দেখাতে দেখাতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন এই প্রৌঢ় কৃষক- “আমার তো কোনও কিসুর তো অভাব নাই বাপ। আমার পোলা কেন ডাকাতি করতি যাবি। ওরে কেউ গুলি করি মেরে ফেলছে।”
গত ৬ অক্টোবর দুপুরে পাইকগাছায় সুন্দরবনের গাংরক্ষীর চরে বনদস্যুদের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ সময় পালাতে গিয়ে যে ১১ জন মারা যান, তাদের একজন পাশের উপজেলা ডুমুরিয়ার গোলনা গ্রামের ২২ বছর বয়সী জুনায়েদ।
সেদিন ভোরে পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ঝিলবুনিয়া গ্রাম থেকে প্রশান্ত কুমার ঢালী নামে এক শিক্ষককে অপহরণের পর বিগরদানা এলাকায় গণপিটুনির পর পুলিশ গ্রেপ্তার করে জুনায়েদসহ ১১ জনকে।
বিগরদানায় পুলিশের সঙ্গে দস্যুদের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুজন। গ্রেপ্তার ১১ জনকে নিয়ে পুলিশ অভিযানে নামলে ওই দিন দুপুরে কথিত বন্দকযুদ্ধে প্রাণ হারান ১১ জন।
তবে এটা বন্দুকযুদ্ধ ছিল বলে মেনে নিতে ঘোর আপত্তি নিহতদের স্বজনের। তবে পুলিশের দাবি, সেটা বন্দুকযুদ্ধই ছিল এবং নিহতরাও নিষ্কলুষ নন।
কথিত এই বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা হলেন- পাইকগাছা উপজেলার মাগুরা গ্রামের শরীফ মোড়লের ছেলে সবুর মোড়ল (৪০), দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের সুলতান গাজীর ছেলে হানিফ গাজী (৩৪), বাগেরহাটের মংলার ছিকলের দেওয়ান এলাকার মৃত নান্নু মোড়লের ছেলে আলম মোড়ল (২৭), ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের আজিজ শেখের ছেলে আমিরুল ওরফে আখিরুল শেখ (২৬) ও তার চাচাত ভাই নাছরুল শেখ (২২), একই উপজেলার শরাফপুর গ্রামের সাত্তার মোল্লার ছেলে মফিজুল মোল্লা (৩০) ও তার বড় ভাই ইব্রাহিম ওরফে মাহাব্বু মোল্লা (৪১), ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের শহীদ শেখের ছেলে শফিকুল শেখ (২১) ও জলিল শেখের ছেলে আফজাল শেখ (২৪), ডুমুরিয়া উপজেলার গোলনা গ্রামের গাফফার শেখের ছেলে রুবেল শেখ (২৩), একই এলাকার ইউসুফ আলী খানের ছেলে জুনায়েদ খান (২২)।
যে এলাকা থেকে স্থানীয় কলেজের শিক্ষক প্রশান্তকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, নিহত বেশিরভাগেরই বাড়ি তা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে পাশের উপজেলায় ডুমুরিয়ায়।
ঘটনার সপ্তাহখানেক পর ডুমুরিয়ার গোলনা গ্রামে গিয়ে পাওয়া যায় জুনায়েদের বাবা ইউসুফ খানকে। তিনি অবস্থাপন্ন কৃষক বলে স্থানীয়রা জানায়।
বাড়িতে ঢুকে দেখা যায় পাশাপাশি দুটো মাটির ঘর। তার পাশে অন্তত ২০ জোড়া বিভিন্ন ধরনের কবুতর রাখার ঘর। বাসার উঠোনে মাটির চৌকিতে বসেই কথা হয় ইউসুফের সঙ্গে।
ডুমুরিয়া সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জুনায়েদ এই কবুতরগুলো পুষত। ভাল দাম পেলে হাটে বিক্রি করত বলেও তার বাবা জানান।
“কবুতরের জন্য খাবার কেনার টাকা না দিলে অভিমান করত আমার ছেলে,” বলেন ইউসুফ খান।
ছেলেকে মেরে ফেলার যে অভিযোগ করেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কারা মারবে- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তা বলতে পারি না। আমি সুষ্ঠু তদন্ত চাই।”
