একের পর এক পেট্রোল বোমা, আগুন আর হাতবোমায় সাধারণ মানুষ হতাহতের ঘটনায় অবরোধ আহ্বানকারী খালেদা জিয়ার হৃদয়ে কি কোনো বেদনার সৃষ্টি হয় না?-এ প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
Published : 17 Feb 2015, 01:55 PM
দেড় মাসের অবরোধের আগুনে পুড়ে নিহতদের স্বজন এবং দগ্ধদের যন্ত্রণার কথা শোনার পর এ প্রশ্ন করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে যারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মঙ্গলবার জাতীয় জাদুঘরে ‘বিএনপি-জামাতের অগ্নি সন্ত্রাস-লুণ্ঠিত মানবতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা বলেন, “আমি সকলকে বলব- অন্তত বিএনপি নেত্রীকে বলেন, মানুষের লাশের, মানুষ খুনের রাজনীতি বন্ধ করেন।
“আমরা মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। আমরা দেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। এভাবে, নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
রাশিয়া, ভারত, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ভুটান, লিবিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভ্যাটিকান, চীন, ওমান, মালদ্বীপ, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের কূটনীতিক ও প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
গত ৫ জানুয়ারি অবরোধ শুরুর প্রায় তিন সপ্তাহের মাথায় ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেলে শোকাহত খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশানে তার কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় দরজা না খোলায় কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “কোনো মায়ের কান্না কী তার বুকে বাজে না? একটু বুঝে না? একটুও মন কাঁদে না?
“যারা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা শুরু করেছে- তারা মানুষের কল্যাণ চাইতে পারে না।”
উপস্থিত অগ্নিদগ্ধদের দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এরা তো কোনো রাজনীতির সাথে নেই। এই নিরীহ মানুষের ওপর কেন হামলা?”
জামায়াতে ইসলামী ধর্মের নামে ‘ভাওতাবাজি’ করছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “দোজখের আগুন কেন জীবন্ত মানুষকে দেখতে হবে? কেন এই ছিনিমিনি খেলা?”
শেখ হাসিনা বলেন, “যারা মানুষকে পুড়িয়ে মারছে- তারা আল্লাহর বিচারের ভার নিজেরাই নিয়ে নিয়েছেন।
“এটা কোন সংজ্ঞায় রাজনীতি বলবেন? পেট্রোল দিয়ে মানুষ হত্যা। আমি তো কোনো সংজ্ঞা খুঁজে পাই না। এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।”
দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে দেশের বিবেকবান মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশে কেনো জঙ্গি-সন্ত্রাসীর স্থান হবে না। এর বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।”
গত ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোল বোমায় অগিদগ্ধ হয়ে নুরুজ্জামান পপলু ও তার মেয়ে মাইশা মারা যান। অনুষ্ঠানে মাইশার মা মাফরুহা বেগম তার স্বামী ও মেয়ের শহীদের মর্যাদা দাবি করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, “এরা তো শহীদের মর্যাদাই পাবে।”
অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে অগ্নিদগ্ধদের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং আলোচনার আগে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর আগুন-বোমায় আক্রান্তদের মর্মস্পশী বর্ণনা শুনে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই কাঁপাকাঁপা গলায় বলেন, “আসলে বক্তব্য দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই।”
অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের উপস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদও করা হলেও তিনি সেটা পড়েননি।
সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, গত ৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত পেট্রোল বোমা ও ককটেল হামলায় নিহত হয়েছেন ৫৫ জন, আহত হয়েছেন ৫৫৬ জন।
এ সময় ৬৬৪টি যানবাহন পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪১০টি যানবাহন ভাংচুর করেছে অবরোধ সমর্থকরা। ২৮টি স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রেলপথে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ২৫টি; নৌপথে ছয়টি।
“আর কত? কোথায় থামবে? কেন মানুষকে পুড়িয়ে মারা? এদের কি একটুও মানবিকতা নেই?”
বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে সংলাপের আহ্বানকারীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার একটা অনুরোধ থাকবে, এক পাড়ে ফেলবেন না।”
“দয়া করে এক পাড়ে আমাকে ফেলবেন না,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমি রাজনীতি নিজের জন্য করি না। কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই আমার। এর প্রমাণ আমাকে দিতে হবে না। আমি রাজনীতি করি দেশের মানুষের জন্য। এই দেশের মানুষের জন্য আমার বাবা-মা, ভাই জীবন দিয়ে গেছে। কত শহীদ রক্ত দিয়ে গেছে। এই দেশের মানুষকে আমি একটা সুন্দর জীবন দিতে চাই। সেজন্যই, আমার রাজনীতি।
“আমার একান্ত অনুরোধ, খুনিদের সাথে, যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে- তাদের সঙ্গে আমাকে এক পাড়ে ফেলবেন না। এটা আমার জন্য সব থেকে কষ্টের। আমাকেও তো হত্যার চেষ্টা করেছিল।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বহু বাধা পেরিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি দেশকে নিয়ে।
“দেশের মানুষের একটা সুন্দর জীবনের জন্য দিনরাত কাজ করছি। কিন্তু সেই মানুষগুলোকে যদি এভাবে পুড়িয়ে মারে, তাহলে এর থেকে কষ্টের কী থাকতে পারে?”
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শেষে আবারো উপস্থিত দগ্ধ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম পরে সভাপতির বক্তব্য রাখেন।
আগামী এক সপ্তাহ চিত্র প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।