‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৩ মৃত্যু: স্বজনরা বলছেন হত্যা

কোরবানির ঈদের আগের দিন খুলনার পাইকগাছায় পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৩ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবও সুবীর রায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Oct 2014, 05:24 PM
Updated : 17 Oct 2014, 05:24 PM

পুলিশের দাবি, নিহতরা সবাই সুন্দরবনের কুখ্যাত ডাকাত কাশেম বাহিনীর ‘সক্রিয়’ সদস্য ছিল, যদিও স্বজন বা এলাকাবাসী বলেছেন ভিন্ন কথা। 

বিষয়টি ডাকাত-পুলিশের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধ’, নাকি ‘ডাকাত সন্দেহে’ গ্রামবাসীর গণধোলাইয়ের শিকার ১৩ জনকে সুন্দরবনে নিয়ে গুলি করে হত্যা- এমন প্রশ্ন আসছে ঘুরে ফিরে।

গত ৫ অক্টোবর ভোরে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ঝিলবুনিয়া গ্রামে এবং দুপুরে সুন্দরবনের গাংরক্ষীর চরে কথিত সেই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ঘটে।

পুলিশের করা মামলার এজাহারে বলা আছে, গাংরক্ষীর চরে পুলিশ ও ডাকাত কাশেম বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের সময় পুলিশের হেফাজত থেকে পালাতে গিয়ে ১১ ‘ডাকাত’ নিহত হন। তার ঘণ্টা সাতেক আগে বিগরদানায় আরেক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ওই দলের দুইজন।

নিহতদের স্বজনরা বলছেন, লাশ বুঝে নেওয়ার সময় অনেকেরই হাত-পা ও ঘাড় ভাঙা ছিল, শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন, যা পুলিশের বন্দুকযুদ্ধের বিবরণের সঙ্গে মেলে না।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, ওই ১৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গুলিতে, আর অধিকাংশের গুলি লেগেছে বুকে। অথচ পুলিশের দাবি, হাতের বাঁধন খুলে পালানোর সময় দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়ে তাদের মৃত্যু হয়।

এর মধ্যে ১১ জন পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন বলে স্থানীয়রা জানালেও পুলিশ বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। গণপিটুনিতে গুরুতর আহতদের হাসপাতালে না নিয়ে পুলিশ কেন অভিযানে গেল- সে প্রশ্নও স্বজনরা তুলেছেন। 

এজাহার যা বলছে

পাইকগাছা থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৫ অক্টোবর দিবাগত ভোর পৌনে ৪টার দিকে পাইকগাছা থানার ওসি শিকদার আককাছ আলী মোবাইল ফোনে খবর পান ঝিলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা কলেজ প্রভাষক প্রশান্ত কুমার ঢালীকে ১৪/১৫ জন বনদস্যু বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ট্রলারে করে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।

এরপর দেলুটি পুলিশ ক্যাম্পের সহায়তায় পুলিশ সদস্যরা ওই এলাকার বিগরদানায় পৌছান ভোররাত পৌনে ৫টার দিকে। এ সময় পুলিশ ও গ্রামবাসী বনদস্যুদের ধাওয়া করলে দস্যুরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশও পাল্টা গুলি করলে অপহরণকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এজাহার বলছে, স্থানীয়রা এক পর্যায়ে ‘ডাকাতদের’ ধরে পিটুনি দেয়। গ্রামবাসীর সহায়তায় সেখান থেকে ১১ দস্যুকে আটক করা হয়। আর ডুমুরিয়ার হাবিবুর সরদার ওরফে হবি (৩০) ও একই এলাকার কারিমুল (২৮) নামের দুইজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা সদর হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়।

গ্রেপ্তাররা নিজেদের ‘ডাকাত কাশেম বাহিনীর’ সদস্য হিসাবে পরিচয় দেয় বলে পুলিশ দাবি করেছে। পুলিশ বলছে, কাশেম সুন্দরবনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুদ করে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করেছে বলেও জিজ্ঞাসাবাদে তারা তথ্য পান, যার ভিত্তিতে গাংরক্ষীর চরে তারা অভিযানে যান।

এরপর ৬ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের ৩৩ জনের একটি দল গ্রেপ্তার ১১ জনকে নিয়ে সুন্দরবন সংলগ্ন গাংরক্ষীর চরে যায়।

এজাহারে বলা হয়েছে, গাংরক্ষীর চরে পৌঁছানোর পর কাশেম বাহিনীর সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ‘বৃষ্টির মতো’ গুলি চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে থাকা আসামিরা পালানোর চেষ্টা করে। দুইপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে ১১ জন নিহত হন।