লাশ পুলিশের থেকে বুঝে নেওয়ার সময় জুনায়েদের পা ভাঙা ছিল বলেও জানান তিনি। জোনায়েদের মা বলেন, “ঘাড়, বাম হাতও ভাঙা ছিল। বাম দিকে শুধু একটা গুলি লেগেছিল।”
পুলিশ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রায় ১০০ রাউন্ড গুলি ছোড়ার কথা বললেও নিহতদের বেশিরভাগের দেহে একটি মাত্র গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
গণপিটুনির পর আহত অবস্থায় এই ১১ জনকে হাসপাতালে না নিয়েই অভিযানে নেমেছিল পুলিশ।
জুনায়েদের সঙ্গে গোলনা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ডুমুরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রুবেল শেখও মারা যান।
গফুর শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ছেলে ডাকাত হতে পারে না। এলাকায় তার কোনও বদনাম নাই। তার খারাপ কোনও সঙ্গও ছিল না।”
জুনায়েদের মতো রুবেলও কবুতর পুষত জানিয়ে তার পোষা পায়রাগুলো দেখান গফুর শেখ। এসময় রুবেলের মা পাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছিলেন।
গফুরের বাড়ির কাছের গোলনা বারবি মসজিদের ইমাম আবদুল মালেক বলেন, রুবেল মসজিদে নিয়মিত নামাজ পড়ত। এলাকায় খারাপ কোনও কাজে কখনও দেখেননি তাকে।
শুঁটকি মাছের ব্যবসা শুরু করবে বলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার চার দিনের মাথায় ‘ডাকাত’ হিসেবে রুবেলের মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।
আবদুল মালেক বলেন, “সে ডাকাত দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এমনটি শুনি তার মৃত্যুর পর বিভিন্ন খবরের কাগজে। কিন্তু তা বিশ্বাস হয় না।”
একই ঘটনায় নিহত ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামের শহীদ শেখের ছেলে শফিকুল শেখের দাদি সুফিয়া বেগমেরও দাবি, তার নাতি ডাকাত ছিল না।
শফিকুল যে ছোট মাটির ঘরটিতে থাকতেন, তা দেখিয়ে তিনি বলেন, “গত বছর ওর বিয়ে হইছিল। নিজেই নিজের সংসার চালাতে পারত না। টাকা-পয়সা তেমন ছিল না। ডাকাতি করলি তো তাগো টাকা থাকে।”
আখিরুল শেখের বাবা আজিজ শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ছেলে ও ভাস্তে ডাকাত ছিল না।
স্থানীয় একটি চিংড়ির ঘেরের কর্মী মো. আজিজ বলেন, “ওরা ডাকাত ছিল না। ওদের কাছে কোনও দিন কোনও বন্দুক দেখি নাই।”
আখিরুলের বিরুদ্ধে গত ঈদের আগে ডাকাতির একটি মামলা হয়েছিল। তবে সেটা ‘মিথ্যা মামলা’ বলে পরিবারের দাবি।
নিহত আজফাল শেখের স্ত্রী জেসমিন বেগম বলেন, “সাত বছর ধরে তার সঙ্গে সংসার করি। দুটো সন্তান আছে। আমি জানি, উনি ডাকাত ছিলেন না।”
বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে টিউবওয়েলের কাজ করতে শরীয়তপুর যাওয়ার কথা আখিরুলও বলে গিয়েছিলেন বলে তার স্ত্রী জানান।
এই ঘটনায় পাইগাছা থানায় পুলিশ চারটি এবং অপহরণচেষ্টার শিকার কলেজ শিক্ষক প্রশান্ত কুমার ঢালী একটিসহ মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে।
নিহতদের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে পাইকগাছা থানার ওসি শিকদার আককাস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিহতরা ডাকাতই ছিল।”
“তারা শরীয়তপুর গিয়েছিল বলে পরিবারকে মিথ্যা কথা বলেছিল। কারণ জনতা তাদের ঝিলবুনিয়া থেকেই ধরে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল।”