনারা আব্দুল জব্বার, সিরাজ শেখ, নুরুল ইসলাম শেখ, রুস্তম শেখ ও আব্দুল মজিদুল শেখদের তাদের নিজ বাড়ি হতে এবং তালেব শেখ, আকবর শেখ, হারুন-অর-রশিদ, মানিক খাঁ, উটকেন শেখ, কাদের শেখ, খেদন শেখ, কাদের শেখ-পিতা-শহীদ খেদন শেখ, গেদন সরদার, দেলবার শেখ, ইয়াদ আলী সরদার ওরফে কেতা সরদার, হাকিম সরদার ও সিরাজুদ্দিন শেখদেরকে তাদের বাড়ি ও গ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অপহরণ করে ভাড়ারা স্কুল মাঠে মসজিদের সামনে নিয়ে যায়। উক্ত স্থানে মওলানা সুবহানের উপস্থিতিতে পাকিস্তানী আর্মিরা মজিদুল হককে গুলি করে হত্যা করে। অভিযান কালীন সময়ে পাকিস্তানী আর্মিরা ভাড়ারা গ্রামের কালি কমল পালকে তার নিজ বাড়িতে হত্যা করে। মজিদুলকে হত্যা করার পর মওলানা সুবহান ও আর্মিরা অপহৃত অন্য সকলকে আর্মিদের গাড়িযোগে পাবনা শহরস্থ নূরপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে আটক ও নির্যাতন করে। আর্মিরা চলে গেলে মজিদুল হকের গ্রামের লোকজন ভাড়ারা কবরস্থানে তার লাশ দাফন করে এবং কালি কমল পালের লাশ শ্বশানে পোড়ায়।
পরেরদিন ২১ মে ১৯৭১ সালে বেলা ২টায় অপহৃত রুস্তম শেখ, জব্বার শেখ, সিরাজ শেখ, নুুরুল ইসলাম শেখ, হারুন শেখ, তালেব শেখ, উটকেন শেখ, মানিক খাঁ, দেলবার শেখ, আকবর শেখ ও সিরাজউদ্দিনসহ মোট ১১ জনকে পাকিস্তানী আর্মিরা গাড়িতে করে আটঘরিয়া থানাধীন দেবত্তোর বাজারে যায়। সেখানে সিরাজউদ্দিন শেখকে ছেড়ে দিয়ে বাকী ১০ জনকে নিয়ে আর্মিরা দেবত্তোর বাজারের পূর্বপাশে একটি বড় বাঁশবাগানের ভিতরে ঢুকে এবং সবাইকে এলোপাথারিভাবে গুলি করে। এতে জব্বার শেখ, সিরাজ শেখ, নুরুল ইসলাম শেখ, হারুন শেখ, উটকেন শেখ ও তালেব শেখ তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করে এবং মানিক খাঁ, রুস্তম শেখ, দেলবার শেখ ও আকবর শেখ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে। সবাইকে মৃত মনে করে আর্মিরা দ্রুত চলে যায়।
এ ঘটনায় আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ),(জি) ও (এইচ), ৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের যে কোনো দিন বেলা ২টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত সঙ্গীয় কয়েকজন রাজাকারসহ একটি গাড়িযোগে দুবলিয়া বাজারস্থ রাজাকার ক্যাম্পে আসে এবং দুবলিয়া বাজারের গোবিন্দের চায়ের দোকান থেকে পাবনা জেলার সদর থানাধীন চরতারাপুর টাটিপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক কলিমউদ্দিন খাঁসহ অপর একজন লোককে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটক করে অমানুষিক নির্যাতন করে। ওইদিনই সন্ধ্যা সময় মওলানা সুবহান ও তার সঙ্গীয় রাজাকাররা কলিমউদ্দিনকে তার সাথে আটককৃত একজনসহ গাড়িতে করে পাবনা শহরের দিকে চলে যায়। মওলানা সুবহান তার সঙ্গীয় রাজাকাররা পরেরদিন সকাল ১০টার দিকে কলিমউদ্দিন ও আটককৃত লোকটিকে গাড়িযোগে সদর থানাধীন (বর্তমান আতাইকুলা থানা) কুচিয়ামাড়া গ্রামে রাধা গোবিন্দ কালি মন্দিরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সুবহান রাজাকারদের নিয়ে চলে গেলে কলিমউদ্দিনের আত্মীয়-স্বজন তার লাশ এনে শ্রীকোল দেয়ারপাড়া গ্রামে দাফন করে।
এ ঘটনায় ১৯৭৩ সালের আন্তার্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), (জি)ও (এইচ,৪(১),৪(২) ও ২০(২) ধারায় অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ৯: ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে মওলানা সুবহানের নেতৃত্বে ঈশ্বরদীর খোদাবক্স খান ও ইসহাক রাজাকারসহ স্থানীয় ৫০/৬০ জন রাজাকার গাড়ি নিয়ে বেতবাড়িয়া গ্রামে এসে অভিযান চালায়। মওলানা সুবহান রাজাকারদের নিয়ে বেতবাড়িয়া সাকিনে সফিউদ্দিনের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে ধরে ফেলে এবং তার বাড়িতে লুটপাটসহ বাড়িঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ওইদিন মওলানা সুবহান তার সঙ্গের কয়েকজন রাজাকার নিয়ে সকাল টার দিকে পার্শ্ববর্তী রামনাথপুর গ্রামে সাবেদ আলীর বাড়িতে প্রবেশ করে উক্ত বাড়ির লোকজনদেরকে মারধর করে এবং সাবেদ আলী পুত্র ওসমানকে রশি দ্বারা পিঠ মোড়া বাধ দিয়ে আম গাছের সাথে বেধে রাখে। রাজাকাররা তাদের বাড়িতেও লুটপাট করে ও আগুন দিয়ে বাড়িতে থাকা ৭/৮টি ছনের ঘর পুড়িয়ে দেয়।
মওলানা সুবহানের নেতৃত্বে রাজাকাররা বেতবাড়িয়া ও রামনাথপুর গ্রামে সকাল ১০টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে সফিউদ্দিন প্রামাণিক, সাবেদ আলী প্রামাণিক, খবিরউদ্দিন সরদার, তোফাজ্জল বিশ্বাসদের বাড়িসহ ১০/১২টি বাড়িতে লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অভিযানের সময় রাজাকাররা বেতবাড়িয়া গ্রামের ভাদু ও বয়না নামক দুইজনকে আটক করে। অভিযানশেষে মওলানা সুবহান ও রাজাকাররা আটককৃত শফিউদ্দিন প্রামাণিক, ওসমান, ভাদু ও বয়নাকে ঈশ্বরদী মূলাঢুলী সাকিনের মওলানা ইসহাক রাজাকারের বাড়ি সংলগ্ন সিএসডি গুদামের পাশে শান্তি কমিটির অফিসে নিয়ে আটকে রাখে। তিনদিন পর রাজাকাররা তাদেরকে ঈশ্বরদী থানার সামনে ডাক বাংলায় আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। তাদের লাশের কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।
এ ঘটনায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(সি)(জি)(এইচ),৪(১), ৪(২) ও ২০(২) ধারায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।