এই বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা হলেন- পাইকগাছা উপজেলার মাগুরা গ্রামের শরীফ মোড়লের ছেলে সবুর মোড়ল (৪০), দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের সুলতান গাজীর ছেলে হানিফ গাজী (৩৪), বাগেরহাটের মংলার ছিকলের দেওয়ান এলাকার মৃত নান্নু মোড়লের ছেলে আলম মোড়ল (২৭),  ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের আজিজ শেখের ছেলে আমিরুল ওরফে আখিরুল শেখ (২৬) ও তার চাচাত ভাই  নাছরুল শেখ (২২),একই উপজেলার  শরাফপুর গ্রামের সাত্তার মোল্লার ছেলে মফিজুল মোল্লা (৩০) ও তার বড় ভাই ইব্রাহিম ওরফে মাহাব্বু মোল্লা (৪১) ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের শহীদ শেখের ছেলে শফিকুল শেখ (২১) ও জলিল শেখের ছেলে আফজাল শেখ (২৪), ডুমুরিয়া উপজেলার গোলনা গ্রামের গাফফার শেখের ছেলে রুবেল শেখ (২৩) একই এলাকার ইউসুফ আলী খানের ছেলে জুনায়েদ খান (২২)।

ওই ঘটনায় পাইকগাছার ওসি শিকদার আককাস আলীসহ মোট ছয় পুলিশ সদস্য ‘ছররা গুলি ও গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে’ আহত হন বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। 

‘হাসপাতালে না নিয়ে’ অভিযানে

ঝিকরগাছা সংলগ্ন বিগরদানা ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম দফায় পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধের পর গ্রামবাসী ১১ জনকে ডাকাত সন্দেহে ধরে পিটুনি দিলে তাদের অনেকেই গুরুতর আঘাত পান। 

নিহতদের লাশ বুঝে নেয়ার সময়ও অনেকের হাত-পা, ঘাড় ভাঙা, শরীরে বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা বলেছেন স্বজনরা।

তারা বলেন, মারধরে গুরুতর আহতরা তখন হাঁটতে পারছিল না। পুলিশ তাদের ভ্যানে করে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যায়।

আহতদের হাসপাতালে না নিয়ে পুলিশ কেন অভিযানে গেল- সে প্রশ্ন তুলে নিহত রুবেল শেখের চাচাত ভাই মহসিন শেখ বলেন, “পুলিশ তো চাইলি একজনরে নিয়েই অভিযানে যাতি পারত। ১১ জন নিয়েই যাতি হবি? আর পুলিশের গুলিতে সবাই মরল, কই পুলিশ তো মরল না?”

নিহত জুনায়েদের বাবা ইউসুফ আলীও দাবি করেছেন ছেলের লাশ বুঝে নেয়ার সময় তার দুই পা ভাঙা ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের দেলুটি পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল জলিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিল তাদের ভ্যানে করে খুলনা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। বাকি ১১ জনকে পায়ে হাঁটিয়ে পুলিশের সঙ্গে অভিযানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।”

‘ডাকাত নয়’

ডুমুরিয়া থানা ঘুরে নিহত আখিরুল, নাছরুল, শফিকুল, রুবেল, জুনায়েদ ও আফজালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র। মাটির ঘরে গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা টিউবওয়েলও নেই। এসব পরিবারের প্রধান পেশা কৃষি। বাড়ির পেছনেই নিহতদের কবর দিয়েছেন তারা।

স্বজনরা জানিয়েছেন, ওই ছয়জন কোনো স্থায়ী পেশায় যুক্ত ছিলেন না, দুজন ছিল ছাত্র। বাকিরা কেউ টিউবওয়েল মিস্ত্রি, কেউ বাসের হেলপার হিসাবে কাজ করতেন। কেউ আবার ছিলেন কৃষিকাজে যুক্ত।

তাদের দাবি, নিহতদের নামে আগে কোনো মামলা ছিল না। তারা ডাকাতির সঙ্গে ‘কোনোভাবেই; জড়িত ছিলেন না। 

আখিরুল শেখের ভাই আতিয়ার শেখ জানান, এলাকায় নিলামে তোলা প্রায় ১০ বিঘা জমি নিয়ে আখিরুলের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা গাজী হুমায়ুন কবির বুলুর ‘কিছুটা দূরত্ব’ তৈরি হয়েছিল।

জাতীয় নির্বাচনের আগে ডুমুরিয়া থানা যুবদলের আহ্বায়ক থাকলেও বুলু সম্প্রতি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

একসময় বুলুর সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে ডুমুরিয়া থানায় আখিরুল ও নাছরুলের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বলেও আতিয়ারের দাবি।

আখিরুল ও নাছরুলকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে আতিয়ার বলেন, “ডাকাত হলে থানার সঙ্গে তাদের ভাল সম্পর্ক থাকে কীভাবে?”

