মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে আলবদর বাহিনীর যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যিনি, সেই জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে রংপুর অঞ্চলে গণহত্যা চালিয়ে অন্তত ১৪০০ লোককে হত্যা এবং ১৪ জনকে খুনের অপরাধে।
Published : 30 Dec 2014, 05:47 PM
ওই অঞ্চলের বহু নারীকে রংপুর টাউন হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে ধর্ষণের জন্য তুলে দেওয়ার দায়ে একাত্তরের এই বদর কমান্ডারকে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার এ মামলার রায়ে আজহারের মৃত্যুদণ্ড ঘেষণা করে।
আজহারুল ইসলাম একাত্তরে ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের জেলা কমিটির সভাপতি। সে সময় তার নেতৃত্বেই যে বৃহত্তর রংপুর এলাকায় আলবদর বাহিনী যুদ্ধাপরাধ ঘটায়- তা উঠে এসেছে এই রায়ে।
রায়ে বলা হয়, “যে ঘৃণ্য অপরাধ আজহারুল ইসলাম করেছেন, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজায় তার সুবিচার হয় না।”
প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের মধ্যে ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে ঝাড়ুয়ার বিল ও দমদম ব্রিজে গণহত্যা এবং ৫ নম্বর অভিযোগে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।
৬ নম্বর অভিযোগে অপহরণ ও আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় আসামির জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
আর ১ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় আজহারকে খালাস দিয়েছে আদালত।
তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হওয়ায় আজহারকে আর জেল খাটতে হবে না। তিনি ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাবেন।
রায়ের পর প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “ট্রাইব্যুনালে যতগুলো বড় গণহত্যার ঘটনার বিচার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ঝাড়ুয়ার বিলের গণহত্যা। সংখ্যার দিক থেকে এত বড় গণহত্যার বিচার ট্রাইব্যুনালে হয়নি।”
সর্বোচ্চ সাজা
অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আজহার ট্রেনে করে নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ট্যাক্সেরহাট রেলগুমটিতে যান। সেখান থেকে ধাপপাড়া যাওয়ার পথে দুই পাশের একাধিক গ্রামে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায় তারা। ধাপপাড়ায় পৌঁছে তারা মোকসেদপুর গ্রামে গুলি চালিয়ে ১৪ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে।
এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় আজহারের বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তার প্রাণদণ্ড দিয়েছে আদালত।
অভিযোগ ৩: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুর ১২টা থেকে ৫টার মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে আজহারুল ইসলাম রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিলের আশেপাশের গ্রামে হামলা চালিয়ে এক হাজার দুইশর বেশি নিরীহ হিন্দু গ্রামবাসীকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এছাড়া আরো অন্তত দুইশ’ লোককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামগুলোর বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে তারা।
এই ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল রাত ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে বদর বাহিনীর সদস্য ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও একজন অধ্যাপকের স্ত্রীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আজহারের ফাঁসির রায় এসেছে।
২৫ বছর কারাদণ্ড
অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা এবং স্থানীয় বিহারীরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের তথ্য সংগ্রহ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করত। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা অনেক পরিবারের সদস্যদের অপহরণ, আটক ও নির্যাতন চালানো হয়। ওই সময়ের মধ্যে রংপুর শহর এবং আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মনসুরা খাতুনসহ অসংখ্য নারীকে ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়।
এ ঘটনায় অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) এবং ২০(২) ধারায় আজহারকে দেওয়া হয়েছে ২৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।
৫ বছর কারাদণ্ড
অভিযোগ ৬: একাত্তরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় শওকত হোসেন রাঙাকে নির্যাতন করেন অভিযুক্ত এটিএম আজহার। এরপর রাঙার ভাই ও ছাত্রলীগের কারমাইকেল কলেজ শাখার ছাত্রলীগ কর্মী রফিকুল হাসান নান্নুকে রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের শহীদ মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে নির্যাতন ও জখম করা হয়। পরে নাসিম ওসমান নামের এক অবাঙালির সহায়তায় নান্নুকে ছাড়িয়ে আনেন তার বড়ভাই সাজ্জাদ জহির।
এ ঘটনায় অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ)(জি) ও (এইচ) এবং ২০(২) ধারায় আজহারকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
খালাস
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে ইসলামী ছাত্র সংঘের রংপুর শাখার সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের সশস্ত্র সদস্য এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের আয়কর আইনজীবী এ ওয়াই মাহফুজ আলী ওরফে জররেজ মিয়াসহ ১১ জনকে অপহরণ করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের সাতদিন আটক রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এরপর ৩ এপ্রিল তাদের রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে আজহারের লোকজন। এ সময় দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে মন্টু ডাক্তার আহত হলেও বেঁচে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার শরীরে সেই গুলির জখম ছিল।
এ ঘটনায় এটিএম আজহারের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।