দুর্বৃত্তের হামলার পর অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন মোবাইল ফোনটি হাতে ধরা অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন সহকর্মীরা।
Published : 17 Nov 2014, 09:48 PM
কোনোভাবেই মোবাইল ফোনটি শফিউল ছাড়তে চাননি বলে জানান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এস এম এক্রাম উল্যাহ, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রোবাসে করে সহকর্মীকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এস এম এক্রাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার হাত থেকে মোবাইলটি নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি মোবাইলটি আঁকড়ে ধরে ছিলেন। মনে হয় মোবাইলে কিছু ধারণ করা আছে।”
এক্রামের সঙ্গে থাকা মার্কেটিং বিভাগের আরেক শিক্ষক ওমর ফারুক সরকারও বলেন, “কোনোভাবেই তিনি মোবাইলটি ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। পুলিশ মোবাইলটি নিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত শক্ত করে ধরে ছিলেন।”
নিহত শফিউলের মোবাইল ফোনটি বর্তমানে পুলিশের কাছে রয়েছে।
মতিহার থানার ওসি আলমগীর হোসেন মোবাইল ফোনের কললিস্টসহ বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষার কথা বললেও তদন্তের স্বার্থে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি।
গত শনিবার দুপুরের পর ক্যাম্পাস থেকে মোটর সাইকেলে এক সহকর্মীকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন অধ্যাপক শফিউল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেইটে সহকর্মীকে নামিয়ে দিয়ে আরেকটু সামনে চৌদ্দপাই এলাকায় নিজের বাসায় ফেরার সময় হামলার শিকার হন তিনি।
মোটর সাইকেলে শফিউলের সহযাত্রী অধ্যাপক জুলফিকার আলী ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে তার বাসার কাছে যেতেই হামলা হয়। সে কিংবা আমি কেউই কিছু বুঝতে পারিনি।”
হত্যাকাণ্ডের দুদিন পেরুলেও সন্দেহভাজন ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতির খবর জানাতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তার অধিকাংশই বিনোদপুর এলাকার।
“আমরাও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না,” সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন মতিহার থানার ওসি।
তবে খুনিদের ধরতে অভিযান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা অনেককে আটক করলেও জিজ্ঞাসাবাদ করে অনেককেই ছেড়ে দিয়েছি।”
ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয় অধ্যাপক শফিউলকে, বিনোদপুর এলাকায় আহলে হাদিস মসজিদের কাছে একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুসকে।
লালনভক্ত শফিউলের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে দাবি করেছেন, তার বাবাকে জঙ্গিরাই হত্যা করেছে; পুলিশ তাও খতিয়ে দেখছে বলে ওসি আলমগীর, যিনি এই হত্যামামলার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন।
এই অধ্যাপকের পারিবারিক জীবনও তদন্তের আওতায় রেখেছে পুলিশ।
শফিউল তিনবার বিয়ে করেন। এর মধ্যে প্রথম স্ত্রী আত্মহত্যা করেন, অন্য দুই স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একাই থাকতেন তিনি।
দুই বছর ধরে লালনভক্ত শফিউল
অধ্যাপক শফিউল ইসলাম দুই বছর আগে লালনভক্ত হয়ে উঠে অনেকটা ‘আধ্যাত্মিক’ জীবনযাপন শুরু করেন জানিয়ে তার কয়েকজন সহকর্মী বলেছেন, প্রতি সোমবার তার বাড়িতে গানের আসর বসত।
শফিউলের (৪৮) ছাত্র ও বর্তমানে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নাজমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দুই বছর আগে লালনচর্চা শুরু করেন তার শিক্ষক।
জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে লালনের গান ও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনে সাঁইজির গান ও দেহতত্ত্বের মর্মভেদ করার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন শফিউল, জানান রাজশাহীর দুর্গাপুরের কানপাড়ার সামছুল ফকির।
প্রতি সোমবার সন্ধ্যার গানের আসরের নিয়মিত এই লালনসাধক বলেন, “শফিউল প্রায়ই নিষ্ঠার সঙ্গে বলতেন, লালন ধর্ম ছাড়া আত্মার কোনো মুক্তি নেই।”
লালনভক্ত হওয়ার পর মাথা মুড়িয়ে বাউলেরও পোশাকও পরা শুরু করেন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক, যার ডাক নাম লিলন।
রাজশাহীর লালন সঙ্গীত শিল্পী সুলতান আলী বলেন, সোমবারের ওই আসরে ১৫ থেকে ২৫ জনের মতো উপস্থিত থাকত।
“আসরে আমরা লালনের গান গাইতাম, সাইজির কথার ভিত্তিতে আলোচনা হত। স্যার বলতেন- সৃষ্টিকর্তা সবাইকে সমানভাবে ভালবাসেন, সব ধর্মই তার।”
গত সপ্তাহে সোমবারের পরিবর্তে মঙ্গলবার আসর বসেছিল জানিয়ে সুলতান বলেন, “ওটাই শেষ।”
তিনি বলেন, “স্যারের বাসায় যারা মজমায় আসতেন, সবাইকে উনি যাতায়াত খরচ দিতেন। মাঝে-মধ্যে মুড়ি মাখিয়ে খাওয়াতেন।
“এই মানুষকে কেউ মারতে পারে চিন্তাও করতে পারি না, ভাবনায়ও আসে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা অবাক শফিউলকে খুনের ঘটনায়। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন দল-উপদল কিংবা কারো সঙ্গে কোনো জটিলতা ছিল না তার।
বিভাগের ছাত্রীদের বোরকা পড়া নিয়ে ২০১০ সালে এই শিক্ষককের মন্তব্যের যে কথা জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামকে উদ্ধৃত করে একটি ফেইসবুক পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়ে তার সহকর্মীরা কিছু বলতে পারেননি।
সংগ্রামের ওই খবরটি ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামে একটি ফেইসবুক পৃষ্ঠায় শফিউলের হত্যার দায় স্বীকার করে শনিবার রাতেই দেওয়া পোস্টে শেয়ার করা হয়েছে।
বিভাগের ছাত্রীদের বোরকা না পরার বিষয়ে এই শিক্ষক কিছু বলেছিলেন কি না- কোন মন্তব্য করেছিলেন কি না- জানতে চাইলে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নাজমুল বলেন, “আমরা কেউ শুনিনি। তবে দৈনিক সংগ্রামে ২০১০ সালে এ রকম নিউজ হয়েছিল বলে শুনেছি।”
সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ওয়ারদাতুল আকমাম বলেন, বোরকা নিয়ে মন্তব্যের বিষয়ে কেউ লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগও কখনও করেনি।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস মনে করেন, জীবনচর্চা এবং নিজের ফেইসবুক অ্যাকউন্টে মতামতের জন্যই হয়ত শফিউলকে হত্যা করা হয়েছে।
“স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যারা করেন, তাদের হত্যা করে একটা মেসেজ তারা ছড়িয়ে দিতে চায়। অধ্যাপক ইউনূসকেও একইভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
অধ্যাপক শফিউল তিনটি বিয়ে করলেও ২০১০ সালের পর থেকে কোনো স্ত্রীই তার সঙ্গে থাকতেন না বলে একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না শর্তে জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শফিউলের প্রথম স্ত্রী ২০০৩ সালে আত্মহত্যা করেন। ছেলেটি তার এই স্ত্রীরই সন্তান।
দ্বিতীয় স্ত্রী ২০০৬ সালে এই অধ্যাপককে ছেড়ে যান, পরে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধকের দপ্তরের এক কর্মকর্তার মেয়েকে শফিউল বিয়ে করলেও ২০১০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।
এর পর থেকেই একাকী জীবন যাপন করে আসছিলেন তিনি। ক্লাস-পরীক্ষা কিংবা শিক্ষক ক্লাব ছাড়া ক্যাম্পাসেও কোনো কার্যক্রমে তাকে তেমন দেখা যেত না।
খুন হওয়ার আগে যিনি সর্বশেষ শফিউলের সঙ্গে ছিলেন সেই অধ্যাপক জুলফিকার বলেন, খুব একটা বের হতেন না শফিউল, তবে সন্ধ্যার দিকে শিক্ষক ক্লাবে এসে নিয়মিত আড্ডা দিতেন।