ডুমুরিয়া উপজেলার গোলনা গ্রামের গাফফার শেখের ছেলে রুবেল শেখ ছিলেন স্থানীয় ডুমুরিয়া সরকারি কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ঘটনার চার দিন আগে শুঁটকির ব্যবসা করার কথা বলে বাড়ি ছাড়েন তিনি।

একই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন জুনায়েদ। তার বাবা ইউসুফ আলী খান বলেন, “আমার পোলা কেন ডাকাতি করতি যাবি। ওরে কেউ গুলি করি মেরে ফেলসে। কেন মারসে তা বলতে পারি না। আমি সুষ্ঠু তদন্ত চাই।”

ময়নাতদন্ত

পাইকগাছা থানার এজাহারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ব্যবহৃত গুলির যে হিসাব পুলিশ দিয়েছে, তাতে পিস্তলের ১৯ রাউন্ড, চাইনিজ রাইফেলের ২০ রাউন্ড ও শট গানের ৫৪টি গুলি ছোড়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে দস্যুরা ৭০/৮০টি গুলি করেছিল বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৩টি লাশের ময়নাতদন্ত করা চিকিৎসক সুরজিৎ বাইন জানান, ১৩ জনই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। গুলি অধিকাংশের বুকে লেগেছিল। অনেকের ঘাড়ে, মুখে ও মাথায়ও গুলির চিহ্ন ছিল।

ময়নাতদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অন্য এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নিহত ১০ জনের শরীরে একটি করে গুলি ছিল, অধিকাংশই ছিল বুকে।

“অন্তত দুই জনের শরীরে একাধিক গুলি ছিল। গুলি কারো কারো ঘাড়, মুখ বা পিঠ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিল আঘাতের চিহ্ন।”

নিহতদের স্বজনরা প্রশ্ন তুলেছেন- ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই পক্ষে দেড় শতাধিক রাউন্ড গুলি ছোড়া হলে নিহতদের শরীরের বিশেষ জায়গায় কীভাবে গুলি লাগে।   

আখিরুলের বাবা আজিজ শেখ জানান, আখিরুলের মুখে ও তার ভাতিজা নাছরুলের কপালে একটি করে গুলি লেগেছিল। এছাড়া শরীরের কোথাও গুলির চিহ্ন ছিল না।

তিনি বলেন, “আমার তো মনে হয় ওগের প্রত্যেকরে ঠেক দিয়া গুলি করে দিছে।”

পুলিশের বক্তব্য

ডুমুরিয়া থানার ওসি এম মশিউর রহমান বলছেন, পুলিশের সঙ্গে যারা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র মামলা ছিল।

“তিন মাস আগে আখিরুল ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। কারিমুল তিনটি বিদেশি বন্দুকসহ গ্রেপ্তার হয়েছিল, হবির বিরুদ্ধেও ডাকাতির মামলা ছিল।”

গাজী হুমায়ূন কবির বুলুর সঙ্গে আখিরুল নিয়মিত থানায় যাতায়াত করত বলে স্বজনরা যে দাবি করছে সে বিষয়ে ওসি বলেন, “প্রায় চার মাস আগে আমি এ থানার দায়িত্ব নিয়েছি। কারো সঙ্গে আখিরুল থানায় আসতো কিনা জানা নেই। তবে আমি থাকতে আসার সাহস করেনি।”

১৩ জনকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে- স্বজনদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে পাইকগাছা থানার ওসি শিকদার আককাস আলী বলেন, “পুলিশ অপহৃত এক শিক্ষককে ‍উদ্ধার করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে অপহরণকারীদের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। এতে অপহরণকারীদের ছররা গুলিতে ৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়ে চিকিৎসা নেন। তাদের পুলিশ হত্যা করেছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।”

একই দাবি করেছেন খুলনার পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান।

তিনি বলেন, “পুলিশের সঙ্গে ডাকাতরা বন্দুকযুদ্ধেই মারা গেছে। এটি নিয়ে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই। জনতা তাদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। পুলিশ কাউকে বাড়ি থেকে ধরে নেয়নি।”

দুই দফায় অভিযানে ১৩টি দেশি বন্দুক, তিনটি পাইপ গান ও ৫৭টি গুলি উদ্ধার করা হয় বলেও পুলিশের দাবি।

</div>  </p><p> <div class="embed"> <iframe height="400" src="https://www.youtube.com/embed/8K5pG936ImE" width="640"/> </div>  </p><p> <div class="embed"> <iframe height="400" src="https://www.youtube.com/embed/5ZuQn9dIM7Y" width="640"/> </div>  </p><p> <div class="embed"> <iframe height="400" src="https://www.youtube.com/embed/XjaV_X9P63w" width="640"/> </div>  </p>