‘বন্দুকযুদ্ধের’ পর আতঙ্কে দু’পক্ষই

সুন্দরবনে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের আখিরুল শেখ; তার বাবা আব্দুল আজিজ শেখ এখন পুলিশের ভয়ে আছেন। নিহত অন্যদের স্বজনরাও বললেন পুলিশের হয়রানির আতঙ্কের কথা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব পাইকগাছা থেকে ফিরেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2014, 10:10 AM
Updated : 19 Oct 2014, 10:12 AM

অন্যদিকে যাকে অপহরণের পর ১২ দিন আগে পুলিশের কথিত এই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১১ জন, সেই কলেজ শিক্ষক প্রশান্ত কুমার ঢালী তো বটেই, তার স্বজনরাও কারও সঙ্গে দেখা দিচ্ছেন না। ডাকাতরা যদি হামলা চালায়, এই তাদের ভয়।

পুলিশ অবশ্য বলছে, তারা প্রশান্তের এলাকা পাইকগাছা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন দেলুটি ইউনিয়নে নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করেছে। আর নিহতদের কারও পরিবারকে বিনা কারণে হয়রানিও করা হবে না বলেও আশ্বাস দিয়েছে।

গত ৬ অক্টোবর ভোরে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ঝিলবুনিয়া গ্রাম থেকে প্রশান্তকে অপহরণের পর বিগরদানা এলাকায় পুলিশের সঙ্গে দস্যুদের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুজন, গণপিটুনির পর গ্রেপ্তার করা হয় ১১ জনকে।

গ্রেপ্তার ১১ জনকে নিয়ে পুলিশ অভিযানে নামলে ওই দিন দুপুরে সুন্দরবনের গাংরক্ষীর চরে বনদস্যুদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সময় পালাতে গিয়ে ১১ জনই মারা যান বলে পুলিশের দাবি। তবে নিহতদের স্বজনদের দাবি, এটা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ছিল না।

কথিত এই বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা হলেন- পাইকগাছা উপজেলার মাগুরা গ্রামের শরীফ মোড়লের ছেলে সবুর মোড়ল (৪০), দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের সুলতান গাজীর ছেলে হানিফ গাজী (৩৪), বাগেরহাটের মংলার ছিকলের দেওয়ান এলাকার মৃত নান্নু মোড়লের ছেলে আলম মোড়ল (২৭), ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের আজিজ শেখের ছেলে আমিরুল ওরফে আখিরুল শেখ (২৬) ও তার চাচাত ভাই  নাছরুল শেখ (২২), একই উপজেলার শরাফপুর গ্রামের সাত্তার মোল্লার ছেলে মফিজুল মোল্লা (৩০) ও তার বড় ভাই ইব্রাহিম ওরফে মাহাব্বু মোল্লা (৪১), ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের শহীদ শেখের ছেলে শফিকুল শেখ (২১) ও জলিল শেখের ছেলে আফজাল শেখ (২৪), ডুমুরিয়া উপজেলার গোলনা গ্রামের গাফফার শেখের ছেলে রুবেল শেখ (২৩), একই এলাকার ইউসুফ আলী খানের ছেলে জুনায়েদ খান (২২)।

দুপুরে গাংরক্ষীর চরে এরা মারা যাওয়ার আগে ভোরে বিগরদানায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ডুমুরিয়ার হাবিবুর সরদার ওরফে হবি (৩৫) ও একই এলাকার কারিমুল (৪২)।

যে এলাকা থেকে স্থানীয় কলেজের শিক্ষক প্রশান্তকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, নিহত বেশিরভাগেরই বাড়ি তা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে পাশের উপজেলায় ডুমুরিয়ায়।

ঘটনায় সপ্তাহ খানেক পর পাইকগাছায় গিয়ে নিহতদের পরিবারের মধ্যে ক্ষোভের পাশাপাশি আতঙ্কের ছাপও দেখা যায়।  

তারা বলেন, পরিবারের অন্য কেউ ডাকাতিতে জড়িত কি না, তা জানতে এলাকায় উপস্থিত হচ্ছে পুলিশ।

কোনও কোনও পরিবারের সদস্যকে থানায় ডেকে পাঠানো হচ্ছে বলেও জানান নিহত আখিরুল শেখের বাবা আবদুল আজিজ শেখ।

নিহত আখিরুলের ভাই

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার পর পুলিশ বাসায় এসেছিল। আমাকে ডুমুরিয়া থানায় যেতে বলিছিল। আমি যাইনি। এখন ওরা আমাগে আর কোনও ক্ষতি করে কি না, তা নিয়ে ভয়ে আছি।”

নিহত রুবেল শেখের চাচাত ভাই মহসিন হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ নাকি বলেছে, রুবেল মারা যাবার আগে কার কার যেন নাম বলেছে। এখন সবাই আতঙ্কে আছে, পুলিশ আবার হয়রানি করে কি না।”

অন্যদিকে পাশের উপজেলা পাইকগাছায় কলেজ শিক্ষক প্রশান্ত কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন না। তার স্বজনরাও নিজেদের টেলিফোন বন্ধ রেখেছেন বলে জানান দেলুটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নির্মল মণ্ডল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার পর থেকে প্রশান্ত ও তার পরিবারের সদস্যরা কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। ওরা ভীষণ ভয়ে আছে।”

দেলুটি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান সমরকান্তি হালদার বলেন, “সুন্দরবনের বেশ কাছে আমাদের এই এলাকাটি। চারপাশে নদী, এখানে নিরাপত্তা অনেক দুর্বল। তাই প্রশান্ত ও তার পরিবার আতঙ্কে আছে।”

এলাকাবাসী রাত জেগে এখন এলাকা পাহারা দিচ্ছে বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান। “সবাইকে বলা আছে চায়ের দোকানে রাস্তায় বাড়ির উঠোনে থেকে গল্প আড্ডা দিতে, ডাকাতরা এলে তাদের প্রতিহত করা হবে।”

নিহত রুবেল শেখের বাবা গফুর শেখ

পুলিশের দেলুটি ইউনিয়ন ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল জলিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রশান্ত সাহেবের এলাকায় পুলিশের একটি পেট্রল টিম নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। সেখানের জনগণ এখন অনেকটাই নির্ভয়ে রয়েছে।”

তবে প্রশান্ত ঢালী এলাকায় নেই বলে জেনেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

কলেজ শিক্ষকের এলাকার নিরাপত্তায় ‘যথেষ্ট’ পুলিশ রয়েছে বলে জানলেন খুলনার পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানও।

নিহতদের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশ বিনা কারণে কাউকেই হয়রানি করবে না। তবে ডাকাত দলের সদস্যদের সঙ্গে কেউ জড়িত কি না, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”